[ ক্রিকেটে আয়ারল্যান্ড রূপকথা কারো কাছে নতুন নয়। ২০০৭ বিশ্বকাপে আইরিশ কাব্য কারো অজানার কথাও নয়! আধুনিক ক্রিকেটের উদাহরন বলা হয় আইরিশদের। ব্রিটিশদের কাছাকাছি থাকার সুবাদে তাদের ক্রিকেট টা তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু ক্রিকেটের মূল জোয়ারে আসতে আসতে তাদের বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। বর্তমানে টেস্ট স্ট্যাটাস দাবিকারী সহযোগী দেশদের মধ্যে আয়ারল্যান্ড অন্যতম এবং তাদের দাবি সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য। ইতিমধ্যে আইরিশ বেশকিছু ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের জাত চিনিয়ে রেখেছেন, অনেক তাদের চিনেন অনেকে চিনেন না। তাদের নিয়ে কিছু লিখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ]
কেভিন ও'ব্রায়েনঃ
আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ক্রিকেটার হিসেবে তাকে সম্মান দেয়া হয়! ও'ব্রায়েন ভাইদের মধ্যে ছোটজন তিনি, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরীর মালিক তিনি। এই কির্তি তিনি গড়েন ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। এটা তো একটি মাত্র অর্জন তার জন্য, তিনি ব্যাটিং এ নামলে বিপক্ষের বোলারদের দিন যে কতটা খারাপ হতে পারে তার সাক্ষীর অভাব নেই।
শুরুটা তার ২০০৪ সালে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দলকে সেমিতে উঠানোর মাধ্যমে। ২০০৬ সালে হয় আন্তর্জাতিক অভিষেক। বর্তমানে তাকে পুরোদস্তর অলরাউন্ডার বলা হলেও ক্রিকেটে এসেছিলেন একজন বোলার হয়ে, করতেন ফাস্ট বোলিং এবং ব্যাটিং এ নামতেন ৮-এ! কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ এ কেনিয়ার বিরুদ্ধে ১৪২ রানের একটি ইনিংস তার জাত কে চেনাতে শুরুতে করে। ২০০৭ বিশ্বকাপে তার করা দুর্দান্ত এক অভার এর মাধ্যমে আয়ারল্যান্ড পায় নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই টাই! বাংলাদেশ কে সুপার এইট এ হারাতে তার ৪৮ রানের অবদান ছিল বেশ।
কাউন্টি তে কেভিন এক পরিচিত মুখের নাম। ২০০৯ থেকে বিভিন্ন কাউন্টি দলের হয়ে খেলে আসছেন নিয়মিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার আছে দু'হাজারের অধিক রান, সাথে ২টি শতক এবং ১১টি অর্ধ-শতক। পাশাপাশি উইকেটের সংখ্যা ৭৪টি। ফার্স্ট ক্লাস এবং লিস্ট এ ক্রিকেটের ক্যারিয়ার ও বেশ প্রশংসনীয়। এই ক্রিকেটার বিপিএল এর দ্বিতীয় আসরে খেলেছিলেন রংপুরের হয়ে, এছাড়াও ক্যারিবিয়ান টি-২০ তে একবার ত্রিনিদাদ কে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ২০১৩ সালে অর্জন করেন সহযোগী দেশসমূহের মধ্যে সেরা খেলোয়ারের পুরষ্কার।
পল স্টারলিংঃ
কাউন্টি দল মিডলএসেক্স এর দ্বিতীয় দলের হয়ে ক্রিকেট জীবন শুরু করা এই অপেনার তার ক্যরিয়ারের প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলতে নেমেই সেঞ্চুরী হাকান ২০০৯ সালের ইন্টারকন্টিন্যান্টাল কাপে। ২০১০ সালে আইসিসি উদীয়মান খেলোয়ারদের তালিকায় একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে স্থান করে নেন, যিনি সহযোগী দেশের ক্রিকেটার। সেই বছরেই মিডলএসেক্স তার সাথে পূর্ন চুক্তি করে।
মারকাটারি টাইপের এই অপেনার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫টি সেঞ্চুরীর মালিক, যার ২টি আবার টেস্ট খেলুড়ে দেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে। এর মাঝে ১৭৭ রানের একটি ইনিংস ও আছে কানাডার বিপক্ষে। মাত্র ৫৩ ম্যাচে তার রানসংখ্যা ১৮০০+। আন্তর্জাতিক টি-২০ তেও তিনি যথেষ্ট সমীহ জাগানীয়া ব্যাটসম্যান। ২৬ ম্যাচে ৫টি অর্ধ-শতক সহ পাচ-শতাধিক রানের মালিক তিনি। ব্যাটিং ছাড়াও ডানহাতি অফ-ব্রেকে নিয়মিত উইকেট নিয়ে থাকেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ছোট ক্যারিয়ারে ইতিমধ্যে ৯বার ম্যাচ সেরার খেতাব ঝুলিতে পুরেছেন তিনি। ২০১১ সালে ছিলেন আইসিসি বর্ষসেরা খেলোয়ারদের সংক্ষিপ্ত তালিকায়। মিডলএসেক্স এর নিয়মিত এই জার্সিধারী ২০১৩ সালে বিপিএল মাতিয়েছিলেন সিলেটের হয়ে।
ট্রেন্ট জনস্টনঃ
এই ক্রিকেটারের জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়! সবথেকে খেতাবি ক্লাব হিসেবে পরিচিত নিউ সাউথ ওয়েলস এর মূল দলে খেলেছেন তিনি! হঠাত ২০০৪ সালে চলে আসেন কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে, কারন টা অজানাই বটে! সারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। পরবর্তিতে আয়ারল্যান্ড সরকার তাকে পাসপোর্ট দেয় ক্রিকেটের স্বার্থে!
