somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাসের অনুবাদের ১১তম পর্ব

০১ লা জুলাই, ২০২০ সকাল ১০:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এর আগে ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাসের ১০টি পর্ব দিয়েছি। আজ দিচ্ছি ১১তম পর্বঃ
.
কন্সট্যান্স থিওর দিকে তাকিয়ে ওর চোখ নাচাল। "নির্দোষ সাজার ভান করবি না। হেনরি ল্যাশিংটনের বোনের কাছ থেকে আমি শুনেছি, ব্ল্যাক টাউনের একটি বেশ্যা পল্লীতে গত সপ্তাহে তোকে তিনবার একজন ভারতীয় মেয়ের সাথে দেখা গিয়েছে।"
থিওর মনটা সাথে সাথে সেই ভয়াবহ রকমের ধোঁয়াটে, আঁধারঘেরা রুমগুলোতে চলে গেল। ওই রুমগুলোর বাতাসে ভাসছিল মাথা ধরিয়ে দেয়ার মতো উৎকট গন্ধের সব ঘ্রাণ। জায়ফল এবং বিভিন্ন রকমের মশলার গন্ধ ভাসছিল ওই রুমগুলোর মাঝে। ওখানে প্রচুর সুন্দরী মেয়েও ছিল। বিশেষ করে একজনের কথা থিওর মনে পড়ে গেল। সুন্দর চেহারার কমবয়সি একজন তরুণীকে ওর মনে ধরেছিল। মেয়েটির নরম, কোমল ত্বককে ওর কাছে মনে হয়েছিল আঙ্গুলের ডগা দিয়ে স্পর্শ করা সুক্ষ্ম সুতার রেশমী কাপড়ের মতো। স্মৃতিটা মনে পড়তেই থিওর শরীরটা কেঁপে উঠল।
"ওটা আলাদা ব্যাপার।"
"অবশ্যই, অবশ্যই। ওটা তো আলাদা ব্যাপার হবেই। তবে আমাকে যদি অভিভাবকহীন অবস্থায় ওরকম কোনো একটা বেশ্যাপল্লীতে একজন নেটিভ পুরুষের সাথে দেখতে পাওয়া যেত, আমাকে তখন লাথি দিয়ে এই সমাজ থেকে বের করে দেয়া হত।"
"আমি ওটা বুঝাতে চাইনি।"
"নিয়মগুলো ছেলে আর মেয়েদের জন্য এক রকম হল না কেন? আমরা সবাই-ই তো রক্ত-মাংসের মানুষ, তাই না?"
থিওর চেহারাটা হঠাৎ করেই টকটকে লাল হয়ে উঠল। "তোর সম্মান রক্ষার জন্য।"
কন্সট্যান্স এই কথায় হেসে উঠল। "তুই নিশ্চিত থাকতে পারিস, ভাই আমার। আমার সম্মান ভালো জায়গাতেই রক্ষিত আছে। আমার ধারণা আমাদের কাজিন চাইছে আমাকে কোনো একটা সামুদ্রিক জাহাজের ক্যাপ্টেন বা কোম্পানির একজন ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে দিতে। সে ইতোমধ্যে আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সহায়-সম্পত্তির ব্যাপারে মাদ্রাজের গভর্নর সন্ডার্সের সাথে পত্রবিনিময় করা শুরু করে দিয়েছে। সে বলেছে সে ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে আমাদের সম্পত্তি হয়তো আমাদের অনুপস্থিতিতে বাজেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু আমার ধারণা সত্যিকার অর্থে ওর দুশ্চিন্তাটা হচ্ছে আমার কাছে হয়তো স্বামীকে যৌতুক দেয়ার মতো কিছু থাকবে না, এবং শেষে গিয়ে আমি ওর বাড়িতে একজন বৃদ্ধ চাকরাণী হিসেবে রয়ে যাব। যাকে কিনা ওকে সারাজীবন ধরে খাইয়ে যেতে হবে।"
