somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তারা ও দোলনচাঁপার গল্প ( দুই পর্ব একসাথে)

০৩ রা জুন, ২০১১ রাত ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছি। এমন সময় কলিং বেল বাজলো। উঠতে একদম ইচ্ছা করছে না। কিন্তু আম্মু ঘুমিয়ে আছে। আমাকেই খুলতে হবে দরজা। অগত্যা বিছানা থেকে নামলাম। আই হোল দিয়ে দেখি তারা দাঁড়িয়ে আছে।অনেক অবাক হলাম। তারা দোতালায় থাকে আর আমরা চার তালায়। তারারা এখানে বাসা নিয়েছে খুব বেশী দিন হয় নি। সাত কি আট মাস হবে। এমনিতে সিঁড়িতে উঠতে – নামতে, ছাদে অনেক বার দেখা হয়েছে। অনেক কথাও হয়েছে। কিন্তু কখনও বাসায় আসে নি। আজ হঠাৎ? যাই হোক। দরজা খুললাম। তারা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “ আপু, আপনি বাসায়? !!আমিতো ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ভেবেছি আপনাকে পাব না।“

তারা মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দরী।এই বছর এইচ. এস . সি পরীক্ষা দেবে। ওকে এক নজর দেখার জন্যই বিকেল হলেই আমাদের পাড়ায় ছেলেদের আনাগুনা বেড়ে যায়। সাধারণত সুন্দরী মেয়েরা বেশ অহংকারী হয়। কিন্তু তারার মধ্যে এই রকম কোন ব্যাপার সেপার নেই। তাই বেশ ভালো লাগে। আমি মুখে বড় একটা হাসি দিয়ে বললাম,
“ হুম। আজ মাত্র একটা ক্লাস ছিল। তারপর এক ঘণ্টার মতো ঘুরাঘুরি করে বাসায় চলে এসেছি ।কি ব্যাপার, তারা!! আজকে হঠাৎ কি মনে করে? তুমি তো কখনও বাসায় আসো নি। তাই এত কিছু জিজ্ঞেস করছি। আসো আসো, ভেতরে আসো।“ তারা কে আমার রুমে নিয়ে আসলাম। তারা বসতে বসতে বলল, “ আপু, আপনার সাথে বেশ কয়েকদিন কথা হয় না। ছাদে ও রেগুলার আসেন না। আজকে আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল। তাই সোজা বাসায় চলে আসলাম। আমি বললাম, “ ভালো করেছো। তুমি না আসলে কিছুক্ষণ পর আমি নিজেই ছাদে যেতাম।“ “ আপু ,আপনি আজ অনেক খুশি খুশি। ঘটনা কি?” বলে তারা চোখ নাচাল।


“দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি “বলে খাট থেকে নেমে টেবিলের উপর রাখা দোলনচাঁপা ফুল গুলো নিয়ে আসলাম। “ দেখো তো, ফুল গুলো অনেক সুন্দর না!!! আজকে একজন দিয়েছে! এখন প্রশ্ন করো না যে কে দিয়েছে! আমি সেই কবে বলেছিলাম যে দোলন চাপা আমার ভালো লাগে। এটা এখনও তার মনে আছে।যখন আমার হাতে ফুল গুলো দিল তখন আমি এত অবাক হয়েছিলাম যে খুশির চোটে কিছুই বলতে পারি নি। অথচ বাসায় আসার পর থেকে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলা দরকার। যাই বল, আমি আজ অনেক খুশি”। এই কথা গুলো হড়বড় করে তারা কে বলার পর তারার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সেই হাসি মুখের উপর যেন ঝড় বয়ে গেছে। মুখটা কেমন জানি রাগী রাগী হয়ে গেছে। ও এক দৃষ্টিতে দোলনচাঁপা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এতক্ষণ যা বলেছি তার কিছুই যেন তারার কানে যায় নি। আমি তারাকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বললাম, “ কি হয়েছে?” তারা কেমন জানি একটা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ দোলনচাঁপা গুলো মোটেও সুন্দর না। আমি এই ফুল ঘৃণা করি” । আমি অনেক অবাক হয়ে বললাম,” কি আবোল তাবোল বলছ, তারা!! দোলনচাঁপার মতো সুন্দর ফুল খুব কমই আছে। কিন্তু তুমি এই ফুল ঘৃণা করো কেন? “ হঠা ৎ দেখি তারার চোখে পানি। ছল ছল করছে। নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। তারা মেয়েটাকে আমি অনেক শক্ত টাইপের মেয়ে হিসেবে জানি। চোখে পানি দেখে আমার অনেক মন খারাপ হল। আমি কিছু বললাম না। যেন কিছুই হয় নি এমন একটা ভাব নিয়ে তারা কে বললাম, “ আচ্ছা, বাদ দাও। আমি দুই কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি। তারপর চা খেতে খেতে গল্প করবো। অনেক গল্প জমে আছে।“ কথাটা বলেই কিচেনের দিকে হাঁটা ধরলাম। কিছুটা সময় নিয়ে চা বানালাম। তারপর রুমে এসে দেখি তারা দোলনচাঁপা গুলির দিকে তাকিয়ে আছে। তারা এখনও স্বাভাবিক হয় নি দেখে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এক কাপ চা তারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “ নাও, চা খাও। চা খেতে কেমন হয়েছে? তোমার ফাইনাল পরীক্ষা কবে থেকে শুরু? রুটিন কি এখনও পেপারে আসে নি?“

