ত্রিপুরা, ভারত
০২/১১/৭১ ইং
শ্রদ্ধেয় আব্বা,
আসসালামু আলাইকুম । আশা করি আল্লা তায়ালার অসীম রহমতে ভাল আছেন। আপনাদের দোয়ায় আমিও ভাল আছি। পর সমাচার এই যে, গত ৫ই জুন মুক্তিবাহিনীতে অংশগ্রহণের জন্য বাড়ি হতে ভারতের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলে আলগী বাজারে এসে বড় ভাইয়ের কান্নাকাটির ফলে বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু দেশ ও বাঙালির এই চরম দুর্যোগ মুহূর্তে ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের জঘন্যতম অত্যাচার আমরা চোখ মেলে সহ্য করতে পারি না। আপনি তো জানেন শেখ মুজিবুর রহমান একজন মহান নেতা। সারা বাংলার জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে, আপনিও তাকে বাংলার যোগ্য ও সাহসী নেতা হিসেবে ভোট দিয়েছেন। দেশের স্বার্থে তিনি যদি প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকেন, তবে তার ডাকে আমরা যদি পিছপা হয়ে যাই, তবে কোন দিনই দেশের মুক্তি আসবে না। তাই দেশের স্বার্থে প্রতিটি যুবক-কিশোরকে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিয়ে পাকিস্তানিদের মোকাবেলা করা দরকার বলে মনে করে বাড়ি থেকে চলে এসেছি - আব্বা, আপনাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছি, সেই জন্য আমাকে মাফ করে দিবেন।
ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি, আপনি একসাথে মা ও বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন। নানা ধরণের আবদার ও অনেক দুষ্টুমিতে আপনি রাগাহ্নিত হয়েছেন, আবার স্নেহভরে মায়ের মত কোলে তুলে নিয়েছেন। যদি দেশ স্বাধীন হয় তবে বীরদর্পে আপনার নিকট ফিরে আসব। আর যদি কোন যুদ্ধে শহীদ হই তবে আমাকে মাফ করে দিবেন। বড় ভাইকে বোঝাবেন, যাতে আমার জন্য কোন চিন্তা না করে। হয়তো বা বোনেরাও ছোট ভাই হিসেবে অনেক কান্নাকাটি করে - তাদেরকেও সান্ত্বনা দিবেন। আসার সময় মুতি ভাইকে বলে এসেছি। আমার কাছে ১৬ টাকা ছিল মতু ভাই আসার সময় ২০ টাকা দিয়ে বলেছে, তুই যা আমিও আসছি। জানি না মুতি ভাই কোথায় আছে, কী করছে। ইন্ডিয়া এসে দেশের অনেকের সাথে দেখা হয়েছে। আমার গ্রামের আপ্তাব উদ্দিন ভূইয়া এমএলএ একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে আছে। তার সাথে এক সপ্তাহ ছিলাম। ২০ দিন অস্ত্র ট্রেনিং শেষ করার পর বর্তমানে তাড়াইল-এর ক্যাপ্টেন আ. মতিন সাহেবের ক্যাম্পে আছি। ক্যাম্পের নাম ই-কোম্পানি, ৩ নং প্লাটুন, ৩ নং সেক্টর। ক্যাম্পটি আগরতলার কাছে মনতলায় অবস্হিত। বাড়ি থেকে আসার সময় ও ট্রেনিং সেন্টারে অনেক কষ্টই হয়েছে। বর্তমানে খাওয়া দাওয়া সবকিছুই ভালো ।প্রতিমাসে কিছু বেতনও পাচ্ছি । প্রায়ই বর্ডারে ডিউটি করতে হয় । গত ২৮ তারিখে সিলেটের মনতলার কমলপুরে একটি অপারেশনে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের জয় হয়েছে। আমাদের এখানে রায়পুরায় ১৪ জন আছি। আমাদের গ্রামের জহির, আ. হাই ও আবদুল্লা আমার সাথে আছে। এলাকার অনেকেই ট্রেনিং শেষে বাড়ি চলে যাচ্ছে । কিন্তু আমাদের ক্যাপ্টেন সাহেব আমাদের ছাড়ছেন না । তিনি বলেন, আমরা দেশ স্বাধীন করতে এসেছি। দেশ স্বাধীন করে আমরা একসাথে দেশে যাব। জানি না কবে দেশ স্বাধীন হবে, কবে দেশে আসতে পারব। সময় কম। ব্যারাক ডিউটির সময় হয়েছে। ডিউটিতে চলে যাব। পরে সুযোগ পেলে সব কিছু জানাব ।
আমার জন্য সবাইকে দোয়া করতে বলবেন। আল্লাহ আপনাদের সকলের মঙ্গল করুক।
ইতি-
আপনার স্নেহের পুত্র -
নজরুল ইসলাম (নয়াব মিয়া)
চিঠি লিখেছেন: মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম (নয়াব মিয়া)।
চিঠি প্রাপক: বাবা আলাউদ্দিন আহমেদ (দুদু মিয়া)
চিঠি পাঠিয়েছেন: লেখক নিজেই। বর্তমান ঠিকানা: গ্রাম ও পোষ্ট: রায়নগর(মতিনগর), উপজেলা, রায়পুরা, জেলা: নরসিংদী।
==========================================
একাত্তরের চিঠি সংকলনের টেক্স্ট কন্টেন্ট প্রকল্পের অংশ হিসাবে প্রকাশিত
বইটি স্ক্যানের জন্য ব্লগার পথিক!!!!! এবং পাতলা খানের কাছে কৃতজ্ঞ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০০৯ রাত ৯:২৬