মামা , যাবেন টিএসসি?
হ যামু ,উডেন ..
একটু অবাক হলাম ।নিউমার্কেট মোড় থেকে টিএসসির দিকে সচরাচর কোন রিকশা দরকষাকষি ছাড়া প্রথম দফায় যেতে রাজি হয় না ।অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে ।যা হোক মিরাকল ভেবে নিয়েই তড়িঘড়ি করে রিকশায় উঠেই বললাম, মামা জোরে পেডাল দেন ।কারণ, ভাষা ইন্সটিটিউটের ক্লাস শুরু হতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি ।ক্লাস মিসের শংকায় আমার পরিপূর্ণ মনোযোগ তখন গতির দিকে ।রিকশাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলো ।রিকশা চল্ল হাওয়ার বেগে ।হঠাৎ ব্রেক কষতেই গতি জড়তার কারণে সামনে হেলে গেলাম।ভিষণভাবে চমকে উঠলাম । রিকশাওয়ালার বাম হাত কব্জি থেকে বাকি অংশ পুরোপুরি উধাও।না, কোন দূর্ঘটনা নয়, আগে থেকেই উনার শরীরের উক্ত অংশ নেই । অথচ, রিকশা চালনায় তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত ।আংগুল এবং তালুবিহীন কব্জির হাঁড় দিয়েই তিনি দিব্যি বেল বাজাচ্ছেন, দিক ঠিক রাখছেন আর সাবলীল ভাবে কাটিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক রিকশাকে। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আমি বুঝলাম জোরে চালাতে বলার পর তার মুচকি হাসির কারণ।তাড়াহুড়োয় প্রথমে উনার হাতের অবস্থা দৃষ্টিগোচর হয় নি।কিভাবে তিনি এক হাতে নিপুণভাবে রিকশা চালান আর কেনইবা হাতের এ পরিণতি,জিগ্গেস করলাম।মন থেকে ক্লাসের চিন্তাটা বেমালুম উবে গেলো।
জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী শাহজাহান মিয়ার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ,বয়স ছাপ্পান্ন কি সাতান্ন।থাকেন পুরান ঢাকার আজিমপুরে।ওখানকারই স্থানীয় গ্যারেজের রিকশা চালান।দুই মেয়ে আর ছেলে সহ স্ত্রী থাকেন গ্রামে। ভিটেটুকু ছাড়া বাড়তি জায়গা-জমি নেই, উপার্জনক্ষম(!) শাহজাহান সাহেবের আয়েই চলে অভাবের সংসার। বর্তমানে বাড়তি চিন্তা যৌবনে পা দেয়া বিবাহউপযুক্ত মেয়েটি।যৌতুক ছাড়া যে বিয়ে হচ্ছে না তার ।আর হ্যাঁ, শরীরের এ অসম্পূ্র্ণতাকে জয় করেছেন দীর্ঘ চেষ্টায়।তার ভাষায় "আল্লায় যার লগে থাকে হের কুনু ক্ষেতি নাই, আমি মামু ভিখ্ করি না, আল্লায় কইছে কামাই করতে, ভিখ্ (ভিক্ষা) করতে না করছে , হের লাইগা আমি রিশকা চালাই, আমার কথা আল্লায় হুনে!" আরেকবার স্তম্ভিত হলাম লোকটির প্রখর জীবনবোধ আর বিশ্বাসের দৃঢ়তায়, এর ছিটেফোঁটাও আমাদের মাঝে অনুপস্থিত! ততক্ষণে আমরা হাকিম চত্বরের গেটে। মামা লামেন ।ক্লাস শুরু ততক্ষণে, দশ মিনিট লেট।কোন আফসুস নেই আমার।আরও দুমিনিট লেট করে উনার কয়েকটা ছবি তুললাম। ডুবন্ত সূর্যের আবছা আলোয় ছবিগুলো তেমন ক্লিয়ার হলো না মোবাইলে।তাও শেয়ার করলাম আপনাদের সাথে। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বিশ টাকা বেশি দিলাম।ভিক্ষাবৃত্তিকে আজকাল পেশা হিসেবে নিচ্ছে অনেকে ।এদের চেয় এই খেঁটে খাওয়া প্রতিবন্ধী লোকটাকে একটু বাড়িয়ে দেয়া ভালো কাজ।আরও কিছু করতে না পারার অক্ষমতা ভিতরে বেশ খোঁচাচ্ছিল।ঘুরে দেখলাম, রিকশাওয়ালা শাহজাহান মিয়া নতুন ট্রিপের খুঁজে পেডালে চাপ বাড়িয়েছে।
অদ্ভুত এক শ্রদ্ধাবোধে ভরে গেলো মন।শরীরের বড় অসম্পূর্ণতা সত্বেও অফুরান প্রাণশক্তিতে এ জীবনসংগ্রামী করে চলেছেন জীবনের চাষ।মন থেকে হাজারো সালাম জানালাম তাকে, আর চোখে ভেসে উঠলো আমাদের সমাজের সামগ্রিক চিত্র, অস্থিরতার দূষিত বাতাস।
প্রিয় পাঠক এবং ব্লগার, নিজের দেখা এই লোকটির কথা অনেক আবেগতাড়িত হয়ে লিখেছি।আমরা এই সংগ্রামী রিকশাওয়ালার মত কোরে সামগ্রিকভাবে কবে অন্যের দয়া-দক্ষিণার অমুখাপেক্ষি একটা আত্নমর্যাদাশীল জাতি হব ?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:০৪