somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সলিমুল্লাহ খানের সাথে একটি বিকেল এবং কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

২৩ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রখ্যাত বক্তা ও বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খানের সাথে আমার আধাঘণ্টার একটি সৌজন্যসাক্ষাতের সুযোগ হয়। সে ছিল বড় মজাদার সাক্ষাতকার। ভাবলাম, সেই অভিজ্ঞতাটুকু আজকের জার্নালে শেয়ার করা যাক।

আগে কিভাবে এই সাক্ষাৎলাভের উপক্রম হল , তা বলি।

প্রথম ঘটনা ২০১৪ সালের। এক শুক্রবার সকালে শাহবাগের পাঠক সমাবেশে ওনার সাথে আমার প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ। তখন ওনার সাথে কথোপকথনের একফাকে ওনাকে জানাই যে আমার একটি প্রকাশিত বই আছে, শেষ বসন্তের গল্প নামে। উনি আমাকে জানান, জহির রায়হানেরও একটি বই আছে শেষ বিকেলের মেয়ে নামে। আমি আমতা আমতা করি পরবর্তী বাক্যের জন্যে, আরও পরিষ্কার হওয়ার জন্যে যে জহির রায়হানের কথা উল্লেখ করে উনি কি বোঝাতে চাইলেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে রায়হানের হাজার বছর ধরে পড়া ছাড়া ওনার আর কোন সাহিত্যকর্মের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। যাই হোক, সলিমুল্লাহ সাহেব ওনার একটা ভিজিটিং কার্ড তিনি আমাকে দিয়ে বলেন, আমার বইটি এক কপি যেন ওনাকে দিই। উনি পড়ে দেখবেন।

দ্বিতীয় ঘটনা ২০১৬ সালের। সলিমুল্লাহ সাহেবের একটা ভালো অভ্যাস হল, তার মোবাইলে টেক্সট পাঠালে তিনি রিপ্লে করেন। তা অপরিচিত কারো হলেও। ২০১৬ সালে একটা টক শোতে - এক সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী, যিনি আমার সরাসরি শিক্ষকও ছিলেন , তাকে সলিমুল্লাহ সাহেব একদম ধুয়ে দেন। আমি সে রাতেই সলিমুল্লাহ সাহেবকে টেক্সট করে তার সাহসী বক্তব্যের জন্যে ধন্যবাদজ্ঞাপন করলে উনি রিপ্লে দেন ইংরেজিতে, বাংলায় যার তর্জমা করলে অর্থ দাঁড়ায় - "এত সিরিয়াসলি নিয়েন না ব্যাপারটা, খানিকটা উইটের সাথে গ্রহণ করেন।" মানুষকে সামনা সামনি, হাসিমুখে বাঁশ দিতে পারাটা একটা বিরল সক্ষমতা, বিশেষত উইটের সাথে, পার্সোনালি না নিয়ে। সলিমুল্লাহ সাহেবের সেই সক্ষমতার সাথে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটে আরও খানিকটা বিলম্বে।

গেল বছর, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি নানা কারণে প্রফেশনাল লাইফে বেশ টালমাটাল অবস্থায় ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এমন সকল রঙে রূপে আমার সামনে উপস্থিত হচ্ছিল - যার ব্যাপারে আমি আগে ওয়াকেফহাল থাকলে হয়তো কখনোই শিক্ষকতায় আসতাম না। যাক, তো, ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারি মাসে আমি আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্যে গুরুস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ শুরু করি। কারণ, আপনি যত বড় হবেন, দেখবেন পরামর্শ নেয়ার মত লোক তত কমতে থাকবে। আশেপাশে কেবল আপনাকে প্রতিযোগী ভাবা স্বার্থপর, হিংসুটে মানুষের গিজগিজানো বাড়বে। সেই সূত্র ধরেই আমি পুনরায় সলিমুল্লাহ সাহেবকে টেক্সট করি, তার সাথে একবেলা দেখা করবার সুযোগ চেয়ে। এবার আর সত্বর জবাব আসে না। জবাব আসে ছয়দিন পর। ফেব্রুয়ারির বইমেলায় হাঁটছি, এমন সময় একটা ম্যাসেজ এলো। দেখি, সলিমুল্লাহ সাহেব ঐ ম্যাসেজে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ২০১৯ এর বইমেলায় তার একটি বই এসেছে "প্রার্থনা" নামে। এবং একটি নির্দিষ্ট দিন আমাকে ধার্য করে দেন, তার কর্মস্থলে এসে তার সাথে চা পান করে যাবার।

আমার মূল গল্পের শুরু এখান থেকে।

২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল বেলা আমাকে দেখা যায় ধানমণ্ডির একটি প্রখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসিপশনে কিঞ্চিত শঙ্কিত অবস্থায় বসে থাকতে। আমার ব্যাগে সলিমুল্লাহ সাহেবের প্রকাশিত নতুন বই 'প্রার্থনা'। সাথে আমার নিজের প্রকাশিত ছ'টি বই। পাঁচ বছর আগে একটি বই ছিল, সেটা নেড়ে চেড়ে দেখতে চেয়েছিলেন। কালে কালে আরও পাঁচটি বই যোগ হয়েছিল আমার ঝুলিতে, তার সবগুলিই এককপি করে নিয়ে এসেছিলাম ওনাকে উপহার দেবার জন্যে।