কিন্তু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে তারা বলল, “ আপু, আমি মনে হয় আপনার মন খারাপ করে দিয়েছি। কিন্তু সেটা ইচ্ছা করে করি নি। আসলে দোলনচাঁপা দেখলেই আমার আগের কথা মনে পড়ে। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। সিলেটে থাকতাম তখন। তখনকার ঘটনা। ক্লাস সেভেনে পড়তাম । সেই ছোট্ট বয়সে দোলনচাঁপা আমার জীবনে বিভীষিকা হয়ে এসেছিল! আম্মু সিলেটে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে আমরা সরকারি কলোনিতে থাকতাম। আমার জন্ম ও হয় সেই কলোনিতে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমি সেখানে কাটিয়েছি। আমরা মানে আম্মু, আমি আর ভাইয়া। আর আব্বুকে ঢাকায় থাকতে হতো কারণ উনার পোস্টিং ছিল সেখানে। কিন্তু আব্বু প্রতি বৃহস্পতি বার আসতেন। কখনও সেটা মিস হয় নি। শুক্রবার ভোর রাতে আবার ঢাকায় চলে যেতেন। এইভাবে চলছিল। ওখানে থাকাকালীন সময়ে আমার প্রধান কাজ ছিল পুরা কলোনিতে সারাদিন চক্কর দেয়া, দৌড়ঝাঁপ করা, গাছে উঠা, রান্না বাটি খেলা, ক্রিকেট খেলা ইত্যাদি। মাঝে মাঝে সারাদিন বাঁদরামি করতে না পারলেও বিকেল হলে আমাকে কেউ আটকিয়ে রাখতে পারতো না। এইসব কাজে আমার সঙ্গীর অভাব ছিল না!!এই গুলো করতে করতে আস্তে আস্তে আমি ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস সেভেনে উঠলাম। আর ভাইয়াও এস .এস. সি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করতে লাগলো।ঘটনার শুরু তখন থেকেই।

আমি যে স্কুলে পড়তাম সেটা ছিল গার্লস স্কুল। স্কুল শুরু হতো সকাল দশটায় আর শেষ হতো দুপুর তিনটায়। একদিন হঠাৎ ছুটির পর বাসায় ফেরার পথে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আমার পেছন পেছন কেউ আসছে। আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি একটা ছেলে। দেখতে বেশ বড় সরো। আমি তাকানোতে ছেলেটা খুব অদ্ভুত ভাবে হাসল। কেমন জানি একটু ভয় ভয় লাগছিল। আর রাস্তাটা ও খুব নির্জন ছিল। তো আমি ছেলেটাকে দেখে একটু তাড়াতাড়ি হাঁটা ধরলাম। ছেলেটাও সাথে সাথে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।প্রায় আমার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। এর আগে কখনও আমার সাথে এমন হয় নি। হঠাৎ ছেলেটা আমাকে ডাকল, “ এই, তারা। তোমার সাথে আমার কথা আছে।“ এই কথা শুনে আমার কেন জানি খুব ভয় লাগলো। আর আমি সাথে সাথে হাঁটা বাদ দিয়ে এক দৌড় দিলাম। ছেলেটাও একই কাজ করলো। পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো। এক দৌড়ে বাসার সামনে এসে যখন পৌঁছলাম তখন পেছনে ফিরে দেখি ছেলেটা আমাদের বাসার সামনের কড়ই গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে সেই বিশ্রী হাসি।

