somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙাল মস্তিস্কের বি উপনিবেশায়ন - ৪ঃ বাক স্বাধীনতা, প্রাচ্যে - পাশ্চাত্যে

২০ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১।

বর্তমান বিশ্বের মেটাল ব্যান্ড সমূহের মধ্যে জনপ্রিয়তম জার্মান ব্যান্ড রামস্টেইনের সূত্র ধরে আলোচনা শুরু করি। পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের 'সহনশীলতা', এবং 'বাক স্বাধীনতা' র সংজ্ঞা এবং প্রয়োগে তফাৎগুলো স্পস্ট করবার জন্যে এ লেখা। গবেষণালব্ধ ফলাফল নয়, আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া। দ্বিমত হতেই পারে, ,সহনশীলতার গণ্ডিতে থেকে।
.
রামস্টেইন নামক উক্ত ব্যান্ড, নব্বইয়ের দশকে তাদের যাত্রার শুরু থেকেই রাজনীতি হোক বা যৌনতার মতো ইস্যু হোক - সবকিছু নিয়েই খুব এক্সপ্লিসিট গান তৈরি করতে থাকে। আমি তাদের গানের ভিডিও দেখে নই, বরং অডিও অ্যালবাম শুনে তাদের ফলো করা শুরু করি। সাধারণ, কিন্তু মারাত্মক হ্যাভি রিফে তাদের এক একটা গান তৈরি। ইউটিউবে তাদের প্রায় প্রতিটা গানেরই কমেন্ট সেকশন ডিজেবল করা থাকে, ম্যাচিওর কনটেন্ট বলে।

দু' বছর আগে, ২০১৯ সালে তারা ডয়েচল্যান্ড নামে একটি গান রিলিজ দেয়, যাতে নির্মম সততার সাথে জার্মান জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের কাঁটাছেড়া করা হয়েছে। সেটা একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় কতোগুলো ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে একটা জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জার্মেনিয়ার উত্থান। ৯ খ্রিস্টাব্দে 'ব্যাটল অফ টয়টোবুর্গ ফরেস্ট' এ রোমানদের পরাজিত করবার মাধ্যমে জার্মান জাতির উত্থান। জেনারেল আর্মিনাসের নেতৃত্বে সে লড়াইয়ে এমন নির্মমভাবে রোমানদের জার্মানিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংঘবদ্ধ জাতিগোষ্ঠীরা পরাজিত করে যে, তারপর থেকে রাইন নদীর পূর্বপার্শে রোমানদের পা রাখার সাহস কখনোই হয় নি। বলা হয়ে থাকে, এই যুদ্ধে টয়টোবুর্গ বনের একটা গাছ ছিল না, যাতে মৃত রোমান সৈন্যদের লাশ ঝুলছিল না। এই টয়টোবুরগের যুদ্ধের নৃশংস দৃশ্যাবলীর মাধ্যমে গানের শুরু।
.
গানটা সাড়ে নয় মিনিট লম্বা। পুরো গানের বর্ণনা, বা গানে বর্ণিত ইতিহাসের আলোচনায় যাবো না। প্রথম - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নাজিবাহিনীর দ্বারা ইহুদী, সমকামীদের ফাঁসীতে ঝুলানোর ভয়াবহ দৃশ্য এতে উপস্থিত। পরাজয়ের পর দুইভাগ হয়ে যাওয়া জার্মানিতে রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা তো আছেই, আছে খোদ জার্মানি রাষ্ট্রের সমালোচনা। এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে ভিডিওর আদ্যোপান্ত জার্মেনিয়ার মূর্ত রুপ হিসেবে দেখানো হয়। সে নিজে কখনো নৃশংস উপায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর ওপর। কখনো তাকেই তার দেশের দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিকরা কেটে খায়। এই কেটে খাওয়ার ক্যানিবলিস্টিক দৃশ্য আছে ভিডিওতে। যখন ইহুদী আর সমকামীদের নাজিরা ফাঁসীতে ঝোলায়, জার্মানরূপী সে নারী পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফোঁকে। কখনো জার্মেনিয়া নিজেই লাস্যময়ী হয়ে মারামারি লাগিয়ে দেয় দুই বলিষ্ঠ পুরুষের সাথে, ধরে নেয়া যায় তারা দুটো রাষ্ট্র। কখনো সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে জার্মানরূপী সে নারীমূর্তিকে গর্ভবতী দেখানো হয়। কিন্তু সে প্রসব করে কুকুরছানা।
.
এই ভিডিও দেখতে দেখতে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্ন আসে, - বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার, বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন রুথলেস কাঁটাছেড়া আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না।
.
