এই যে ভাইয়া নিন সেই ডাইরি।
তার মানে তুই বলতে চাস সত্যি সত্যিই তোর কাছে ইবলিশ এসেছিল?
আমি কিছু বলতে চাইনা। আপনি ডাইরিটা পড়ে দেখেন। আপনার কাছে যদি মনে হয় মনগড়া, তবে আমার কিছু করার নেই।
এই ছিল জাহানের সাথে আমার শেষ কথা। এরপর ও আর আমার কাছে কখনও আসে নি। শুনেছিলাম স্কলারশিপ পেয়ে গতবছর নাকি নিউইয়র্ক চলে গেছে । আমার মন বলছিল- শিক্ষা দিক্ষা কিছু নয়, ও গিয়েছে শয়তানের ওপর উচ্চতর ডিগ্রী আনতে।
জাহান আমার গীটারএর ছাত্র। প্রচুর খ্যাপাটে স্বভাবের। লম্বায় প্রায় ছয় ফুট, হেংলা পাতলা গরন, মুখ ভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এমনিতে কথা খুব কম বলে। কিন্তু একবার যদি বলতে শুরু করে তবে আর থামার নাম নেই।
প্রথম থেকেই ওর আচার আচরণে আমি খুব বিরক্ত বোধ হতাম। নানা রকম উদ্ভট কথা বলতো ও। আমি যে জাহানকে খুব বেশী পছন্দ করিনা সেটা আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েও দিতাম। কিন্তু কেন যেন সে সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করত। একবার ও আমাকে বলল-ভাইয়া আমাকে শয়তানিক সংগীত সিখিয়ে দেন।
আমি বললাম শয়তানিক সংগীত আবার কি!
যেই সংগীত শুনলে শয়তান এসে হাজির হয়।
শয়তানকে হাজির করে তুই কি করবি?
শয়তানের ধর্ম গ্রহন করব।
সেদিন ই বুঝেছিলাম ছেলেটার মাথায় গণ্ডগোল আছে। মিনিটে দশবার শয়তান শয়তান করে। শয়তান নাকি তার প্রভু, শয়তান নাকি তার মুক্তিদাতা!আমি একদিন তাকে দুষ্টুমি করে বলেছিলাম- তুই যে এত শয়তান শয়তান করিস, পারলে আমাকে একটা শয়তানের ওপর সাক্ষাতকার এনে দিস।
ওর দেওয়া ডাইরিটা আমি ফেলে রেখেছিলাম ড্রয়ারে। আজ যখন মোহিতের কাছে জানলাম জাহান আর পৃথিবীতে নেই, তখন কেমন যেন বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল। একবার ভাবলাম –আমি তো ইচ্ছা করলেই পারতাম ওকে সুস্থ স্বাভাবিক সৎ জীবনে ফিরিয়ে আনতে। তাহলে হয়তো ওর এ ভাবে মরতেও হতনা। কিন্তু এই নিষ্ঠুর শহরে আমরা এতবেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছি যে, অন্য মানুষ তো দুরের কথা নিজেদের জন্যও এত টুকু সময় আমাদের নেই!
ডাইরির রঙটা কালো। দেখেই বোঝা যায় অনেক পুরনো আমলের ডাইরি। ডাইরির পাতা গুল ও পানি পানি ধাঁচের, না দেখলে ঠিক বোঝা যায় না। একে বারে কাছে এসে তাকালে আয়নার মত নিজের চেহারাও দ্যাখা যায়। এ রকম অদ্ভুত ডাইরি আমি জীবনেও দেখিনি।
আমরা সাধারনত ডাইরির প্রথম থেকে লেখা শুরু করি। কিন্তু এখানে প্রথম থেকে লেখা শুরু হয় নি। শুরু হয়েছে মাঝ খান থেকে এবং উলটোভাবে! লেখার দিকে চোখ পরতেই আমি বিস্মিত হলাম। ছেলেটা এমনিতে যাই হোক, হাতের লেখা মারাত্মক সুন্দর। জাহান নিজের প্রতিভার প্রতি অবিচার করেছে বলে আমি মনে মনে আবারো আক্ষেপ করলাম এবং ডাইরিটা উল্টো করে ধরে পড়া শুরু করলাম!