সাড়ে চারটা বাজলে রিসিপশনে গিয়ে বলি যে সলিমুল্লাহ স্যারকে একটি ফোন দিয়ে আমার আগমনের কথা জানাতে। পারমিশন পাওয়ার পর লিফটে উঠে গিয়ে দেখি, সলিমুল্লাহ সাহেব নিজেই তার রুম ছেড়ে বাইরে এসে অপেক্ষা করছেন আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। আমি ওনার আতিথিয়তায় মুগ্ধ হই। তবে এও বুঝি, আমার চেহারা আমাকে মার দিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সাথে আজ চার বছর ধরে জড়িত থাকলেও, আমাকে এখনো দেখে ছাত্রই মনে হয়। এর অসুবিধা এই যে - মানুষ আমাকে সিরিয়াসলি নিতে চায় না। আমার পুরনো আশঙ্কাই ফিরে এলো, সলিমুল্লাহ সাহেবের সাথে আমার সাক্ষাৎকার পর্ব হয়তো ধারণার চেয়েও সংক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছে। তাহলে আমার আড়াইশো টাকা সিএনজি ভাড়াটা বাজে খরচের কাতারেই পড়তে চলেছে। এছাড়াও, তার প্রার্থনা বইটা কষে পড়ে এসেছিলাম, তার ওপর খানিকক্ষণ আলোচনা করতে। সে সুযোগও বোধয় হবে না।

ওনার রুমে গিয়ে বসার পর প্রথমেই ওনার বইটা আগিয়ে দিয়ে একটা অটোগ্রাফ চাইলাম। সলিমুল্লাহ সাহেব খুব আন্তরিকতার সাথেই অটোগ্রাফ দিলেন। পরে একে একে আমার ছয়টি বই বের করে তাকে এগিয়ে দেয়া মাত্র চেহারা দেখে মনে হল উনি খানিকটা বিরক্ত। তিনি সবার ওপরের বইটি তুলে ধরে আমার নাম দেখে প্রথম কথাটি যেটা বললেন তা হল - "আপনার নাম সাজিদ উল হক কেন?" আমি উত্তর দিলাম, এটাই আমার পিতৃপ্রদত্ত নাম। তিনি আমাকে বুঝালেন, আরবি না জানার কারণে আমার বাবা এই ধরনের "মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি" একটা নাম রেখেছেন। কারণ, প্রকৃত আরবি অনুযায়ী নামটা হবার কথা সাজিদুল হক, অথবা সাজেদ আল হক। আমার নাম এ দুটির মাঝামাঝি।

কেন প্রথমবারেই আমার নামের বানান ধরে আমাকে নাস্তানাবুদ করার প্রয়োজন মনে করলেন সলিমুল্লাহ সাহেব, এটা নিয়ে পরে আমি অনেক ভেবেছি। সলিমুল্লাহ সাহেবের ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে ওনার চরিত্রের ব্যাপারে জেনে, এবং আমার সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা থেকে যে ব্যাখ্যা আমার মাথায় এসেছে, তা হল ওনার মত একজন গুরুস্থানীয় মানুষকে আমার মত অর্বাচীনের নিজের একসঙ্গে ছয়খানা বই উপহার দেয়ার ধৃষ্টতা প্রদর্শন ওনাকে কষ্ট দিয়েছিল। হয়তো তিনি ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত অবমাননা হিসেবেই নিয়েছিলেন।

সলিমুল্লাহ সাহেবের যে বইগুলি বাজারে আছে, তা বেশীরভাগই তার সম্পাদনায়, বা অনুবাদ কাজ। এছাড়াও, আমার শিক্ষকস্থানীয় অনেকের সঙ্গে পূর্ব আলাপচারিতার দরুন আমার জানা ছিল যে, অরিজিন্যাল/ সৃষ্টিশীল কাজ যারা করে, অর্থাৎ ফিকশান রাইটার শ্রেণীর প্রতি তাদের অনেকেরই একটা চাপা ক্ষোভ কাজ করে। সৃজনশীলতা ঈশ্বরের উপহার। সবাই তা পায় না।

যাক, জিজ্ঞেস করলেন আমি পড়াশোনা কোথায় করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের নাম শুনে তিনি বেশ কিছুক্ষণ বিষোদগার করলেন এই বিভাগের শিক্ষকদের প্রতি - যে তারা কিভাবে কলোনিয়াল প্রোপ্যাগান্ডা এখনো তলায় তলায় ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। এখন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি - এটা জিজ্ঞেস করলে আমি আমার কর্মস্থলের নাম বললাম। জানতাম যে দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষ করে আসার পর তিনি আমার কর্মস্থলেই প্রথম অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু মালিকপক্ষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তিনি এখানে বেশীদিন চাকুরী করতে পারেন নি। দীর্ঘদিন তিনি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার পর তার বর্তমান কর্মস্থল ইউল্যাবে যোগদান করেন। যাক, কোন এক কারণে তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষকেও তুমুল তুলাধুনা করলেন কিছুক্ষণ। আমি সুযোগ খুঁজছিলাম এই অস্বস্তিকর বিষয়সমূহ থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।

