৪ তলার নতুন ভাড়াটিয়াদের কার যেন বিয়ে। সেই উপলক্ষে সারা বিল্ডিং এ লাইটিং করা গত দুই দিন ধরে। রাত ২টার দিকে যখন ঘরের আলো নিভিয়ে শুতে গেলাম- আমার ঘর তখন ছেয়ে আছে বেলকোনি থেকে আসা খুব মৃদু একটা নীল আলোয়। বেলকোনির দরজাটা নকশা খোদানো ইষদচ্ছ কাঁচের। তাতে প্রতিসরিত হয়ে ছোট্ট ছোট্ট "মরিচ বাতি"গুলো কেমন ঢাউস আকৃতির হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে- কোনোটা চারকোনা, কোনটা ত্রিভুজ, আবার কোনটা বা উপবৃত্ত।
রঙিন আলো আমার ভাল লাগে। তাই শুয়ে শুয়ে ওদের ওই আলোগুলোকে দেখছিলাম। আমার আর ওদের মাঝখানে একটা মাত্র কাঁচ। আর তাতেই আমার চোখে বদলে গেছে ওদের সবকিছু।
বদলে যাওয়াও আমার ভাল লাগে। তাই আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওই নীল নকশার দিকে। নকশাটা একসময় আমাকে ডাকলো- "আমার কাছে জাদু আছে। তুমি দেখবে?" আমি তার ডাকে রাজি হলাম। ধীরে ধীরে সে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো তার নিজের দিকে। নকশাটা বড় হচ্ছে। নাকি আমিই ছোট হচ্ছি? বোঝার জন্য পেছনে ফিরে তাকালাম। দূরে- বহু দূরে নিথর হয়ে পড়ে আছে আমার বিশাল শরীরটা। আমার ওই শরীর আর আমার মাঝে খেলা করছে বিক্ষুব্ধ একটা বাতাসের সমুদ্র... নীল সেই সমুদ্রে নিজের শরীরটাকে মনে হচ্ছিল যেন ঘুমন্ত কোন নীলতিমি।
এই প্রথম আমি নিজেকে দেখলাম।
.
.
আরো এগুবো নাকি পিছাবো এই নিয়ে যখন আমি কনফিউসড, ঠিক তখনই নিজের ভেতর থেকে একটা তাড়না টের পাই আমি- আমাকে হারাতে হবে। হারিয়ে যেতে হবে এই ২৫ বছরের একঘেয়ে জীবন থেকে.....
মানুষ খুব বেশীদিন একই ভাবে একই কাজ করতে পারে না। তাদের ছুটি লাগে, তাদেরকে হারিয়ে যেতে হয়। সপ্তাহে একদিন হারিয়ে যেতে হয় স্কুল থেকে, দুদিন হারাতে হয় অফিস থেকে। আবার ঠিক নিয়ম করে প্রতিদিন ছুটি নিতে হয় নিজের চেতনা থেকে- হারিয়ে যেতে হয় ঘুমের রাজ্যে।
আজ আমি হারাতে চাই। হারাতে চাই এই চেনা পৃথিবীটা থেকে। হারাতে চাই এই একঘেয়ে শরীরের বন্দিশালা থেকে, হারাতে চাই ৫ ইন্দ্রিয়ের এই সীমানা থেকে। আমি ক্লান্ত। আমি ক্লিষ্ট। আমি অতিষ্ঠ এই একঘেয়ে জীবনে। তাহলে কেন আমি ফেরত যাবো ওই পুরোনো শরীরটায়?