পরের দিন খুব ভয়ে ভয়ে স্কুলে গেলাম। কিন্তু কেউ ছিল না। আসার পথে ও কেউ ছিল না। মনে মনে অনেক খুশি হলাম যে আর ভয় পেতে হবে না। তারপর অনেক দিন ওই ছেলেটাকে দেখি নাই। আমিও সব ভুলে গেলাম। এর মধ্যে ভাইয়ার রেজাল্ট ও দিয়ে দিল। ভাইয়া অসাধারন রেজাল্ট করেছিল। এই কারণে আব্বু-আম্মু দুই জনই ঠিক করেছিল যে ভাইয়া কে আর এখানে রাখবে না। ঢাকায় ভালো কোন এক কলেজে ভর্তি করাবে। তো ভাইয়া ও ঢাকার খুব নামকরা এক কলেজে চান্স পেয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর আমাদের বাসা পুরা খালি খালি হয়ে গেল। আম্মু দশটা- চারটা অফিস করতো। আমার স্কুল ছুটি হতো তিনটায় আর বাসায় আসতে আসতে সোয়া তিনটা বেজে যেতো। চারটা পর্যন্ত আমি একা থাকতাম। আর দুপুরে কলোনি প্রায় নির্জন থাকতো। কারণ সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত থাকতো।

ভাইয়া যাওয়ার দুই কি তিন দিন পর স্কুলে যাওয়ার পথে আবারও সেই ছেলেটাকে দেখলাম। এবার ছেলেটা আমার পেছন পেছন আসে নি। স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমড়া খাচ্ছিল। আমি না দেখার ভান করে গট গট করে স্কুলে ঢুকে গেলাম। তারপর কোন ক্লাস এ আমার মন বসে নাই। ভয় ভয় লাগছিল। আসলে ছেলেটার চাহনিটাই এমন ছিল যে ভয় না লেগে যায় না। কেমন জানি একটা গুন্ডা গুন্ডা চেহারা। তারপর স্কুল ছুটির পর গেট থেকে বের হয়ে আশপাশটা একটু আড়চোখে দেখে নিলাম । কেউ নাই। দেখে অনেক শান্তি লাগছিল। কিন্তু পাঁচ মিনিট হাঁটার পর পরই দেখি যে ওই ছেলেটা এবং সাথে আরও কয়েকটা ছেলে আমার দিকে হেঁটে আসছে। আমি না দেখার ভান করে মাথা নিচু করে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ওরা কি যেন বলছিল। আমি ঠিকমতো শুনতে পাই নি। ওদের কে ক্রস করে যাওয়ার পর ওরা এবার আমার পেছন পেছন আসতে লাগলো।বাসার কাছাকাছি আসতেই আবার দৌড় দিলাম। এক দৌড়ে বাসায়। কোন মতে গেটের তালা খুলে বাসায় ঢুকলাম।কেউ না থাকলে আমাদের বাসার মেইন গেট তালাবদ্ধ থাকতো। কিন্তু সব রুমের জানালা গুলো খোলা থাকতো। কারণ কিছুক্ষণ পর সবাই চলে আসবে এই রকম ধারনা করে আমাদের বাসায় কেউ জানালা লাগাত না। তাছাড়া কলোনি হওয়াতে সবাই সবাইকে চিনতো। আর সেজন্যই বোধ হয় সবার বাসারই একই অবস্থা ছিল। কেউ দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে দরজা-জানলা বন্ধ করতো। তা না হলে জানালা সব খোলাই থাকতো। আর জানালা গুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল খুবই অদ্ভুত। প্রত্যেক রুমেই তিনটা- চারটা করে জানালা ছিল। আর জানালা গুলো ছিল ও প্রমাণ সাইজের। বাইরে থেকে ভেতরের সব কিছু দেখা যেতো। বাসায় ঢুকে আমার রুমে গিয়ে ব্যাগটা রাখলাম। তারপর পানি খেতে খেতে এমনিতেই খুব স্বাভাবিকভাবে বাইরের দিকে তাকালাম। কিন্তু যা দেখলাম তাতে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। ওই ছেলেটা এবং তার বন্ধুরা বাসার সামনে যে কড়ই গাছ ছিল সেখানে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি করে সব রুমের পর্দা নামালাম। তারপর ভয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর পর পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখছিলাম। গেল কিনা সেটা দেখার জন্য। এক সময় চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরই আম্মু আসে।

