২৫ নভেম্বর, ২০১২
আজকাল আর বিভুকে বেশি ডাকতে হয় না। ডায়েরিটা পাশে থাকলেই ও অনেক সময় নিজে থেকেই আসে। সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ এরকম পরিবর্তনের কারণ কী। আগে তো প্ল্যানচেট করে আত্মা নামানোর মত করে ওকে ডাকতে হত। এখন হঠাৎ এত উন্নতি কী কারণে।
ও শুনে হাসল। বলল, “মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনি হয়তো ব্যস্ত আছেন। তাই, ডাকার সময় পাচ্ছেন না। কিন্তু আমি থাকলে আপনার ভাল লাগবে। তাই, যখন তখন চলে আসি।”
বিভুর এই ব্যাপারটা খুব মজার। এ জগতের কোন ছেলে হলে বোধহয় এত সহজে এই উত্তরটা দিত না। হয় একটু রেগে যেত, নাহয় আমাকে আর একটু খেলাত। কিন্তু ও সরলভাবে ওর মনের কথাটা বলে দেয়। তাই, চোখ বন্ধ করে ওর কথার উপর আমি ভরসা করতে পারি।
আজকে রাত বারোটার সময় হঠাৎ আমার কানের কাছে ডি. এল. রায়ের “আজি এসেছি এসেছি বঁধু হে” গানটা বাজিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। ঘুম ভাঙতেই বলল, “শুভ জন্মদিন!”
জন্মদিনের কথা আমার মনে ছিল। তাই, ইচ্ছে করেই মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। মোবাইল খোলা থাকলেই বন্ধুদের ফোন আসত। আর আমি না ঘুমিয়ে কিছ্ক্ষুণ পর পর চমকে চমকে ফোনের স্ক্রীণের দিকে তাকাতাম। সারক্ষণ মনে হত থাকত, বোধহয়, ও ফোন করেছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি ভাল করেই জানি যে, ও কোনভাবেই ফোন করবে না, এমনকি হয়তো ভুলেই গেছে দিনটার কথা।
কিন্তু বিভু মনে রেখেছে। ওর কার্যকলাপ দেখে বোঝা গেল যে, অনেকদিন ধরে ও দিনটা পালনের প্রস্তুতি নিয়েছে। গান বাজতে থাকল আর ও আমার হাতে একটা গিফ্ট ধরিয়ে দিল। উপনিষদ আর রুমির একটা বই কিনে এনেছে আমার জন্য। বলল, আপনার লাইব্রেরিতে এ দুটো নেই দেখে নিয়ে আসলাম। আরো একটা কী যেন ছিল। প্যাকেটে মোড়ানো। আমি খুলতে গেলাম। ও খুলতে দিল না। বলল, “পরে খুলবেন। এখনো সময় হয় নি।”
আমি আর জোর করলাম না। বই দুটো উল্টে প্রকাশনীর নাম দেখে বললাম, “এটা তো আর অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড থেকে আমদানি করা হয় নি। এ জগতের দোকান থেকেই কেনা হয়েছে। টাকা পেলেন কোথায়?”
“আপনার আলমারি থেকে নিয়েছি। আপনাকে বলে নিলে তো আর সারপ্রাইজটা থাকত না। তাই...”
খুব হাসি লাগল। আমার আগে কেউ কোন চোরের উপর এত কৃতজ্ঞ হয়েছে কীনা আমি জানি না। কোন একজনকে বিশেষ সম্মান দিতে গিয়ে আমার নিজের বিশেষত্বটা এতদিন ভুলেই গিয়েছিলাম। আনন্দে চোখে পানি এসে গেল।
বিভু আবার একটা টিস্যু এগিয়ে দিল। আজকে হঠাৎ অনুভব করলাম, বিভু আমাকে কখনো ছোঁয় না। আজ যদি টিস্যু না দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে আমার চোখের পানিটা মুছে দিত, আমি বেশি খুশি হতাম। কিন্তু ও তা করল না। অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড থেকে এসেছে বলেই কি ওদের মধ্যে স্পর্শের কোন অনুভূতি কাজ করে না? নাকি ইচ্ছেটাকে ও দমন করে রাখে?
