somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ম্যাজিক ডায়েরি (পর্ব ২)

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৭ নভেম্বর, ২০১২
বাসায় এসে থেকে বিভুর জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু বিভু তো এল না। বেশ রাগ লাগছে।
ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলাম। দুই ভ্রুর মাঝখানে আবারো ব্যাথা করে উঠল। কিন্তু চোখ খুলে ওকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু এরকম তো ও করে না। যেদিন আসার কথা থাকে, সেদিন তো ও চলে আসে।
ও আচ্ছা! ও তো বলেনি যে আজ আসবে। তবু বারবার বিভুকে ডেকে আনার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে গিযে মাথাটা কেমন ফেটে যেতে চাচ্ছে!
অর্ধচেতন অবস্থায় বিভুর দ্বিতীয় দিনের আসার স্মৃতিটা মনে পড়ল। ততদিনে এক আইনজীবি বন্ধুর মারফত জেনেছি, রাতুল নাকি আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমি কদিন ধরে খুব কেঁদেছিলাম। কেমন যেন অস্থির লাগছিল। ওকে ভোলার জন্য তাড়াতাড়ি করে টিন এজ বয়সের একটা পুরনো ডায়েরি শেলফ থেকে বের করে নিয়েছিলাম। ঠিক তখনি বিভু হাজির।
চুপ করে আমার মুখোমুখি কিছুক্ষণ বসে থাকল।
“কী হয়েছে?” এমনভাবে জিজ্ঞেস করল যেন উত্তরটা আগে থেকেই জানে।
“বন্ধ দরজা ভেদ করে ঢুকে পড়তে পারেন আর কী হয়েছে সেটা বুঝতে পারেন না?”
“পারি তো। কিন্তু আমি তো জানার জন্য জিজ্ঞেস করি নি। বললে আপনারই মন হালকা হবে।।
“হবে না। আমি খুব কমপ্লিকেটেড চরিত্রের মেয়ে। কারো কাছে মনের কথা বললে আমার নিজেকে কেমন ছোট লাগতে থাকে। তার চাইতে আপনি বলেন তো, আপনি কোথায় থেকে এরকম মাটি ফুঁড়ে উদয় হন?”
“হুম, তাহলে তো বিরাট লেকচার দিতে হয়। শোনার ধৈর্য আছে?”
“বলেন, শুনি।”
“আপনার অবশ্য বুঝতে বেশি কষ্ট হবে না। কারণ আপনার তো প্লেটোর আইডিয়াল ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে পড়া আছে। ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম। আপনাদের এই পৃথিবীর বাইরেও আর একটা পৃথিবী আছে। বিশ্বাস করতে অনেকটা কষ্ট হবে কিন্তু একটু মন দিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবেন। আপনাদের এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ কল্পনাপ্রবণ। শিশুরা সবচাইতে বেশি। দেখবেন, ওরা একা একা কথা বলে, বাসার সোফাটাকে অনায়াসে গাড়ি কল্পনা করে সেটা নিয়ে খেলতে শুরু করে। ওদের ছোট্ট বারান্দাটাকে একটা জঙ্গল ভেবে বিভিন্ন রকম অভিযানে বের হয়। ওর সাথে থাকা বিভিন্ন খেলনা হাতি, ঘোড়া, আর পুতুলগুলো হয়ে যায় ওর কল্পনার বিভিন্ন চরিত্র। কেউ রাক্ষস, কেউ রাজকন্যা। ্ওর এইসব কার্যকলাপ বড়দের চোখে হাস্যকর, কিন্তু ওর কাছে ওটা একটা অন্য লেভেলের রিয়ালিটি।
এই পর্যন্ত বলতেই আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। “কিন্তু এর সাথে আপনার সম্পর্ক কী? আপনি কি বলতে চান, আপনি প্লেটোর আইডিয়াল ওয়ার্ল্ড থেকে এসেছেন?”
