“কণ্যাকুমারী” শব্দটি শুনে নাই এমন কোন মানুষ মনে হয় নেই, যারা ভারতের ভ্রমণ সম্পর্কে খবর রাখেন। দক্ষিণ ভারতের শেষাংশ, যেখানকার সমুদ্রসীমায় মিলিত হয়েছে তিনটি ভিন্ন সমুদ্রের পানি, জায়গাটাকে বলা হয় “ত্রিবেণী সাঙ্গাম”। তো কেরালা ট্যুর প্ল্যান করার সময় আমি ভীষন সময় সংকটে পড়ে যাই, হাতে সময় মোট ষোল দিন। এই সময়ের মধ্যে মোটামুটি পুরো কেরালার সাথে গোয়া এবং মুম্বাই কাভার করার চিন্তা। ফলে কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখি, ট্যুর শুরুর আগে মাথা খারাপ অবস্থা। ভ্রমণ পরিকল্পনা করার সময় আমার কেরালার ট্যুর এজেন্ট এর সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ, মিস লিলা’র সাথে প্রায় শ’দুয়েক মেইল চালাচালি হয়েছে, যার অধিকাংশই ছিল এই সময় এবং স্পট এর মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা নিয়ে।
যাই হোক, আমরা গতদিন ছিলাম কুমারোকম এ। আগের দিন রাতে দেখা কুমারোকম এর হোটেল গ্রীণ ফিল্ডস এত পরিপাটি এবং সুন্দর ছিল যে, মন চাইছিল এখানেই কয়েকদিন থেকে যাই। কিন্তু মন চাইলেই তো আর হবে না, আছে তাড়া, যেতে হবে বহুদূর। তাই, ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে বেড়িয়ে পরলাম পরবর্তী গন্তব্য কণ্যাকুমারী'র উদ্দেশ্যে, যাত্রাপথ মাত্র ২৬৫ কিলোমিটার। আর এই নিয়েই লিলা’র সাথে আমার বিতর্ক। আমার কথা, গাড়ী যদি ৬০ কিলোমিটার গতিতেও চলে, এই দূরত্ব যেতে পাঁচ ঘন্টাই এনাফ। পর অনেক তর্ক করে জানলাম, এই পথে প্রায় বিশটির মত শহর-উপশহর ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে, যেখানে থাকবে ট্রাফিক জ্যাম। ফলে ট্যুর লিস্ট হতে ছেটে ফেলা হল ভারতের অন্যতম সুন্দর একটি সমুদ্র সৈকত “কোভালাম”। কিন্তু আমার মাথার ভেতর থেকে ছেটে ফেলতে পারলাম না।
ফলে সেই থিক্কাদি থেকেই আমি আমাদের ড্রাইভার কাম ফ্রেন্ড মিঃ বিনয় এর সাথে আলোচনা করতে লাগলাম, এমন কি উপায় আছে যাতে করে কুমারোকম থেকে কণ্যাকুমারী যাওয়ার পথে আমরা কোভালাম হয়ে যেতে পারি। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে, কণ্যাকুমারী যাওয়ার হাইওয়ে হতে কোভালাম সী-বিচ মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল আমরা খুব ভোরবেলা (যা গত চার রাত ধরেই করে আসছিলাম ) রওনা দিয়ে দেব, যাতে করে দিনের কর্মব্যস্ততা শুরু হওয়ার আগেই অনেকটা শহরতলী পথ পাড়ি দিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু সমস্যা একটা রয়েই যায়। কণ্যাকুমারী’র অন্যতম গন্তব্যস্থল স্বামী বিবেকানন্দ রক যাওয়ার যে ফেরী আছে, তা শেষ ছেড়ে যায় বেলা সাড়ে তিনটা নাগাদ। তাই আমাদের তিনটার মধ্যে ফেরীঘাটে পৌঁছতে হবেই। সবশেষে ডিসিশান হল, আমরা যদি বেলা এগারোটার আগে কোভালাম ক্রস করতে পারি, তবে গাড়ী কোভালাম সী-বিচের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, এবং সেখানে সর্বোচ্চ আধঘন্টা সময় দেয়া হবে। এই শর্তে আমাদের এদিনের যাত্রা শুরু হল।
ভোর পাঁচটায় যাত্রা করে ১৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার পর পথিমধ্যে ঘন্টাখানেকের যাত্রা বিরতী কেরালা'র অন্যতম টুরিস্ট ডেস্টিনেশন 'কোভালাম সী বিচ'। আগের দিনগুলোর মতই আমার ভ্রমণসঙ্গীরা পেছনে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছে, আমি সামনের সীটে ড্রাইভার বিনয় এর সাথে নানান গল্পে মেতে রইলাম। এদিন ওর সাথে অনেক গল্প হল। এদিন কিন্তু হোটেল থেকে কোন ব্রেকফাস্ট নিয়ে বের হই নাই। ফলে পেছন থেকে একটু পরপর সবার জিজ্ঞাসা নাস্তা করবো কবে। আমি আর বিনয় প্ল্যান করেছিলাম, যত বেশী সম্ভব এগিয়ে যাওয়া যায়, ততই বেটার। তাই আগের দিনগুলোতে আটটায় নাস্তা করলেও, এদিনে আমরা প্ল্যান করলাম সাড়ে আটটা, পারলে নয়টায় নাস্তা করবো। পেছনের সাথীদের বারংবার জিজ্ঞাসায় আমরা উত্তর দিচ্ছিলাম, ভাল কোন রেস্টূরেন্ট পাচ্ছি না, তাই গাড়ী থামানো হচ্ছে না। কিন্তু কতক্ষণ আর পারা যায়? সাড়ে আটটা নাগাদ একটা রোড সাইড রেস্টুরেন্টে গাড়ী থামানো হল, বেশীর ভাগই পরোটা-সবজি-ডিমভাজি দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম, কেউ কেউ ভেজ-ধোসাও খেল। এরপর চা পান করে আবার গাড়ী নিয়ে ছুটে চলা।
একের পর এক ছোট বড় শহরতলী পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি, দেখছি কেরালার জনজীবন। আসলে গত পাঁচ-ছয় দিন ব্যস্ত ছিলাম সাইট সিয়িং এ, ফলে মূল জনপদ তেমন দেখা হয় নাই। যা এদিনের যাত্রা পুষিয়ে দিয়েছে। বাজার, দোকানপাট, মানুষজনের কর্মব্যস্ততা, বাস এর ভীড়, আমাদের শহরতলীগুলোর মতই জনজীবন। কেরালার মানুষজন খুব স্বাস্থ্য সচেতন, পুরো কেরালা জুড়ে দেখবেন ভেষজ ব্যবহার। খাবারে দেয়া হয় পুষ্টিকর তেল-মসলা, যা আবার আমাদের বাঙ্গালীদের জিভে রুচবে না। এমনকি সাধারণ খাবার হোটেলের পানিতে ভেষজ উপাদান দেয়া, এবং উষ্ণ গরম পানি পরিবেশন করা হয়। চল্লিশ ডিগ্রী’র উপরের তাপমাত্রার আবহাওয়ায় উষ্ণ গরম পানি!! ভাবা যায়? কারন স্বাস্থ্য সচেতনতা। অনেকেরই কেরালার খাবার নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু আমার কাছে খুব উপভোগ্য মনে হয়েছে সেখানকার খাবারগুলো। ইচ্ছে আছে কেরালার ভ্রমণ সিরিজ শেষ হলে কেরালার খাবার নিয়ে পোস্ট দেয়ার।
বেলা সাড়ে দশটার কিছুটা পর আমরা কোভালাম চলে এলাম। যাক, আমার ইচ্ছে পূরণ হল। আসলে, নিয়তেই বরকত। কোভালাম বীচের পাশে পার্কিং লটে একটি গাছের ছায়ায় গাড়ী পার্ক করল আমাদের ড্রাইভার মিঃ বিনয় পি জোশ। কেরালা’র অত্যাধিক গরমে গাড়ী অল্পতেই তেঁতে ওঠে, তাই আমি বিনয়কে বলেছি ছায়া দেখে পার্ক করতে, আর পারলে আমরা প্রতিটি স্পট ভিজিট শেষে ফিরে আসার মিনিট দশেক আগে এসি অন করে দিতে। নইলে গাড়ীর গরমে টেকা দায়। এমনিতে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির গরমে ঘুরে বেড়াতে খুব একটা সমস্যা হয় না, তবে কেরালার গরমে বাতাসের আদ্রতার ভিন্নতার কারনে ঘাম হয় না, গা কেমন চিটচিটে হয়ে যায়, আর হালকা জ্বালা করে। যে ধরনের গরমের সাথে আমরা বাংলাদেশীরা অভ্যস্ত না। যাই হোক, আমরা ক্যামেরা সমেত গাড়ী হতে নেমে এলাম। হাতে যেহেতু সময় কম, তাই সবাইকে বললাম, আমাকে ফলো করতে।