সেই থেকে শুরু হল। ছেলেটা স্কুলে যাওয়া-আসার পথে,বিকালে আমাদের বাসার সামনে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। আমিও বিরক্ত হয়ে বিকাল বেলা কলোনি চক্কর দেয়া বন্ধ করে দিলাম। আমি কাউকে কিছুই বলি নি। কারণ ব্যাপারটা একটু লজ্জার ছিল। আর সেই সময় আমার ভালো কোন বন্ধু ও ছিল না যে তার সাথে সেটা শেয়ার করবো। সবাই কি মনে করবে কে জানে। আর আম্মুকে বলার প্রশ্নই আসে না। কারণ আম্মুকে আমি তখন অনেক ভয় পেতাম। আমি অনেক দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম বলে আম্মু সারাক্ষণ আমাকে শাসনে রাখতেন। কিন্তু আম্মু এটা কখনই খেয়াল করেন নি যে আমি হঠাৎ করেই অনেক শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

একদিন আমি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড জ্বর। আম্মু আমাকে বলল স্কুলে না যেতে। আমি তো প্রচণ্ড খুশি। স্কুলে যেতে হবে না। অফিসে যাওয়ার সময় আম্মু আমাকে বলল যে আজকে ছুটি নিয়ে একটার দিকেই চলে আসতে চেষ্টা করবেন। আমি অনেক খুশি হলাম। আম্মু দশটায় চলে গেল। শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে আমি বোর হয়ে গেলাম। তখন প্রায় সাড়ে এগারোটার মতো বাজে। আমি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গেলাম। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম ওই ছেলে এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গ কড়ই গাছটার নিচে বসে বাসার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার হাতে দোলনচাঁপা আর মুখে বিশ্রী একটা হাসি। আমি দেখা মাত্র তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলাম। কিন্তু ওরা যে কিছুক্ষণ পর জানালা পর্যন্ত চলে আসবে সেটা বুঝি নি। দশ কি এগার মিনিট পর হঠাৎ শুনলাম কে জানি আমার নাম ধরে ডাকছে। ভালো করে শুনে দেখলাম একটা ছেলে কণ্ঠ।সব জানালার পর্দা নামানো ছিল। আমি একবার ভাবলাম সব গুলো জানালা লাগিয়ে দেই। কিন্তু মনে হল জানালা লাগাতে গিয়ে যদি দেখি ওরা জানালার সামনে। তখন কি হবে? প্রচণ্ড ভয় লাগছিল। আর ছেলে গুলা কিছুক্ষণ পর পর আমার নাম ধরে ডাকছিল। আমি তাড়াতাড়ি আমাদের ডাইনিং রুমে গেলাম। ওই রুমটা পেছনের দিকে ছিল। ওই রুমের সাথে ও বড় বড় জানালা। আমি তাড়াতাড়ি ওই রুমে গিয়ে জানালা গুলো আটকিয়ে ডাইনিং টেবিলের নিচে বসে রইলাম। কতক্ষণ ওই অবস্থায় ছিলাম জানি না। হঠাৎ শুনি কে জানি দরজা কড়া নাড়ছে। ডাইনিং রুমে বড় একটা দেয়াল ঘড়ি ছিল। তাকিয়ে দেখি তখনও একটাও বাজে নি। সোয়া বারোটার মতো বাজে। আমি দরজা খুলবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না।আম্মু বলেছিল একটার সময় আসবে।ওই সময় আম্মু আসার প্রস্নই আসে না। তাহলে বোধ হয় ওরাই। এই রকম আশঙ্কা করে আমি আর দরজা খুললাম না। প্রায় দশ- পনের মিনিট দরজা কড়া নেড়ে ওরা চলে গেল। আমি বারান্দায় গিয়ে দেখার ও চেষ্টা করলাম না যে ওরা এখনও আছে নাকি চলে গেছে। যদি আবার দেখে ফেলে। তাই প্রায় দেড়টা পর্যন্ত চুপ করে ডাইনিং রুমে বসে রইলাম। দেড়টার সময় আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।অনেকক্ষণ দরজা খুলি নি। পরে যখন আম্মু নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলো তখন গিয়ে দরজা খুললাম। আম্মুকে দেখে অনেক শান্তি লাগলো।আম্মু ভেবেছিল যে আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই আর আমাকে কিছু বলে নি। আমি আমার রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার রুমের পেছনের জানালায় দোলনচাঁপা ফুল রাখা।অনেক গুলো ফুল। ফুল দেখে আমার এত ঘেন্না লাগলো যে কি বলবো!! ছিরে কুটি কুটি করে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম।

আমার প্রায় চার- পাঁচ দিন জ্বর ছিল। তাই স্কুলে যাওয়াও বন্ধ।ওই সময় টাতে আম্মু চলে যাওয়ার পর পরই আমি আমার রুমের সব জানালা বন্ধ করে দিতাম। বারান্দার দরজা বন্ধ করে রাখতাম। অন্ধকার রুমে অল্প সাউন্ড দিয়ে টিভি দেখতাম। আম্মু যাওয়ার পরপরই ওই ছেলে আর সাথের সাঙ্গপাঙ্গ গুলো আসতো। ওরা যে জানালার পাশে ঘুরাঘুরি করতো সেটা আমি টের পেতাম।মাঝে মাঝে আবার নাম ধরেও ডাকতো। প্রচণ্ড ভয়ে ভয়ে থাকতাম। আম্মু ও চলে আসতো দেড়টা –দুইটার দিকে। আম্মু আসার পর আমি বারান্দার দরজা খুলতাম। প্রতিদিনই দেখতাম বারান্দায় অনেক গুলো দোলনচাঁপা ফুল রাখা। ইচ্ছা করতো যে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেই। তারপর ফেলে দিতাম। অবশ্য আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে কেন আমি আমার রুমের দরজা –জানালা বন্ধ করে রেখেছি। আমি সুন্দর করে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম যে চোখে আলো লাগে সেজন্য ঘর অন্ধকার করে রেখেছি।সত্যি কথা বলার সাহস হয় নি।