লাল কালিতে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা-
১৩ই ফেব্রুয়ারী, ২০১২।
শয়তানের বিশেষ সাক্ষাতকারঃ
প্রশ্ন- আমি শুনেছিলাম আপনার চেহারা তিব্র ভয়ংকর। কালো কালো লোমশ শরীর, কুৎসিত হাসি আর বীভৎস দৃষ্টিতে ভয়াবহ আপনার অবয়ব। কিন্তু বাস্তবে দেখছি আপনি সম্পুন্ন তার বিপরীত! ব্যাপার টা আমার কাছে একটু কনফিউজিং! খুলে বলবেন কি?
উত্তর- ব্যাপার টা আসলে টেকনিক্যাল। তোমাকে বুঝতে হবে আমার যদি কাউ কে ম্যানেজ করতেই হয়, তবে অবশ্যই তার কছে আমার সব কিছু খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কাও কে যদি প্রথম দেখাতেই তোমার ভাল না লাগে, তবে তার কথা তুমি কেন শুনবে তাই না?
প্রশ্ন- আপনি এটা তোঁ বিশ্বাস করেন যে আপনার কর্মসীমা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বেধে দেওয়া? অর্থাৎ পৃথিবী ধ্বংসের দিনও আপনার চূড়ান্ত ধংশ অনিবার্য।
হ্যাঁ আমি এটা স্বীকার করি। কিন্তু তোমাকেও বিশ্বাস করতে হবে যে, আমি অসীম মেধাবী এবং ক্ষমতাধর বলেই পৃথিবীর একটা বিশাল অংশ এখনও সফল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি। আমার দিঢ় বিশ্বাস, সময় সীমা পার হবার আগেই আমি স্রস্টা কে পরাজিত করতে সক্ষম হব এবং তার হাত থেকে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ পুরো পুরি ছিনিয়ে নিয়ে নিজের অধি-পত্ত প্রতিষ্ঠা করব।
প্রশ্ন- এটা কি অদৌ সম্ভব!
হ্যাঁ এটা অনেক ভাবেই সম্ভব এন্ড আই এম ওয়ার্কিং অন ইট। অলরেডি আমার অনুসারীদের আমি অমরত্তের গোপন রহস্য জানিয়ে দিয়েছি। এমন কি পৃথিবী যদি কখনও ধ্বংস ও হয়ে যায়, তবে আমারা আমাদের বিকল্প আবাসও খুজে রেখেছি। এই ব্যাপারে মানুষ অনেক এগিয়ে গেছে। আশা করি, আমি আমার মত অমর হব, তারা তাদের মত অমর হবে। কিন্তু তারপরও যদি আমরা টোটাল টিম ব্যার্থ হই, তবে ভেবে নেব এ ছিল আমাদের নিয়তি।
প্রশ্ন- আপনি কি তখন আপনার নিয়তির জন্য নিজে কে দোষারোপ করবেন না?
উত্তর- প্রশ্নই আসেনা। আমি তোঁ স্রষ্টাকে বলিনি আমার ভেতর নেতিবাচক চিন্তা দাও। আমি তো স্রষ্টাকে বলিনি আমাকে সৃষ্টি করো। তাহলে যেই জীবন আমি নিজে চেয়ে আনিনি সেই জীবনের দায় ভার কেন আমি নেব? সবচে বড় কথা আমি যদি ইবলিশ হই, তবে তিনিও কিন্তু কোন না কোন ভাবে আমার সৃষ্টিকর্তা।
প্রশ্ন- তার মানে আপনি নিজেও স্রষ্টার ওপর বিশ্বাসী। অর্থাৎ আপনি নাস্তিক নন?
ইয়েস, আমি স্রষ্টার ওপর বিশ্বাসী এবং আমি নাস্তিক নই। তবে নাস্তিকদের ব্যাপারে আমার কিছু চিন্তা ভাবনা আছে। তা হোল- স্রষ্টাও নাস্তিক অপছন্দ করে, আবার আমিও করি। তুমি লক্ষ করবে, যে স্রস্টা বিশ্বাস করবেনা সে কিন্তু ইবলিশও বিশ্বাস করবেনা। আর কেও যদি আমাকে নাই বিশ্বাস করে তবে তার পিছনে শ্রম দেওয়া বৃথা বৈকি! সো এই গর্দভ শ্রেণীর সাথে নরকে আমার একটা দীর্ঘ সময় থাকতে হবে , এ জন্য আমি লজ্জিত।
প্রশ্ন- এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। কাল বিশ্ব ভালবাসা দিবস। আপনার সারা দিনের পরিকল্পনা কি!
