somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আলিপ্পে টু কোচিন - (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১৪)

০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



টানা পাঁচদিনের ঘুমের ঋণ এদিনে এসে যেন সুদে আসলে উসুল করে নেয়া হল। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগেও প্ল্যান ছিল ভোরবেলা উঠে কেরালার ব্যাকওয়াটারে সকালের প্রথম সূর্য কিরনের রক্তাভা মাখবে ঘুম জড়ানো চোখের পাতায়। যেহেতু চল্লিশ ডিগ্রীর উপরে তাপমাত্রার কেরালায় হাউজবোট এর এসি’র ইলেক্ট্রিসিটি লাইন ভোর ছয়টায় বন্ধ করে দেয়া হবে, তাই অগ্যতাই ঘুম ভেঙ্গে যাবে গরমে। কিন্তু “শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়” প্রবাদ মিথ্যে করে দিয়ে তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমের রাজ্যে। সকাল সাড়ে আটটা কি নয়টা’র দিকে আমাদের হাউজবোটের রাঁধুনি ভদ্রলোক এসে দরজায় নক করতে ঘুম ভাংগলো। নাস্তা তৈরী করে সে বসে আছে সেই ভোরবেলা হতেই। যাই হোক বেলা নয়টা নাগাদ ফ্রেশ হয়ে সবাই এসে জড়ো হলাম হাউজবোটের ডাইনিং এ, বোট যথারীতি চলছে ফিরতি পথের যাত্রায়। আর মাত্র ঘন্টাখানেক পরেই তরী ভেড়াবে সেই যাত্রা শুরুর তীরে। ঝাঁকে ঝাঁকে নৌঘর মৃদু গতিতে শান্ত ব্যাকওয়াটারের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে, দুই পাশে সারি সারি নারিকেল গাছে ছেয়ে থাকা পাড়; কিছু পরপর দু’চারটি বাড়িঘর দেখা যায়। নির্মল প্রকৃতি বলতে যা বুঝায়, তারই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ যেন কেরালার এই জনপদ।









নীল জল চিরে এগিয়ে যাওয়া হাউজবোটের সারি, দুপাশে সবুজের মেলা.... নারিকেল, কলা সহ নানান গাছের সমারোহ। "কেরালা ব্যাকওয়াটার" হল নানা মিঠা পানির প্রবাহ সাগরে গিয়ে মেশার আগে আটকে রাখা জলাভুমি, কোথাও প্রাকৃতিকভাবে, কোথাও কৃত্রিমভভাবে। আর এই আটকে থাকার ফলে সাগরের নোনা পানি এসে মিশতে পারে না মিঠা পানির সাথে। বর্ষা মৌসুমে বাধ খুলে দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়া হয় সাগরের বুকে। ব্যাকওয়াটার এর সৌন্দর্য উপোভোগ করতে করতে চলল নাস্তা খাওয়া, মেন্যু পিওর কেরালা আইটেম সকল। দশটার দিকে ফিরে এলাম সেই ঘাটে যেখান থেকে গতকাল দুপুরে রওনা হয়েছিলাম। যথা সময়ের অনেক আগেই হাজির ছিল আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড কিন্তু বন্ধুর মত, মি: বিনয়, তার ইনোভা গাড়িখানা নিয়ে।









আজকের প্রথম দ্রষ্টব্য ছিল আল্লিপপে সী বিচ। কেরালার অন্যতম শহর আলিপ্পে সমুদ্র তীরবর্তী শহরতলী। এখানকার সমুদ্র সৈকত একটু ভিন্ন ধরনের, ওভাল আকৃতি নিয়ে খাড়া ঢালু হয়ে নেমে গেছে; সমুদ্রের ঢেউয়ে টান বেশী। তীরে ছোট ছোট ঝোপ জাতীয় গাছে ভরা। আর সেই গাছের ছায়ায় এই সকাল দশটায় দেখা গেল স্কুল পালানো প্রেমিক যুগল দলের। “স্কুল পলাতক মেয়ে” শুধু নয়, ছেলেও আছে এই দলে। এদের ব্যাতীত তেমন কোন মানুষ চোখে পড়ল না। এই সৈকতে প্রায় দেড়শ বছরের পুরানো নৌ জেটি রয়েছে যেখানে এককালে ভিড়ত বণিকদের জাহাজ, পড়ত নোঙ্গর আলাপ্পুঝা তথা এই আলিপ্পের তীরে। এখানে প্রতি বছরে অনুষ্ঠিত হয় বিচ ফেস্টিভাল, স্যান্ড আর্ট ফেস্টিভাল, নিউ ইয়ার ফেস্টিভাল সহ নানান অনুষ্ঠান। বীচের অদূরেই রয়েছে একটি লাইট হাউজ, যা “আলাপ্পুঝা লাইট হাউস” হিসেবে পরিচিত।









এই বীচে ভ্রমণের একটি সুবিধা হল একটি বাইপাস হাইওয়ে এর পাশ দিয়ে চলে গেছে। ফলে নানান শহরের পথ এসে মিশেছে এই বাইপাস সড়কে, যা ধরে অতি সহজেই চলে আসা যায় এখানে। ঢালু খাড়া নেমে যাওয়া বিচটি তুলনামূলক দীর্ঘ কিন্তু ঢালু খাড়া বলে পর্যটকদের জন্য অনুপযোগী। একসময় এখানে “ক্যামেল সাফারী” বেশ জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু কয়েক বছর আগে তা প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। বেশ কিছু সময় এখানে কাটালাম আমরা, তীব্র গরমে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে বিচের ধারে বিক্রি হতে থাকা ওয়াটার মেলন জুস খেলাম সবাই, যেমন চমৎকার তার স্বাদ, তেমন চমৎকার এর প্রস্তুত প্রক্রিয়া।















