আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার ঠিক দুই দিন আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়ে দিল প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, সাংসদদের আয়কর দিতে হবে না। অথচ চলতি অর্থবছরের বাজেটে তাঁদের আয়কর দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল।
সাধারণ মানুষের জন্য জাতীয় বাজেটে দেওয়া প্রতিটি করপ্রস্তাব দ্রুত আইনে পরিণত হলেও প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী ও সাংসদদের বেতন-সম্মানী ও ভাতা আয়করের আওতায় আনার প্রস্তাব বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়নি এনবিআর। ফলে তাঁদের বেতন-সম্মানী-ভাতা বরাবরের মতো আয়করমুক্তই থাকছে। যদিও বাজেটে একই সময়ে পাস হওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজেদের আয়কর দেওয়ার বিধান বহাল রাখা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটে মানুষের হাততালি পেতে মন্ত্রী-সাংসদেরা আয়কর দেবেন বলা হয়েছিল। আর এখন চুপিচুপি একটি চিঠি দিয়ে আয়কর দেবেন না বলে দেওয়া হলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আসলে তাঁরা যে সাধারণ মানুষের মতো কর দিতে চান না, এনবিআরের এ চিঠি তারই প্রমাণ। সরকার কৌশলে তাঁদের বাধ্য করেছে এ ধরনের চিঠি তৈরি করতে।’
এনবিআর গতকাল বুধবার সংসদ সচিবালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে। এনবিআরের প্রথম সচিব (আয়কর নীতি) অপূর্ব কান্তি দাস স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, অর্থ আইন-২০১১-এর মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এ সংশোধনী আনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং সাংসদদের বেতন-সম্মানী-ভাতাকে করযোগ্য করা হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর (সম্মানী ও ভাতা) অ্যাক্ট ১৯৭৫, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার (সম্মানী ও ভাতা) অ্যাক্ট ১৯৭৪, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী (সম্মানী ও ভাতা) অ্যাক্ট ১৯৭৩ এবং সাংসদ (সম্মানী ও ভাতা) ১৯৭৩—এ চারটি আইনেরই ৩ নম্বর ধারায় সংশোধনী আনা প্রয়োজন। এ জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো এখনো সংশোধিত না হওয়ায় ওই সম্মানিত ব্যক্তিদের বেতন-সম্মানী বা ভাতাদি আয়করমুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। তাঁদের বেতন-সম্মানী বা ভাতাদির ওপর ২০১১-১২ করবর্ষের আয়কর রিটার্নে কোনো আয়কর প্রযোজ্য হবে না। এ চিঠি পাওয়ার পর সংসদ সচিবালয় গতকালই সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি অবহিত করেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম গতকাল বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, সাংসদদের বেতন-ভাতা-সম্মানী পৃথক চারটি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাজেটে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদের আয়কর দেওয়ার বিধান পাস করা হলেও সংশ্লিষ্ট আইনগুলো এখনো সংশোধন করা হয়নি। এ সংশোধনী না থাকায় তাঁদের আয়কর নেওয়া যাচ্ছে না। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়কর নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে পেশ করা ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট উপস্থাপন করে বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন মহল থেকে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সাংসদদের সুবিধা বৈষম্যমূলক বিধায় এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার হিসেবে সবার ক্ষেত্রে আইন সমভাবে প্রয়োগের জন্য তাঁদের বেতন-ভাতাদির ওপর করমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।’ অর্থমন্ত্রীর এ প্রস্তাব ৩০ জুন সংসদে পাস হয়।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এনবিআরের নতুন চিঠি নিয়ে আরও বলেন, দেশে নাগরিকদের জন্য পৃথক আইন থাকতে পারে না। তাই অন্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন, দেশের সব মানুষের আয়ই করযোগ্য হতে হবে। বছরে এক লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি আয় করলেই একজন নাগরিকের আয়কর দিতে হয়। অথচ মন্ত্রী ও সাংসদেরা প্রতি মাসেই প্রায় এ পরিমাণ আয় করেও কর দেবেন না, এটা অন্যায়। এ কারণে নাগরিকদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক উপদেষ্টা ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান বলেন, সংসদে বাজেটে পাস হওয়ার পরও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইন না হওয়ায় সরকারের কাজের সমন্বয়হীনতাই প্রকট হয়ে উঠেছে। এটি ভালো নয়। তিনি আরও বলেন, সরকারি কর্মচারীদের আয়কর নিজেদের দিতে হলেও তাঁদের পুরোনো হিসাবেই বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এতে তাঁদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে।
সাংসদদের বেতন-ভাতা: একজন সাংসদ বেতন-সম্মানী-ভাতা মিলে মাসে এক লাখ ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন। এর বাইরে সাংসদেরা সরকারি বাসস্থানের আনুষঙ্গিক খরচের জন্য মাসিক চার হাজার টাকা ভাতা পান। সংসদ অধিবেশন চললে প্রতিদিনের জন্য একজন সাংসদ ৫০০ টাকা করে ভাতা পান।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের বেতন: রাষ্ট্রপতির মূল বেতন ৬১ হাজার ২০০ টাকা, প্রধানমন্ত্রীর ৫৮ হাজার ৫০০, স্পিকার ৫৭ হাজার, ডেপুটি স্পিকার ৫৩ হাজার ৭০, মন্ত্রীদের ৫৩ হাজার ৭০, সংসদ উপনেতার ৫৩ হাজার ৭০, চিফ হুইপের ৫৩ হাজার, হুইপরা পান ৪৯ হাজার ৪০০, প্রতিমন্ত্রীদের ৪৭ হাজার, উপমন্ত্রীদের ৪৫ হাজার ২০০ টাকা। এর বাইরে তাঁরা বাসাভাড়া, যানবাহন-ভাতা, আপ্যায়ন খরচসহ অন্যান্য ভাতা পেয়ে থাকেন।
*সুত্রঃপ্রথম আলো*