আযান এমন একটি প্রজ্ঞার ধারা প্রবাহিত করে যা মনকে বিশৃঙ্খলিত করে।এটা ছিল রমাদান মাস, যখন আযান আমার কানে পৌঁছাতো, তখন আমার মনে হত আমি যেন কল্পনার রাজ্যে আছি।
—ইন্দিরা সত্যনারায়ণ
রমাদানের রোজা চলাকালে আমার বন্ধু জহির মেমন (NCP National secretary- এডভোকেট মাজিদ মেমন এর ছেলে) আমাকে 'Muhammad- A Biography of the Prophet' বইটা ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত সমেত পড়তে দেয়। কেননা, বইটা ছিল তার বিয়ের উপহার। লেখিকা কারেন আর্মস্ট্রং বইটিতে একটি রত্ন অঙ্কিত করেছেন যে, একজন রোমান ক্যাথলিক নান বলেন, আযানের নিগূঢ় সুললিত ধ্বনি আমার উপর তীব্র প্রভাব ফেলে।
মুসলিমদের নিকট আযান হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত কিছু ইবাদত করার ডাক মাত্র। কারেন আর্মস্ট্রং নবী (স.)-এর জীবনীতে উল্লেখ করেন, 'আমাদের ইসলাম ও তার বিধিনিষেধ মেনে চলা মানুষদের সম্পর্কে এটা নিখুঁত ও প্রগাঢ় ধারণা প্রদান করে।' তিনি ব্যাখা করেন, ৬২৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস ও হিজরতের সাত মাস পর মুহাম্মদ (স.) মদিনায় একটি বড় মসজিদ তৈরি করেন, যেখানে আগে সালাতের জন্য একটা বড় ময়দান ছিল। প্রথমত লোকেরা আহবান (আযান) ব্যতীত সালাতের জন্য আসতো; তবে প্রত্যেকে বিভিন্ন সময় উপস্থিত হওয়ার কারণে এটা স্পষ্টতই অসন্তোষজনক ছিল। যথাযথ সালাতের আহবান গঠনের জন্য একটি পরামর্শ সভার অনুষ্ঠিত হল। মুহাম্মদ (স.) প্রথমে প্রাচ্যের খ্রিস্টানদের ও ইহুদিদের মত কাঠের ঘণ্টার মতো একটি ভেড়ার শিং ব্যবহার করার কথা ভাবলেন। কিন্তু একজন মুহাজির স্বপ্ন দেখলেন, একজন সবুজ জোব্বা পরিহিত ব্যক্তি তাকে বললেন যে, লোকদের সালাতের জন্য ডাকার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে অনুনাদিত কণ্ঠে 'আল্লাহু আকবর' দিয়ে ডাকা। আযানের বাক্যগুলো এভাবেই চলতে থাকলো: 'আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। সালাতের জন্য এসো। সালাতের জন্য এসো। ঐশ্বরিক কল্যাণের দিকে এসো। ঐশ্বরিক কল্যাণের দিকে এসো। আল্লাহু আকবর (আল্লাহ মহান)।আল্লাহু আকবর।'
মুহাম্মদ (স.) এই অভিপ্রায়কে প্রাধান্য দিলেন এবং হযরত বিলাল (রা.) কে এই কার্যাভারের দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন। প্রত্যেক ভোরে সুউচ্চ ও চমৎকার কণ্ঠের অধিকারী কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম হযরত বিলাল (রা.) মসজিদের নিকটবর্তী সর্বোচ্চ বাড়ির চূড়ায় বসে ভোরের প্রথম রশ্মির উপস্তিতির জন্য অপেক্ষা করতেন। যখন তিনি রশ্মিগুলো দেখতেন, তখন বাহু প্রসারিত করে কা'বার দিকে মুখ করে আযান শুরু করার আগে বলতেন," হে আল্লাহ! আমি আপনার প্রশংসা জ্ঞাপন করছি। আর কুরাইশদের জন্য তোমার অনুগ্রহ কামনা যেন তারা ইসলাম গ্রহণ করে।"
এটা বিশ্বাস করা হয় যে, পুনরুত্থান দিবসে মুয়াজ্জিনের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। মুসলিমরা এটাও বিশ্বাস করে যে– সালাত ব্যতীত নবজাতকের জন্মের পর তার ডান কানে আযান দেওয়া সুন্নাহ্।
