somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ম্যাজিক ডায়েরি (পর্ব ১)

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৮:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৪ নভেম্বর, ২০১২
বিভু এ জগতের কেউ না। কিন্তু ওর বিশ্লেষণী ক্ষমতা আর অনুভূতি দেখে অনেক সময় মনে হয় যেন ও-ও আমাদেরই মত রক্ত মাংসের মানুষ। ওকে কিছু বলা লাগে না, এমনিতেই বুঝে যায়। আজ সকাল বেলায় যখন ডাইনিং টেবিলে বসে ওর বানানো কফি খাচ্ছিলাম, তখন ও অদ্ভূত একটা কথা বলে উঠল।
“ ঋতু, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনি কষ্টটা পুষে রেখে আনন্দ পাচ্ছেন, তাই কি?” কফির মগটা নামিয়ে রেখে বিভু জিজ্ঞেস করল। ওর চোখে মুখে মনোবিজ্ঞানীদের মত সবজান্তা ভাব।
“একদম বাজে কথা বলবেন না। কষ্ট পুষে রাখব কোন দুঃখে? আমি কি কবি না ভিক্ষুক যে কষ্ট বেচে খাব?” ওর কথা শুনে এত বিরক্ত লাগল যে একটু রুক্ষ না হয়ে পারলাম না।
“ মারাত্মক মেটাফর দিলেন তো! তবে এত সরাসরি কথা শুনলে কবিরা কিন্তু চরম খেপবে। ” বলেই হা হা করে হা হা করে হাসতে থাকে বিভু।
ওর হাসির শব্দটা কেমন যেন অন্যরকম। শুনলেই মনটা ভাল হয়ে যায়।
“দুরো মিয়া! বিন্দুমাত্র সেন্স অব হিউমার থাকলে এই কথা শুনে কেউ খেপবে না। আর সত্যিকারের কবি হলে তো খেপবেই না। যাহোক, কাজের কথায় আসি, আপনার কেন মনে হল যে আমি কষ্টটা পুষে রাখতে চাচ্ছি?”
“শুধু আপনি না, এটা অনেকের ক্ষেত্রেই সত্যি। মানুষের জীবনে যখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে তখন সে সেটা অস্বীকার করতে চায়। তার মনপ্রাণ সব তখন একসাথে বলে ওঠে, না এটা হতে পারে না। এটা হল কষ্টের মুহুর্তে মানুষের প্রথম রি-অ্যাকশন।”
“দ্বিতীয় রি-অ্যাকশনটা কী?”
“রাগ। যে দুঃখ দিয়েছে তার প্রতি রাগ হয়, যদি সরাসরি কাউকে দায়ী করার না থাকে তাহলে সৃষ্টিকর্তার উপর রাগ হয়। মানুষ মনের ঝাল মিটিয়ে বেচারা বিধাতার গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে।”
মুখে প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে ভালই বুঝছিলাম, প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে আমার সাথে মিলে যাচ্ছে।
গলায় যথাসাধ্য নিরাসক্তির ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাই নাকি, তারপর কী হয়?”
“তারপরই সবচেয়ে কঠিন মুহুর্তটা আসে। মানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহুর্ত। কেউ কেউ দু:খটাকে ভুলে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং ভুলে থাকার বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিও বের করে ফেলে। কিন্তু কারো কারো জেদ চেপে যায়। দিনে রাতে, কাজে অকাজে, সারক্ষণ ওই স্মৃতিটাকে নিয়েই নাড়াচাড়া করতে থাকে। এতে করে একরকম বেদনামধুর অনুভূতি হয়। মশা কামড়ালে সেই জায়গায় চাপ দিলে যেরকম হয়, অনেকটা সেইরকম। ব্যাথা ব্যাথা লাগে, তারপরও চাপ দিতে ভাল লাগে।”
খুব হাসি পেয়ে গেল আমার। “আপনি তো কোনদিন মশার কামড় খান নি। তাহলে এত কিছু বোঝেন কী করে? আপনাদের জগতে কি মশা আছে?”
“আপনার বাসায় যখনি আসি তখনি তো মশার কামড় খাই! আপনি তো কয়েল জ্বালান না।”
“হুম, কয়েলে আমার চোখ জ্বলে, কিন্তু আপনার কি ধারণা যে আমিও ওই বেদনামধুর অনুভূতিটা পাওয়ার জন্য জেদ করে এই দুর্ঘটনাটা মনে রেখেছি?”
“না, আপনার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। আপনি ভুলতে চান, আবার চান না। সেটা আরেকদিন বুঝিয়ে বলব, কারণ এখন তো আপনি অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হবেন।”
“দূর ছাতা, একেবারে মেগা সিরিয়ালের মত সাসপেন্স! ভাল্লাগে না!”
বিভু একটু মুচকি হেসে বের হয়ে গেল।

