অনন্ত এবং অপমানের সংস্কৃতি
নভেম্ভর ৫, ২০১২
এম এ জলিল অনন্ত, দেশের একজন সফল ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্রের নায়ক, প্রযোজক এবং পরিচালক। তিনি প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছে। তার আরো ছবি তৈরি হচ্ছে এবং মুক্তির অপেক্ষায় আছে। দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ে তার একটা নির্দিষ্ট স্বপ্ন (Vision) আছে, সে স্বপ্নকে অর্জন করার জন্য তিনি তার লক্ষ্য ঠিক করেছেন এবং সে লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে তার পরিকল্পনা আছে, আর সে অনুযায়ী তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর তার এই একাগ্রতা, পরিশ্রম, মৃত প্রায় একটা শিল্পকে বাঁচানোর চেষ্টা – সর্বোপরি তার কাজের যত না তারিফ করা হচ্ছে তার চেয়ে বহুগুন ব্যক্তি অনন্তকে নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনা করছে। তার উচ্চারণ দুর্বলতা ও জীবন-যাপন নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-উত্যক্ত (Bully)-কটুক্তি (Verbal abuse) করা হচ্ছে যা অশোভন, নিন্দনীয় এবং অন্যায়। আমরা যে কম সভ্য জাতি, তা প্রমানের জন্য এসব আচরণই যথেষ্ট!
কারা এসব করছে? কিছু তথাকথিত শিক্ষিত-সভ্য মানুষ; এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়, এর মধ্যে কয়েকজন আবার ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমেও সক্রিয়। নাম করা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী; মূলধারার শীর্ষস্থানীয় প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক প্রচার মাধ্যম। ঘটনার সূত্রপাত ২-৩ মাস পূর্বে। অনন্তর ভাষ্য অনুযায়ী সে তার স্ত্রী বর্ষাকে নিয়ে এক খাবারের দোকানে গিয়েছিলেন যেখানে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ক’জন ছেলে-মেয়ে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে নেতিবাচক মন্তব্য করে। অনন্ত তার প্রতিবাদ করে এবং এক পর্যায়ে বলে ‘Are you from Ghana?’ (তুমি/আপনি কি গানা থেকে এসেছেন?)। সেই ঘটনাটাই পরে এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি বর্ণনা করেন। তথাকথিত শিক্ষিত-সভ্যজনদের দাবী, অনন্ত ‘…ফ্রম ঘানা’ এর পরিবর্তে ‘…পোম গানা’ উচ্চারণ করেছেন। সেই থেকে শুরু, এই উচ্চারণ নিয়ে তার প্রতি অশোভন, অসম্মানজনক ব্যাঙ্গ-উপহাস (Cyber bully), কটুক্তি চলছে যা রীতিমত মানসিক আঘাত । যার শুরুটা হয়েছিল সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে, তারপর বুয়েটের শিক্ষার্থীদের প্লাকার্ডে, ইদানিং এর সাথে যোগ দিয়েছে মূলধারার প্রচার মাধ্যম। সর্বশেষ তাকে সস্ত্রীক উত্যক্ত এবং কটুক্তি করা হয়েছে জনসমুক্ষে, সামনাসামনি।
সেই টিভি অনুষ্ঠানের ভিডিওটি দেখে আমার মনে হয়নি সে ‘ফ্রম’ কে ‘পোম’ বলেছে; আমার মনে হয়েছে ‘ফম’। পোম বা ফম এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অনন্ত যা বলতে চেয়েছে আমি তা পুরোপুরি বুঝেছি। আমার ধারনা সে যেভাবেই উচ্চারণ করুক না কেন যারা ঐ অনুষ্ঠান দেখেছে তারা সবাই বুঝতে পেরেছে। Ghana এর উচ্চারণ ‘ঘানা’ নয়, অনেকটা ‘গায়ানা’ যা সে ঠিকই উচ্চারণ করেছে। যেমন, এক সময় আমরা ঢাকাকে ইংরেজীতে লিখতাম Dacca কিন্তু সবসময়ই উচ্চারণ করতাম ‘ঢাকা’, কখনো ‘ডাকা’ বা ‘ডাক্কা’ উচ্চারণ করতাম না। যে কোন ভাষার প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যোগাযোগ স্থাপন করা (Communicate) যা অনন্ত সফলভাবেই করেছে। এটা ঠিক যে তার উচ্চারণে কিছুটা দুর্বলতা আছে যা সে নিজেই স্বীকার করেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ইংরেজী আমাদের দ্বিতীয় ভাষা, আর দ্বিতীয় ভাষায় একজন মানুষ উচ্চারণে ভুল করবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া, অনন্ত যদি তার উচ্চারণে ভুল করে থাকে সেটা শুধুই একটা ভুল, সেটা কোন অন্যায় বা অপরাধ না। কিন্তু তার এই দুর্বলতা নিয়ে তাকে যারা ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ-কটুক্তি-উত্যক্ত করার মাধ্যমে তারা রীতিমত অন্যায় করছে যা উন্নত দেশে অপরাধ হিসাবে বিবেচিত । এরা শুধু অন্যায়ই করছে না, আবার সেই অন্যায়কে জায়েজ বা যুক্তিযুক্ত (Rationalize) করার জন্য তার ব্যক্তিগত জীবন-যাপন নিয়ে উপহাস করছে। যেমন বলা হচ্ছে, সে বড়লোকি দেখাতে হেলিকপটার নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছে, নিজে নায়ক হয়েছে, নিজের এবং বউর প্রসংশা করে বেড়াচ্ছে ইত্যাদি…। যেন সে এসব করছে তাই তাকে অবমাননা করা জায়েজ! সে যদি এসব করে তাতে অন্যদের সমস্যা কী? সে যা করছে তা কোন সমস্যা না বরং তাকে যারা অবমাননা করছে তাদেরই মানসিক সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। একজন মানুষ নিজেকে কিভাবে মূল্যায়ন করে, কিভাবে জীবন-যাপন করে সেটা একান্তই তার নিজের ব্যাপার। এটা ঠিক যে সে একজন সেলিব্রিটি এবং তাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকবে। তার মানে এই না যে তার ব্যক্তিগত দুর্বলতা নিয়ে তাকে প্রচার মাধ্যমে এবং সামনাসামনি উত্যক্ত করা যায়, অবমাননা করা যায়। তার কাজ নিয়ে, পর্দায় তার উপস্থিতি নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা এমনকি কৌতুক হতে পারে, যা সব দেশেই চলচ্চিত্র নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে হয়।
উচ্চারণগত সমস্যা আমাদের দেশের অনেক মানুষেরই আছে, এমন কি বাংলাতেও । শুধু উচ্চারণগত দুর্বলতার কারণেই যে অনন্তকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-কটুক্তি করা হচ্ছে,- তা মনে হয় না। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের পাত্র-পাত্রি, কলাকুশলীদের সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক গৎবাঁধা ধারণা (Stereotype) বিদ্যমান।
ঘটনার সূত্রপাত, খাবারের দোকানে অনন্তর প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য। ঐ মন্তব্যই প্রমান করে আমাদের দেশের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষদের সম্পর্কে তথাকথিত শিক্ষিত-সভ্য মানুষদের অবজ্ঞা। যে কোন সমাজেই গৎবাঁধা ধারণাকে বহাল রাখে বা পাকাপোক্ত করে মূলত প্রচার মাধ্যম, সেটা হতে পারে কোন নির্দিষ্ট পেশার মানুষদের সম্পর্কে, অথবা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সম্পর্কে। যেমন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা আগেই উল্লেখ করেছি; এ ছাড়া, সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকা এবং একটি টিভি চ্যানেলে অনন্তর যে সাক্ষাৎকার ছাপানো/প্রচারিত হয়েছে সেখানে অধিকাংশ প্রশ্ন করার ধরনই ছিল যথেষ্ট অশোভন এবং অসম্মানজনক। একটা