ক’দিন আগে পাড়ার বশির চাচা তার বখে যাওয়া ছেলেটাকে ইঙ্গিত করে আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘বুজলে বাবা, আমার ছেলেটা একদম গেছে।’ সেদিন ঠিক একইভাবেই বর্তমানে দেশের উচ্চ শিক্ষার প্রতি ইশারা করে দেশের বিখ্যাত এক অধ্যাপক বলছিলেন, ‘দেশের উচ্চ শিক্ষার যা অবস্থা, বলা যায় একদম গেছে।’ তার মতে, বিভিন্ন দুষ্ট চক্রের ফাঁদে পড়ে সাধারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার মান অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। যা থেকে ফিরে আসা আর অতো সহজ নয়। অর্থাৎ চাচার বখাটে ছেলের মতো সাধারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যেই ‘গেছে’। তবে অল্প দিন আগেও এর ব্যতিক্রম ছিল উচ্চ শিক্ষার দু’টি ক্ষেত্র। তার একটি ঐতিহ্যবাহী বুয়েট। সেটিও গত কয়েকদিন ধরে ‘রাজনৈতিক শিক্ষাবিদদের’ হাত ধরে ‘যাওয়ার’ তালে আছে! বুঝা যাচ্ছে না, আদৌ এ ‘গমন’ কেউ ঠেকাতে পারবে কিনা। আর সর্বশেষ যে ক্ষেত্রটি বাকি ছিল, সেটি হলো মেডিকেল। মানে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা। এটিও সম্ভবত এখন ‘যাওয়ার’ পথে। আশংকায় আছি, কিছুদিন পরে কারো কাছ থেকে হয়তো শুনব, ‘এবার মেডিকেলটাও গেছে।’ বিষয়টাকে অনেকেই পাত্তা দিচ্ছেন না। কিন্তু কেন, তা রহস্যাবৃত।
ঘটনাটা হল, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ বছর অর্থাৎ ২০১২-২০১৩ সেশন থেকে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে না। এসএসসি ও এইচএসসি’র ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে! বিষয়টা শুনতে খুব সহজ সহজ মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। এইতো বেশ বেশ! পরীক্ষার প্রস্তুতি, দৌড়াদৌড়ি এসব বাড়তি ঝামেলা থেকে বাঁচা গেল! কিন্তু আসলে কি তাই? চলুন একটু দেখা যাক এ সিদ্ধান্তের ফলটা কেমন হতে পারে।
সিদ্ধান্তটি নেয়ার আগে প্রথমেই মনে একটি প্রশ্ন জাগা উচিত, এদেশের এসএসসি ও এইচএসসি’র ফলাফল একজন শিক্ষার্থীর মেধার মুল্যায়নে কতটুকু ‘পারফেক্ট’? এর উত্তর, এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রায় কোনো পরীক্ষায়ই মেধার যথাযথ মুল্যায়ন হয় না। আর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সেটি আরও বেশি প্রযোজ্য। কারণ, এক: এ দুই স্তরে পরীক্ষার খাতায় পছন্দ-অপছন্দের শিক্ষার্থীকে (বিজ্ঞানের ভাইভা’তে) নম্বর বেশি-কম দেয়ার অভিযোগ এদেশে নিয়মিত ঘটনা। দুই: পরীক্ষার খাতা দেখার কোনো সার্বজনীন পদ্ধতি নেই। যে যার মতো করে নম্বর দেন। এতে একই প্রশেুর একই উত্তর লেখে দু’জন ছাত্র দু’ধরনের নম্বর পায়। তিন: এ দুই স্তরে, বিশেষ করে এসএসসি’তে পরীক্ষকরা প্রশ্নের উত্তরের গুণগত মানের চেয়ে পরীক্ষার্থীর হাতের লেখার সৌন্দর্যের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সুন্দর হাতের লেখায়ই তারা বেশি নম্বর দেন। মফস্বল এলাকার পরীক্ষকদের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা মারাত্মক। অথচ উচ্চতর পড়াশোনার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মেডিকেলে পড়তে হাতের লেখার সৌন্দর্য্য কোনো কাজেই আসে না।
এখন তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, হ্যাঁ, আমাদের বর্তমান পদ্ধতির এসএসসি ও এইচএসসি’র ফলাফলই মেধা যাচাইয়ের একটি ‘পারফেক্ট’ মানদন্ড, তাহলে আসে নতুন প্রশ্ন। সেটা হল, নতুন পদ্ধতিতে হাজার হাজার ’সমান’ ফলাফলধারীর মধ্য থেকে মেডিকেলের অল্প সংখ্যক আসনের জন্য প্রার্থী নির্বাচন করা হবে কিভাবে? এখানে কয়েকটি তথ্য দেয়া প্রয়োজন। এবারের এইচএসসি’তে ৯ বোর্ডে (মাদ্রাসা ছাড়া) বিজ্ঞান শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩০ হাজার ১২৩ জন। এসএসসি’তে এ সংখ্যা দ্বিগুণের কাছাকাছি হবে। এদের সাথে যোগ হবে গত সেশনের পাশ করা আরও কয়েক হাজার জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থী। আর সরকারি মেডিকেলগুলোতে এবার আসন বাড়ানোর পর দাড়িয়েছে ২ হাজার ৬৮৬ টি। এ বছর ও গত বছরের এইচএসসি এবং এসএসসি’তে এ বিপুল সংখ্যক জিপিএ-৫ ধারীদের মধ্যে উভয় পরীক্ষায় গোল্ডেন ‘এ-প্লাস’ ধারীর সংখ্যা কত, তার কোনো তথ্য যোগাড় করতে পারিনি। তবে ধরে নেয়া যায়, মেডিকেলের বর্তমান আসন সংখ্যার চেয়ে সেটা কয়েকগুণ হবে। প্রশ্ন হল, এইচএসসি এবং এসএসসি’র ফলে ভিত্তিতে মেধাস্কোর প্রণয়ন করলে দু’পরীক্ষায় গোল্ডেন এ-প্লাস’ধারী সবার স্কোর সমান হবে! এক্ষেত্রে ভর্তিতে প্রাধান্য পাওয়ার অতিরিক্ত যোগ্যতা কি হবে??? বাংলাদেশের ঐতিহ্য (!) অনুযায়ী এ জায়গায় অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসাবে যে কয়টি বিকল্প আসতে পারে সেগুলো কল্পনা করা যায়- এক: রাজনৈতিক পরিচয়/মন্ত্রী/এমপির ফোন; দুই: মোটা অংকের টাকার লেনদেন; তিন: কলেজের কর্তা ব্যক্তিদের আত্মীয়-পরিজন হওয়া ইত্যাদি। এটুকুই যথেষ্ট! বাকি কল্পনাটুকু পাঠকই করে নেবেন।
