এরিক ফন মানস্টেইন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সবচেয়ে মেধাবী জার্মান জেনারেল। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় অপারেশনের অন্যতম মাস্টার ছিলেন এই জেনারেল। জার্মান আর্মির পাপেট মাস্টার হিসাবেও পরিচিত ছিলেন তিনি। সামরিক পরিবারের মধ্যে জন্ম নেয়া এই জেনারেল সারাটা জীবন ব্যয় করে গেছেন সামরিক জীবনে। দাদা থেকে শুরু করে তার পরিবারের সবাই ছিলেন সামরিক বাহিনীর অফিসার। ফন মানস্টেইন ছিলেন প্রুসিয়ান আর্মির আর্টিলারি বিভাগের জেনারেল এডওয়ার্ড ফন লুইন্সকি(১৮২৯-১৯০৬) ও হেলেন ফন সার্পালিং(১৮৪৭-১৯১০) এর দশম সন্তান। যদিও তিনি তার বাবা মার কাছে লালিত পালিত হন নি। তার মা হেলেনের ছোট বোন হেডলিং ফন সার্পালিং, যে সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিল তার কাছে লালিত পালিত হন ২য় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম নেপথ্যের নায়ক এই জার্মান জেনারেল। তার পালক পিতা(তার খালু)ও ছিলেন জার্মান সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল। তার পালক পিতার নাম ছিল লে. জেনারেল জর্জ ফন মানস্টেইন। তিনি তার পালক পিতার পদবীই পরবর্তীতে গ্রহন করেন।
মানস্টেইনের জন্মের পূর্বেই তার পিতা জেনারেল এডওয়ার্ড ফন লুইন্সকি(১৮২৯-১৯০৬) ও হেলেন ফন সার্পালিং(১৮৪৭-১৯১০) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাদের এই সন্তানকে তারা হেলেনের ছোট বোন হেডলিং ফন সার্পালিংকে দিয়ে দিবেন। কারন তিনি সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন। সেই অনুসারে ২৪ নভেম্বর ১৮৮৭ সালে যখন মানস্টেইনের জন্ম হয় তখন এডওয়ার্ড ফন লুইন্সকি, জর্জ মানস্টেইনকে টেলিগ্রাম করেছিলেন যে, “তার একটি সুস্থ ছেলে জন্ম নিয়েছে। এবং মা ও সন্তান ভাল আছে।”
মানস্টেইনের রক্তের মাঝে সামরিক বিষয়টি মিশে ছিল অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে। শুধু মানস্টেইনের বাবাই নয়, তার দুই দাদা ও তার মায়ের দুই ভাইও প্রুশিয়ান আর্মির জেনারেল ছিলেন। এর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন গুস্তাভ ফন লুইন্সকি, তিনি ১৮৭০ সালে ফ্রেঙ্কো-প্রুসিয়া যুদ্ধে প্রুসিয়া সেনাবাহিনীর একটি বিরাট অংশের নেতৃত্ব দেন। সেই সাথে তিনি ছিলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জার্মান সেনাবাহিনী প্রধান ও পরবর্তীতে জার্মান প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল পল ফন হিন্ডেনবার্গের ভাগিনা। মানস্টেইন মা হেলেনের বোন গারথার ছিলেন হিন্ডেনবার্গের স্ত্রী। সামরিক পরিবারে জন্মগ্রহন করা এই সেনানায়কের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ইমপেরিয়াল লুজমে ১৮৯৪ সালে। এই স্ট্রেসবুর্গের এই ক্যাথেলিক স্কুলে ছয় বছর কাটানোর পর মানস্টেইন ছয় বছর ক্যাডেট হিসাবে জার্মান সেনাবাহিনীতে কাটান। এর পর ১৯০৬ সালের মার্চে তিনি কোলনের থার্ড পদাতিক রেজিমেন্টে যোগদান করেন। যোগদানের পরের বছর মানস্টেইন ১৯০৭ সালে লেফটেন্যান্ট পদে পদন্বতি পান। এবং ১৯১৩ সালের অক্টোবরে তিনি প্রুশিয়ান যুদ্ধ একাডেমিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রবেশ করেন।
তরুন মানস্টেইন
