অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, রেসিপির বই হিসাবে কোন বইটা কেনা যেতে পারে। আমি তাদের পরিষ্কার করে বলে দেই, অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীরের বই ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’। এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৭৮ইং এবং এর পর এই বই নানানভাবে নানা ভাবে বিভক্ত হয়ে উনার নামে বেনামে অনেক ভাবেই বাজারে এসেছে কিন্তু এই প্রথম প্রকাশের বইটাই আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে। গত প্রায় ২১ বছর ধরে আমাদের পরিবারে এই বইটা আছে, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী এই বই সংগ্রহ করেছিলেন আমাদের বিবাহের পরে, সেই সময় তিনিও ভাল রান্না জানতেন না এবং ছোট ভাইকে একটা রান্নার বই নিয়ে আসতে বললে সে এই বইটা নিয়ে আসে, সেই থেকেই! আমি নিজে কারনে অকারনে এই বই দেখি। আমি আমার রেসিপি লেখা এবং গল্প ও রান্না সাইট চালাতে এই বই থেকে অনেক রেসিপি নিয়েছি এবং এই বই ফলো করে আমাদের পরিবারে অনেক রান্না হয়েছে। তবে এত শত শত রান্নাতে কিছু রান্নায় পরিমানে কিছু এদিক সেদিক আছে কিন্তু সেটা দেশে পাওয়া অন্যান্য বই থেকে অনেক কম। আমার ধারনা তিনি এই বইয়ের প্রতিটা রান্না নিজে করে দেখেছেন এবং সেই মতেই পরিমান দিয়েছেন। এদিকে দেশে পাওয়া অন্যান্য রেসিপি বই গুলোর বেশিরভাগ রেসিপি নকল বা চুরি করে লেখা বলে মনে হয়, কারন সেই সব রেসিপির পরিমান মত রান্না করলে অধিকাংশ সময় স্বাদ হয় না! এরা মুলত রান্না না করেই রেসিপি নকল করে বসিয়ে দেন! একবার এক রেসিপি বই থেকে আমি ও আমার প্রিয়তমা স্ত্রী রসগোল্লা তৈরী করেছিলাম, সেই রেসিপি মোতাবেক, বিশ্বাস করুন, সেই লজ্জা আজো আমার মনে আছে, প্রায় ৫০০ টাকার খরচের সেই খাবার আমরা কেহ খেতে পারি নাই বা হয় নাই! ফেলে দিতে হয়েছিল! আমাদের গল্প ও রান্না’য় সেই সুযোগ নেই! আমরা প্রতিটা রান্না করেই আপনাদের সামনে নিয়ে আসি। এমন অনেক হয়েছে, রান্না ভাল হয় নাই, সেই রান্নার ছবিও প্রকাশ করি না।
যাই হোক, আমাদের রান্নার ‘গুরুমা’ অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীর নিয়েই আজকের আলোচনা চলুক। উনাকে আপনারা সবাই চিনেন বা যারা আজ রান্নায় ওস্তাদ হিসাবে আছেন, তারা নিশ্চয় উনার বই পত্র বা টিভিতে উনার অনুষ্ঠান দেখেছেন। বাংলাদেশের রান্নার জগতে উনাকে রাখতেই হবে, তিনি অবশ্যই ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। আমার প্রায় উনার কথা মনে পড়ে, রাতের পর রাত উনার রান্নার সিডি গুলো আমরা দেখতাম, দেখতাম টিভি অনুষ্ঠান গুলো। রান্না করতে গেলে তো উনার বই সংগী থাকত। বিশেষ করে একটু ভাল রান্না গুলোতে অবশ্যই! চলুন উনার কথা জানি। উইকিপিডিয়া থেকে উনার এই ছবি ও জীবনী নেয়া হয়েছে।
সিদ্দিকা কবীরের জন্ম পুরানো ঢাকার মকিম বাজারে, ১৯৩৫ সালের ৭ মে। তার পিতা মৌলভি আহমেদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ও পরবর্তীতে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। সিদ্দিকা কবীরের মাতা সৈয়দা হাসিনা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে সিদ্দিকা কবীর ব্যাংকার সৈয়দ আলী কবীরকে বিয়ে করেন।
সিদ্দিকা কবীর পড়াশোনা করেন প্রথমে ইডেন কলেজে। সেখান থেকে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হন ও সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পর তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি হতে ১৯৬৩ সালে খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় সিদ্দিকা কবীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধপূর্ব তৎকালীন পাকিস্তান রেডিওতে ঘোষক হিসাবে খণ্ডকালীন চাকরিতে যোগ দেন। স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পরে প্রথমে ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করেন। এর পর তিনি ইডেন কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের পর দেশে ফিরে তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, আজিমপুর, ঢাকা এর সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬৫ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান হতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রান্না শেখা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি তদানিন্তন পাকিস্তান টেলিভিশনে “ঘরে বাইরে” নামে রান্নার অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা শুরু করেন। সিদ্দিকা কবীর তার “রান্না খাদ্য পুষ্টি” বইটির জন্য ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলাদেশের সর্বাধিক বিক্রিত বইগুলির মধ্যে এখন পর্যন্ত বইটি অন্যতম। বইটি প্রথম প্রকাশের সময় মুক্তধারা, বাংলা একাডেমী সহ অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা এটি প্রকাশ করতে রাজী হয় নাই। পরে এটি নিজ খরচে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশের পর এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৪ সালে ইংরেজি ভাষায় একটি কারি রান্নার বই লিখেন। ১৯৮০ সালে লিখেন পাঠ্যবই খাদ্যপুষ্টি ও খাদ্য ব্যবস্থা, যা স্নাতক পর্যায়ে পড়ানো হয়। এছাড়া তিনি ১৯৯৭ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে রসনা নামে কলাম লিখেন, যা পরবর্তীতে খাবার দাবারের কড়চা নামে প্রকাশিত হয়। প্রাইভেট টেলিভিশন এনটিভিতে তিনি সিদ্দিকা কবীরস্ রেসিপি নামের রান্নার অনুষ্ঠান নির্মানে জড়িত ছিলেন।
অধ্যাপক সিদ্দিকা কবীর ৩১ জানুয়ারি ২০১২-তে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার স্কয়্যার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি হৃদরোগসহ বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুপূর্ব বেশ কিছুদিন সিআরপি-তে চিকিৎসারত থাকার পর, উন্নত চিকিৎসার জন্য স্কয়্যার হাসপাতালে স্থানান্তরের পর সেখানে চিকিৎসারত থাকাকালীন তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন।
[উপহার কিংবা পুরুস্কার ইত্যাদিতে উনার তেমন আগ্রহ ছিল বলে আমার মনে হয় না। তিনি বিশাল ব্যক্তিত্ব নিয়ে থাকতেন, কর্মেই পরিচিত হতে চাইতেন। অন্যান্য জ্ঞানী গুনি ব্যক্তিদের মত তিনিও হয়ত রাষ্ট্রীয় সন্মান পান নাই, তবে মানুষের মনের কোঠায় তিনি যে ভালবাসা পেয়েছেন তা অসাধারন। আমিও এমন ভালবাসা চাই! মৃত্যুর পরেই মানুষ ভালবাসা চাই।।]
(গল্প ও রান্না থেকে লিখন, তথ্য সুত্র উইকিপিডিয়া)
(রান্না শিখুন, রান্নার অপর নাম ভালবাসা)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:২১