“না, অল্টারনেটিভ রিয়ালিটি থেকে এসেছি। এই পৃথিবীতে মানুষ অনেক কিছু কল্পনা করে। তার অজান্তেই এই কল্পনাগুলো অল্টারনেটিভ রিয়ালিটিতে কপি হয়ে যায়। আপনি সারাজীবন ধরে আমার মত একজন বন্ধু পেতে চেয়েছেন। কিন্তু আপনার মন বা বয়স কোনটাই তখন আমাকে গ্রহণ করার জন্য তৈরি ছিল না। আর যখনই আপনি আপনার পুরানো ডায়েরিটা ধরেন, আপনার মনের অজান্তেই আপনার মনের মধ্যে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়। মনে হয়, ডায়েরিতে যার কথা লিখেছিলাম, সে যদি সত্যি সত্যি থাকত!--- ”
“আর তাই আপনি আজ সত্যি সত্যি হাজির হয়ে গেলেন, তাই তো? কিন্তু এর আগেও তো আমি বহুবার ভেবেছি আপনার কথা। তখন কেন আসেন নি?”
“ঘা না খেলে মন পরিণত হয় না। আর আজকে চোখটা বন্ধ করে আপনি আপনার ‘ভেনা আমোরিস’-টা ডায়েরির ঠিক মাঝখানে রেখেছিলেন।”
“ভেনা আমোরিস আবার কী জিনিস?”
“আমাদের বাম হাতের অনামিকা আঙুল থেকে সরাসরি একটা ভেইন চলে গেছে হৃদপি- পর্যন্ত। রোমানরা এটাকে ভেনা আমোরিস বলে ডাকত। এই কারণেই বিয়ের আঙটি সবাই এই আঙুলে পরে। অবশ্য কারণটা না জেনেই পরে। তাই আজ ওই আঙুলটা ডায়েরির মাঝখানে-মানে আপনার টিনএজ বয়সের সেই ইমোশনগুলোকে ভেনা আমোরিস দিয়ে ছোাঁয়ার সাথে সাথে আপনার মনের আলফা লেভেলে সিগন্যাল চলে গেল। কারণ, প্রথমত, আপনার মন আজ আপনার সহ্যশক্তির সর্বোচ্চ সীমায় পেঁছে গিয়েছিল, দ্বিতীয়ত, ভেনা আমোরিস দিয়ে ডায়েরিটা ছুঁয়ে দিলেন। ব্যস সিগন্যাল অল্টারনেটিভ রিয়্যালিটিতে পৌঁছে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও হাজির।”
আমি অবাক হয়ে সেদিন ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিজের কল্পনাকে এত কাছে , চোখের সামনে দেখব কখনো ভাবি নি। এই জন্যেই কি ওর এরকম অদ্ভূত আবির্ভাব দেখেও আমার ভয় লাগে নি? আমার অবচেতন মন ওকে দেখে চিনতে পেরেছিল?

১৮ নভেম্বর, ২০১২
আজ বিভু এসেছে। আমার বাসার একটা ঘর এখন ওর হয়ে গেছে। যখনি আসে, ওই ঘরটায় থাকে। আমি বসে বসে ল্যাংগুয়েজ লেসনগুলো ঘষামাজা করছিলাম। ও পাশে বসে বসে দেখছিল, এটা ওটা মন্তব্য করছিল। ও পাশে না থাকলে কাজটা শেষ করতে পারতাম না। কখনো পরামর্শ দিয়ে, কখনো নিজেই একটা লেসন প্ল্যান করে আমার পুরো কাজটাকে ও-ই প্রায় শেষের পথে এনে দিয়েছে। তার বদলে অবশ্য ওকে খাওয়াতে হবে। ও আগেই বলে রেখেছে। আমাদের জগতে এলেই নাকি ওর ক্ষুধা লাগে।
সেই খাবারটাও আবার আমাকে নিজে হাতে বানাতে হবে। সেটাও আবার নতুন কিছু হতে হবে। কী আর করা! ওর আবদার মেটানোর জন্য বেশ কয়েকটা রান্নার বই কিনেছি। ছুটির দিনে ওইগুলো প্র্যাকটিস করতেই করতেই সময় কেটে যায়। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। ও কি সত্যই খাওয়ার জন্য এইরকম অদ্ভূত বায়না ধরেছে নাকি আমাকে ব্যস্ত রাখার একটা কৌশল এটা?