মজার ঘটনা হচ্ছে, এই গান যে বছর রিলিজ পায়, সে বছরেই রামস্টেইন রাশিয়া সফর করে। রাশিয়া - জার্মানির মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি হয়েছিল, আমরা জানি। তবুও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ৭০ বছর পর, রামস্টেইন রাশিয়ার মস্কোতে পারফরম করে ২০১৯ সালে। ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারের নাকের ডগায়, স্টেডিয়ামে উপস্থিত লাখখানেক রাশান দর্শককে সঙ্গে নিয়ে রামস্টেইন চিৎকার করে গায় - 'Deutschland, Deutschland über allen!' বা 'জার্মানি, সবার উপর জার্মানি!'
.
ইউটিউবে মস্কোতে পারফর্মেন্সের ভিডিওর মন্তব্যের বক্সে মন্তব্যগুলো পড়লে হাসতে হাসতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। রাশান কেউ মন্তব্য করছেন - 'রাশিয়া দখল করার তরিকা ১০১ঃ শীতকালে আক্রমণের পরিকল্পনা করো না, আর রামস্টেইনকে পাঠিয়ে দাও।' কেউ বলছেন, 'আমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সারভাইবার দাদাঠাকুর আজ বেঁচে থাকলে নির্ঘাত এই গান, আর ডয়েচল্যান্ড ডয়েচল্যান্ড শ্লোগান শুনে হার্ট ফেইল করে মারা যেতেন।' জেনোফোবিক মন্তব্য খুব কম দেখলাম।
.
এখানেই আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন - একই কাজ বাংলাদেশে, বা ভারতে, বা পাকিস্তানের মাটিতে সম্ভব কিনা। ক্রীড়ার ক্ষেত্রে হয়ত জাতীয় সঙ্গীত বাজায়। মেইনস্ট্রিম এন্টারটেইনমেন্ট হলে? কোন পাকিস্তানী ব্যান্ড ভারত / বাংলাদেশের মাটিতে পারফর্ম করতে এসে পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দিতে পারবে? বা আমরা পারবো পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে এই শ্লোগান দিতে? উত্তর আমাদের জানা নেই। আমাদের কমনসেন্স বলে, এটা সম্ভব না।
.
এই গানের বিরুদ্ধে জার্মানির জিউইশ কাউন্সিল, জার্মানিতে থাকা ইসরায়েলের অ্যাম্বাসেডর, গভমেন্ট কমিশন অফ এন্টি সিমাটিজম - সবাই মিলে ইউটিউব থেকে এই গানের রিমুভাল চেয়েছেন, জার্মানিতে ব্যান্ডের শাস্তি দাবী করেছেন - ইহুদী জাতির উপর নিপীড়নের, হত্যাকাণ্ড পরিচালনার দৃশ্যাবলীকে রামস্টেইন তাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে বলে। কোন ব্যবস্থাই ব্যান্ডের বিরুদ্ধে নেয়া হয় নি। গানটাও বহাল তবিয়তে আছে। জার্মান সংস্কৃতির এম্বাসেডর হিসেবে জাত শত্রু রাশিয়ায় বুকের উপর জার্মানি জিন্দাবাদ জার্মানি জিন্দাবাদ নিজেরা গেয়ে এবং রাশিয়ানদের গাইয়ে এসেছে তারা।
.
জেনে রাখা ভালো, এই সুযোগ কিন্তু 'সিস্টেম অফ এ ডন' নামের আরেক ফেনোমেনা ব্যান্ড, তুরস্কের মাটিতে গিয়ে পায় নি। কারন সিস্টেম অফ এ ডন আর্মেনিয়ান জাতিস্বত্বার পক্ষে কথা বলে। তুরস্কের সরকার এই আর্মেনিয়ান অরিজিনের বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ডকে দেশে ঢুকতেও দেয় নি।
.
নিজেদের প্রশ্ন করা দরকার, কেন সারা পৃথিবীর বিতর্কিত লেখক - চিন্তক - বুদ্ধিজীবী - শিল্পীরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। এলিফ শাফাক, যার লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, একজন ইউরোপিয়ান ভদ্রমহিলা যিনি রুমি আর শামসুদ্দিন তাব্রিজের মধ্যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ককে এত অসাধারণভাবে ব্যখ্যা করেছেন, কেন তাকে তুরস্কে গ্রেফতারি পরোয়ানার মধ্য দিয়ে যেতে হয়? কেন তাকে ইংল্যান্ডকে নিজের বাসস্থান হিসেবে বেছে নিতে হয়?
.
বোঝা যায় আমাদের, আমাদের বলতে সারা পৃথিবীর মুসলিম, ভারতের হিন্দু, এবং মায়ানমারের বৌদ্ধ কমিউনিটির বাক স্বাধীনতার যে সংজ্ঞা, তার সঙ্গে ইউরোপের বাকস্বাধীনতার সংজ্ঞা মেলে না।
.