ভাবলাম, যা কিছুই বলছি, যেহেতু তিনি বিরক্তই হচ্ছেন, নিজেকে খানিকটা ভালনারেবল রূপে তার সামনে উপস্থাপন করা যাক। বললাম - স্যার, যদিও আমার পড়াশোনা ইংরেজিতে, তবুও আমার ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে আমি খানিকটা দ্বিধায় থাকি, সেটা নেটিভ এক্সেন্টের মত হয় না বলে। এইবার সলিমুল্লাহ সাহেবকে খানিকটা উৎসাহিত মনে হল। তিনি আমাকে বুঝালেন যে নেটিভদের সংস্পর্শে না থাকলে উচ্চারণ কখনো নেটিভদের মত হয় না। তিনি দশ বছরকাল সময় অ্যামেরিকায় ছিলেন। অ্যামেরিকার টিভি শো গুলি দেখে দেখে তিনি উচ্চারণ শুধরেছেন।

আলোচনার এই পর্যায় থেকে বাকিটুকু সময় তিনি আমার সাথে স্রেফ ইংরেজিতেই কথা বলেন। কেন, এইটা নিয়ে পাঠকের চিন্তার একটা স্পেস ছেড়ে দিচ্ছি।

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন - এই যে মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের এত হই হল্লা, এত আবেগ, তবুও কেন মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা দানের ব্যাপারে আমাদের পলিসি মেকিং লেভেলে এত অনীহা? কেন ক্লাসরুম গুলিতে শিক্ষকদের বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজিতেই কথা বলা লাগে? কেন বেশীরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজিতে? কেন দোকানপাট, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ইংরেজিকরন করা হচ্ছে? একটু উত্তেজিত হয়ে তিনি বলে বসলেন - যারা বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে নাম রাখে, তারা শুয়োরের বাচ্চা। ছফা সাহেবের চ্যালাদের রেগে গেলে মুখ ঠিক থাকে না, এটা তাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিকভাবে গ্রহণ করাই যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ঢাকা শহরে আমার স্থায়ী নিবাস আমার মায়ের নামে - রোকেয়া ভিলা। কাজেই সলিমুল্লাহ সাহেবের দোষ যদিও নাই, কিন্তু তবুও গালিটা আমার গায়ের ওপরই যেন ল্যান্ড করলো। আমি প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

লেখার প্রসঙ্গ আসতে সলিমুল্লাহ সাহেব কথায় কথায় উল্লেখ করলেন আশির দশকের ঢাবির ছাত্রসমাজের তৎপরতার কথা। তার ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি একটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন, যেখানে খুব সিরিয়াসধরনের তাত্ত্বিক সামাজিক আলোচনাগুলি হত। সলিমুল্লাহ সাহেব বেশ গর্ব করে বললেন - নাম ছিল সে পত্রিকার "প্রাক্সিস জার্নাল"।

এবার আমার ছাই দিয়ে মাছ ধরার পালা। আমি শিক্ষকস্থানীয় কারো সাথে কখনোই সামনে বা পেছনে অভব্য আচরণ করতে পারি না। কিন্তু মায়ের নামে বাড়ি, আর সলিমুল্লাহ সাহেবের গালির তোড়ে সেদিন মুখ দিয়ে প্রায় বের হয়েই যাচ্ছিল যে - আপনার ছাত্রজীবনে লিটল ম্যাগের নাম প্রাক্সিস জার্নাল রাখার ফলে আপনার কী নিজেকে বর্তমানে একজন শুয়োরের বাচ্চা মনে হয়? কিন্তু আদতে বললাম - স্যার, আপনার ছাত্রজীবনে প্রকাশিত লিটল ম্যাগের নাম মাতৃভাষায় না রেখে প্রাক্সিস জার্নাল রাখার কারণে কি আপনার এখন কোন দুঃখবোধ হয়? তিনি খানিকটা হতচকিত হয়ে বললেন - না। একটু পর চিন্তা করে বললেন প্রাক্সিস টার্মটা গ্রেশিয়ান ফিলসফি থেকে ধার করা। আমি ভাবলাম, আচ্ছা, গ্রীক দর্শনের আরও অনেক চমৎকারী গুণের একটি হল শুয়োরের বাচ্চাকে মানুষের বাচ্চা বানিয়ে ফেলা।

উক্ত দিনের শেষ ভুলটা করলাম এর পর। ঢাবির ইতিহাস বিভাগের এক প্রথিতযশা অধ্যাপক আমার পিতৃস্থানীয়। তিনি আশির দশকে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও সারাজীবন বামপন্থী রাজনীতির সাথে তার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল। আশির দশক পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির রাজনীতিতে পিঙ্ক পার্টি, তথা জাসদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আমার চাচা ছিলেন সে দলেরই মুখপাত্র। পোস্ট কলোনিয়াল থিওরির আন্তর্জাতিক মহারথী দিপেশ চক্রবর্তী চাচার বন্ধুস্থানীয়। পাকিস্তানে মুসলিম লীগের পতনের উপর চাচার পিএইচডি থিসিস বাংলাদেশের ইউপিএল থেকে প্রকাশিত, যেটার বঙ্গানুবাদ আমি করেছিলাম ২০১৫ সালে, এবং এর উপর একটি বক্তৃতা করার সুযোগ হয় ২০১৬ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু তে, বাংলাদেশ স্টাডি ফোরামের নিমন্ত্রনে