১ম বিশ্বযুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফন মানস্টেইন জার্মানির পশ্টিম ও পূর্ব ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে তিনি বেলজিয়াম অভিযানে অংশ নেন কিন্তু এর কিছু দিন পরেই তাকে পূর্ব ফ্রন্ট প্রুসিয়াতে বদলি করা হয়। এই সময় ১৯১৪ সালে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ ত্যাগ করার সময় তিনি মারাত্মক আহত হন এবং প্রায় এক বছর পর সুস্থ্য হয়ে আবার যুদ্ধে যোগদান করেন। এর মাধ্যে তিনি ক্যাপ্টেন পদে পদ্বন্বতি পান এবং সেই সাথে স্টাফ অফিসার হিসাবে নিয়োগ পান। এসময় তিনি পোল্যান্ড ও সার্বিয়াতে দায়িত্ব পালন করেন এবং তার সাহসী যুদ্ধ নৌপূন্যের জন্য আয়রন ক্রস(১ম শ্রেনী) পদকে ভুষিত হন। এপ্রিলে তিনি পুনরায় বদলি হন, তার নতুন যুদ্ধ ক্ষেত্র সেই পশ্চিম ফ্রন্ট। সেখানে তিনি ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ডিভিসন স্টাফ অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তিনি ভলেন্টিয়ার স্টাফ অফিসার হিসাবে ফ্রন্টিয়ার ডিফেন্স ফোর্সে যোগদান করেন এবং ১৯১৯ সাল পর্যন্ত ব্রুসলানে দায়িত্ব পালন করেন।
যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে
১ম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফন মানস্টেইন নতুন জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯২০ সালে তিনি সিলিয়ানের এক জমিদার কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী জুটা সিবিলিয়া ফন লিচ এক কন্যা গেসিলা ও দুই পুত্রের(গেরো ও রূডিগার) জন্ম দেন। তার বড় ছেলে গেরো ১৯২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহন করেন এবং পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসরন করে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দান করেন এবং সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ অঞ্চলে ২৯ অক্টোবর ১৯৪২ সালে মারা জান।
১ম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের কারনে এক সময়ের প্রবল পরাক্রমি জার্মান সেনাবাহিনীকে দূর্বল করে ফেলা হয়। এসময় অনেক জার্মান অফিসারকে জার্মান সেনাবাহিনী থধেকে বরখাস্ত করা হয়। এসময় জার্মান সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ১ লক্ষ নির্ধারন করে দেয়া হয়। এসময় মানস্টেইন সেনাবাহিনীতে থেকে জান। ১৯২০ সালে ওয়াইমার রিপাবলিকের অধীনে গঠিত নতুন ফর্মেশনে যোগ দেন। ১৯২০ সালে তিনি কোম্পানী কমান্ডার হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯২২ সালে তিনি ব্যাটিলিয়ন কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব নেন।
১৯২৭ সালে তিনি মেজর পদে পদ্বনতি হন এবং জেনারেল স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন। এবং এই সময় তিনি সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে ভ্রমন করেন।
এর মাঝে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারনে জার্মানিতে ক্ষমটায় আসে হিটলারের নেতূত্বাধীন নাজি পার্টি। নাজি পার্টি ক্ষমতায় এসেই ভার্সাই চুক্তি বাতিল করে এবং নতুন উদ্দ্যমে সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়ন শুরু করে এবং সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি শুরু করে।
মানস্টেইনের উত্থান শুরু হয় মূলত ১৯৩৫ সালে। ১ জুলাই হিটলার তাকে আর্মি জেনারেল স্টাফের হেড হিসাবে নিয়োগ দেন। যা ছিল আর্মি হাই কমান্ডের সরাসরি আওতা ভুক্ত। সেই হিসাবে মানস্টেইন জার্মানীর ফ্রান্স ও চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমনের প্রথম নীল নকশা তৈরী করেন যা ১৯৪০ সালে ফ্রান্স আক্রমনে হিটলার ব্যবহার করেন। এই সময় তিনি এই আর্মি অপারেশনের নাম দেন ফল রোট(কেস রেড)। এসময় মানস্টেইন হ্যানজ গিদেরিয়ান ও অসওয়াল্ড লুটজ তার অফিসার গ্রুপের সাথে পরিচয় হয়। হ্যানজ গুদেরিয়ান সে সময় তার বহুল আলোচিত ট্যাংকের সর্বত্তম ব্যবহার নিয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিলেন। কিন্তু আর্মি জেনারেল স্টাফ আফিসার লুডাউইগ বেকের মতো রক্ষনশীল আর্মি অফিসাররা এই ধরনের নতুন যুদ্ধ কৌশলের বিরোধী ছিলেন সেই সময় মানস্টেইন স্টেইনগানের ধারনা দেন যা এক ধরনের সেল্ফ প্রোপাইল্ড অটোমেটিক গান যা তার ভারি গোরা বর্ষন করে ইনফ্রেন্টিকে সাপোর্ট দিবে। ফলে গুদেরিয়ানের ট্যাংক যুদ্ধ পরিকল্পনা যেমন জার্মান সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে তেমনি মানস্টেইনের পরিকল্পনাও কাজে আসে। পরবর্তীতে ২য় বিশ্বযুদ্ধে এই স্টেইন গানই সবচেয়ে বিপদজনক ও সফল অস্ত্র হিসাবে প্রমান হয়েছে।