একটা প্রশ্ন থেকে যায়। মানলাম ইউরোপ ফ্রিডম অফ স্পিচের এক পরম রক্ষক। এখনও তলে তলে হয়তো তারা কট্টর ন্যাশনালিস্ট, কিন্তু আর্ট - কালচারের ক্ষেত্রে সে ছাড়টুকু তারা দিচ্ছে। কিন্তু মুসলিমদের কী তারা ভিন্ন চোখে দেখে?
.
প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নও আমাদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার বা বিচার/জাজ করবার কোন কারন আমরাই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি কিনা। গতবছরের বয়কট ফ্রান্স ইস্যুর সঙ্গে মিলিয়ে চিন্তা করবার অনুরোধ।
.
২।
উল্লেখ করলাম রাশিয়ার বর্তমান প্রজন্মের জার্মানির সংস্কৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরার ঘটনা। বললাম জার্মানির সবচে বিখ্যাত ব্যান্ড রামস্টেইনকে রাশিয়ায় আমন্ত্রণ করে তাদের সঙ্গে 'জার্মানি জিন্দাবাদ জার্মানি জিন্দাবাদ' শ্লোগান দেয়ার গল্প, গানের তালে তালে। পাকিস্তান '৭১ এ তাদের যুদ্ধাপরাধের জন্যে আমাদের কাছে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায় নি। যদি চায়ও, পাকিস্তানী কোন ব্যান্ড তারপর বাংলাদেশে এসে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে চিৎকার করলে বাংলাদেশের মানুষ তাদের সঙ্গে গলা মেলাবে বলে মনে হয় না। অন্তত আমি পারবো না। '৭১এর ক্ষত এখনও শুকায়নি আমাদের মনে।
.
জাতীয়তাবাদ, ধর্ম - এ সমস্ত ইস্যুকে দক্ষিন এশিয়ার জনসাধারণ খুব সিরিয়াসলি ধারন করে ব্যক্তিজীবনে। পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদরা জাতীয়তাবাদ ও ধর্মকে নিয়ে যতটা সচেতন, তাদের রাজনীতির প্রয়োজনেই, তাদের আমজনতার মাথাব্যাথা অতটা নয়। বিশেষত ধর্মকে তাদের অধিকাংশই আর সিরিয়াসলি নেয় না। মনে হতে পারে যে আমি আন্দাজে কথা বলছি, বা ঢালাওভাবে মন্তব্য করছি। আমি সংস্কৃতির জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখি, আমি অনুরোধ করবো ইউরোপ - অ্যামেরিকায় স্যাক্রিলিজিয়াস, স্যাটানিক ব্যান্ডের সংখ্যা, তাদের কনসার্টে কি পরিমান মানুষ হয়, তারা কি ধরনের লিরিকের গান লেখে, এসমস্ত ব্যাপারে একটু খবর নিয়ে দেখতে। আমার সবচে পছন্দের ব্যান্ড ল্যাম্ব অফ গডের একদম প্রথম অ্যালবামের নামই ছিল 'বার্ন দা প্রিস্ট'। হেভি মেটাল জনরার সবচে পুরনো এবং সবচে বিখ্যাত একটি ব্যান্ড স্লেয়ারের সাম্প্রতিক একটা রিলিজের শ্লোগান হচ্ছে - 'গড হেইটস আস অল' ! এরকম অসংখ্য অসংখ্য উদাহরন দেয়া যাবে, যা থেকে বোঝা যায় পাশ্চাত্যে ধর্মভীরুতা কমে একদম তলানিতে ঠেকেছে। আমি জাজ করছি না। বলছি যে, এটা তাদের দীর্ঘদিনের চর্চা, এবং অবস্থা।
.
এসমস্ত ব্যাপারকে প্রাককথন হিসেবে বিবেচনা করলে ফ্রান্সে শারলে হেবদোতে আমাদের রাসুল (সঃ) কে নিয়ে আঁকা ব্যাঙ্গচিত্রের ঘটনাটি স্রেফ বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা বলে মনে হয় না। মনে হয়, তারা 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা' -র যে ফর্ম প্র্যাকটিস করে, সেটার এক কন্টিনিউয়েশন।
.