উদাহরন, সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী দুজনই বার বার ‘পোম গানা’ প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে তাকে হেয় করার চেষ্টা করছিলেন। সাক্ষাৎকারের নামে একজন মানুষের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলে সেই মানুষটিকে বিব্রত করা অশোভন এবং অবমাননাকর। যা সাধারন নৈতিকতা বিরোধী (Unethical) কাজ। আবার ঐ দুই প্রশ্নকারী বার বার ‘ঘানা’ বলে ঐ দেশের নামটি ভুল উচ্চারণ করছিলেন এবং প্রমান করার চেষ্টা করছিলেন ‘ঘানা’ই সঠিক উচ্চারণ, আর অনন্তর উচ্চারণ ‘গানা’ ভুল। আর এটা করে পাঠক-দর্শকদের অনন্ত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাই দেয়া হচ্ছিল, যা চলচ্চিত্র শিল্পীদের সম্পর্কে গৎবাঁধা ধারণাকেই পাকাপোক্ত করে। এ ধরনের গৎবাঁধা ধারণার কু-প্রভাব দুদিন আগেই আমরা জেনেছি -এক খাবার দোকানে অনন্ত এবং বর্ষাকে উত্যক্ত করা হয়েছে, আপত্তিকর ভাষায় তাদের কটুক্তি এবং অবমাননা করা হয়েছে। অনন্ত এবং বর্ষার প্রতি কিছু মানুষের এই অসম্মানজনক আচরণের দায় তাই প্রচার মাধ্যম এড়াতে পারে না।
কী কারণে কিছু মানুষ অন্যদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-কটুক্তি করে সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। মনোবিজ্ঞান এবং অপরাধবিজ্ঞান অনুযায়ী সাধারণত সেইসব মানুষ অন্যদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে যারা আত্মবিশ্বাসহীন বা কম আত্মবিশ্বাসী, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং নিজেদের ভুল-ত্রুটি-ব্যর্থতা মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। এরা অন্যদের ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করার মাধ্যমে নিজেদের উর্ধ্বতন (Superior) হিসাবে কর্তৃত্ব জাহির করে একধরনের ভ্রান্ত ক্ষমতার অধিকারী মনে করে অত্মতুষ্টি লাভ করে। এরা সাধারণত অ-সুখী, নেতিবাচক, ঈর্ষাপরায়ন এবং অন্যকে মানসিক আঘাত দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। অন্যদিকে, অনন্ত একজন সফল ব্যবসায়ী, যথেষ্ট অর্থের মালিক (নিজের উপার্জনের অর্থ) এবং বর্ষার সাথে সফল সম্পর্কে একজন সুখী মানুষ (আমার ধারণা্)। আর এ সবকিছু মিলে সে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী, উচ্চাকাংখী এবং পরিশ্রমী একজন মানুষ। সফল হবার জন্য যে সব গুনাবলী এবং যা থাকা দরকার তার সবকিছুই অনন্তর আছে। যা অনেকের ঈর্ষার কারণ হতেই পারে। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আত্মজীবনীতে লিখেছেন জাতি হিসাবে আমরা পরশ্রীকাতর!
আত্মসম্মানহীন, আত্মভালবাসাহীন মানুষেরা সাধারণত অন্যদের সম্মান করে না, করতে জানে না। এরা সাধারণত কোন ইতিবাচক পরিবর্তন বা উন্নয়নের জন্য কিছু করে না বা করতে পারে না বরং ঈর্ষাপরায়ন হয়ে অন্যদের ইতিবাচক কর্মকান্ডে বাধাপ্রদান করার চেষ্টা করে। কোথায় যেন পড়েছিলাম যারা অন্যের পেছনে লেগে থাকে তারা সবসময় পেছনেই থাকে, কখনো সামনে যেতে পারে না (দুঃখিত তথ্যসূত্র মনে নেই)। আমার বিশ্বাস অনন্ত ঐসব মানুষের নোংরামি উপেক্ষা করে, সকল বাধা অতিক্রম করে আরো সাফল্যের দিনে এগিয়ে যাবে। আমাদের দেশে যে আরো অনেক অনন্ত দরকার .
সীনা আক্তার: গবেষক।
অনন্ত এবং অপমানের সংস্কৃতি
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৩৩