“প্রশ্নের উত্তরটা পেলেন?” হঠাৎই জিজ্ঞেস করে উঠল বিভু।
“কোন প্রশ্ন, ভুলতে চাওয়া না চাওয়া? কিন্তু সেটার উত্তর তো আপনি দেবেন বলেছিলেন।”
“না, আমি আপনাকে ভাবাতে চাচ্ছিলাম। একটু ঠা-া মাথায় না ভাবলে আপনার নিজের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হবে না।”
“আমি জানি আমি কী চাই।”
“তো, সেটা আমার সাথে শেয়ার করেন। আচ্ছা, ঠিক আছে, আগে বলেন, রাতুলকে কি আপনি আবার ফিরে পেতে চান?”
“অসম্ভব! সেটা কেন চা’ব? যে একবার আমাকে ছেড়ে অন্য কারোর কাছে যেতে পারে তাকে ফিরে চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি আসার আগে ওর জীবনে যাই হয়ে থাক, আমি ওর জীবনে থাকা অবস্থায় যদি কেউ ঢুকে পড়ে তাহলে সে ছেলেকে বিশ্বাস করা কোনভাবেই সম্ভব না।”
“সে-ও ফিরে আসছে না, আপনিও আর তাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছেন না। ব্যস, মিটে গেল। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
“ সমস্যাটা ওর হিপোক্রেসি নিয়ে। শেষ যেবার আমাদের ঝগড়া হল তখনই মাসখানেক পর থেকে আমার সিক্সথ সেন্স আমাকে বলছিল যে ওর জীবনে অন্য কেউ এসেছে। কেন জানি আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ওর কোন বন্ধুর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। ওর কোন রকম আপডেট পাওয়ারও কোন সুযোগ ছিল না। তবু কেন জানি মনে হয়েছিল যে, ওর জীবনে কেউ এসেছে। তবু চুপচাপ ওর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, যদি সত্যি সত্যি ওর সাথে আমার সম্পর্কটা টেকার হয়, তাহলে ও একবারের জন্যেও ফিরে আসবে। একটা ফোন করবে।”
“ সে তো ফোন করেছিল এবার। করে নি?”
“হ্যাঁ করেছিল। ফোন করে কী বলেছিল জানেন? বলেছিল, ‘ তোমার বন্ধুত্বটা আমি এখনো খুব মিস করি। আমরা চাইলে এখনো বন্ধু থাকতে পারি। এভাবে একা একা থেকো না। তুমি যদি চাও, আমি তোমার জন্য কাউকে খুঁজে দিতে পারি।’ সাথে সাথে আমার ওকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, ‘ ও, তাহলে তোমার নিজের কাজটা জায়েজ হয়, তাই তো?’ কিন্তু ও হজম করতে পারবে না বলে বলিনি। এর পরেও কয়েকবার আমি ওকে ফোন করেছি, ও আমাকে ফোন করেছে। কিন্তু প্রতিবারই ওকে খুব দূরের মানুষ বলে মনে হত। মনে মনে বুঝতাম, ও এখন অন্য কারোর হয়ে গেছে। তাই আমাকে এড়িয়ে চলতে চায়। হয়তো নতুন মানুষটার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য।”
“ এই ব্যাপারে সরাসরি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি?”