আযান দিনে পাঁচবার দেওয়া হয়। আমি বলি, "কেন পাঁচবার দেওয়া হয়?" আমার প্রশ্ন আমার বন্ধু জহির মেমনের কাছে শিশুসুলভ হাস্যকর মনে হয়েছে। "আপনাকে সারাদিনই আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে।", এটা ছিল গভীর উত্তর।
ভোরের ক্রূর নিরবতা ভেঙে আযান একটি ঘুম ভাঙার ডাক হিসেবে কাজ করে। আযান মুসলিমদের জানিয়ে দেয়," ঘুম থেকে সালাত উত্তম।" তাদের পার্থিব দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত হওয়ার জন্য স্মরণ করিয়ে দেয়।
একবার ভোর ৫ টা ৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠার জন্য এলার্ম দিতে ভুলে গেলাম। কিন্তু সেদিন আযান এলার্ম হিসেবে কাজ করে এবং আমাকে জাগিয়ে তুলে। একদিন বিকেলে জেদ্দার ব্যস্ততম বালাদ রাস্তায় ব্যবসা যখন চরম পর্যায় ছিল, তখন সালাতের জন্য দোকান বন্ধ করে দিল। আমি বললাম, "এটা কি লাভের থেকে ক্ষতি হবে না?" একটি জুয়েলারি দোকানের মালিকের কাছ থেকে যে উত্তর পেলাম তা হল, ব্যবসা বা জাগতিক দায়িত্ব পালন করার সময়ও জড়বাদী আহবান কে প্রকৃত ও আধ্যাত্মিক আহবানের উর্ধ্বে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ নয়।
কারেন আর্মস্ট্রংয়ের মুহাম্মদ (স.) -এর জীবনীটির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তিনি তাঁকে নবী ও কবি উভয়ের চরিত্রে অঙ্কিত করেছেন। বইটি আযানের সুরের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমার কৌতূহল জাগিয়ে তুলে। আমি আমার কম্পিউটার স্পিকারটি চালু করে আযান সার্চ করার জন্য গুগল সাইটে গেলাম। এটা ছিল রমাদান মাস! আমি যখন আযান শুনছিলাম মনে হচ্ছিল যেন কল্পনার রাজ্যে আছি। আযানটি ছিল হাফিজ মোস্তফা ওজকান নামে তুরস্কের একটি মসজিদের। এটা আমার উপর প্রভাব বিস্তার করল যে– আযান একটি সুশ্রাব্য ও সুরেলা মর্মভেদী আহবান যা স্বতন্ত্র আত্মা থেকে মানবতার আত্মার এবং তাদের মহান রবের দিকে ডাকে।
বছরখানেক আগে Y.B. Chavan অডিটোরিয়ামে Secular Activists Watch কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিচারপতি শ্রী কৃষ্ণ বক্তৃতার সময় এক মন্তব্য করেন যেটা আমার সব সময় মনে থাকবে। বিচারপতি বলেন, ছোটবেলায় ভোরে যখন তার পিতা গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করতেন, তখন মসজিদ থেকে আযান আরম্ভ হত। যখন গায়ত্রী মন্ত্রটি ছিল সংস্কৃত ভাষায় আর আযান হত আরবি। প্রার্থনার ভাষা ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য ছিল একই- ঈশ্বরের সাথে মানুষের যোগাযোগের প্রচেষ্টা।
আযান শোনার সময় আমি অনুধাবন করতাম যে, কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করা সত্বেও সঙ্গীতটি সুদৃঢ় এবং আধ্যাত্মিকভাবে উন্নয়ন সাধিত ছিল। আমি রাগ, তাল এবং ভাবার একটি আনন্দদায়ক মিশ্রণ আবিষ্কার করেছিলাম। আযানের আধ্যাত্মিক গভীরতা, কাব্য এবং আক্ষরিক বচন এক মহিমান্বিত বাণী যা মহান প্রভুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে।
২০১২ সালে Islamic voice নামক একটা ব্লগ সাইটে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের অনুবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১১:২৯