সন্ধা থেকেই টিভি খুলে বসি আছে। গসিপ শো। বিনোদনের উদ্দেশ্য নয়। পেশাগত কারণে। রাস্তাঘাটে ভিড় কমে গিয়েছে। মডেলদের নাম সবার মুখস্ত থাকে। যে মেয়েটা আজ সেখানে যাবে তাকে নিয়ে দারুণ টেনশনে। মেয়েটা, বুটপিনের মডেল কিন্তু মিটিং রূমে তাকে নার্ভাস লেগেছিল। বস আশ্বস্ত করলেও সে কি পারবে বুটপিনের মান রাখতে?
বলা দরকার গত বছর থেকে "গ্রীন বাংলা বুটপিন" কোম্পানীর অন্তরালে, চীন থেকে উন্নত বুটপিন আমদানী করে বিক্রি করছি। টিভিতে বিজ্ঞাপনও এসেছে। সেই সুত্রে জানা, দর্শকেরা বিজ্ঞাপন পছন্দ করে না। চ্যানেল পাল্টায়। বুটপিনের বিজ্ঞাপনের সময় উঠে যায়, ভাত রান্না করে, গল্প করে অথবা এটিএনে জা-জি-জু শোনে।
আমি ২০ বছর মার্কেটিং এ আছি। অভিজ্ঞতায় বলতে পারি বুটপিনের মতো এত মিষ্টি প্রোডাক্ট সচরাচর দেখা যায় না। প্রথমবার মাথায় বিদ্ধ করার পদ্ধতিটা শেখানোটা একটু ঝামেলা। বিড়ির খদ্দেরকে একবার ধরিয়ে দিলে সারাজীবনেও ভুতের আছর ছাড়ে না। তেমনি বুটপিনেও মাদকতা আছে।
লাইভ শোটি হীট হওয়া উচিত। মেয়েটা নাটকে গেছে। সুতরাং ক্যামেরার ভীতি তাকে টলাবেনা। প্রেমের সত্যিকারের স্মৃতিচারণ হলে হয়তো বিষয়ই ছিলনা। কিন্তু স্মৃতিটা ওর ইচ্ছামত হলে আমাদের কী লাভ? হাভার্ডের ভাড়া করা গবেষক স্ক্রীপ্ট দিয়েছে। সেই অনুযায়ী মেয়েটার শৈশবে ঝড় হবে। কিন্তু আম পাড়তে গিয়ে বুটপিন বিধে যেতে হবে। তার যে মা, সে দোলনায় বুটপিনের খোঁচা খাবে এবং রক্ত ঝরলে মায়ের আঙুলে বুটপিনের ছবি ভাসবে পর্দায়। আর প্রেমের শুরুটাই হবে লুকিয়ে রিক্সায় যেতে বুটপিনের আঁচড়ে।
অবশ্য হিউমার যোগাতে অনুদিত কৌতুকও যুক্ত হবে সাক্ষাত্কারে। গোপন জিনিস সবসময়ই চলে। সুতরাং ঐ ঘটনাটা ভাবেই হবে। আমি দেখেছি দর্শকেরা এসব সাক্ষাত্কারের সঙ্গে ঠোঁট নাড়ে। মুখস্ত করে। পরে বাসে অফিসে গল্প করে। কত সহজেই মানুষ ভেড়া হয়।
কিন্তু মেয়েটার আচরণ সন্দেহজনক। সে কি ভুলে গেছে বুটপিন কোম্পানীর এম্বেসেডর হিসাবে তাকে পয়সা দেয়া হয়েছে? এম্বেসেডরদের কুকুরের মত অনুগত থাকতে হয়। ঘর মোছার জন্য ক্লিনিং এম্বেসেডরকে মনে করাতে হয় না। গাড়ী চালানোর জন্য ড্রাইভিং এম্বেসেডরেও ঠিক ঠাক চলে। সমস্যা এই মিডিয়া এম্বেসেডরকে নিয়ে। তারা ভাবে তারা স্বাধীন। কিন্তু কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী চলনে বলনে তার বুটপিন বুটপিন জিকির তোলার কথা।
যা হোক। শুরুতে সে ভালই করছিল। হাসিটা নিষ্পাপ আর সুন্দর। সাক্ষাত্কারের দশ মিনিটের মাথায় তার বলার কথা "হা হা, দর্শক, আমার আম্মু ছোট বেলায় দুষ্টুমি দেখে। হি হি হি"। গুড, এবার চায়ে চুবানো বিস্কুটটা দর্শককে দাও। যে বিস্কুটে বুটপিন লুকানো। কিন্তু রেডিও ধারাভাষ্যের মতো বলতে হলো, না! তুমি একি করলে, পাগলা ড্রাইভারের মতো নরসিংদীর ট্রেন আখাউড়ার লাইনে ওঠায়ে বলে ফেলেছ, "জানেন, মা বলে আমার মাথার স্ক্রু ঢিলা"।
