জন্মসূত্রে জাহান্নামী
রাত ন'টা।
না শীত না গরম।
রাস্তা বোঝাই মিহি ধুলো পাক খাচ্ছে বাতাসে। বিকট শব্দে একটা মাইক বাজছে- খুব কাছেই। বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে মাদ্রাসায়। শংকর মাহফিল শুনতে যাচ্ছে। প্রতিবারই যায়। চুপচাপ এক অন্ধকার কোনে দাঁড়িয়ে বয়ান শোনে একমনে। মাঝে মাঝে একটু বাইরে বেরিয়ে সারি দেয়া ঝুড়ো দোকানগুলো থেকে টোট্কা কিছু কিনে খায়। এই যে এত আলো- এত শব্দ আর এত মানুষের সমাগম-গমগম; তার কাছে ভালই লাগে। উৎসবের উষ্ণতা রয়েছে জায়গাটার।
'ভাইয়েরা আমার। আসুন শপথ নেই- একজন খাঁটি মুসলমান হয়ে মরবো। নাইলে বেহেশত ??? কপালে নাইরে নাইইই....' আঞ্চলিক ভঙ্গীতে কৌতুককর মূদ্রা করেন বয়ানরত হুজুর। লোকজন হেসে ওঠে। আজকাল হুজুরগণও যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে(!) যাচ্ছেন দোর্দন্ড প্রতাপে। মাহফিলের গুরুগম্ভীর আলোচনার মাঝে মাঝে যদি চাটনি টাইপের একটু কানরোচক কথাবার্তা, হয়তো একটু কান গরম !!!! না না, ভালই লাগে...ভালই লাগে শংকরের।
মাহফিল শেষ হয় বেশ রাতে।
ফিরতে ফিরতে শংকরের মাথায় কেবল একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়। মুসলমানদের অত সুন্দর বেহেশতে শুধু মুসলমানরাই যেতে পারবে? আনমনেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে শংকরের বুক চিরে। কেন যে মুসলমান হয়ে জন্মালো না....ইশশশশ....রুটিটা ছোট ছোট টুকরো করে রাস্তায় ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চলল সড়ক ও জনপদের মহাসড়কের বামপাশ ঘেঁষে। বহুদিনের পথচলার সাথি নেড়ি কুকুরটাও রুটি খেতে খেতে অনুসরণ করে শংকরকে।
নিস্তব্ধ রাত।
বহুদূরে রাত্রির কালচে নীল দিগন্ত মুচড়ে বিলাপ করে উঠলো একটা কুকুর। শংকরের পাশ দিয়ে নিঃশব্দে হুঁশ্ করে চলে গেল হুজুরের কালো দামী গাড়িটা- রাত্রির কালো অন্ধকারে মিশে থাকা কুঁচকুচে কালো চিতার মতো।
ঘটেই গেল ঘটনাটা। চেষ্টা করেও পার পেল না রুটি খেতে মগ্ন ছাল ওঠা কংকালসার কুকুরটা। দড়াম্ করে বাড়ি খেল গাড়ির ফ্রন্ট বাম্পারে। লাট্টুর মতো ছিটকে চলে গেল রাস্তার একপাশে। মাথা তুলে দু'একবার হাঁক ছাড়লো বিবশ্ কন্ঠে। কোনদিকে না তাকিয়ে দ্রুত এগিয়ে কুকুরের মাথাটা কোলে তুলে নিল পরম মমতায়- স্কুল দপ্তরী শংকর। দু'চোখ ভাসিয়ে অশ্রু নামছে তার। দুরে মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে হুজুরের দামী গাড়ির লাল দু'টো জ্বলন্ত চোখের মতো টেললাইট। ঠিক তেমনি দৃষ্টিতেই সেদিকে তাকিয়ে রইল শংকর- অনেকক্ষণ...অনেকক্ষণ....।
কুকুরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে শংকরের দু'হাতের মধ্যেই। অথচ কিছুই করার নেই তার। প্রচন্ড ক্ষোভে-আক্রোশে মুখ তুললো আকাশে- 'স্বর্গ-নরকে আমার সাধ ঘুঁচে গেছে প্রভু। হুজুরের বেহেশতে যাবার কোন লোভই আমার নেই। তুমি শুধু এই অবোধ জীবটাকে দয়া করো...মুক্তি দাও।'
নিস্তব্ধ রাত।
রাস্তায় পাক খাচ্ছে মিহি ধুলো। আর মিহি ধুলোর সাথে মিশে থাকা অজস্র মিহি প্রশ্নরাজি।
চারিদিক সুনসান।
কেউ কোত্থাও নেই।
না না...কেউ আছেন.....একজন আছেন।
যিনি সর্বত্র। যিনি কোন নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠির নন। নিজ সৃষ্ট সৃষ্টির প্রতিটি স্পন্দনে...রন্ধ্রে রন্ধ্রে যিনি মিশে থাকেন।
শংকরদের অনুভূতীর এ পুরস্কার যিনি নিজ হাতেই দেবেন বলে জানেন। অনুভূতীর এ অমূল্য উপহার, শ্রেষ্ঠত্বের উপহার। হুজুর যা'র নাম'ই জানে শুধু-
-বেহেশত।!
[দেখা একটি ঘটনার সাথে নিজের মনের কিছু জিজ্ঞাসা-উত্তর মাখানো লেখাটি ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বরিশাল-এর একটি আঞ্চলিক দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। নিশ্চই কিছু বোঝাতে পারিনি বলেই কাছের মানুষদের কাছ থেকেও পাইনি কোন প্রতিক্রিয়া। আমার বক্তব্য কিন্তু এখানে খুবই ছোট- 'শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম কোনদিন মানুষের মনে অর্থবহ উৎকর্ষতা নিয়ে পূর্ণতা পেতে পারে না।' তাইতো ধর্মকে মন্ত্রজ্ঞানে পূঁজো করে আসছে মানুষ। বস্তুজগত আর মনোজগৎ এর কম্বিনেটেড উৎকর্ষতায় পৌঁছতে পারছে না কোনমতেই। লেখা দেখে ঐ পত্রিকার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী দাঁড়িওয়ালা কম্পিউটার অপারেটর আফসার ভাই দু'দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে আফশোস করে বলেছিলেন- আস্তাগফিরুল্লাহ্...নাউজুবিল্লাহ্.....। আর আমি তা'র জবাবে বোধহয় একটু জোরেই হেসে ফেলেছিলাম...হাঃ হাঃ হাঃ...দুঃখিত।]
*সংযুক্তি: লেখাটি ব্লগে ঢোকার কিছুদিন পরেই পোষ্ট করেছিলাম। কিন্তু তখন আমি 'ওয়াচ' জোনে ছিলাম বিধায় প্রথম পাতায় যায়নি।
ধন্যবাদ মডারেটরকে...সেই সাথে নিজেকেও....
মডারেটর আমাকে সবুজ সংকেত দিল।
আর, আমিও চান্স পেয়ে রি-পোস্ট মেরে দিলাম...হাঃ হাঃ হাঃ...