যাই হোক এখান থেকে আমরা চলে এলাম কোচিন শহরে। এখানে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল Synagogue, ইহুদীদের ধর্মীয় উপাসনালয়, যা মাত্তানচেরি নামক দ্বিপে অবস্থিত। ফোর্ট কোচি থেকে ঐতিহ্যশালী মাত্তানচেরি দ্বীপে পৌছতে সময় লাগে আধ ঘণ্টার মত। ভারতের একমাত্র এই দ্বীপে রয়েছে ইহুদিদের জন্য পৃথক পাড়া। বংশ পরম্পরায় এখনও অনেক ইহুদি এখানে বসবাস করেন। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সুন্দর গোছানো এই কলোনি। ১৫৫৮ সালে নির্মিত একটা সিনাগগ রয়েছে এখানে। সিনাগগের অভ্যন্তরস্থিত রঙিন টাইলসের কারুকার্য বেশ সুন্দর। প্রচুর ঝাড়লন্ঠন রয়েছে এই সিনাগগে। সিনাগগ থেকে একটু দুরেই মাত্তানচেরি প্রসাদ। দেশ বিদেশ থেকে ট্যুরিস্টরা কোচিনে আসলে কোচিনের অনেক কিছুর সাথে এই শত শত বছরের পুরাতন সিনাগগও দেখে যায়। ৫ রুপির টিকেট কাটতে হবে, জুতা খুলতে হবে এবং বিশাল লম্বা লাইন ধরতে হবে; ফলে ভেতরে ঢুকার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। এত হ্যাপা নিয়ে এটি দেখার আগ্রহ জাগলো না। এখান থেকে বের হয়ে আমরা চলে এলাম জিউ স্ট্রিট এ। সারি সারি নানান দোকান, সুভ্যেনিয়রে ঠাসা রাস্তার দু’ধারে। বেশীরভাগই প্রাচীন এন্টিক টাইপের পুরানো জিনিষপত্রে ঠাসা।





















এখান হতে আমরা গেলাম কেরালা’র সর্ববৃহৎ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর “হিল প্যালেস” দেখতে। এটির অবস্থান ত্রিপুনিথুরা নামক এলাকায়। কোচিনের মহারাজার কেন্দ্রীয় সভা ছিল এখানে এবং এখানেই সেই সভার সভাসদেরা বসবাস করতেন। ১৮৬৫ সালে প্রায় ৫৪ একর জমির উপর ৪৯টি ভবন নিয়ে এই কমপ্লেক্স টাইপ স্থাপনাটি নির্মিত হয় বর্তমানে যা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে যার তত্ত্বাবধান করে কেরালা রাজ্য সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর। ১৯৮০ সালে কোচিন রয়্যাল ফ্যামিলি হতে সরকার এর কাছে এই ভবন হস্তান্তর করা হয়। প্রতি সোমবার ব্যতীত বাকী ছয়দিন সকাল নয়টা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা হয়ে দেড় ঘন্টার বিরতির পর দুপুর দুটো হতে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। এই জাদুঘর কিন্তু মালায়াম ভাষার সিনেমার জনপ্রিয় একটি শ্যুটিং স্পট। এই জাদুঘরে কেরালা’র রয়্যাল ফ্যামিলির ব্যবহৃত মুকুট, স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় ১৪ ক্যাটাগরির জিনিষপত্র প্রদর্শিত হয়েছে। পেইন্টিং, মার্বেল পাথরের স্ক্যাল্পচার, নানান মুদ্রা, অস্ত্র ইত্যাদি রয়েছে এই তালিকায়। বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটানোর পর একটি রেস্টুরেন্ট আমরা লাঞ্চ সেরে নেয়ার পর মিঃ বিনয় আমাদের নিয়ে রওনা হল সেইন্ট ফ্রান্সিস চার্চ এবং ব্যাসিলিকা চার্চ এর উদ্দেশ্যে। কেরালা ভারতের এমন একটা প্রদেশ যেখানে নানান ধর্মর অনুসারী জাতিসত্ত্বার সম্মিলন ঘটেছে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদী... নানান বর্ণ, নানান ধর্ম সবাই বসবাস করছে পাশাপাশি।







































আগের পর্বগুলোঃ
যাত্রা শুরুর গল্প (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০১)
ট্রানজিট পয়েন্ট কলকাতা... অন্যরকম আতিথিয়তার অভিজ্ঞতা (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০২)
অবশেষে কোচিন - তৃতীয় রাতে যাত্রা শুরুর স্থানে (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৩)
ডেস্টিনেশন মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৪)
মুন্নার টি মিউজিয়াম (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৫)
মুন্নার ভ্রমণ - মাতুপত্তি ড্যাম এবং ব্লোসম পার্ক (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৬)
ইকো পয়েন্ট এবং টপ ষ্টেশন অফ মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৭)
ট্রিপ টু কুলুক্কুমালাই... (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৮)
পেরিয়ার লেক - ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি (থিক্কাদি - কেরালা) (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৯)
শিকারা রাইড এন্ড সানসেট এট ব্যাকওয়াটার (কুমারাকোম - কেরালা) (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১০)
কোভালাম সী বিচ (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১১)
কন্যাকুমারী দর্শন (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১২)
কেরালা ব্যাকওয়াটার হাউজবোটে একদিন - (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১৩)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১১:৩৯
৬টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×