ছি! জঘন্য! ফা*ং । বুল*িট, স্ক্রু কোম্পানীর এমডি সুখু মিয়া নিশ্চয়ই এখন হাত তালি দিচ্ছে। মডেলগুলোকে বিশ্বাস নাই। সেই কোম্পানী কি গোপনে পয়সা দিয়েছে নাকি? গুনে গুনে চার লক্ষ টাকা ক্যাশ দেয়া হয়েছে এই মেয়েটাকে। আর টিভিতে প্রতি বুটপিন বলার জন্য ৫,০০০ টাকা করে বোনাস। টিভিও জানে কম্পিটিশন কত স্ট্রং। সেফটিফিন, তারকাটা অথবা নাটবল্টুর মডেলগুলো তো ভুলেও বুটপিনের নাম নেয় না।
মেয়েটা আগে সাবানের এড করতো। এজন্য সাবান ভাব রয়ে গেছে। পরে ফ্রীজের এডে মাছের সুবাস দেখাতেই ওকে পছন্দ হয় বুটপিনের জন্য। যে পঁচা মাছ ফ্রীজ থেকে বের করে আহ! বলতে পারে তার সম্ভাবনা অনেক। সে ড্রাই রিহার্সালে ঠিকই ছিল। স্ক্রুকে বলেছিল প্যাচানো বুটপিন, আর তারকাটাকে - কাঠের বুটপিন।
মেয়েটা মাঝে মাঝে তোতলাচ্ছে। তোতলাদের কি পাবলিক খায়? মুখ ফসকে বসকে বলেছিলাম, বুদ্ধিমতি আর চালু কাউকে পেলে এ বাদ। সিইও বেশ কৃপণ। খরচ কমাতে তার আগ্রহ। খোঁজ নিয়েছিলাম ঐশ্বরিয়াদের মতো ডজন খানেক মেয়ে আছে। কিন্তু তারা প্রতি হাসিতে ২০,০০০ টাকা চায়। এই মেয়েটা ক্যাটরিনার মতো চুল আঁচড়াতে পারে। পত্রিকায় তার চুলে বুটপিন লাগানো ফ্যাশন দেখে মেয়েরা হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে হোম ডেলিভারীতে বুটপিন কিনেছিল। তখন তো জানা ছিল না যে সে দুগ্ধপোষ্য এক শিশু।
রক্ষণশীল সমাজ। সুতরাং নারীমডেলের নাকপেষণ পরীক্ষা করার অনুমতি পাওয়া যাবে না। ছেলে হলে সত্যিই ড. খনার থিসিস মেনে নিতাম। নাসারন্ধের সুড়ঙ্গে দুগ্ধনহর পরীক্ষা করে ফেলতাম চর্টলাইট দিয়ে। টিভি তো পত্রিকা না।
পত্রিকায় দুধ ওয়ালা লোক বরং বেশী চলে। লোকে দুধের ভেজাল পড়তে ভালবাসে, ভেজাল দুধ কে পুলিশ ধরে কি করলো এগুলো লিখে পাতা ভরানো যায়। আমাদের নাকি শিশু মৃত্যু হার অনেক। কিন্তু এত মরেও সব শিশুই থাকে। বড় মানুষ তেমন দেখিই না। বিবিসিতে বলেছিল দ: এশিয়ায় শিশু উৎপাদন বেশী, শৈশবও দীর্ঘতর। সিদ্ধান্ত ফাইনাল, বুটপিনের ব্যবসা বন্ধ করে দেব। দুধের ব্যবসা ধরবো। মালয়েশিয়া থেকে ইউএইচটি দুধের এলসি খোলা বেশ সহজ।
বুটপিনটা চলেনা, কারণ পুরনো টেকনোলজী। শুনেছি লাঙ্গল নিষিদ্ধ করে ২০০ কোটি টাকার চীনা ট্রাকটরের কেনার জন্য সংসদে বিল আসছে। আর কৃষকদের পায়ে চাকাওয়ালা স্কেটিং জুতা। শিশু নির্যাতনের মতো কৃষকদের অমানবিক পদ্ধতির চাষাবাদ বন্ধ নিয়ে বুদ্ধিজীবিরা সোচ্চার। নতুন প্রযুক্তির ফিউশনেই তো ব্যবসা। আমার স্ত্রী যেমন খ্যাপা। নারিকেল তেল কিনেছিলাম গ্রাম থেকে। খাঁটি। কিন্তু টোকোফেরল না থাকায় তার চুল পড়ে গেছে। ওকে ঘুষ দেয়ার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে ফাউন্টেন দেখিয়েছি। সন্তোষা দ্বীপের রেলকারে দুলিয়েছি। মাথা ঠান্ডা হলে ভিটামিন ডি উৎপাদন হয়। সে বলে আর ঢাকা আসবে না। কারন বাংলাদেশে মায়েদের ঝামেলা বেশী।