“সরাসরি জিজ্ঞেস করার আগেই আমি সবকিছু জেনে গিয়েছিলাম। এমনকি মেয়েটার নাম পর্যন্ত জানতাম। একটা ইরানী মেয়ে। এই দেশের একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও আমি চাইতাম, ও আমাকে সরাসরি বলুক। তাই অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, ‘তোমার কি নতুন গার্লফ্রে- হয়েছে?’ ও প্রশ্নটা শুনলেই কেমন যেন হয়ে যেত। অপ্রস্তুত ভাবটা ঢাকার জন্য কখনো হাসত, কখনো বলত, ‘সেটা জেনে কি লাভ হবে তোমার?’ আমি যদি আর একটু জোরাজুরি করতাম তখন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকত, তারপর বলত, ‘না, হয়নি।’ এই মিথ্যেটা আমাকে এখনো খুব কষ্ট দেয়। এরকম একটা মিথ্যাবাদী, কাপুরুষকে এতদিন ভালবেসেছি, এর পিছনে এতটা সময় নষ্ট করেছি মনে হলে নিজের প্রতি খুব বিরক্ত লাগে।”
“মিথ্যা বলার কারণটা কি এখন ধরতে পারেন?”
“ হয়তো ওর নতুন রিলেশনশিপটা তখনো প্রপোজালের সীমা ডিঙ্গিয়ে অফিসিয়ালি কনফার্মড হয় নি। সেই জন্য আগে থেকে বলতে চায় নি। কিন্তু মনে মনে ও যে মেয়েটার প্রতি সর্ম্পূণ ডেডিকেটেড হয়ে গেছে সেটা ওর হাবে ভাবেই বোঝা যেত। কিন্তু ওর নতুন আকর্ষণের কথা আমার কাছে স্বীকার করার সাহসটুকু ওর হয় নি। কিন্তু আমি এটুুকু সৎ সাহস ওর কাছ থেকে আশা করেছিলাম। যদি সত্যি সত্যিই ও আমাকে একফোঁটা চিনে থাকত, তাহলে কথাটা আমার কাছে স্বীকার করত। এইটুকু রেসপেক্ট আমাকে দিত। শেষ যে দিন দেখা হল সেদিনও বলল, আমিই নাকি ওর বেষ্ট ফ্রেণ্ড। ও আমাকে বন্ধু হিসেবে সারাজীবন মনে রাখবে। আমি যদি এভাবে ভেঙ্গে না পড়তাম, তাহলে নাকি ও এখনো আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখত। কতখানি হাস্যকর কথা একবার ভেবে দেখেছেন?”
বিভু হা হা করে হেসে উঠল। “ব্যাপারটা কেমন হল আমি বলি। হাইজ্যাকার সব কিছু কেড়ে নিয়ে যদি বলে, ‘কিপ ইন টাচ।’- এই কথা শুনলে যেমন লাগবে আপনারও ঠিক তেমন লেগেছে।”
আমারও হাসি এসে গেল। বিভু এই জগতের মেটাফরগুলো এত মোক্ষম জায়গায় ব্যবহার করে যে, না হেসে পারা যায় না।
“আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় যে আপনার প্রতি ওর এখনো কোন আকর্ষণ আছে?”