"ও যদি আমার জন্যও এরকম উদ্বেগ দেখাত, আমি খুব খুশি হতাম।" যদিও জেরার্ড তার ব্যবসার কাজে ঘন ঘন ফোর্ট উইলিয়ামে গভর্নরের বাড়িতে যায়, কিন্তু সে বলতে গেলে কখনই থিওর সাথে সাক্ষাৎ করে না।
"আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, সে ইচ্ছে করে আমাকে এড়িয়ে চলে।"
"সে এমনটা তোর ভালোর জন্যই করে," কন্সট্যান্স বলল। "সে চায়, তোর নিজের মাঝে যেন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। সে চায় না যে লোকে বলুক, তুই ওপরে উঠেছিস স্রেফ বড়লোক আত্মীয়ের সাথে তোর সম্পর্কের কারণে। এই ব্যাপারটাতে ও খুবই স্পর্শকাতর! ওর নিজের বাবা, মানে আংকেল ক্রিস্টোফার, তিনি সবসময় জেরার্ডের জীবনে অযথাই হস্তক্ষেপ করতেন, সেই কারণে ওর বন্ধুরা ওর ওপরে বিরক্ত ছিল।"
"তবে এতে করে ওর ক্যারিয়ারে কোনো সমস্যা হয়েছে বলে তো মনে হয় না।" থিও বলল, জেরার্ডের ওই বিশাল প্রাসাদের কথা চিন্তা করছে।
কন্সট্যান্স বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে থিওর গালে চুমু খেল। "আমাকে এবার যেতে হবে। এই সন্ধ্যায় ম্যানিংহামের ওখানে আমাদের দাওয়াত আছে। হেয়ারড্রেসারের কাছে আবার যেতে হবে আমাকে। আপাতত বিদায়।"
***
সময় যতই অতিবাহিত হতে লাগল, থিওর কর্তাব্যক্তিরা লক্ষ করল যে প্রতি সপ্তাহে ওর খতিয়ান বইয়ের জের অন্যসব কেরানীদের থেকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। থিও এবার কলকাতার বাইরেও আসা-যাওয়া শুরু করল, মাঝে মাঝে বেশ কয়েকদিনের জন্য বাইরে থাকতে হত ওকে। দূরবর্তী সরবরাহকারীদের সাথে সাক্ষাৎ করতে হত ওকে। এই দেশটার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করত ও, যদিও এসব যাত্রার শম্বুক গতির কারণে থিও খুব বিরক্তবোধ করত। এমনকি ভারতবর্ষের মধ্যেই স্বল্প দূরত্বে এক জায়গা ত্থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলেও মহাসাড়ম্বর এবং ধুমধাম করে যাওয়া লাগত। দেখতে হত যাত্রাটা যেন রাজকীয় হয়। স্তম্ভাকারে সজ্জিত সৈন্যসারির সামনের দিকে থাকতো ট্রাম্পেট এবং ড্রাম হাতে থাকা মিউজিশিয়ানরা। অন্যদিকে কোম্পানির ব্যবসায়ীরা তখন হাতির পিঠের ওপরে থাকা হাওদায় আরাম করে বসে থাকতেন। ওদের সাথে সৈনিকদের একটা দল তো থাকতই, সেই সাথে থাকত একগাদা কর্মচারী। এবং ওরা যেখানেই যেত, নেটিভ অধিবাসীদের একটা বড়সড় দল ওদেরকে মৌমাছির ঝাঁকের মতো অনুসরণ করতে থাকত। ভাগ্য ভালো হলে কখনও কখনও ওরা সারা দিনে পাঁচ মাইল পথ অগ্রসর হতে সক্ষম হত।