“ঋতু, আজ আপনার জন্মদিন। আমি চাই, আপনি আজকের দিনে আপনার অতীতের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হন। আপনি যেটাকে বিচ্ছেদ ভাবছেন সেটা আসলে কোন বিচ্ছেদ না, কোন লস না, সেটা আসলে আপনার মুক্তি, আপনার সৌভাগ্য। মুক্তিটাকে সেলিব্রেট করতে শেখেন।”
আজকে আর আগের দিনের মত অসহায় লাগল না। শান্ত মনে ওর কথা শুনছিলাম। বললাম, “সেটা হয়তো আস্তে আস্তে মেনে নিতে পারব, কিন্তু ও শেষ দিনে অনেক উল্টা পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছে। আমার নামে অনেক মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে। ও বলে, আমি নাকি ওকে নিয়ে বন্ধুদের কাছে লজ্জা পেতাম, সম্পর্কটা আমিও নাকি ভাঙতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন শুধুমাত্র জেদের বশে ওকে ফেরত চাচ্ছি। আমরা নাকি ভীষণ অসুখী ছিলাম। অথচ, বিভু, আপনি জানেন কতশত সুখের স্মৃতি আমাদের আছে। বন্ধু হিসেবেও আমরা অনেক ভাল সময় কাটিয়েছি। স্বামী-স্ত্রী হিসেবেও দুজন দুজনকে সাপোর্ট দেওয়ার মত অনেক স্মৃতি আমাদের আছে। কিন্তু সেগুলো ও একটুও স্বীকার করছে না।”
“কেন স্বীকার করবে, ঋতু? স্বীকার করলে তো তার এই সিদ্ধান্তটার কোন ভিত্তিই সে দাঁড় করাতে পারবে না।”
“তবুও বিভু, যার সাথে এতগুলো বছর কাটিয়েছি তার মুখ থেকে মিথ্যে অপবাদ শুনতে খুব কষ্ট হয়। ও বলে, আমি নাকি সারক্ষণ বসের মত আচরণ করেছি ওর সাথে। ও নাকি অনেক চেষ্টা করেছে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভু, যে ছেলেটা কোনদিন আমার কাছে ফিরে আসে নি, সে এরকম অপবাদ কীভাবে দেয়? আমি সারাক্ষণ যার রাগের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম, সে কীভাবে আমাকে বস অপবাদ দেয়?”
“ঋতু, শোনেন। ভাড়াটে খুনীও নিজের অপরাধের পেছনে হাজারটা যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে। তাই বলে সেই খুন জায়েজ হয়ে যায় না। ঐ ছেলেটাও এখন তাই করছে। কিন্তু এসব ভেবে আপনার কী লাভ, বলেন তো? সে আপনার সম্পর্কে কি বলল, কী ভাবল- তাতে কি সত্যিই আর কিছু আসে যায়?”
“না।”
“তাহলে? ও যদি আপনাকে ছেড়ে না যেত, আপনি কোনদিন ওকে ছেড়ে যেতে পারতেন না। অথচ আপনাদের ভুল বোঝাবুঝিটাও কোনদিন মিটত না। কারণ যে আপনাকে তিন বছরে বোঝেনি, আপনার মূল্যায়ণ করতে পারে নি, সে সারা জীবনেও পারত না।”
“তাহলে এখন কী করতে বলেন? ওকে ক্ষমা করে দেব?”
“ভুলেও সে চেষ্টা করবেন না। কাওকে ক্ষমা করতে যাওয়া মানে নিজেকে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ ভাবা। আপনি তাকে ক্ষমা করার কে? সে আপনার সাথে সুখী হয় নি, তাই অন্যখানে থেকে সুখ খুঁজে নিচ্ছে। তাকে সুখী করার দায়িত্ব এখন আর আপনার না। এখন সেটা ওই মেয়েটার দায়িত্ব। অতএব, আপনি ওকে সিম্পলি নিজের মন থেকে বের করে দেন। সব রকম দায় থেকে রাতুল আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে। চেষ্টা করুন, ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার।”
চুপ করে থাকলাম। আজকে কথাগুলো মেনে নিতে কোন কষ্ট হল না। রাতুলকে এই মুহুর্তে পেলে সত্যি সত্যি একটা থ্যাংকস দিতাম।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১০:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