“আরে না! আগেও আমার প্রতি ওর খুব একটা আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু ও একা থাকতে পারত না। সেই সময় অন্য কোন মেয়ে বন্ধু ওকে এত সময় দিচ্ছিল না। আমি তখন নতুন ছিলাম ওর কাছে। আমার কাছে ওর আগের রিলেশনশিপটা নিয়ে ইচ্ছেমত কাঁদুনি গাইতে পারত। অন্য কারোর তো এত ধৈর্য ছিল না ওইসব প্যাঁচাল শোনার। কিন্তু আমি শুনতাম। ওর একাকীত্ব আমাকে খুব ছুঁযে যেত। ভাবতাম, ও-ও আমার মত শুদ্ধতাবাদী, আর দশজন ছেলের মত বহুগামী নয়। ওর প্রথম প্রেমের খুঁটিনাটি বর্ণনা আমাকে শোনাত, ওর ওই ইমোশনগুলো আমার কাছে খুব পবিত্র মনে হত। কিন্তু ও আসলে আমাকে আমার কাছে ওর সমস্ত দু:খ কষ্টের কথা বলতে পারত, তাই, নি:সঙ্গতা কমানোর একটা হাতিয়ার হিসেবে এতদিন আমাকে ব্যবহার করে গেছে। সেইজন্য, প্রতিবার ঝগড়ার পর শুধু আমিই ওর কাছে ফিরে গেছি। ও কিন্তু একবারের জন্যও ফিরে আসে নি। এতেই তো স্পষ্ট যে, আমি ওর জীবনে জাস্ট একটা অপশন ছিলাম, কোন ডেসপারেট নিড ছিলাম না। আর এবার ঝগড়ার পর যেই পছন্দসই একটা মেয়েকে পেয়ে গেল, ওমনি আমাকে দূরে সরিয়ে দিল।
“তাহলে আপনি ওকে আপনার জীবনে এতখানি জায়গা দিতে গেলেন কেন?”
“ওর যখন মন ভাল থাকত, তখন ও আমাকে খুব ভালবাসত। খুব ইমোশনাল হয়ে যেত। একবার জ্বরের ঘোরে আমাকে খুব কাকুতি-মিনতি করে বলেছিল, ‘কখনো যদি আমি খুব অভিমান করে থাকি, তবু তুমি যেন আমাকে ভুল বুঝ না, আমাকে আবার ফিরিয়ে নিও, আমার কাছে ফিরে এস।’ আমি সেদিন ওকে কথা দিয়েছিলাম। আর তাই শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছি ওকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কারণ আমার মনে হত, পৃথিবীতে একটা অন্তত এমন মানুষ আছে যার জীবনে আমি অপরিহার্য, ইররেপ্লেসিবল। কিন্তু যেই বুঝতে পারলাম যে, আমি যে কোন মুহুর্তে যে কারোর দ্বারা রিপ্লেসড হয়ে যেতে পারি, সেই মুহুর্ত থেকে মোহটা ভেঙ্গে গেল।”
গলার কাছে কেমন যেন একটা বিশ্রী দলা পাকাতে লাগল। ভয় হল, বিভুর সামনেই কেঁদে ফেলব না তো? কান্না আড়াল করার জন্য বিভুর দিক থেকে একটু ঘুরে বসলাম। ভান করলাম যেন ওপাশে প্রিণ্ট করে রাখা লেসনগুলো চেক করার জন্য এবার আমাকে বাধ্য হয়ে ঘুরে বসতে হয়েছে।
“একটা প্রশ্ন করি, খুব ভেবে উত্তর দেবেন। কোনটা ভেবে বেশি কষ্ট হয়? ওকে আর পাবেন না বলে নাকি ওর জীবনে নতুন কেউ এসেছে বলে?”
“দুটোর কোনটাই না। একটা সম্পর্ককে যে পুরনো জামাকাপড়ের মত বদলে ফেলতে পারে, তাকে পেতে চাওয়ার কোন মানে হয় না। আর, ওর নতুন রিলেশনশিপ হওয়াতে আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। আমি নিজেও চাচ্ছিলাম, এটা হোক। কারণ রিলেশনশিপ না হলে, শত তিক্ততার পরেও এখনো আমার ভেতরে ওর জন্য একরকম দায়বদ্ধতা কাজ করত। মনে হত, ও হয়ত ঠিকমত খায় নি। হয়তো আবার জ্বর এসেছে। ওর খুব ঘন ঘন জ্বর আসত। একা একা আছে, দেখাশোনা করার জন্য কেউ আছে কীনা- এরকম হাজারটা টেনশন ভিড় করত। এখন ওই দায়টা থেকে আমি মুক্ত।”
“ওর বাড়িতে কেউ নেই?”