এই কাজের ফলে ফন মানস্টেইন সরাসরি জার্মান আর্মির হাই কমান্ডের নজরে এসে পরে। ফলস্রুতিতে ১৯৩৬ সালের ১ অক্টোবর তিনি জেনারেল লুডাউইগ বেকের অধীনে ডেপুটি চিফ অব স্টাফস পদে নিয়োগ পান।
১৯৩৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ওয়ারনার ফন ফ্রেটিসকে বরখাস্ত করে মানস্টেইনকে ১৮তম ইনফ্রেনট্রি ডিভিসনের কমান্ডার করা হয় এবং এসময় মানস্টেইন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে প্রমোশন পান।
১৯৩৮ সালে জুলাই এর শেষের দিকে তিনি তার উর্ধতন জেনারেল বেক কে চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমনের ব্যপারে তার ধারনা শেয়ার করেন। কিন্তু বেক তার পরিকল্পনা নিয়ে জার্মান ফুয়েরার হিটলারের সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। এবং তিনি মানস্টেইনকে এই বলে সাবধান করে দেন তার এই পরিকল্পনা হিটলারের কাছে উত্থাপন করলে হিতে বিপরিত হতে পারে। তিনি ঝুকি নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং হিটলারের কাছে নিজেই পরিকল্পনা উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন।
২০ এপ্রিল ১৯৩৯, হিটলারের ৫০তম জন্মদিন। হিটলারের জন্মদিনে মানস্টেই্নকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তিনি তার বক্তব্যে হিটলারতে ঈস্বর প্রেরিত জার্মান জাতির রক্ষক হিসাবে বর্ননা করেন এবং তিনি হুশিয়ার করেন জার্মানদের জন্য অবরুদ্ধ বিশ্ব খুলে দেয়ার জন্য যাকে একজন সাধারন জার্মান স্বপ্ন দেখতে পারে। মুলত ২য় বিশ্বযুদ্ধের আন্যতম একটা বীষ বৃক্ষ রোপিত হয়েছিল মানস্টেইনের এই বক্তব্যে।
জাতীয় নেতার জন্মদিন উদযাপন করা জার্মান সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য না হলেও হিটলারের ৫০তম জন্মদিন জার্মান আর্মি অফিসাররা আন অফিসিয়াল ভাবে পালন করে। জার্মান সেনাবাহিনীর ৪২ শতাংশ অফিসার এই জন্মদিন পালন করে। আর এই জন্মদিন পালনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন মানস্টেইনের মতো অফিসাররা। মুলত জার্মান সেনাবাহিনীর আন ফিল্ড অফিসাররা এর মাধ্যমে নাজি পার্টির নজরে আসেন। এবং তারা কোন না কোন ভাবে নাজি পার্টির সদস্য হন। এই আন ফিল্ড অফিসারদের সাথে নাজি পার্টির সম্পর্ক সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর বর্ননাটি দেন ইযরাইলি ইতিহাসবিদ ওমর বারতোভ। তিনি বলেন
“ব্যক্তিগত উচ্চাসা, প্রযুক্তিগত উচ্চাসা এবং কট্টর জাতীয়তাবাদি হিসাবে হিটলারের সেনাবাহিনীতে নিজেদের প্রমান ও ব্যক্তিগত, পেশাগত ও আর্মি লিডার হিসাবে নিজেদের প্রমান করার জন্য তারা সবসময় চেস্টা করে গেছে। বেক বা গুদেরিয়ান, মানস্টেইন বা রোমেল, ডোনেতৎ বা কিসারলিং, মেলরিক বা উডিচ তারা তাদের পেশাগত দায়িত্বের প্রতি উৎসর্গ ছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে নাজি আদর্শ ও নাজিজমে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে গেছেন। এবং হিটলার এবং তার জেনারেলরা মনে করতেন নাজি জার্মানী তাদের জন্য স্বর্গ। এবং জার্মান সেনাবাহিনীতে তারা নাজিজমের প্রসার ঘটিয়েছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত বেক ও গুদেরিয়ান নাজিজম থেকে সরে এসেছিলেন।”
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৬