এরকম বেশির ভাগ ভ্রমণেই থিওর সাথে সঙ্গী হিসেবে থাকত ডিগান নামের একজন সিনিয়র এজেন্ট। সে স্কটল্যান্ডের লোক। বহুদিন যাবত আছে ভারতবর্ষে। সম্ভবত আর কোনো ব্রিটিশ তার মতো এতদিন যাবত ভারতবর্ষে অবস্থান করেনি। এবং সে খুব জোর দিয়ে বলে, তার মৃত্যু ভারতবর্ষেই হবে, স্কটল্যান্ডে না। "এখানকার এই উত্তপ্ত আবহাওয়া এবং মদের কারণেই আমার দেহটা এখনও টিকে আছে," সে যুক্তি দেখাল। "যদি আমি স্কটল্যান্ডের শীতকালে এক মৌসুম কাটাই, ওখানকার ওই শীতল হাওয়া আমার শরীরটাকে কেটে একেবারে দুই ভাগ করে দেবে।" ডিগান ভারতীয় স্টাইলে জীবনযাপন করে। ওর পরনে ঢিলেঢালা ভারতীয় পোশাক। বিশালাকৃতির একটা পাগড়ি দিয়ে মাথাটিকে মুড়িয়ে রেখেছে সে। এবং ওর খাবারের রুচিটাও অদ্ভুত। সে ভীষণ ঝাল এবং মশলাযুক্ত খাবার খায়, যেসব খাবারের স্বাদ থিও আগে কখনও নেয়নি। ডিগানের একজন ভারতীয় স্ত্রী আছে, যদিও বাজারে জোর গুজব যে স্কটল্যান্ডের এডিনবরাতেও আরেকজন মিসেস ডিগানের অস্তিত্ব আছে।
"একবার যদি কোনো ভারতীয় মেয়ের শরীরের টেস্ট তুমি নাও, তুমি আর কখনও ওই দেশে ফিরে যেতে চাইবে না," সে ওর একটা চোখ টিপে থিওকে বলল। ওরা তখন একটা ট্রেডিং স্টেশনে থাকা এজেন্টের বাড়ির ভেতরে বসে কথা বলছিল। "এদের মতো এমন নরম-কোমল শরীর আর কোথাও পাবে না তুমি।"
সে থিওর হাতে হুক্কা পাইপের শীর্ষভাগটা ধরিয়ে দিল। থিও পাইপটা হাতে নিয়ে লম্বা করে একটা টান দিল। এই পাইপের মধ্যে আছে বাষ্পীভূত সুয়াজ্জেল। এটা সিরাপসদৃশ তামাক-মিশ্রণ। এতে তামাক ছাড়াও আছে ঝোলাগুড়, ভেজিটেবল অয়েল, এবং বিভিন্ন ফলের নির্যাস। হুক্কা পাইপে জোরালো কয়েকটা টান দিতেই থিওর মাথাটা সামান্য ঝিমঝিম করে উঠল। ওর শরীর-মন সামান্য রিল্যাক্সড হল এতে। তবে সে ডিগানের কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলল না।
"আমি এর জন্য দোষ দিই, ওরা যেই পোশাকটা পরে তার ওপরে। আমাদের সুন্দরী ইংরেজ মহিলারা নিজেদেরকে চিকন দেখানোর জন্য আঁটসাঁট অন্তর্বাস পরে, এটা ওদের শরীরকে এত শক্ত করে চাপ দিয়ে ধরে রাখে যে ওদের শরীর পুরনো লেদারের মতো শক্ত হয়ে যায়। আর ভারতীয় মেয়েদেরকে দেখো, ওরা ওদের স্তনকে মুড়িয়ে রাখে মসৃণ আর মোলায়েম সুতি কাপড় দিয়ে, যতটা সম্ভব প্রকৃতির কাছাকাছি থাকে ওদের দেহটা।"
থিও কন্সট্যান্সের কথা ভাবল, শাড়ি পরার জন্য মায়ের সাথে কেমন একটা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিল ও। আর যেদিন থেকে ওরা কলকাতায় এসেছে, থিও দেখছে কন্সট্যান্স শুধুই নিখুঁতভাবে মাড় দেয়া ইংরেজ পোশাকই পরছে।
ডিগান ওর হুক্কা পাইপটা কিছুক্ষণ চুষল এবং এরপরে ধোঁয়ার একটা রিং ছুঁড়ে দিল বাতাসে। "থিও, তুমি কি কখনও একদম ভোরবেলায় নদীর তীরে গেছ? যখন নেটিভ মেয়েরা নদীতে গোসল করতে যায়?"