আমি সামনে ফিরলাম। নীল বাতাসে সাঁতার কেটে কেটে চলে গেলাম কাঁচের গায়ে আঁকা ওই নীল নকশাটার কাছে। কাঁচ আমাকে আদর করে তার ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো।
কাঁচের ভেতরে ঢুকে আমি চমকে উঠলাম। চারিদিকে গোল গোল কিছু খয়েরি রঙের বল- আস্তে আস্তে নড়াচড়া করছে। আর তাদের চারিদিকে পড়িমরি করে ছুটে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট হলুদ রঙের কিছু বল। ব্যাপারটা আমি বুঝলাম না। সাবধানে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম আমি। একসময় খেয়াল করলাম ঘুরতে থাকা ওই বলগুলোর ফাঁক দিয়ে কাঁচের ওপাশ থেকে ছুটে আসছে আরো ছোট ছোট অসংখ্য নীল রঙের বল। ওরা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে আমাকে, কখনো বা ধাক্কা খাচ্ছে অন্যান্য বলের সাথে। তারপর দিক পরিবর্তন করে বেরিয়ে যাচ্ছে কাচের ভেতরের এই অদ্ভুত জগতটা থেকে।
আমি ভাল করে খেয়াল করি ওই নীল বলগুলোকে- কাচের বাইরে প্রকান্ড উজ্জ্বল একটা আগ্নেয়গিরি। সেখান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বের হয়ে আসছে ওরা। আমি আগ্নেয়গিরিটাকে চিনতে পারলাম। এটাই সেই "মরিচ বাতি"। আর এই নীল বলগুলো হল আলোর কণা- যাকে বলে "ফোটন"।
আমি এক ধাক্কায় আমার আশেপাশের পুরো জগতটাকে চিনে ফেললাম। ব্যাপারটা বেশ সহজ ছিল। আমিই কেন যেন বুঝিনি। কাঁচের ভেতরে ঢুকতে হলে তো আমাকে তার অনুর ফাঁক দিয়েই ঢুকতে হবে। আর তাই আমাকে হতে হবে অনুর থেকেও ছোট কোন সত্ত্বা। এখানে তাই-ই হয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতে হুশ করে একটা ইলেকট্রন আমার একটুখানি সামনে দিয়ে চলে গেল। ওফ.... কি বাঁচাটা বাঁচলাম। সামান্যর জন্য ধাক্কা লাগেনি। আমি পথ চলায় মন দিলাম। ইলেকট্রনগুলো আস্তে আস্তে আরো বড় হতে থাকলো। আমি উত্তেজনায় নিজের নিঃশ্বাস চেপে ধরলাম-
আমি ছোট হচ্ছি- আরো ছোট হচ্ছি..……
ইলেকট্রনগুলো আস্তে আস্তে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকলো আমার চোখে। আমি ঝাপসা দেখতে থাকলাম ওদেরকে- অনেকটা মেঘের মত... একসময় আমার আশপাশের পুরো জগতটাই ধোঁয়াটে হয়ে গেল। আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না পরিষ্কারভাবে। চারিদিকে শুধু আবছা হলুদ রঙের মেঘ।
কি ভেবে যেন চোখ কচলে আবার সামনে তাকালাম আমি। হ্যাঁ, এই তো- এখন স্পষ্ট দেখছি- প্রকান্ড হলুদ একটা গোলক। আর সবকিছু পরিষ্কার। কিন্তু ও এমন স্থির কেন?
হুট করে অদৃশ্য হয়ে গেল ওই গোলকটা।
আমি এবার নিশ্চিত যে আমি পাগল হয়ে গেছি। আর না এগিয়ে ঘুরে যাওয়া উচিৎ কিনা এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত আবার যখন আমি দ্বিধায়, ভুশ করে তখনই আবার উদয় হল ওই ইলেক্ট্রনটার। এবার এক্কেবারে আমার গায়ের কাছে। আমি সাথে সাথে লাফিয়ে পড়লাম পেছন দিকে আর সে ভ্যানিশ হয়ে গেল। আরিব্বাস.... আরেকটু হলে তো....
আমি কথাটা শেষ করতে পারি না- আমার জগত ধুপ করে আবার পাল্টে হয়ে যায়। চারিদিক হলুদ- একদম শান্ত একটা জগত। নাহ, এবার আর মেঘ-ধোঁয়া না। এটা সলিড রঙ। আমি সাথে সাথেই বুঝলাম ব্যাপারটা। আমি ওই ইলেক্ট্রনটার ভেতরে। স্থান-কালের একই স্থানে একই সাথে অবস্থান করছি আমরা দুইজন। মানুষের পার্সেপশনের জগতটাতে যা সম্ভব না কোনদিনই...
আমি বুঝতে পারলাম আমার চারিদিকের অদ্ভুত নিয়মে চলা এই দুনিয়াটাই হল সেই বিখ্যাত "কোয়ান্টাম লেভেল"।
আমি মুগ্ধতায় বাকরূদ্ধ হয়ে গেলাম মুহুর্তে। আমার মনে ভর করলো এক অদ্ভুত প্রশান্তি.... অবশেষে আমার সারা জীবনের আশা পূরন হল। আজ আমি এমন একটা জগতে আসলাম যেখানে এতদিনের দেখে আসা কোন "নিয়ম" আর কাজ করবে না। আজ আমি দেখবো- চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখবো যা কেউ কখনো দেখেনি, কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। শুধু খাতা কলমে হিসাব কষে কষে এর সূত্র মিলিয়েছে...
