১৯৭১ সালের জুলাই মাসে যখন আমরা কুমিল্লায় গ্রামে আমাদের দাদা বাড়িতে ছিলাম, তখন পাকিস্তানি মিলিটারিরা আব্বাকে আর বাকি যে কয়জন বাঙ্গালী ডাক্তার বেচে ছিল, তাদের সবাইকে কুমিল্লা সি এম এইচে বন্দী করে রাখে। তারা তাদেরকে তখন কাজ করতে দেয় নাই। তখন কোন বেসামরিক লোক অথবা কোন পাকিস্তানি অফিসার বা সৈনিকদের তাদের পরিবার পরিজনকে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে রাখার বা প্রবেশ করার অনুমতি ছিল না।
দাদা বাড়িতে বড় দালানটায় তখন মেঝ চাচিরা আর ছোট চাচা চাচিরা থাকতেন। আর আমার বড় চাচি বা জেঠিমা থাকতেন উঠানের আরেক পাশে তার নিজেদের ঘরে, সেটা বড় একটা মাটির ঘর ছিল। আমার বড় চাচার নাম আস্ মত আলি। উনি ১৯৫৫ সালের দিকে আমাদের গ্রামে এক ভয়াবহ কলেরা মহামারিতে মারা জান। আমার বড় ফুফু জোহরাও মারা যান সেই কলেরা মহামারিতে। মৃত্যুকালে বড় চাচার তিন ছেলে আর এক মেয়ে ছিল। তারা হচ্ছেন নুরু ভাইয়া, শামসু ভাইয়া, শাহজাহান ভাইয়া, আর মুরশিদা আপা। সব চেয়ে ছোট ছেলে মুনির ভাইয়ার তখনো জন্ম হয় নাই, চাচির পেটে ছিল।
বড় চাচি দেখতে সুন্দরী ছিলেন। মানে ফরসা গায়ের রঙ, সুন্দর চেহারা, লম্বা চুল আর দাতগুলি পান জর্দা খেয়ে কালো কালো। চাচির চোখ হালকা খয়েরী ছিল। আর মুরশিদা আপা আর মুনির ভাইয়ার চোখও সেরকম ছিল। শোনা কথা যে বড় চাচিকে নাকি মাঝে মধ্যে জিনে ধরত, গ্রামের বাশ ঝাড়ের নীচে দিয়ে খোলা চুলে গিয়েছিলেন উনি সেই জন্য। তবে আমি কখনো ওনাকে কোন অদ্ভুত ব্যাবহার করতে দেখি নাই। আমি দিনের বেলায় জিন-ভুতে বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু সন্ধ্যা হলে সেই বাশ ঝাড়ের নীচে দিয়ে যেতে ভয় লাগত। মুরশিদা আপা বিয়ের পরে দুলাভাইয়ের সাথে নারায়ণগঞ্জে থাকতেন, তার দুই ছেলে ছিল - আলম আর মাসুদ। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে যখন আমরা দাদা বাড়িতে যাই, মুরশিদা আপা তখন তার দুই ছেলেকে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছিলেন তার মায়ের কাছে। ওনার বড় ছেলে আলমের তখন বয়স ছিল ৩-৪ বছর, আর ছোট ছেলে মাসুদের মনে হয় ২ বছর বয়স ছিল।
আমরা যখন দাদা বাড়িতে ছিলাম, তখন সবার নানা রকম অসুখ বিসুখ হত। একবার বাচ্চাদের আর বড়দের সবার চোখ উঠেছিল। ছোঁয়াচে রোগ, এড়ানোর কোন উপায় নাই। তখন চিকিৎসা বলতে আমার ছোট চাচার হোমিওপ্যাথি ওষুধ ভরসা আর নরম কাপড় ফটিক পানিতে ভিজিয়ে সেটা দিয়ে ঘন ঘন চোখ মোছা। ফটিক পানি হচ্ছে টিউব ওয়েলের পানি কলসিতে ভরে সেটার মধ্যে ফটিক লবণের স্বচ্ছ চাকা গুলে রেখে দিলে সব ময়লা নীচে জমে যায়, আর উপরের পরিস্কার পানিটা চোখ মোছার জন্য ব্যাবহার করা যায়। সেভাবে চিকিৎসা করে চোখ উঠা কয়েকদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু তার পরে গ্রামে ডিপথেরিয়া মহামারি দেখা দিল। এই রোগ কোথা থেকে আসলো আর কিভাবে ছড়ালো বা তার কি নাম, কোনটাই আমাদের জানা ছিল না। গ্রামের লোকের ধারনা ছিল বাচ্চারা বিড়ালের লোম খেলে তাদের এই রোগ হয়। সব চেয়ে প্রথমে ডিপথেরিয়া হয়েছিল ছোট চাচার ছোট মেয়ে ফাতেমার, তার তখন তিন বছর বয়স, আমার ছোট বোন শাহীনের থেকে একটু বড়। ছোট চাচা তার হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে ফাতেমাকে ভালো করার পরানপণ চেস্টা করলেন, কিন্তু তাকে বাচাতে পারলেন না। ইতিমধ্যে আমি ছাড়া আমার সব ভাই বোনদের ডিপথেরিয়া হয়। প্রথমে ধরে শাহীনকে, তার পরে শামীম আর রাশেদ ভাইয়াকে।
যখন ফাতেমা মারা গেল তখন ঘোর বর্ষাকাল। তাকে কবর দেওয়ার জন্য কোথাও শুকনা মাটি খুজে পাওয়া যায় নাই। মাটি খুড়লেই পানি। তাই তার কবরের উপরে কলা গাছের গুড়ি খুটি দিয়ে গেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও কবর দেওয়ার এক দিন পরে গ্রামের শেয়াল্ গুলি মাটি খুড়ে তার লাশ বের করে ফেলেছিল। শেয়াল গুলিকে তাড়া করে ফাতেমার দেহের অবশিষ্ট অংশ আবার কবর দেওয়া হয়েছিল।
আর তার দুই দিন পরে আমার ছোট বোন শাহীন মারা গেল। আমাদের গ্রামের মসজিদেই শাহীনের জানাজা পড়া হয়েছিল, আমার চাচা ইমামতি করেছিলেন। মেয়েরা জানাজায় যায় না বলে আম্মাসহ আমরা সবাই পকুরের মেয়েদের ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে শাহীনের জানাজা দেখেছিলাম। আর আমার আম্মা নিঃশব্দে "শাহীন, শাহীন" বলে কাঁদছিলেন । শাহীনের জানাজা হয়ে যাওয়ার পরেই আম্মা বললেন যে "আমি এক্ষুনি আমার বাচ্চাদের চিকিৎসার জন্য ময়নামতি নিয়ে যাব, নয়ত এখানে থাকলে এই দুই জনও মারা যাবে"।
যদিও তখন কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে কোন বেসামরিক লোকের প্রবেশ করার অনুমতি ছিল না, তবুও আম্মা ঠিক করলেন আমাদের সেখানে নিয়ে যাবেন। তিন বাচ্চা, তার মধ্যে দুই জন অসুস্থ, তাদেরকে নিয়ে আম্মা একলা কিভাবে যাবেন এই দীর্ঘ পথ, সাথে যাওয়ার লোক নাই। কারন তখন মিলিটারিরা অল্প বয়সী বাঙালি ছেলে দেখলেই মেরে ফেলত, আর সবার আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে হত। লোকে সেটাকে বলত ডান্ডি কার্ড। আমার বড় চাচার ছোট ছেলে মুনির ভাইয়া তখন ক্লাস নাইন বা টেনের ছাত্র, সেই বিপদের দিনে সেই আমাদের সাথে ময়নামতি গিয়েছিল। শাহীন মারা যাওয়ার পরের দিন সকাল বেলা আমমা আমাদেরকে আর মুনির ভাইয়াকে সাথে নিয়ে দাদা বাড়ি থেকে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে রওয়ানা দেন।
কিভাবে সেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ময়নামতি পৌঁছেছিলাম আমার ঠিক মনে নাই। খালি মনে আছে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের ঢোকার পথে চেকপোস্টে মিলিটারিরা আমাদের আটকিয়েছিল। আম্মার কথা শুনে আর অসুস্থ বাচ্চা দেখে আমাদের ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দিয়েছিল। আমাদেরকে সিএমএইচে পৌঁছে দিয়ে মুনির ভাইয়া নিরাপদেই গ্রামে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।
আমরা সিএমএইচে পৌঁছনোর পরে আব্বা রাশেদ ভাইয়া, শামীম আর আমাদের সবাইকে সেই হাস্পাতালে ভর্তি করালেন। আব্বা যখন আম্মাকে "শাহীন কোথায়?" এই কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন আম্মা প্রথমে বলেছিলেন যে তাকে আমার চাচাতো বোন নুরজাহান আপার কাছে রেখে এসেছেন, তার মারা যাওয়ার খবরটা পরে কখন আব্বাকে বলেছিলেন জানিনা।
সিএমএইচে রাশেদ ভাইয়া আর শামীমকে আলাদা আলাদা বেডে ভর্তি করা হয়েছিল। আমাকে কি বলে ভর্তি করা হয়েছিল মনে নাই, তবে পুস্টিহীনতায় ভুগছি এটা হয়ত হতে পারে। আম্মা তিন রোগীর মা হিসাবে থাকার অনুমতি পেয়েছিলেন। তারপরে সঠিক রোগ ধরা পড়ে এবং ডিপথেরিয়ার সঠিক চিকিৎসা পেয়ে রাশেদ ভাইয়া আর শামীম সুস্থ হয়েছিল।
(To be continued)
প্রথম খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
দ্বিতীয় খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
তৃতীয় খন্ডের লিঙ্ক Click This Link
৪র্থ খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
৫ম খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
৬ষ্ঠ খণ্ডের লিঙ্ক - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:৫৯