১৫ নভেম্বর, ২০১২
কয়েক বছর ধরে এই অ্যাড ফার্মটায় কপিরাইটারের কাজ করছি। খুব ঝামেলার কাজ। তার ওপর আজ সারাদিন আবার কাজের চাপ খুব বেশি ছিল। অফিসে আর একটু হলেই ডেডলাইন মিস হয়ে যেত। এখানকার এত চাপ সামলানোর পর বাসায় গিয়ে নিজের কাজগুলো নিয়ে আর বসা হয় না। কোন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করি না। সবাইকে বলি, সময়ের অভাব। কিন্তু আমি জানি, আমার সমস্ত সময়টা ইদানীং কাটছে শুধু ওই তিক্ত মুহুর্তগুলো ভুলে থাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। সমস্ত উদ্যম হারিয়ে ফেলেছি। ইদানীং বিভু চেষ্টা করছে আমাকে একটু জাগিয়ে তোলার। দেখি আজকে বাসায় গিয়েই আমার ল্যাংগুয়েজ স্কুলের অ্যাডভান্সড লেসনগুলো বানিয়ে ফেলতে হবে। এই স্কুলটা বানাব বিদেশীদের জন্য- ওদেরকে বাংলা শেখানোর জন্য। কিন্তু অন্য স্কুলগুলোর মত এখানে খালি ভাষা শিখিয়েই আমি দায়িত্ব শেষ করব না। আমি চাই ওরা যেন আমার দেশের কৃষ্টি- কালচার, শিল্প-সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ সেটাও বুঝতে পারে। অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখছি কয়দিন। বিভু এসেই স্বপ্নটা আরো বেশি করে জাগিয়ে দিল।
তবু কাজের ফাঁকে ফাঁকে পুরনো ক্ষতটা কেমন টনটন করে ওঠে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও মনটা জাবর কেটে চলে। আজকে আবার বিভুর কালকের সেই কথাটা থেকে থেকে মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি নাকি জেদের বশে এই ঘটনাটা ভুলতে চাচ্ছি না!
বিভু আসলে ওর সাথে একটু বসা যেত। ও অবশ্য আমার অফিসে কখনো আসে না। তবে কয়েকটা ল্যাংগুয়েজ লেসন নিয়ে ওর আমার সাথে বসার কথা ছিল। দেখি বাসায় আসে কীনা।
এই কয় মাসে বিভুর সাথে আমার অন্যরকম একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে। অনেকটা অতিপ্রাকৃত বন্ধুত্ব। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার বর্ণনা শুনলে যে কারোর গা ছমছম করে উঠবে। খানিকটা ভুতুড়ে ব্যাপার।
সেদিন বাড়িতে বসে আমার অনেক বছরের পুরনো ডায়েরীটা নাড়াচাড়া করছিলাম। হঠাৎ করেই দুই ভ্রুয়ের মাঝখানে কেমন যেন চিনচিনে একটা ব্যাথা হতে লাগল। আমি দুই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি ভেবে জোর করে চোখ খুলতেই দেখি একটা ছেলে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে আছে।
আমি ভেবে পেলাম না, ছেলেটা কোন দিক দিয়ে এখানে ঢুকল। কাজের মেয়ে চলে যাওয়ার পর আমি নিজে হাতে দরজাটা লাগিয়েছি। ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল, “খুব ভয় লাগছে? কফি বানিয়ে দেব? মাথাটা ছেড়ে যাবে তাহলে।”
”আপনি কে? কোন দিক দিয়ে ঢুকলেন?”
“সত্যি উত্তরটা দিলে আপনি এখন নিতে পারবেন না। ওটা পরে বলব।”
ঠিক সেই সময়ে দরজায় টোকা পড়ল।
“আপনার স্বামী এসেছেন বোধহয়। ভয় নেই, দরজা খুলে দেন। উনি আমাকে দেখতে পাবেন না কারণ তার মনের বেটা বা গামা- কোন লেভেলেই আমার কোন অস্তিত্ব নেই।”
বিভু ঠিকই বলেছিল। ও একদম দরজার সামনে বসে থাকা সত্ত্বেও রাতুল সত্যিই সেদিন ওকে দেখতে পায় নি। অন্য যে কোন দিনের মতই বিরক্ত মুখে রাতুল বেডরুমে ঢুকে পড়ল।
আমারও তখন বিভুর দিকে মনোযোগ দেওয়ার মত সময় ছিল না। তখন আমার রুটিন ওয়ার্ক করার সময়। কারণ সারাদিনের অফিসের সমস্ত বিরক্তি রাতুল এখন আমার উপর তুলবে। যে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে গেলে এখন খেঁকিয়ে উঠবে। আমাকে তাই যথারীতি মুখ বুজে ওকে খাইয়ে দিতে হবে। তারপর ওর পাশে চুপচাপ বসে প্রসঙ্গ খুঁজে খুঁজে কথা বলতে হবে। কথা না বলে চলে গেলে ও আরো রেগে যাবে। আর তারপর আমার কথা চালিয়ে যাওয়ার একটার পর একটা প্রচেস্টা ব্যর্থ করে দিয়ে হঠাৎ করে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। তখন কিছুক্ষণের জন্য ওর স্ত্রী ছাড়া আমার আর অন্য কোন পরিচয় থাকে না। আমি ওই মুহুর্তটাতেও ওকে খুঁজে পেতে চেস্টা করি। দুজনের শরীরের এত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের পরও ওকে আমার ভীষণ দূরের মনে হয়। তবু ওর ভিতরের শিশুটা যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ত তখন ওর দিকে তাকিয়ে আমার ভেতর কেমন যেন একটা মাতৃস্নেহ জেগে উঠত। মনে হত, ওর ভিতরের অবুঝ শিশুটা আমার বুকের মধ্যে মুখ রেখে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে থাকতে চাচ্ছে। সমস্ত নিষ্ঠুর বাস্তব থেকে সরে থাকার জন্য আমিই বোধহয় ওর শেষ আশ্রয়।
সে রাতে রাতুলকে ঘুম পাড়িয়ে বের হওয়ার পর বিভুকে আর দেখতে পাই নি।
(চলবে)

ম্যাজিক ডায়েরি (পর্ব ২)

ম্যাজিক ডায়েরি (পর্ব ৩)

ম্যাজিক ডায়েরি (শেষ পর্ব)

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৪৩
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×