“ওর বাবা-মা চিটাগাংয়ে থাকে। ও আর ওর ছোট ভাই ঢাকায় থাকে।”
“বিয়ের পর আপনারা কোথায় ছিলেন?”
“কখনো কখনো আমার সাথে আমার বাসায় থাকত। মাঝে মাঝে ওর ভাইয়ের কাছে গিয়ে থেকে আসত।”
“আপনাদের বিয়ের কথা কে কে জানত?”
“দুজনের কেউ-ই মা-বাবাকে বলি নি। আসলে আমি চেয়েছিলাম দুজনেই ঠিকমত নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়েটা করব। কিন্তু ও কিছুদিন এমন অসুস্থ হয়ে যেতে লাগল যে ওর দেখাশোনা করার জন্যই হুট করে বিয়েটা করে ফেললাম। কিন্তু মা-বাবার কানে যাতে না যায় সেজন্য আমি আমার কোন বন্ধুর কাছেও একথা বলি নি। কেন যে কাউকে বলি নি সেটা কিন্তু ও-ও জানত। আর ওর সাথে পরিচয় হওয়ার পরে অন্য সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলাম। ও ছাড়া আমার আর কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে সময় ছিল না। কিন্তু এখন ও আমার নামে কী বলে জানেন? আমি নাকি ওর পরিচয় দিতে লজ্জা পেতাম বলে কারোর কাছে ওর কথা বলি নি! এতদিনে এ-ই চিনেছে ও আমাকে?”
কান্না আর সামলাতে পারলাম না। বাঁধ ভেঙে সব কষ্ট যেন বের হয়ে আসতে লাগল। গলা আটকে গেল। কথা বলার জন্য মুখটা যে-ই খুলতে যাচ্ছি, গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। ভাগ্যিস, তা-ও মুখটা একদিকে ফেরানো। বিভু আমাকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে না।
ওপাশে বসে বসেই বিভু এবার একটা টিস্যু বাড়িয়ে দিল। বুঝলাম, মুখ ফিরিয়েও কোন কাজ হয় নি। মুখ ঢাকলেও, কণ্ঠস্বর তো আর ঢেকে রাখতে পারছি না।
“আমি বুঝতাম যে ও আমার সাথে একেবারেই সুখী ছিল না। সব ছেলের কল্পনায় একটা নরম নরম, কোমল কোমল গার্লফ্রেন্ডের প্রত্যাশা থাকে। আমি তো সেরকম না। আমার সাজগোজের কোন সেন্স নেই। রুক্ষ, পুরুষালি ধরণের একটা মেয়ে। আমাকে নিয়ে যদি কোন বন্ধুর কাছে গার্লফ্রে- হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়, তাহলে তারা আড়ালে হাসবে। আমার আরো একটা সমস্যা ছিল, আমি নতুন মানুষের সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না। ওর সাথে যত বকবক করে কথা বলতাম, ওর বন্ধুদের সাথে পারতাম না। অনেক মানুষের মধ্যে গেলে নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগত। এটা নিয়ে ওর মনে মনে একটু আফসোস ছিল। আমি বুঝতে পারতাম। ওকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি এই কথা। কিন্তু ও সে কথা স্বীকার করত না। বলত, তুমি যেরকম, সেরকমই থাকো। আমি তোমাকে তোমার মত করে ভালবাসি। সেসব যে কত বড় মিথ্যা সেটা এখন বুঝি।”
বিভু আবার একটা টিস্যু এগিয়ে দিল।
জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, যার সাথে রিলেশন হয়েছে তার উপর কি আপনার রাগ হয়?”
“নাহ, তার উপর কেন রাগ হতে যাবে? সে বেচারীর তো এখানে কিছু করার নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ও মেয়েটার কাছে সব কিছু চেপে গেছে। এমনকি যদি মেয়েটা জেনেও থাকে, তবু আমি মেয়েটার কোন দোষ দেব না। কারণ সম্পর্কটা আমার রাতুলের সাথে, মেয়েটার সাথে না। রাতুলই যদি বিশ্বস্ত না থাকে, তাহলে মেয়েটার কি গরজ আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার?”