২০০৫ সালে তাকে ইন্টারকন্টিন্যান্টাল কাপের অধিনায়ক করে দল ঘোষনা করা হয়।তার অধিনায়কত্বে আয়ারল্যান্ড সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়! তার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তাকে ২০০৭ বিশ্বকাপের অধিনায়ক নির্বাচিত করা হয়। এবং পরের গল্প শুধুই রূপকথার! শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাওয়া আয়ারল্যান্ড সকল্কে জাত চিনিয়ে আসে "চিকেন ড্যান্স" এর মাধ্যমে! নেপথ্যের নায়ক এই জনস্টন, যার সাহসি সিদ্ধান্ত সকলের প্রশংসা অর্জন করে। কাউন্টি ক্রিকেটেও তিনি ছিলেন নিয়মিত পারফর্মার। ২০০৭ সালে তার করা কাউন্টি ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক টি ছিল ১৩০ বছর পর কোন আইরিশ ক্রিকেটারের করা হ্যাটট্রিক!
২০০৮ সালে ব্যাক্তিগত সমস্যার দোহাই দিয়ে ক্রিকেট থেকে সরে যান, যদিও পরবর্তিতে তিনি ফিরে আসেন। কিন্তু এই সরে যাওয়া ছিল তার ক্যারিয়ারের স্বপ্নের পথে বাধা! তিনি এই বিশ্রাম এর মাধ্যমে নিজের ক্যারিয়ারে অনেক পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এর আগে ২০০৭ সালের শেষের দিকে প্রকাশ করেন বিশ্বকাপ মিশন নিয়ে লেখা তার বই "রেইডার্স অফ দ্য ক্যারিবিয়ান"!
বিশ্রাম থেকে ফিরে এসে অর্জন করেন আইরিশ ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ৫০ উইকেট অর্জনের কৃতিত্ব! জাতে ডানহাতি এই ফাস্ট বোলার এর ক্যারিয়ারে রান সংখ্যা ও কম না। ৬৬ টি আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচে ৬৬ উইকেটের মালিক এ ক্রিকেটার ২০১২ সালে সব ধরনের ক্রিকেট ছেড়ে দেন। ২০১৪ সালে তিনি ফিরে যান আপন ঠিকানায়, পান নিউ সাউথ ওয়েলস এর সহকারী কোচের দায়িত্ব। সেই বছরেই তাকে একই পদে নিয়োগ দেয় বিগ-ব্যাশ দল সিডনী সিক্সার্স।
উইলিয়াম পোর্টারফিল্ডঃ
তিনি এমন একজন ক্রিকেটার, যিনি অনুর্ধ্ব-১৩ থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে অধিনায়কত্বের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। ৭টি শতক এবং ১১টি অর্ধ-শতকের মালিক এই ক্রিকেটার বর্তমানে আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলের অধিনায়ক। ২০০৮ সালে ট্রেন্ট জনস্টন দায়িত্ব ছাড়ার পর তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।
২০০৭ বিশ্বকাপে সুপার এইট পর্বে বাংলাদেশ কে হারানোর মূল নায়ক ছিলেন তিনি। তার ক্যারিয়ার টা শুরু হয়েছিল স্বপ্নের মত। প্রথম দিকে তিনি মাঠে নামলেই রান ছাড়া ড্রেসিং রুমে ফিরতেন না। ২০০৮ সালে কাউন্টি দল গ্লোস্টারশায়ারে ডাক পান এই বামহাতি মাথা ঠান্ডা স্বভাবের এই অপেনার। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তার সংখ্যা প্রায় ৬হাজার।
২০১১ বিশ্বকাপে তার অধীনে আয়ারল্যান্ড হারায় তাদের বড় ভাই ইংল্যান্ড কে! ৭৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার রানসংখ্যা ২৪০০+! কাউন্টি ক্রিকেটে দারুন পারফরমেন্স করা এই ক্রিকেটার কে ২০১০ সালে চুক্তি করায় ওয়ারউইকশ্যায়ার। দারুন প্রতিশ্রুতিশীল এই ক্রিকেটার বর্তমানে আয়ারল্যান্ড এর অন্যতম ভরষা!
আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট খেলে মূলত ক্রিকেটের জন্ম থেকেই! কিন্তু তাদের পেছনে পরে থাকার অসংখ্য কারনের মধ্যে একটি হল ক্রিকেটারদের কাউন্টিতে সময় বেশি কাটানো! অনেক সময় দেখা যায় কাউন্টির বেশি টাকার লোভে অনেক খেলোয়ার জাতীয় দল ছেড়ে দেয়। সেইসমস্ত নানাবিধ সমস্যা কাটিয়ে আয়ারল্যান্ড দল আজ অনেকটাই পরিনত। আশা করবো আয়ারল্যান্ড সামনে আরো অনেক বড় বড় রূপকথার জন্ম দিবে
ছোট দলের তারকারা : প্রথম পর্ব(আফগানিস্তান)
ছোট দলের তারকারা : দ্বিতীয় পর্ব(কানাডা)
ছোট দলের তারকারা : তৃতীয় পর্ব(বারমুডা)
ছোট দলের তারকারা : চতুর্থ পর্ব(কেনিয়া)
ছোট দলের তারকারা : পঞ্চম পর্ব(নেদারল্যান্ডস)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫৭