কর্মীদের অবমূল্যায়ন, মুখপাত্রের স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থিক অস্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের সন্দেহ থেকে ক্ষোভ আর সেখান থেকে বিভক্তি দেখা দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চে।
সুযোগ কাজে লাগাতে এক মুহুর্ত নষ্ট করেনি মঞ্চের ‘বিতাড়িত’ একটি অংশ।
ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দণ্ড প্রত্যাখ্যান করে গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন করে ব্লগার এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান)। ছোট এক মানববন্ধন দেখতে দেখতে রূপ নেয় গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে মূল কার্যক্রম শুরু করে। সেখানেই বোয়ানের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকারকে মঞ্চের ‘মুখপাত্র’ হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
শুরুর দিকে এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে তরুণেরা। তারাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আন্দোলন। মঞ্চের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ইমরান এইচ সরকার ও ছাত্রনেতারা একসঙ্গে বসে গ্রহণ করতেন। নীতিনির্ধারনী বৈঠকে বোয়ানের প্রতিনিধিত্ব করতেন ইমরান এইচ সরকার। এই বৈঠকের আগে তিনি বোয়ানের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নীচতলার মেঝেতে বসে আলোচনা করতেন। সর্বশেষ সিদ্ধান্তগুলোও মঞ্চের মুখপাত্রের মাধ্যমে জনগণের সামনে উপস্হাপিত হতো। ক্রমেই ইমরান এইচ সরকার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন।
উপেক্ষিত বোয়ান: বক্তৃতার মঞ্চে সকল ছাত্রসংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বক্তৃতা করতে দেখা গেলেও বোয়ানের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ইমরান এইচ সরকার গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে এসে বোয়ানের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেন ইমরান এইচ সরকার। এরপর শুধুমাত্র ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে ইমরান এইচ সরকারের একক বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসতে থাকে। এভাবে আন্দোলনের নীতিনির্ধারণের জায়গাটি থেকে ছিটকে পড়তে থাকেন আন্দোলনের সূচনাকারী ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টরা।
ছাত্রলীগসহ অন্য ছাত্রসংগঠনের নেতারা ইমরান এইচ সরকারকে সামনে রাখলেও অন্য ব্লগার ও সংগঠকদের নানাভাবে হেয় করে। সেই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে একাধিক সংগঠক জানান, একুশে ফেব্রুয়ারি ‘গণজাগরণ মঞ্চের’ পক্ষ থেকে সকল ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী ও ব্লগার-সংগঠকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিতে যান। মিছিলের অগ্রভাগে জায়গা দখল করতে গিয়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার একজন এক ব্লগার-সংগঠককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেন। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশ মঞ্চের দখল নিতে গিয়ে ব্লগারদের প্রকাশ্যে গালমন্দ করেন ছাত্রলীগের নেতারা। ইমরান এইচ সরকার এসব ঘটনার কোনোটিরই প্রতিবাদ করেন নি বলে অভিযোগ তাদের। ছাত্রসংগঠনের ওপর ইমরানের এই নির্ভরশীলতায় ক্ষোভ ছিল ব্লগারদের মনে।
প্রত্যেকেই এরকম নানা ঘটনায় প্রতিকার না পেয়ে ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে থাকেন। বর্তমানে মারুফ রসূল, অমি বাঙাল, অনিমেষ রহমান, দূরন্ত দুরা, পজিট্রন প্রীতমসহ প্রথম দিককার কয়েকজন ছাড়া কেউই মঞ্চের কর্মসূচিতে অংশ নেন না। ইমরান এইচ সরকারও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, এমনটাও শোনা যায় না। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের দিন ও গণজাগরণ মঞ্চের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আবেগঘন দুটি দিন সংগঠনের অনেকেই আশা করেছিলেন তাঁর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হবে। কিন্তু তা হয় নি। উপরন্তু যারা নিজ উদ্যোগে নিজ উদ্যোগে শাহবাগ এসেছিলেন তাদের কারও সঙ্গে ইমরান এইচ সরকার কথা বলেন নি।