আমি উক্ত অনুবাদের সূত্র ধরেই সলিমুল্লাহ সাহেবকে আমার চাচার কথা বলেছিলাম।

সলিমুল্লাহ সাহেব এবার ব্যক্তিগত বিষোদগারে লিপ্ত হলেন। তার স্থির ধারণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশে ফেরার পর তার চাকুরী হয়েই যেতো - যদি আমার চাচা খানিকটা চেষ্টা করতেন। কারণ ঢাবির সিনেটে সে সময় চাচার প্রভাব ছিল। সলিমুল্লাহ সাহেব সাংঘাতিক রকমের কটু কথাবার্তা আমার চাচাকে নিয়ে বলেন, আমার ইদানীং সেটা মনে পড়লে দুঃখ লাগে, এবং নিজেকে খানিকটা আত্মমর্যাদাহীন মনে হয়, যে কেন সে সময়ে চুপ ছিলাম। আবার এটাও মনে হয় যে - শিক্ষক শ্রেণীর মানুষদের সামনা সামনি বেয়াদবি করবার অভ্যাস ছোট বেলা থেকে নেই বলেই হয়তো পেরে উঠি নি।

আমি চাচার সাথে পরবর্তীতে এ বিষয়ে কথা বলি, এবং যেটা জানতে পারি তা হল - সলিমুল্লাহ সাহেব ঢাবির আইন বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করলেও আইন বিভাগে চাকুরী পান নি। পেয়েছিলেন পরবর্তীতে ঢাবির আইবিতে। সেখান থেকে তিনি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে অ্যামেরিকা চলে যান। এক পর্যায়ে তার চাকুরী চলে যায় আইবিএতে। তার বিবিধ ব্যাখ্যা আমি শুনেছি। সেগুলি এখানে উল্লেখ করতে চাই না।

সলিমুল্লাহ সাহেব বলেন, অ্যামেরিকায় ওনার একটা স্থির জীবন ছিল। আমার চাচার নেমন্তন্নেই নাকি উনি সে নিশ্চিত জীবন ছেড়ে ঢাকায় ফেরত আসেন, কারণ তাকে নাকি প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির। লং স্টোরি শর্ট, ঢাকায় ফেরত আসার পর, চাচার তদবিরে, ঢাবির নবগঠিত উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ওনাকে প্রভাষকের পদে চাকরির প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সলিমুল্লাহ সাহেব উষ্মার সাথে সে অফার ফিরিয়ে দেন। কেন ফিরিয়ে দেন তার দু' ধরনের ব্যাখ্যা আমি শুনেছি।

সলিমুল্লাহ সাহেবের কাছ থেকে যে ব্যাখ্যা আমি শুনেছি, তার সাথে আমি নিজেও খানিকটা একমত। তিনি বলেন, অ্যামেরিকার একজন পিএইচডি হোল্ডারকে তারা কোন যুক্তিতে প্রভাষকের চাকরি অফার করে? তিনি নাকি এই প্রস্তাবের উত্তরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উত্তর দিয়েছিলেন বলেছিলেন যে, তার নিয়োগ প্রভাষক পদে হলেও তাকে সহকারী অধ্যাপকের বেতন দিতে হবে। যেটা আসলে ঘুরিয়ে না বলে দেয়ার মতই।

চাচার মুখ থেকে যে ব্যাখ্যাটা পেয়েছি তা হল - সলিমুল্লাহ সাহেবের প্রথম রেসপন্স ছিল যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পড়ানোর যোগ্যতা রাখেন, তাকে লেকচারারের পদ অফার করা হয় কিভাবে। তখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল যে একবার লেকচারার হিসেবে ঢুকলে তার অন্যান্য যোগ্যতা বিবেচনায় দ্রুত প্রোমোশনের ব্যাবস্থা করা যাবে, কিন্তু আগে একবার চাকুরীতে ঢুকে নিন। কিন্তু সলিমুল্লাহ সাহেব রাজি হন নি।

রাজি হননি বটে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনার হরিণ অধরা থেকে যাওয়ার দরুন তার মনের দংশনের কারণেই কিনা কে জানে, ঢাবির শিক্ষকদের প্রতি সলিমুল্লাহ সাহেবের প্রচণ্ড হিংসাত্মক বিদ্বেষমূলক আচরণ টিভিতে স্পষ্টতই দেখা যায়।

শেষ একটি বিষয় সেদিনের বৈঠকে যেটা আমি আলোচনায় এনেছিলাম, তা হল - মেহেরজান বিতর্কের একটা সিরিজ ভিডিও ইউটিউবে আছে। ফরহাদ মজহার সাহেব এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সলিমুল্লাহ খান যে সাহসিকতাপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন, যে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়েছিলেন, ইউটিউবে সে বিতর্ক দেখার পরেই আমি সলিমুল্লাহ খানের অনুরক্ত হয়ে পড়ি। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, অথবা বৃহদার্থে যেকোনো ধরনের জাতীয়তাবাদই যে সর্বাংশে খারাপ নয়, সেটা তিনি ফ্রাঞ্জ ফানোর দা রেচেড অফ দ্য আর্থের রেফারেন্স দিয়ে বুঝিয়ে বলেছিলেন যে - জাতীয়তাবাদ যদি উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার হয়, তবে তা অবলম্বন করাই উচিৎ। '৭১ এর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ছিল তেমনই কিছু। তিনি বলেন সিনেমার খাতিরে যদি পাকিস্তানি আর্মির সাথে বাঙ্গালী মেয়ের প্রেম স্বীকার করতে আমাদের অসুবিধা না থাকে তবে কালকে দেশের কোন একটা অঞ্চল যদি স্বাধীনতার ঝাণ্ডা উড়ায়ে দিয়ে বলে আমরা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনা স্বীকার করি না, তবে তারে অস্বীকার করা যাবে কোন যুক্তিতে।

আমি সলিমুল্লাহ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম - এত এত বাঘা সব প্রতিপক্ষের মধ্যে বসে স্থিরভাবে তিনি কিভাবে সবাইকে যুক্তি দিয়ে ফালা ফালা করেছিলেন সেদিন?