থিও ওর মাথাটা এদিক-ওদিক নাড়ল।
"বুঝলে, ভায়া, ওরা যখন পানিতে ডুব দেয়, ওদের পুরো শরীর কাপড়ে আবৃত থাকে। কিন্তু যখন ওরা পানি থেকে উঠে আসে... কী বলব ভায়া, ওই ভেজা পোশাক ওদের শরীরে এমনভাবে লেপ্টে থাকে যে, ওদের শরীরের কিছুই আর লুক্কায়িত থাকে না। প্রতিটি ভাঁজ বুঝে ফেলা যায়। তুমি তখন ওদের শরীরের সকল সৌন্দর্য আর লাবণ্য দেখতে পাবে।"
"আমাকে ওই সময়টায় সকালের প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে হয়," থিও বলল।
"আয়ি," ডিগান বিরক্তিপ্রকাশ করার ভঙ্গিতে ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করল। "এটাই হচ্ছে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়। এই কোম্পানি তোমাকে গির্জার প্রার্থনাকক্ষে আটক করে রাখবে, মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে রাখতে বাধ্য করবে, কিন্তু তোমার চারপাশে কী ঘটছে সেটা পর্যবেক্ষণ করতে দেবে না।"
"আমি নিশ্চিত না যে, গভর্নর-ও এসব দেখেন কিনা।"
"অবশ্যই তিনি এসব দেখেন না।" ডিগান ওর গ্লাসে থাকা মদটা গলায় ঢেলে দিল এবং মদ পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত থাকা মেয়েটিকে ইশারা করল গ্লাসে আরও মদ ঢালার জন্য। "এই কোম্পানিটা খুব নাদুসনুদুসভাবে বেড়ে উঠছে। প্রচুর পরিমাণে লাভ করে যাচ্ছে এরা। তবে ওই গভর্নরটা একটা বোকাচোদা। এবং এই কাউন্সিলটা এমন এমন সব লোক দিয়ে পরিপূর্ণ, যারা নিজেদের পকেট ভারী করার কাজে এতটাই ব্যস্ত যে ওদের নাকের সামনে দিয়ে কী চলে যাচ্ছে সেটাও ওদের চোখে পড়ে না। আমরা হচ্ছি এই দেশের অতিথি, তবে আমরা যেভাবে এই দেশের মানুষের ওপরে কর্তৃত্ব ফলাই, তা দেখে তুমি ভাববে আমরাই বুঝি এই দেশের রাজা। এখানে আমাদের সংখ্যা হবে মাত্র কয়েকশ, আমাদের বিরুদ্ধে আছে কোটি কোটি ভারতীয়, কিন্তু আমরা ধরে নিয়েছি যে আমরা একদম অপরাজেয়।"
"আমাদের সাথে ব্যবসা করে ভারতীয়রা এত বেশি লাভ করে যে, ওরা কখনই আমাদের বিপক্ষে যাবে না।" থিও বলল। ফোর্ট উইলিয়ামের মেস হলে এই ধরণের মন্তব্য সে প্রায়শই শুনতে পায়।
"ভারতীয়দের নিজস্ব অহংবোধ আছে, অন্য আর সব মানুষের মতো তাদেরও আছে দম্ভ। কারও কারও তো অন্যদের চেয়ে বেশিই আছে। তুমি কি জানো যে, আমাদের স্থানীয় প্রিন্স, মানে যাকে নবাব নামে ডাকা হয়, সে মারা যাচ্ছে?"
"এরকম কিছু গুজব আমার কানে এসেছে।"
"আয়ি। বাতাসে সবসময়ই নানান রকমের গুজব ভাসতে থাকে। গুজব আছে যে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হচ্ছে তার নাতি। যার মেজাজ নিরোর মতো আর যৌনক্ষুধা নাকি ক্যালিগুলার মতো। গুজব আছে যে, সে দেখেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার দাদার সাথে এমনভাবে ব্যবহার করেছে যেন তিনি তাদের চাকর। তাই এই নতুন নবাব চায়, এই কোম্পানিকে ভদ্র আচরণ করার শিক্ষা দিতে। গুজব আছে যে, একজন ফরাসী জেনারেল নাকি তার আদালত-কক্ষের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। এবং কেউই এটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে না কারণ এখনও কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। তুমি কি এমন একটা কাহিনী শুনেছ যে আমাদের শ্রদ্ধেয় গভর্নর ড্রেক কলকাতায় আর্মি জড়ো করছেন, যাতে নদীর ধারে থাকা ফরাসীদের উপনিবেশে হামলা চালানো যায়?"
"কিন্তু এটা তো একেবারেই অসম্ভব?"