ছোট্ট কিন্তু পরিপাটি গোছানো এই সমুদ্র সৈকত মুখরিত দেখলাম সাদা চামড়ার পর্যটক দলের সুর্য স্নানে। মন খারাপ হল অযত্ন আর অবহেলায় থাকা আমাদের দেশের চমৎকার সব সমুদ্র সৈকতগুলোর জন্য। সৈকতে টুরিস্ট পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, লোকাল ছেলেপুলের দল যেন সূর্যস্নানে থাকা সাদা চামড়ার মেমসাহেবদের উত্যক্ত না করে। আমরা যখন বীচে গেলাম, আমাদের এসে বলল, ওদিকে যাওয়া যাবে না, ওটা ফরেইন টুরিস্টদের জন্য। আমি আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বললাম, আমিও ফরেইন টুরিস্ট, বুঝলে। ভদ্রলোক হেসে দিল। আমি, ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, তুমি চিন্তা করো না, অর্ধনগ্ন মেমসাহেবদের দেখা বা ছবি তোলা’র কোনটারই ইচ্ছে বা সময় আমাদের হাতে নাই। আর আমাদের দলেও মেয়ে মানুষ আছে ভাই...
সুন্দর এই বীচটির পশ্চিম পাশ হতে ছবি তুলতে তুলতে হাটা শুরু করলাম, মিনিট বিশেকের মধ্যে অপর প্রান্ত ছুঁয়ে এলাম। পূর্ব প্রান্তে মাছের জাল তুলছে জেলেরা।
দুই প্রান্তের মাঝেখানে রয়েছে বিখ্যাত লাইট হাউস এর স্থাপনা। সেখানে যেতে চাইলে অনুমতি মিলল না। ঝটপট ছবি তুলে নিলাম।
হাতে সময় কম। প্রায় দৌড়ে দৌড়ে পুরো সৈকত এলাকা ঘুরে দেখলাম। পূর্ব প্রান্তে সারি সারি রেস্টূরেন্ট, বার। ইচ্ছে হচ্ছিল, সেখানে বসে ঠান্ডা কোন পানীয় নিয়ে বসে পড়ি, নীল জলের সাদা সফেদ ঢেউ ভাঙ্গার খেলা দেখতে। কিন্তু আমাদের যে আরো গন্তব্য পরে আছে। তাই ফিরতে হল পার্কিং এরিয়ায়, ছাড়তে হল গাড়ী। গন্তব্য কণ্যাকুমারী, পৌঁছতে হবে বেলা তিনটার আগে। (চলবে)।
আগের পর্বগুলোঃ
যাত্রা শুরুর গল্প (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০১)
ট্রানজিট পয়েন্ট কলকাতা... অন্যরকম আতিথিয়তার অভিজ্ঞতা (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০২)
অবশেষে কোচিন - তৃতীয় রাতে যাত্রা শুরুর স্থানে (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৩)
ডেস্টিনেশন মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৪)
মুন্নার টি মিউজিয়াম (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৫)
মুন্নার ভ্রমণ - মাতুপত্তি ড্যাম এবং ব্লোসম পার্ক (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৬)
ইকো পয়েন্ট এবং টপ ষ্টেশন অফ মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৭)
ট্রিপ টু কুলুক্কুমালাই... (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৮)
পেরিয়ার লেক - ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি (থিক্কাদি - কেরালা) (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৯)
শিকারা রাইড এন্ড সানসেট এট ব্যাকওয়াটার (কুমারাকোম - কেরালা) (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১০)