সিঙ্গাপুরে মায়েরা প্রিপেইড দুধ খাওয়ায়। মায়েরা বুকের শেপ নষ্ট হয় না। গভর্মেন্ট সাইটে ক্রেডিট কার্ডে সেই দুধ কেনা যায়। বিষয়টা দুধের মতো সোজা। সিএনজিকৃত গাড়ীর মতো মায়েরা বুকে কনভার্টার লাগিয়ে নেয়। আর ভোরে মিল্কভিটার গাড়িরা দুধের রিফিল পৌছে দেয়। বলপেনের শীষের মতো সেই রিফিল লাগাতেই বাচ্চারা চুক চুক করে খায়। ঠিক দুধ না পামওয়েল। বাচ্চারাও এখন ব্যাকডেটেড দুধ খেতে নারাজ। পামওয়েল কিংবা পেপসিকোলার দুধ চায়। মায়ের দুধে আর সেই রকম টলার হওয়ার উপায় নেই। কারণ সেই তরল উপাদানে কম্পিউটার চালানোর এনার্জি নেই। এখন দুধের বিজ্ঞাপনের জন্য ২ টা স্টেপ দরকার: একটা দুর্দান্ত ফটোজেনিক মডেল। আর একটা টকশোতে বিখ্যাত কেউ। কৃষক নির্যাতনে যেসব বুদ্ধিজীবি চতুর্থ মাত্রা অনুষ্ঠানে ছিল, তাকে কত দেয়া লাগে জানা দরকার।
বেবীফুডে ভাল মডেল পাওয়া যায়। মডেলরা ভাল এড চায়। মা বিষয়টাতে সোশ্যাল এক্সেপটেন্স বেশী। শরীর দেখানোর বদনাম নেই। আর মডেলের বিয়েও হবে ভাল জায়গায়।কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে আর হবে না। যে বুটপিনের মতো সহজ বিষয় পারেনা, দুধ পারবে কি করে।
আমার মনে হয় না, আর ব্যাখ্যা দরকার কেন আমরা বিদেশের চেয়ে ২০০ বছর পিছিয়ে। ওখানে সব কিছুই মসৃণ, ঝকঝকে। ভাইটাল চেক করার জন্য সানমুনেরা এখনো রেক্সিনের ফিতা ইউজ করে। সিঙ্গাপুরে চিড়িয়াখানায় বেঞ্চে বসলে উপরে ৬ ডিজিটে ভেসে উঠেছিল। বাথরুমে বসে বোঝা যায় ৩৪-২৬-৩৪ না ৩৫-৩০-৩৬। সেখানকার বন্ধু উচিন, বাবার লাইব্রেরীর বইগুলো ট্র্যাশ ফেলে দিয়ে সেইরকম একটা যন্ত্রে দিন রাত শরীর মাপে। অথচ আমাদের দেশে সেরকম কিছুই নেই।
খরচ বাঁচাতে ডিরেক্টর সেই পরীক্ষা দেশেই করে ফেলে। ইদানিং মনে হয় টেকনোলজীগুলো দ্রুত নষ্ট হয়। দরজার উপরের লাল বাতিটা আগে নিভে থাকতো। ইদানিং জ্বলে থাকলে আর নিভতে চায়না। ফোনের লাইনে ডায়ালটোন পেতে কষ্ট হয়, মনে হয় বিজি টোনে হ্যাং হয়ে যায়। সেই ভাঙা কলের গানের প্রযুক্তিও এর চেয়ে মজবুত ছিল।
ফোনে টিভির প্রডিউসারকে ঝাড়ি দেয়া হয়েছে। ওরা এরকম স্ক্রুর জিনিস প্রচার করলে আর কাজ দেব না। পরিচালক মাফ চেয়ে ফ্রী বুটপিনের বিজ্ঞাপন দেখিয়েছে মধ্যবিরতিতে। মেয়েটার প্রতি কেন যেন রাগ কমেনি। স্ক্রু বলে হি হি হাসার কৈফিয়ত কে দেবে?