এবার নতুন প্রসঙ্গ। দু’টি পাবলিক পরীক্ষায় ৮-১২ টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরের মোট নিয়েই ফলাফল হয়। সবাই সব বিষয়ে কাছাকাছি ফলাফল করলেও সব বিষয়ে জানার পরিধি সমান থাকে না। ধরা যাক, একজন গোল্ডেন এ-প্লাস’ধারী বায়োলজিতে কোনো মতে ৮০ নম্বর পেল, আর একজন ‘এ’ পাওয়া শিক্ষার্থী একই বিষয়ে পেল ৯৫। মেডিকেলে পড়ার ক্ষেত্রে অধিকতর যোগ্য কে? নিশ্চয়ই বায়োলজিতে ৯৫ পাওয়া শিক্ষার্থীটি। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে সে সুযোগ পাবেনা। বিজ্ঞান ও গণিত নির্ভর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা এজন্যই প্রয়োজন। এ বিষয়টি যে কত গুরুত্বপুর্ণ তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতি বছরের মেডিকেলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ধারীদের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ জিপিএ-৫ না পাওয়া শিক্ষার্থীর সুযোগ পাওয়া। গোল্ডেন এ-প্লাসধারীদেরকে পেছনে ফেলে কম গ্রেডে পাশ করা শিক্ষার্থীদের একটি নয়, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার ঘটনা খবই সাধারণ। এমনও উদাহরণ খুব সহজলভ্য যে বহু গোল্ডেন জিপিএ-৫ ধারী মেডিকেল-বুয়েট তো নয়ই, কোনো সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়েও সুযোগ পায়নি। অর্থাৎ অনেক অনেক জিপিএ-৫ ধারীরও পড়াশোনার ‘বেসিক’ এ অনেক দুর্বলতা থাকে।
আরেকটি বিষয়, এ সিদ্ধান্তে যে শুধু মেডিকেলে সুযোগ না পাওয়া শিক্ষার্থীরা বঞ্ছিত হবে তা নয়, এতে ক্ষতি হবে পরীক্ষা ছাড়া সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরও। ভর্তি পরীক্ষা থাকলে এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত ৩/৪ মাস সময়ে যে প্রস্তুতিটা নেয়া হতো তা মেডিকেলে ভর্তির পর অনেক কাজ দিত। এখন শিক্ষার্থীরা এ সময়টুকু অলসভাবেই কাটাতে পারবে!
রহস্যজনকভাবে তাড়াহুড়ো কওে নেয়া সরকারের এ সিদ্ধান্তের আরেকটি নেতিবাচক ফলও বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। সেটি হচ্ছে, গ্রাম থেকে উঠে আসা ডাক্তারের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে যাবে এ সিদ্ধান্তে! শহরের শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও এইচএসসি’র ফলাফলের দিক থেকে সব সময়ই এগিয়ে থাকে। আর গ্রামের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকে পরিশ্রম করার ক্ষেত্রে। তারা প্রচুর পড়াশোনা করে শহরের নামীদামী কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে পাল্লা দিতে। কিন্তু ভাল ফল করার কিছু টেকনিক্যাল দিক থেকে শহরের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যায়। এইচএসসি পরীক্ষার পর যে সময়টুকু পায় তাতেই শহরে এসে গ্রামের শিক্ষার্থীরা এদিকটায় শহরের শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি চলে আসে। তখন নতুন কোনো পরীক্ষা হলে সেখানে অনেকটা ‘পারফেক্ট’ মুল্যায়ন হওয়ার সুযোগ থাকে। এতে গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী মেডিকেল-বুয়েটসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে চান্স পায়। আমাদের সরকারগুলো শিক্ষিতদের, বিশেষ করে ডাক্তারদের গ্রামমুখী করার বহু ফন্দি-ফিকির করেও সফল হতে পারছে না। গ্রামের যে ছেলেটি ডাক্তার হয়ে শহরে আসে, সে নিয়মিত না হোক অনিয়মিতভাবেও গ্রামে একটি চেম্বারে বসে ‘গ্রামে জন্মের দায়’ শোধ করার চেষ্টা করে। সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তে মনে হয় গ্রামের মানুষগুলো এ থেকে বঞ্ছিত হতে যাচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা, এত এত উদ্বেগের বিষয় থাকলেও ভর্তি পরীক্ষা না নেয়াতে লাভের দিকটা কি তা অজানা। সরকার কোনো কারণ বলেনি। তাহলে কি ধরে নেয়া যায়, কোনো আশংকাজনক উদ্দেশ্য সামনে রেখে এ সিদ্ধান্ত! তার মানে মেডিকেলও 'একদম যাচ্ছে!'