সলিমুল্লাহ সাহেব হেসে উত্তর দিয়েছিলেন - স্যার, সব উপর থেকে নাজিল হইসিলো!

এক অর্বাচীনের সাথে কি নিদারুণ এক তামাশাই না করলেন প্রিয় সলিমুল্লাহ সাহেব।

যাক , সলিমুল্লাহ সাহেব আমাকে চা দিয়ে আপ্যায়ন করেন, এবং বের হয়ে আসার সময় আমাকে একদম লিফটে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীচতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন। পথিমধ্যে কারো সাথে ওনার কথোপকথনের একপর্যায়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন - ইনি আমার বন্ধু। এটা ওনার অপরিসীম উদারতাই বলতে হয়।

গতবছরেই কয়েকমাসের ব্যবধানে সলিমুল্লাহ সাহেবের সাথে আমার প্রায় বারদশেক দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে, যেহেতু ঢাকা ছোট শহর, এবং তার ইন্টেলেকচুয়াল পরিমণ্ডল আরও ছোট। আমি খুব অবাক হয়ে, এবং বিষণ্ণতার সাথে লক্ষ্য করেছি, যতবার আমি ওনার সামনাসামনি হয়েছি, নিজে উপযাচক হয়ে কথা বলতে গিয়েছি, তিনি কখনো আমার সাথে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। আমি জানি না কেন। হয়তো এটা কারণ হতে পারে যে - বেয়াদবের মত আমার আধডজন বই ওনাকে উপহার দেয়ার বিষয়টা ওনাকে অফেন্ডেড করেছে, যদিও এটার সম্ভাবনা কম। রিসেন্ট একটা ভিডিওতে দেখলাম উনি বলছেন - নোয়াম চমস্কি ভাষাতত্ত্বের কিছুই বোঝে না। এই ধরনের মন্তব্য পাগলামোর পূর্বলক্ষণ কিনা, সেটা নিয়ে পৃথক আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু নোয়াম চমস্কিকে যিনি ট্র্যাশ মনে করেন উনি আমাকে মুতে দিলে ভেসে যাবে কাতারের লেখক হিসেবেই ধরার কথা। হয়তো এটাও কারণ হতে পারে যে - আমার চাচার সম্পর্কে প্রচণ্ড রকমের অফেন্সিভ কথা বলার পর তার নিজেরই আর আগ্রহ হয় নাই, বা অস্বস্তি লেগেছে আমাকে দেখে। ধরেন আপনি এক ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে অপর এক মহিলার চরিত্র নিয়ে অনেক বাজে কথা বললেন, পরে দেখলেন ঐ মহিলা তার বৌ, এইরকম আর কি।

জ্ঞানতাপশ আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের একটা তিনমাসের ওয়ার্কশপে আমি পরবর্তীতে অংশ নিই, যেখানে সলিমুল্লাহ সাহেব প্রায় ছ'টি লেকচার দেন। সেখানে ছাত্র - শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে বসে আমি সলিমুল্লাহ সাহেবকে শিক্ষক হিসেবে ডিকোড করার সুযোগ পাই।
এখান থেকে খানিকক্ষণ শিক্ষক সলিমুল্লাহ সাহেবের গাঠনিক সমালোচনা হোক।

সলিমুল্লাহ সাহেব যে বিষয়ে ক্লাসরুমে লেকচার দেন, সে বিষয়ে সেদিনের প্রধান প্রধান টার্মগুলিকে তিনি প্রথমে সাফিক্স প্রিফিক্সে ভেঙ্গে তাদের আদি ল্যাতিন/ গ্রীক রুট নিয়ে লেকচার দেন লেকচারের সময়ের চল্লিশ শতাংশ সময়। যেটা শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেও মনে করি একটা ভালো কাজ। মূল টার্মগুলোর আদি রুট জানাটা উক্ত টার্মকে নৃতাত্ত্বিকভাবে, এবং আরও নানা আঙ্গিকে বোঝার সুযোগ করে দেয়।ক্লাসের বাকি ষাট শতাংশ সময়ের চল্লিশ শতাংশ সময় তিনি উক্ত লেকচার উপলক্ষে যে আর্টিকেল বা বই পড়ে এসেছেন, সেগুলি গুছিয়ে আলোচনা করেন। বাকি বিশ শতাংশ সময় চলে প্রশ্নোত্তর পর্ব, যা প্রায়ই মূল আলোচনার প্রসঙ্গ ছেড়ে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে যা কিছু পড়ছেন, যা ভাবছেন তা নিয়ে ছাড়া ছাড়া আলোচনা করেন, এই সময়টাতে তিনি যাদের দেখতে পারেন না, তাদের প্রচুর গালিগালাজ করেন, এবং খুবই দৃষ্টিকটু ভাবে। জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের উক্ত কোর্সে আমি যাদের সাথে ক্লাসরুম শেয়ার করেছি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের অনেকেই শিক্ষকদের দিকে সমালোচনার দৃষ্টিতে তাকাতে অভ্যস্ত ছিল না, যেটা আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় লুপহোল বলে আমি মনে করি। ফলে সলিমুল্লাহ সাহেবের দিকে তাদের দৃষ্টি ছিল যাদুর বাঁশরী বাজানো যাদুকরের দিকে সম্মোহিত স্রোতার মত, যারা সামনা সামনি সলিমুল্লাহ সাহেবের কথা শুনতে পারছেন বলেই নিজেকে ধন্য মনে করেন। ধন্য মনে করাই যায়, আমি নিজেও খুশী, ওনার বক্তৃতা সামনা সামনি শুনে, যেহেতু উনি এতবড় সেলিব্রেটি এবং পোড়া দেশের একমাত্র স্বীকৃত বুদ্ধিজীবী।