"নিঃসন্দেহে এটা একেবারেই অসম্ভব। চর্বির ভারে কাহিল হয়ে যাওয়া আমাদের মোটা পাছার ওই গভর্নর বেশ্যাখানায় গেলে নিজের সোনা নিজেই খুঁজে পান না, আর তিনি কিনা একটা যুদ্ধ শুরু করে দেবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, অন্য মানুষেরা কেন এটা বলছে?"
"আমাদের সম্মানহানি করার জন্য।"
"আয়ি। ফরাসীরা ভালো করেই জানে ওদের আক্রমণ করার কোনো কারণ আমাদের নেই। বা, আমরা যদি আক্রমণ করিও, আমাদের জেতার আশা নেই। কিন্তু ওরা যদি এভাবে প্রচার করতে থাকে যে আমরা আক্রমণ করব এবং নবাব-ও যদি সেটা বিশ্বাস করে ফেলে, তো তাহলে নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া যায় নবাব এই খবরে খুশি হবে না। তার অতিথিরা তার নিজের ড্রয়িং রুমে বসে মারামারি করবে, সেটা তো তিনি হতে দিতে পারেন না।"
ডিগান আরও একবার তার হুক্কায় লম্বা করে টান দিল। "তুমি কি আজকে মার্কেটে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার লক্ষ করেছ?"
"আমার মনে হয় আজকে আমরা বিস্ময়কর রকম ভালো দামে পণ্য পেয়েছি।"
ডিগান থিওর কথায় সায় দিল। "সেটা আমরা পেয়েছি। তোমার কথা ঠিকই আছে। কিন্তু এর আসল কারণ হচ্ছে, আমরা ওগুলো নগদ টাকায় খরিদ করতে রাজী হয়েছিলাম। যদি আমরা ধারে পণ্য নেয়ার কথা বলতাম, ওরা আমাদেরকে তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে দিত।"
"কিন্তু কেন?"
"কারণ ওদের ধারণা ঋণ শোধ করার জন্য আরও ছয় মাস আমরা এখানে থাকব না।।"
ডিগান ঢেকুর তুলল। ওর নিঃশ্বাসের সাথে ঝাল তরকারী, দেশি মদ এবং তামাকের একটা বিদঘুটে গন্ধের গ্যাস বেরিয়ে এল। ঢেকুর দেয়ার চোটে ওর পাগড়িটা খসে পড়ল মাথার ওপর থেকে। বহু বছর ধরে মদ্যপান এবং সূর্যের প্রখর রৌদ্রে ঘোরাফেরা করার কারণে ওর নাকটা শুকনো মরিচের মতো লাল হয়ে গেছে। এই লোকটার পোশাক, আচার-ব্যবহার দেখলে মনে হয় এই লোক একটা নির্বোধ, নোংরা চেহারার বৃদ্ধ লোক। এই লোকের দেয়া সতর্কবার্তাকে কিভাবে একজন মানুষ গুরুত্বের সাথে নেবে, যেখানে জেরার্ড কোর্টনির মতো একজন সুদর্শন যুবক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকার আত্মবিশ্বাসী প্রতিশ্রুতি দেয়?