সুস্থ হয়ে আবারও স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। ওই ছেলে পিছু ছাড়ে না।দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে ঘুরতে থাকে।সারাক্ষণই ভয় ভয় লাগে। তবে তখন আব্বু খুব করে চেষ্টা করছিলেন আম্মু কে বদলী করে ঢাকায় নিয়ে আসতে। যেন আমরা সবাই একসাথে থাকতে পারি। তো যখনই আমার ভয় লাগতো আমি শুধু ঢাকার কথা চিন্তা করতাম। আমি খুব করে চাইতাম যেন আমাদেরকে বেশিদিন এখানে থাকতে না হয়।অবশ্য আমাকে বেশিদিন থাকতে হয় নি। আম্মুর বদলী হওয়ার আগেই আমাকে কলোনি ছাড়তে হয়। সেটা আমার জন্য খুবই ভালো হয়েছিল। কিভাবে হয়েছিল সেই ঘটনাই এখন বলবো। ওইদিন বৃহস্পতিবার ছিল। সন্ধ্যার পর পরই আব্বু এসে হাজির। আমি তো মহাখুশি আব্বুকে দেখে। আব্বুর আসার সাথে সাথেই কারেন্ট চলে যায়। আম্মু চার্জ লাইট জালায়। তো আব্বু আমার রুমে এসে দেখে আমার রুমের দরজা-জানালা সব বন্ধ।বাইরে অনেক বাতাস ছিল।মেঘলা মেঘলা একটা পরিবেশ। আব্বু আমাকে হাল্কা ধমক দিয়ে জানালা খুলতে বলল যেন রুমে বাতাস ঢুকতে পারে। আমি আব্বুকে বললাম যে আমার ভয় লাগে। আসলে মুখ ফসকে এই কথাটা বের হয়ে এসেছিল।আব্বু অনেক সুন্দর করে হাসি দিয়ে বলল, “ কিসের ভয়?আমি আছি না!”যাই হোক, আব্বু আমার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই সব জানালা খুলে দিলেন। হুর হুর করে বাতাস আসতে লাগলো। জানলার পর্দা গুলো ও আস্কারা পেয়ে উড়তে লাগলো। আমি ভয়ে নিজের রুমে বসতে চাইলাম না। পড়াশুনা বাদ দিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে রইলাম। ওই রুমে অবশ্য আব্বু-আম্মু ও ছিল।হঠাৎ আম্মু আমাকে বলল যে বারান্দা থেকে গামছা নিয়ে আসতে। সামনে যে কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আসতে পারে সেটা কল্পনা না করেই আমি বারান্দায় গেলাম। কোন দিকে না তাকিয়ে গামছাটা নিয়ে ফিরে আসব ওই মুহূর্তে আমি দেখলাম বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে সাদা সাদা কি যেন একটা রাখা। অন্ধকার হওয়াতে ভালো মতো বুঝতে পারছিলাম না। আমি গ্রিলের কাছাকাছি গিয়ে দেখি দোলনচাঁপা আর একটা কাগজ। দেখে আমার আত্মা পুরা শুকিয়ে গেল। কি মনে করে জানি বারান্দা দিয়ে আশ-পাশ তাকালাম।দেখি কেউ নাই। দোলনচাঁপা গুলো ফেলে দেবো এই আশায় যেই না দোলনচাঁপা গুলো ধরতে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে ওই ছেলেটা কোত্থেকে যেন গ্রিলের সামনে এসে হাজির। একদম আমার সামনা সামনি।আমি এত ভয় পেলাম যে চিৎকার করে দোলনচাঁপা গুলো হাতে নিয়েই বারান্দার মেঝেতে পড়ে গেলাম। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম বলতে পারবো না। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার মাথার পাশে আম্মু-আব্বু বসে আছে। আমি আড়চোখে জানালার দিকে তাকালাম।দেখি জানালা বন্ধ।বারান্দার দরজাও বন্ধ। আমি আম্মুকে কিছু একটা বলতে যাবো, তখন আম্মু আমাকে বল্ল,”আম্মু,কালকে তোমাকে তোমার নানুর বাসায় দিয়ে আসব। তোমাকে আর ভয় পেতে হবে না।আর আমরা কিছুদিন পর সবাই ঢাকায় চলে যাবো। তখন তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবো। কখনও তোমাকে ভয় পেতে হবে না।“আমি আনন্দে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লো, তখন ওই কাগজটার কথা মনে পড়লো। ওই কাগজটাতে কি লেখা ছিল জানি না।মনে হয় ওই কাগজটাই আম্মু-আব্বুকে সব কিছু বলে দিয়েছিল। আমাকে কিছু বলতে হয় নি।

আমি নানুর বাসায় প্রায় ২ মাস ছিলাম। ওই দুই মাস অনেক আনন্দে ছিলাম। তারপর একদিন আম্মুর বদলির অর্ডার আসে। আমিও কয়েকদিনের জন্য আমাদের বাসায় ফিরি। ওই ছেলেটাকে তখন আর দেখি নি। কিন্তু যেদিন আমরা ওই কলোনি ছেড়ে চলে যাবো ওইদিন ঠিক ঠিক চলে যাওয়ার সময় পুকুর পাড়ের নারকেল গাছটার নিচে ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। হাতে সেই দোলনচাঁপা। “


“আপু আমার দোলনচাঁপার কাহিনীটা কেমন লাগলো আপনার”, তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি কিছু বললাম না। কি বলবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। বারো বছরের একটা মেয়ের জন্য একটা বিশ- বাইশ বছরের ছেলের দোলনচাঁপা হাতে নিয়ে এত আবেগ, এত ঘুরাঘুরি, এত দেখার চেষ্টা কত টুকু ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা তারার মুখে শুনে বুঝতে পারলাম। আমি তারাকে বললাম, “ তুমি বুঝতে পারো নি যে ছেলেটা কেন এমন করছে?” তারা বলল,” হুম,বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি ছেলেটার আচরণে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই ভয় তখন আর কাটে নি। আর কেউ যে কারো জন্য এগুলো করতে পারে সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার তখনও হয় নি। আমার একটা নিজের জগত ছিল। হুট করে বাধা পরায় আমি আরও ভয় পেয়ে যাই।“ আমি পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, “ বাদ দাও। এখন বল চা খেতে কেমন হয়েছে?” হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমি আর তারা কেউই চা খাইনি। চা প্রায় বরফ হয়ে গেছে। তারা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।




৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×