হাঁড় ঠকঠক কনকনে মাঝরাতের ঠান্ডায় বাসায় ফিরছিলাম ।মনে আনন্দের রেশ, নির্ঘুম অর্ধরজনী কেটেছে গ্রামীন ফোনের ট্রাইনেশন কনসার্টে ।শিতের হিম আবহাওয়া কিসুক্ষনের জন্য গরম করেছিলেন জেমস, পাকিস্তানি শাফকাত আহমেদ আর ইন্ডিয়ার হার্টথ্রব প্লেব্যাক শিল্পী সনু নিগম।কনসার্ট এর হাজার দর্শক মুগ্ধতা নিয়েই বাসায় ফিরেছেন বলে মনে হল।বাস থেকে নেমে হাটা দিলাম, শীতের ধারালো হাওয়া পোঁচ দিচ্ছিল চোখে মুখে ।গলির মুখে ঢুকতেই দেখলাম একদল মজুর মাথায় সিমেন্টের বস্তা বয়ে নিয়ে ট্রাক থেকে একটা নির্মানাধীন ভবনের নিেচ রাখছে । কমন দৃশ্য, ব্যাতিক্রম কিছু নয় । এই লোকগুলো এমন খাটা খাটুনি করেই নিজের অন্নসংস্থান করে থাকে, এদের জন্য দিন রাত নেই। কড়া শীতে ও তাদের এরুপ পাতলা শার্ট আর মাথায় বোঝা নিয়ে জিবিকার সন্ধান করতে হয়। কিন্তু থমকে গেলাম অন্য কারনে ।আজকাল মুঠোফোন বেশ সস্তা যে তা মুটামুটি ভিখিরি থেকে রিকশাওয়ালা সবার কাছেই সহজলভ্য । তো এদের একজনের পকেটে মোবাইল ফোন এবং সেখানে উচ্চ ভল্যুমে নাতে রাসুল বাজছে, "মনে বড় আশা ছিল যাবো মদিনায়......
দিনমজুর তরুণটির একাগ্রচিত্তে নিজের কাজ করে যাওয়া আর জীবন সংগ্রামে লড়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যেন ভেসে আসা সেই সুর । আনমনা হয়ে গেলাম আমি । ছোট বেলায় রেডিও তে আব্বাস উদ্দিন বা আব্দুল আলিম এর কণ্ঠে নজরুল এর ইসলামিক গান, জসীম উদ্দিন এর পল্লীগীতি, হামদ বাজত, মিলাদউন্নবী, শবে কদর বা ঈদগাহের মাঠে এইরকম অনেক ইসলামিক গান, হামদ-নাত শোনা যেত । মানুষ কাজের অবসরে রেডিও শুনত । রেডিওর নতুন সংস্করন এফ এম রেডিও সে যায়গা দখল করেছে। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমরা বিলীন হচ্ছি বিজাতীয় সংস্কৃতিতে। এই 'আমরা' কিন্তু আপামর বাংলাদেশীদের প্রতিনিধি নই। 'আমরা' কতিপয় এলিট বা সুশীল । কিন্তু এই দিনমজুর ঠিকই আপন ঐতিহ্য লালন করছেন, তাঁর কাছে প্রগতি বা প্রতিক্রিয়াশীল এর কোন পরিচিতি নেই, নেই ডান বামের ভেদাভেদ। তিন থেকে চার জনের এই মজুরের দল অদ্ভুত দ্রুততায় নিজেদের কাজ করছেন আর ক্লান্তির উপশমে রসদ যোগাচ্ছে মোবাইল কাম অডিও প্লেয়ার ।সেখানে বাজছে ইসলামি গান। নিজের বিগত কয়েক ঘণ্টার অপচয় / রিক্রিয়েশন কে এই "আনন্দের সাথে কাজ" এর হিসেব মেলানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। এই পাশ্চাত্য ঘরানার অনুরাগী 'শিক্ষিত সুশীল এলিট' আমরা, না কি নিজস্ব বলয়ে বেড়ে উঠে নিজের আপনাকে লালন করা মিডিয়ার পাদপ্রদীপের অন্ধকারের অগুণিত খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিচ্ছবি এই কয়েকজন দিনমজুর বাংলাদেশের প্রতিনিধি, এর উত্তর খুঁজতে লাগলাম।
সেদিন ই সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররমে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোরআন রিসাইটেশন এসোসিয়েশন (ইকরা)’ নামে একটি সংগঠন দেশী-বিদেশী ক্বারীদের নিয়ে ক্বেরাত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ইরান, মিশর, মালয়েশিয়া, ব্রুনাইসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ক্বারীরা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছেন।নৌ পরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান প্রধান অতিথি ছিলেন। নৌপরিবহণ মন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। এক পর্যায়ে তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে কথা বলা শুরু করেন।
তিনি বলেন, “ইসলামে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোনো স্থান নেই। কুরআনে এ সম্পর্কে কোনো আয়াত নেই। রাসুল (সা.) ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি পছন্দ করতে না। তিনি এই কাজটি কখনো করেননি।”
তখন মুসল্লিদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করেন এবং জানতে চান, মুসলমান হিসেবে মন্ত্রী কেন তাহলে রাজনীতি করছেন।
এ সময় নৌমন্ত্রী ওই মুসল্লির প্রতি রাগান্বিত হয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপক্ষে বক্তব্য অব্যাহত রাখলে উপস্থিত মুসল্লিদের অনেকে দাঁড়িয়ে যান এবং সেখানে চরম হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।মন্ত্রী এরই মধ্যে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন। এই অবস্থায় মুসল্লিরা মন্ত্রীকে লক্ষ্য করে মুহুর্মূহ জুতা নিক্ষেপ করতে থাকে।ঘটনাস্থলে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, মন্ত্রী প্রথমে ইসলামের ব্যাপারে সুন্দর সুন্দর কথা বললেও ইসলামী রাজনীতির ব্যাপারে কথা বলার সময় তিনি কুরআনে ইসলামে রাজনীতির কোনো আয়াত নেই- এমন দাবি করে বসলেই মূলত: মুলসল্লিরা প্রতিবাদ করেন। আর এতে মন্ত্রী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে অনেকটা তাদের প্রতি তেড়ে যাওয়ার মতো করে কথা বলতে থাকেন। আর তখনই গণরোষের শিকার হন। তারা জানান, এসময় সেখানে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয় ।
বাসায় এসে অনলাইনে এ খবর পাওয়ার পর আমি দুটি দৃশ্য মেলাতে চেষ্টা করলাম । সাধারন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জুতা ছুঁড়ে এলিট মন্ত্রির মনগড়া ইসলামিক ব্যাখ্যার প্রতিবাদ আর দিনমজুরের শীতের রাতের কষ্টকর শ্রমের অনুপ্রেরণার নাত এ রাসুল যেন এক হয়ে স্বতন্ত্র এক উড়ে আসা জুতা হয়ে আছড়ে পরল "সুশীল'' আমার উপর।