কোন রকম সন্দেহ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের সবচে তুখোড় টিভি আলোচক। যেকোনো টিভি আলোচনায় তিনি অন্যান্য সব আলোচকদের থেকে ঐদিনের টপিকে বেশী পড়াশোনা করে আসেন। ফলে তার টেক্সচুয়াল আলোচনা হয় অন্য সবার থেকে শানিত। সাথে থাকে তার অনন্য উপস্থাপন ভঙ্গী, এবং মানুষকে অপমান করার আজন্মলালিত সক্ষমতা। ২০১৩ সালে ফরহাদ মজহারের সাথে তার মেরুকরণের ব্যাপারে আমার অর্বাচীন মস্তিষ্ক প্রসূত একটা ধারণা হচ্ছে - যদি উনি ফরহাদ সাহেবের বিরুদ্ধে কথা না বলতেন, তাহলে ওনার আর টিভি চ্যানেলে এসে নিজের বুদ্ধি বিক্রি করার সুযোগ থাকতো ন কারণ টিভিচ্যানেল সহ মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলি ততদিনে ফরহাদ সাহেবরে থরোলি বয়কট করা শুরু করেছে। ফরহাদ সাহেবের টিভি না হইলেও চলে। ওনার উবিনিগ আছে, করে কর্মে খেতে পারবেন। সল্লিমুল্লাহ সাহেবের টিভিতে চেহারা দেখানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে গেলে ওনার ইউল্যাবের রুমটা ছাড়া আর কিছু থাকবে না। নইলে যে ফরহাদ সাহেবকে তিনি একসময় মহাত্মা ফরহাদ মজহার বলে উল্লেখ করতেন, তার সাথে এমন ১৮০ ডিগ্রী ইউটার্ন নেবার কোন কারণ তো আমার বুঝে আসে না। এছাড়াও উবিনিগের মালিকানা ভাগাভাগি সংক্রান্ত কিছু গুজব আমার কানে এসেছে। গুজব, গুজবের জায়গায় থাক। তবে, ২০১০ সালের আগে উবিনিগের সেমিনারে সামনের সারিতে বসে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সাথে গ্রামসি নিয়া প্যাঁচ লাগানোর চেষ্টা করার পর স্পিভাকের - 'আমি থিওরি নিয়া ক্যাচাল পাড়ার জন্যে থিওরি পড়ি না, জীবনের সমস্যা সমাধান করার জন্যে থিওরি পড়ি' - এই ঝাড় খাইতে সলিমুল্লাহ সাহেবকে তো দেখাই যাইত। এগুলো তো ঐতিহাসিক সত্য। ইউটিউবে ভিডিও আছে।

সলিমুল্লাহ সাহেবের আর এক নীতিগত আচরণ আমার বুদ্ধির বাইরে। আমরা যারা ঢাকাভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার নিয়মিত স্রোতা, তারা জানি যে সলিমুল্লাহ 'মহাত্মা' জ্যাক লাকার অনুরক্ত, এবং টীকাকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যার ক্লাসরুমে বসে আমি পড়ালেখা শিখেছি - সেই শিক্ষক, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর অনুবাদ, ইউজিসি প্রফেসর ফকরুল আলম স্যারের বিরুদ্ধে তাকে আমি জাহাঙ্গীরনগরের ফুঁকো সংক্রান্ত এক বক্তৃতায় সরাসরি বাজে কথা বলতে শুনেছি, তিনি বলেছিলেন - ফকরুল সাহেবকে আমি জ্যাক লাকার কথা বলা মাত্র ফকরুল সাহেব বলেন - লাকা আমি অমন ভালো বুঝি না। সলিমুল্লাহ সাহেবের অভিযোগ ছিল - হাউ ডেয়ার হি! জ্যাক লাকার সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করার ধৃষ্টতা ফকরুল সাহেবের কি করে হল।

ইউল্যাবে যে দিন আমি সলিমুল্লাহ সাহেবের সাথে দেখা করি, সেদিন উনি হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলেন - ঢাকায় ফিরে এসে আমি দেখি কেউ ফুঁকো বিক্রি করছে, কেউ দেরিদা বিক্রি করছে। ফলে আমি লাকা বিক্রি করা শুরু করলাম। আর আমি লাকা বিক্রি করা শুরু করবার পর দেখি বাকিরা লাকা নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। বলেই তিনি অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়েন।