লাইভ শো গুলোও যে কী! বিদেশে এরকম অনুষ্ঠানে ফিল্টার বোতাম থাকে। প্রিমি টিভিনোঙ্গরেরা সেলিব্রিটিদের ইন্টারভিউ নেয়। সেলিব্রিটিরা বাপ-মা তুলে গালি না দিলে কিসের সেলিব্রিটি। বেফাস কিছু বন্ধ করার দায়িত্ব ব্রডকাস্টারের। সেখানে একটা বোতাম থাকে। কথা আটকাতে হলে বোতাম চাপা হয়। বিপ বিপ শব্দে কী বললো বোঝা যায় না। অনেক সময় বিদ্রোহী রাজনীতিবিদদের অনুষ্ঠানেও বোতামটা কাজে লাগে।
এই মাত্র খেয়াল হল বাচ্চা মডেলটার মাথায় কিছু নেই। শুধু চুল। ফোন করে সবুজ একটা বুটপিনের টুপি পরতে বলবো নাকি? শাড়ীর সঙ্গে ম্যাচ করবে। মেয়েটা ঠোঁট চেপে হাসে। হাসিটা হয়নি। কোনাটায় বুটপিনের শেপ হয়নি। এত ট্রেনিং দিয়ে কী লাভ হলো। ট্রেইনারটারও দোষ। মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে চায়। কাজ ফেলে বকর বকর করে।
চ্যানেলে ওয়াইর রিয়েলিটি শোতে সেফটিপনের কোম্পানী রিয়েলিটি শো হচ্ছে। একজন বিখ্যাত গায়িকা গান গাইছে। এখন উপস্থিত দর্শক বিখ্যাত গায়িকাদের মাথার সেফটিপিন বসাবে। দর্শকের চোখ বাঁধা হবে। অবশ্য খোলা থাকলেই বা কি, খোলা রাখলেও দর্শকেরা কিছু দেখে না। সেফটিপিনটা মাথার বদলে জামায় বসায়। আমাদের বুটপিনের বিপননে এমন কিছু করা জরুরী।
আমাদের চ্যানেলে আসি। মেয়েটা মুক্তিযুদ্ধে তার মায়ের মারা যাবার কথা শুরু করেছে। একসেলেন্ট। স্ক্রীপ্টেই ছিল তা। বলার কথা বেয়নেট খুঁচিয়ে তার মা কে হত্যা করে পাকসেনারা। হত্যার ডিটেইলিংটা সে বলছে দারুণ করে। না, মনে হয় মেয়েটাকে আর ছাড়া যাবে না। এত ছোট মেয়ে কী করে এমন বলে। মেয়েটা বোধ হয় মন থেকেই বলছে। দর্শকরা ফোন করে কাঁদছে। দর্শকদের কিছুটা কাঁদানো দরকার।
কিন্তু মেয়েটা গোলপোস্টের কাছে এসে উপর দিয়ে বল পাঠায়, একটা জলজ্যান্ত টাইট্যানিকের মতো নির্মানকে হুশ করে পানাপুকুরে ডুবিয়ে দেয়। শেষ সিকোয়েন্সে বলার কথা মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধে বুটপিনের ধাতুতে গড়া রাইফেলে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছে। বলেনি। বুটপিনের কথাই বলেনি। না, সিদ্ধান্ত ফাইনাল। এমন মডেলের নিকুচি করি। একে ফায়ার করে নতুন মডেল নিতে হবে।