উত্তর- পরিকল্পনা একটাই। কাল আমি সারাদিন বিশ্ব ঘৃণা দিবস পালন করব।। আশা করি, বছরের যে কোনো দিনের তুলনায় এই দিনটি তে মানুষের অপরাধের সংখ্যা বাড়বে।
প্রশ্ন- এবার আমি জানতে চাইবো, আপনার কাছে সবচে প্রিয় অপরাধ কোনটা?
ভাল একটা প্রশ্ন। অনেকেই মনে করে আমার প্রিয় অপরাধ খুন কিংবা আত্মহত্যা এ রকম কিছু হবে। কিন্তু তুমি শুনলে অবাক হবে আমার কাছে এসব অপরাধ খুব ই নগণ্য! এর চে একটি বালক কিংবা বালিকা কে যখন আমি বিদ্যা শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দুষ্টমির দিকে ধাবিত করি, তখন আমার মনে হয়, ইট ওয়াজ এ গ্রেট যব। কারন একটা মৃত্যু মানে একটা জীবনের পরিসমাপ্তি অর্থাৎ তুমি তার কাছ থেকে আর কিছুই আশা করতে পারনা। কিন্তু যখন তুমি একটা শিশু কে শিক্ষা থেকে দূরে সরাতে সক্ষম হবে, তার মানে হচ্ছে একটা জেনারেশন কে তুমি খুন করে ফেললে।
দারুন বলেছেন।সত্যি ই আপনি বুদ্ধিমান এবং প্রখর জ্ঞান সম্পন্ন। আচ্ছা, মৃত্যু সম্পর্কেও কি আপনার কোন নিজস্ব চিন্তা আছে?
উত্তর- আসলে মৃত্যুর কথা ভেবে আমার যে একে বারেই খারাপ লাগেনা তা নয়। কিন্তু যখন ই অন্যদের মৃত্যুর কথা ভাবি তখনই আবার দারুন আনন্দিত বোধ করি। আমার মতে, যখন একটি মানুষ প্রচণ্ড মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে,সেই দৃশের চে উপভোগ্য দৃশ্য পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় টি নেই।
প্রশ্ন- আমি প্রশ্নের প্রায় শেষের দিকে এসে গেছি। এ অবস্থায় অনুরোধ করব, যারা আপনার পুজারি তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
দ্যাখো যেখানে স্রস্টার অনুসারীদের প্রতি নিরদেরশনার জন্য একাধিক আসমানী কিতাব রয়েছে, সেখানে আমার অনুসারীদের জন্য আমার এক পৃষ্ঠাও সংযোজন করতে হয়নি। কেন জানো? কজ দে নো, হোয়াট দে হ্যাঁভ টু ডু। সবচে মজার ব্যাপার হোল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে তারা আমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। অতএব ওদের আমি পুরুষকৃত করব।
আপনাকে ছাড়িয়ে গেছে! সেটা কেমন?
তোমাকে একটা উদাহারন দিয়ে বলি। একবার এক মহিলা কে আমি প্ররোচনা দিলাম- আমার সন্তুষ্টির জন্য তুমি তোমার সাত মাস বয়সের কন্যা শিশুটি কে হত্যা করো। তখন সেই মহিলা তার কন্যা শিশুটিকে শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হোল না বরং সেই মৃত শিশুর মাংস সয়াবিন তেল দিয়ে রান্না করে ভক্ষন করলো। এই ঘটনায় আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম!
মাই গড!
সর্বশেষ প্রশ্ন। আমি জানতে চাইবো আপনার শেষ ইচ্ছা কি?
আমাকে নরকে না ছুঁড়ে স্রস্টা যেন আমাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দ্যায়।
এই পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে পড়ে আমি মনের অজান্তেই নাউজুবিল্লাহ বলে উঠলাম। একবার ভাবলাম এ আমি কেন পড়লাম! পরে ভাবলাম, এর একটি ভাল দিকও রয়েছে। শত্রুকে প্রতিরোধ করার সবচে সেরা উপায় হোল- শত্রু সম্পর্কে ভাল করে জানা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৫৮