আমি ইলেক্ট্রন থেকে বের হলাম। আমার ডানদিকে হুট করে সৃষ্টি হল একটা ছোট অগ্নুৎপাতের। আর তা থেকে বের হয়ে এলো কিছু ছোট ছোট বেড়াল। তারপর আবার মিলিয়ে গেল বাতাসেই। আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম। এরপর আবার আমার পায়ের কাছে ওই বিষ্ফোরন। আবার বেরিয়ে এলো একগাদা বেড়াল। আমি বুদ্ধি করে কোলে তুলে নিলাম একটাকে। বাকিগুলো মিলিয়ে গেল। বেঁচে যাওয়া বেড়ালটা অবাক হয়ে আমাকে দেখতে লাগলো। আর আমি দেখতে লাগলাম তাকে।
বেড়াল যেহেতু একটা পেলাম- এর একটা নাম দেয়া উচিৎ। আমি ওর নাম দিলাম "প্ল্যাংক"। হাহাহা...
প্ল্যাংক আমার কোলে মাথা ঘষতে থাকলো ঘুম ঘুম চোখে। আর আমি হাত বুলাতে থাকলাম ওর মাথায়। প্ল্যাংক প্রায় ঘুমিয়ে এসেছে ঠিক এমন সময় আমার কেমন যেন অসস্থি লাগা শুরু হল। আমি যেন একসাথে দুই দিক থেকে সবকিছু দেখা শুরু করলাম। চোখ কচলালাম আবার- কিন্তু আমার চোখে কোন স্পর্শ টের পেলাম না। অবাক হয়ে আবার চোখে হাত দিলাম। আমার স্নায়ু এবার একদম টানটান। আমি অবাককর ভাবে একই সাথে চোখের স্পর্শ পেলাম আবার পেলাম না। মাথা চুলকে পাশে তাকাতেই দেখি আমি স্থির চোখে দাঁড়িয়ে আছি আমার নিজের ঠিক পেছনেই। হাতে আরেকটা প্ল্যাংক।
=================================
আমি অনেক্ষন ধরে প্ল্যাংকের পিঠে হাত বুলাচ্ছিলাম। কিন্তু কোন একটা অজানা কারনে সেটা ঠিকমত হচ্ছিল না। আমি আমার আঙুলে প্ল্যাংকের নরম লোমের জায়গায় মাঝে মাঝেই ভেজা চোখের স্পর্শ পেতে থাকলাম। বাস্তবতার আরো ছোট কোন স্তরে চলে গেছি কিনা বোঝার জন্য চোখ তুলতেই দেখি আরেকটা আমি!! সে বেচারা চোখ চুলকাচ্ছে। হাহাহা। আমি তাকে ভড়কে দেয়ার জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার সামনের আমিটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে পেছনে ঘুরে তাকালো এবং আমাকে দেখে যেন সংগে সংগে হাজার ভোল্টেজের ইলেক্ট্রিক শক খেল সে। আমি হাসলাম। আমাকে বললাম- "ব্যাপারটা অসাধারন না? কেউ কখনো ভেবেছে যে এই জিনিসের স্বাদ নিতে পারবে কখনো?"
আরেক আমি একটু ধাতস্থ হয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল - কিন্তু সাথে সাথে আমার সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
শুধু চোখের অন্ধকার নয়, অনুভুতির অন্ধকার- অস্তিত্বের অভাবে আটকে থাকা অদ্ভুত একটা অন্ধকার। যা থাকে মৃত্যুর পর, থাকে জন্মানোর আগে।
আমি শেষ হয়ে গেলাম...
=================================
আমি নিজের সামনে নিজেকে দেখে চমকে উঠি। তবে এটা কিন্তু হওয়ারই কথা ছিল। আমার সামনের আমিটা হাসতে লাগলো। আমি একটু ধাতস্থ হতে হতে সে কি যেন বলা শুরু করলো আমাকে। আর প্রায় সাথে সাথেই- ভুশ। সে উধাও!!
নিজের সামনে নিজেকে উধাও হতে দেখাটা সহজ কিছু না। আমার মায়া লাগলো। ওর কোলের প্ল্যাংকটা লাফিয়ে উঠলো আমার ঘাড়ে। আমি খেয়াল করলাম আশাপাশে আরো অনেকগুলো আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি।
আচ্ছা, কথাটা কি "বেড়াচ্ছে" হবে নাকি "বেড়াচ্ছি" হবে? আমি না ঠিক বুঝতে পারছি না...
হাহাহাহা....
আমি মেনে নিলাম। আমি সবকিছু মেনে নিলাম এই রাতটার জন্য। প্রস্তুতি নিতে থাকলাম আরো অবাক হবার জন্য, দেখার জন্য আরো অদ্ভুত কিছু।
আমি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম এই রাতের পরের পর্বের জন্য.....
.
.
আপনারাও করতে থাকুন....