এই কথার কি অর্থ? জ্যাক লাকাকে সলিমুল্লাহ সাহেব না বিক্রি করলেও উনি পোস্ট ফ্রয়েডিয়ান সাইকোলজির বিশ্বব্যাপী এক অন্যতম অনুষঙ্গ হয়েই থাকবেন। কিন্তু সলিমুল্লাহ সাহেব যেটা আমাকে বললেন, সে বক্তব্যের পর, এটা ভাবাটা কি অন্যায় যে - লাকাকে স্রেফ নাম ভাঙ্গিয়ে চলার জন্যেই উনি বার বার আউড়ান? বাংলাদেশে 'বুদ্ধিজীবী' দের একশ্রেণীকে যেমন - রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, নজরুল বিশেষজ্ঞ, লালন বিশেষজ্ঞ, ফুঁকো বিশেষজ্ঞ হতে বিশেষভাবে উদগ্রীব দেখা যায়, যাতে এইসমস্ত বিষয়ে সভা সেমিনার হলেই তারা তাতে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করতে পারেন। হালকা চালে বলা সলিমুল্লাহ সাহেবের কথাতেও কি সেই স্পৃহাই, বুদ্ধিবৃত্তিক অসততাই স্পষ্ট হয় না?

ফকরুল স্যারের মত একজন শিক্ষক, যিনি আজীবন বলে গেসেন আমার জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে এই পোডিয়ামের পিছে নিভৃতচারী বক্তৃতায়, যার আজীবনের আদর্শ এডওয়ার্ড সায়ীদ, কত অসংখ্য অগণিত মেধাবী ছাত্র ওনার রেফারেন্সে দেশের বাইরে বৃত্তি নিয়ে পড়তে গিয়েছে। আজ যদি প্রশ্ন করি, সলিমুল্লাহ সাহেব টিভিতে দুর্ধর্ষ বক্তৃতা করেন, ওনার রেফারেন্সে কয়জন ছাত্র বাইরে পড়তে গিয়েছে, বা কয়জন ছাত্র/ছাত্রীর চাকরি হয়েছে - সলিমুল্লাহ সাহেব কি উত্তর দেবেন?

কয়েকদিন আগে দেখলাম , উনি টেলিভিশনে বলে চলছেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নাকি সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের সাথে গোপন আঁতাত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। উপস্থাপক, সলিমুল্লাহ সাহেবের এই ধারণার ভিত্তি কি জিজ্ঞেস করতে সলিমুল্লাহ সাহেব বলেন, যেহেতু ওনার নাম শর্ট লিস্টেড হয়েছিল কাজেই ওনার কিছু গোপন আঁতাত তো ছিল নিশ্চয়ই। বলিহারি চিন্তা! এদিকে আজীবন বামপন্থী রাজনীতির অকুণ্ঠ সমর্থক , এবং একরঙা ফুলহাতা শার্ট আর মাথার ওপরে শরীফ ছাতা ধরে টিচার্স কোয়াটার থেকে কলাভবন আর কলাভবন থেকে টিচার্স কোয়াটার যাতায়াত করা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার বিএনপি বা আওয়ামীলীগ - কোন সরকারকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিয়ে কথা বলেন নি জীবনে কোনদিন। এরশাদের আমলে তাকে ভিসি বানানোর প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত ছিল, কিন্তু এরশাদ সরকারের এজেন্ডা তিনি বাস্তবায়ন করতে অপারগতা জানিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে সরে আসেন। তার নির্ভীক উচ্চারণের জন্যেই দলমত নির্বিশেষে তিনি শ্রদ্ধেয়, জাতীয় অধ্যাপক।

মনে পড়ে, সলিমুল্লাহ সাহেব ক্লাসে বলছেন - এই আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার ভালো মানুষ, কিন্তু তার কথা এত লম্বা করার প্রয়োজন কি? সবাই যে সামনে ঘুমায়ে পড়ে, এইটা উনি বুঝেন না কেন। এই ধরনের কথা সর্বজনের শ্রদ্ধার জায়গা থাকা একজন মানুষের পক্ষে আরেকজন শ্রদ্ধেয় মানুষের বলা শোভা পায়? ভরা মজলিসে? সবার সামনে? আনিসুজ্জামান স্যার, আনু মুহাম্মদ স্যার সহ আরও অনেকের ব্যাপারে তার অনেক ব্যক্তিগত ক্ষোভ। তালিকা লম্বা করে কি ফায়দা।

ডঃ হুমায়ূন আজাদ, ডঃ আহমদ শরীফ - আমার পরিবারের সাথে অবিচ্ছেদ্য দুই নাম। সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যয়নরত আমার বাবার সরাসরি শিক্ষক ওনারা দুজন। বাবা দুজনেরই ফ্যান ছিলেন। ফলে আমার অবচেতন শৈশবের একটা অংশ ওনাদের পরিমণ্ডলে কেটেছে। ওনাদের কোলে চড়বার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। হুমায়ূন আজাদ স্যারের ব্যাপারে সলিমুল্লাহ সাহেব অ্যান্ড গং এককথায় ট্র্যাশ শব্দটি উচ্চারণ করেন। আজাদ স্যারের ব্যক্তি মতাদর্শের সাথে আমার পরিণত বয়সের চিন্তার মিল নেই, ওনার গবেষণা পর্যায়ের বইগুলোও নানাভাবে সমালোচিত। কিন্তু আজাদ স্যারের যে সৃজনশীল লেখা, তার কোন জবাব কি সলিমুল্লাহ সাহেবের আছে? আজাদ স্যারের জাস্ট একটা শিশুসাহিত্য - ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না'র শেষ লাইন, আমি এতো ডাকি রাড়িখাল, তুমি হুমাইর দেও না কেন - এর উপযুক্ত কোন বাক্য সলিমুল্লাহ সাহেবের সৃজনশীল কথামালার আদ্যোপান্তে আছে কোথাও?