“হমম্, একটা কথা স্পষ্ট যে, দুজনের কেউই সুখী ছিলেন না। তাই হয়তো ছেলেটা চলে গেছে। সুখী হওয়ার অধিকার তো সবারই আছে, তাই না?”
“খুবই খোঁড়া যুক্তি। পৃথিবীর সমস্ত বহুগামী, অস্থিরচিত্ত মানুষ এই যুক্তিটাই দেখাবে। সুখে থাকার অধিকার তো আমারও ছিল। কই, আমি তো ওকে ছেড়ে সুখের পিছনে ছুটি নি? আমার সামনেরও তো অনেক অপশন ছিল! তবু, আমি তো ধৈর্য ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম? ভেবেছিলাম, ওর অফিসের চাপটা কমলে ও ফিরে আসবে, তখন আমরা আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে বসব। সবচেয়ে রুচিহীন ছিল ওর শেষ কথাটা। ও বলেছে, ‘আমি নাকি অনেক দেরি করে ফেলেছি ওর কাছে ফিরে আসতে।’ তার মানে ফিরে আসার ঠেকা শুধু আমার। ওর কোন দায়িত্ব নেই সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখার। আচ্ছা, বিভু, আমাদের মা-বাবার সবকিছু কি আমাদের ভাল লাগে? তারপরও কি সেসব মেনে নিয়ে আমরা তাদের সাথে থাকছি না? সন্তানের সব কিছুই কি মা-বাবার ভাল লাগে? কই, মা-বাবা তো সুখে থাকার জন্য সন্তানকে ত্যাগ করে না? আপনি হয়তো বলবেন যে, ওগুলোর সাথে প্রেমের তুলনা চলে না। কিন্তু ও যে আমাকে বারবার করে শুধু বলত, আমি নাকি ওর জীবনে সবচেয়ে বেশি দামী। আমাকে ও সবকিছুর চাইতে বেশি ভালবাসে? এই সব কথা তাহলে মিথ্যা ছিল? শুধুমাত্র প্রেম জমানোর জন্য ও এতগুলো মিথ্যা কথা আমাকে বলে গেছে? আমার একটাই দুঃখ, বিভু, যদি ছেড়েই যাবে, আগে কেন যায় নি? আমার সমস্ত দোষ তো ও আগে থেকেই জানত। কেন আমার জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করে দিল? আমি তো ওর কোন ক্ষতি--”
আর কথা বলতে পারলাম না। কথা বলার সমস্ত শক্তি নি:শেষ হয়ে গেছে। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কাঁদতে থাকলাম। বিভু আবার আরেকটা টিস্যু এগিয়ে দিল। কেমন অসহ্য লাগল এবার ব্যাপারটা। ও তো বুঝতেই পারছে, আমি কাঁদছি। শুধু রোবটের মত তখন থেকে একটা করে প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর টিস্যু দিয়ে যাচ্ছে। ওর কি আর কিচ্ছু করার নেই? অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ডের মানুষগুলোর কি অনুভ’তি বলে কিচ্ছু নেই?
মুখ ফিরিয়ে বিভুর দিকে তাকালাম। দেখলাম, ওর কোলের উপর ব্যবহৃত টিস্যুর একরাশ স্তুপ। বুঝলাম, আমার টিস্যুবক্স এতক্ষণ দু’জোড়া চোখকে সার্ভিস দিয়ে গেছে।
মুখ নিচু করে বসে থাকলাম। হাতের টিস্যুটা ফেলে দিলাম। সমস্ত লজ্জা-দ্বিধা-ভয় ভুলে মনটা উজাড় করে কাঁদতে লাগলাম।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৯
৯টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×