কিন্তু তারপরেও, থিও ডিগানের বলা কথাগুলো শুনে গভীর ভাবনা পড়ে গেল।
****
মেজর জেনারেল করবেইলের শরীর থেকে দরদর করে ঘাম বের হচ্ছে। এমনকি নবাবের আচ্ছাদনের ছায়ার আশ্রয়ে থাকার পরেও, নিষ্প্রাণ বাতাসে তার সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার দশা। ফরাসী জেনারেল তার সাদা ইউনিফর্মের কলার ধরে টানাহ্যাঁচড়া করা শুরু করলেন, এই ভারী কাপড়টিকে মনে মনে গালাগাল করছেন। এই কাপড়টা যেই দর্জি বানিয়েছে, তাকে যদি এখন হাতের কাছে পেতেন, তার আঙ্গুলের নখগুলো একটা একটা করে উপড়ে ফেলতেন তিনি।
অন্যদিকে কমবয়সী নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তখন তার সিংহাসনের সোনালী রঙের গদির ওপরে আরাম করে বসে আছেন। নানা মারা যাওয়ায় অতি সম্প্রতি এই সিংহাসন উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন তিনি। এই গোলগাল চেহারার, নাদুসনুদুস শরীরটা দেখে জেনারেল করবেইলের একজাতের নাশপাতির কথা মনে পড়ে যায়, যেটা জন্মায় অর্চার্ডে, তাদের পারিবারিক এস্টেটে। এই ছেলেটা সারাক্ষণ অস্থির ভঙ্গিতে ছটফট করছে। ওর প্রতিটি আঙ্গুলে আংটি লাগানো। ওই আংটিতে আবার মোটাসোটা আকৃতির বহুমূল্য রত্ন-ও লাগানো আছে। একেকটি রত্ন গাদাবন্দুকের বুলেটের মতো মোটা। একে দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন একঘেয়েমিতে ভুগছে।
করবেইল চেষ্টা করল ওর চেহারায় ফুটে ওঠা ঘৃণার ভাবের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আনতে। তাকে তার চেহারায় ফুটে ওঠা অবজ্ঞার অভিব্যক্তিটি লুকিয়ে রাখতে হবে, যা একদম ন্যাচারালি তার ভেতর থেকে উঠে আসছে। এই নবাবটা একটা গর্দভ। এর প্রচণ্ড যৌনক্ষুধা এবং মানুষকে শারীরিকভাবে যন্ত্রণা দিয়ে নির্মম আনন্দ পায় সে। তবে, এ একেবারে অদরকারী না। এই লোকটাকে ব্যবহার করে হয়তো কিছু দরকারি কাজ আদায় করে নেয়া যেতে পারে।
"মাননীয় নবাব, আমি আপনার কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ যে আজকের এই বিনোদন প্রত্যক্ষ করার জন্য আপনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন," জেনারেল করবেইল বললেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে, রাজকীয় আচ্ছাদনের সামনে, একজন নগ্ন পুরুষ চেষ্টা করছিল একটা হাতির কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। তার পায়ের গোড়ালিতে মোটাসোটা দুটো শেকল পরিয়ে দেয়া হয়েছিল। দুটো শেকলের একটা সংযুক্ত আছে মাটিতে থাকা খুঁটির সাথে, আর অন্যটা শক্ত করে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে হাতির পায়ের সাথে। এই রণক্ষেত্রটি বৃত্তাকার, মাটি লেপে বানানো দেয়াল রণক্ষেত্রটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। বৃত্তাকার দেয়ালের চারপাশে প্রচুর সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়েছে আজকের এই বিনোদন অনুষ্ঠান দেখার জন্য।
হাতিটি একটি চওড়া বৃত্তাকার পরিধির ভেতরে রণক্ষেত্রের চারপাশে থপথপিয়ে হাঁটতে লাগল, কিছুক্ষণ পরে পরেই বিরতি নিচ্ছে নিজের শুঁড় দিয়ে ধুলিবহুল মাটিতে আঁচড় কাটবে বলে। শেকল পরা মানুষটি এলোমেলো পায়ে হাতিটির পেছন পেছন যাচ্ছে।
"হাতিটার চলাফেরা খুব ধীরগতির," নবাব তার অসন্তোষ প্রকাশ করল।
আদালতের কর্মকর্তাদের চেহারায় উদ্বেগ ফুটে উঠল। ওরা ওদের মনিবকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক না। ওদের মনিব যদি খুব রেগে যান, তাহলে হয়তো ওই কয়েদির সাথে ওদেরকেও এই রণক্ষেত্রে যোগ দিতে হতে পারে। এরকমটা আগেও ঘটেছে। নিম্নপদস্থ কর্মচারীদেরকে দ্রুততার সাথে জরুরী ভিত্তিতে নির্দেশ প্রদান করা হল। খালি গায়ের কয়েকজন পুরুষ হাতে বল্লম নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে রণক্ষেত্রে গেল, বল্লমের তীক্ষ্ম অংশ দিয়ে হাতির দেহে খোঁচা দিচ্ছে। খোঁচা খেয়ে হাতিটি বুনো কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, নিজের চলার গতি বাড়াচ্ছে। (চলবে)
****
ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের ১ম থেকে ১০ম পর্বঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২০ সকাল ১০:৩৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×