আমি মনে করি, বাংলার ষোল কোটি জনগণের দুর্ভাগ্য যে সলিমুল্লাহ সাহেব বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অধিপতি। আমি ব্রাত্যজন। আমার মনে করায় কারো কিছু আসে যায় না। কিন্তু উনি ক্রমাগত সব বিষয়ে সুইপিং কমেন্ট করে করে দু' চার কলম লিখতে পড়তে পারা বাংলার মানুষজনদের বিচারবুদ্ধির লেভেল নিয়ে ক্রমাগত হাসি ঠাট্টা করে যাচ্ছেন - এ যন্ত্রনাই বা ভুলি কিভাবে?

তবুও , আমি মনে করি সলিমুল্লাহ সাহেব প্রয়োজনীয়। কারণ পেছনে প্রোপ্যাগান্ডা থাক আর না থাক - তিনি স্পষ্টভাবে প্রত্যেকটা কথা উচ্চারণ করেন। তিনি ফুঁকো, লাকা , ফ্রয়েডের টিকা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিয়ে যেতে পারেন, আর আমরা শ্রোতারা যেহেতু অকম্মার ঢেঁকি, কুঁড়ের বাদশাহ , নিজেদের তত্ত্ব নির্মাণ - বিনির্মাণের ইতিহাস নিয়ে বোঝাপড়া করবার আগ্রহ নাই - সলিমুল্লাহ সাহেবের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে ভক্তি গদগদ করে তাকিয়ে থাকতে পারি, কৃষ্ণের প্রতি রাধার নয়নে। শুধু প্রয়োজন উনি যাদের দেখতে পারেন না, যাদের দেখলে ঈর্ষায় ওনার শরীর রি রি করে, তাদের প্রতি আর একটু সহনশীল আচরণ। জিহ্বার আর একটু সংযত ব্যবহার। যা বলি তার সবই মানুষ গিলবে, এমন একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়ে গেলেই যা খুশী তাই বলে বেড়ানোটা ভদ্রজনচিত আচরণ নয়। আমার মত দু' একজন নালায়েক বেয়াদব ছাড়া তার সব ছাত্রছাত্রী তাকে প্রায় পূজা করে। তার স্পষ্টবক্তা স্বভাবের জন্যে আরামপ্রিয় - উদারপন্থী বাঙালীর ঘরে ঘরে তার প্রশংসা। দু'চারটে মুদ্রাদোষ তার যা আছে - সেগুলো যদি তার মর্জি হয়, উনি কাটিয়ে উঠেন তবে তাকে বাংলার টেলিভিশন/টকশোপ্রিয় জনতা স্মরণে রাখবে, শ্রদ্ধাভরেই। তদুপরি গুরু যদি দুই কলম লেখার উদ্যোগ হাতে নেন আবার, তাইলে তো কথাই নাই।

আমার সমালোচনার অংশ খেয়াল করবেন, ওনার পাবলিক বক্তৃতা, আর ছাপার হরফে যা আছে তার ওপর ভিত্তি করে লেখা। ওনার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সূত্রে নয়। নইলে ঢাকার 'বুদ্ধিজীবী' মহলে ওনাকে নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে। সেগুলি সজ্ঞানে এখানে বর্জন করা হয়েছে।

শেষ করি সলিমুল্লাহ সাহেবের প্রার্থনা বইটির ৪২ তম পাতায় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের ওপর লেখা প্রবন্ধের একটি উক্তি দিয়ে, যেখানে তিনি রাজ্জাক স্যারকে মেপেছেন প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার, আর সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের সাথে( সৈয়দ আলী আহসান সাহেব যদ্দুর জানি মেজর জিয়া আর জেনারেল এরশাদের আমলে সব বড়বড় প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন। ওনার সাথে সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারকে এক কাতারে ফেলে বিচার করতে যাওয়ার চেষ্টাটাই কি একটা ফ্যালাসি না? আবার সলিমুল্লাহ খান সৈয়দ আলী আহসান, বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারকে পরিমাপ করেন কিসের যোগ্যতায়, একি তার ইউটিউবে ভিউ সংখ্যার ভিত্তিতে, নাকি অন্যকোন মস্তিষ্কপ্রসূত জটিলতায়, এই প্রশ্ন মনে দানা বাঁধলে কাকে দোষ দিই?

যাক, উক্তিটি হোল

"অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক লেখার মত কিছুই লেখেন নাই - এ কথা অসত্য নয়। তারপরেও আপনারা যাই বলেন না কেন আমি কিন্তু এক ডজন সৈয়দ আলী আহসান কিংবা দুই গ্রোস ( এক গ্রোসে ১৪৪, দুই গ্রোসে ২৮৮) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লগে একজন না - লেখক আব্দুর রাজ্জাকের বদলা নিতে রাজি হব না। জানি এ তুলনাটাও কারো কারো কাছে হাসির খোরাক বৈ নয়।"

এই উক্তির শেষ লাইনটি সলিমুল্লাহ সাহেবের দিব্যজ্ঞানের পরিচায়ক তো বটেই, আর প্রথম লাইনগুলি তার কিসের পরিচায়ক, তা পাঠকদের নির্ণয় করার জন্যেই ছেড়ে দিই।

সলিমুল্লাহ সাহেবের মানসিক ও শারীরিক সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৩০
১৪টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×