পাশ্চাত্য থিঙ্কট্যাঙ্কের/দের মুসলিমদের অপছন্দ করবার একটা কারন হচ্ছে এই যে - পৃথিবীতে এই একটা ধর্ম, যার অনুসারীরা এখনও দাবী করে তাদের ঐশীগ্রন্থের আগমনের পর থেকে তাতে একবিন্দু সংযোজন - বিয়োজন হয় নি। এবং এই ধর্মের লোকরা খুব আক্ষরিক অর্থে তাদের ধর্মকে গ্রহণ ও পালন করে। ধর্মগ্রন্থের অকাট্যতা, এবং জীবনদর্শন নিয়ে মুসলিমদের এই সিরিয়াসনেসের সঙ্গে তারা একাত্মবোধ করতে পারে না, এবং মুসলিমদের সফট কর্নার বিবেচনায় খোঁচা দেয়ার মোক্ষম জায়গা হিসেবে ধরে নিয়ে মাঝেমধ্যে এই খেলাটা খেলে। মুসলিমদের আবেগের সবচে দুর্বলতার জায়গা, রাসুল (সঃ), এবং আল কুরআনকে নিয়ে তামাশা করে। এবং অধিকাংশ সময়েই তাদের কনশাস/সাবকনশাস প্রয়াস সফল হয়। ব্যাঙ্গচিত্র মুক্তি পাওয়ার পর প্রায়ই তাদের উপর মুসলিমদের হামলা চালানোর ঘটনা শোনা যায়। হয়তো সে ঘটনা তাদের দেশে সেই দিন, বা সে সময় অন্যান্য যে সমস্ত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চলছে, তার চে খুব বড় কিছু না। গণতন্ত্রের নামে যে বৈশ্বিক সন্ত্রাসের ফেরি তারা প্রত্যহ করে বেড়ায়, তার চেয়েও খুব বড়মাপের কিছু সে আক্রমন না। কিন্তু ইসলামের নামে যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালিত হয়, তা যে পরিমান মিডিয়া কাভারেজ পায়, সেটা সাধারণ সন্ত্রাসী তৎপরতার চে ৭৫৮ শতাংশ বেশী। (সূত্র)


.
মুসলিমদের এভাবে অভিযুক্ত করবার একটা সাধারণ রাজনৈতিক কারন আমরা আন্দাজ করতে পারি। পুঁজির ফ্লো ঔপনিবেশিক কাল থেকেই পশ্চিমমুখী, ফলে নানা বর্ডার ব্যারিয়ার দিয়েও পশ্চিম অভিমুখী মানুষের ঢল থামানো যাচ্ছে না। তাদের এক বড় অংশ মুসলিম অভিবাসী। আরব। আফ্রিকান। সাউথ এশিয়ান। ইউরোপের সাধারণ শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এই অভিবাসী বিরোধী আক্রোশ বাড়ছে। অভিবাসীরা ভাগ বসাচ্ছে নেটিভদের ইকনোমিতে। আর এ অভিবাসীদের মধ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ আছে হোস্ট দেশের কালচারকে রেস্পেক্ট না করার। একজন ল্যাতিন, একজন কৃশাঙ্গ খৃষ্টান, একজন ভারতীয় হিন্দু, এশিয়ান হয়তো মিলে যেতে পারছে ইউরোপ - অ্যামেরিকা - অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে, মুসলমানরা খুব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও তাদের ধর্ম এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি নিয়ে। ধর্মকে নিয়ে সদা হেলাফেলা করা ইউরোপিয়ানদের এটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। তারা মুসলিমদের জন্যে অভিবাসনের নিয়মে পরিবর্তন আনছে, বা আনার চেষ্টা করছে। এবং যে মুসলিমরা এখনও আছে তাদের দেশে, তাদের ওপর সারভিলেন্স/নজরদারী বাড়াচ্ছে।
.
তাদের এ মনভাবের জন্যে আমি তাদের দোষ কীভাবে দিই? ভারত বা চীন থেকে যারা আমাদের দেশে কাজ করতে আসছে, তাদের আমরা বাংলাদেশীরা কোন দৃষ্টিতে দেখি? রোহিঙ্গারা প্রথম প্রথম যখন এসে উদ্বাস্তুর মতো উঠলো বাংলাদেশে, তাদের প্রতি প্রাথমিক যে প্যান ইসলামিক চেতনায় অনেকের ভালোবাসা উথলে উঠেছিল, এখনও কি সে ভালোবাসা অটুট আছে, না কি রোহিঙ্গা শব্দটি এখন গালি হিসেবে পথেঘাটে ব্যবহৃত হচ্ছে? তাদের এথনোগ্রাফির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে যে - তারা জাতিগতভাবেই সহিংস কিনা। তাদের দেখা হচ্ছে গলার কাঁটা হিসেবে। কাজেই পাশ্চাত্যও যে মুসলিম অভিবাসীদের অপত্যস্নেহের চোখে দেখবে, সে আশায় গুড়েবালি।
.
যখন আমি ইসলামোফোবদের সাথে সাধারণ মুসলিমদের তর্ক দেখি, খেয়াল করি যে একটা হাস্যকর ভুল প্রায়ই মুসলিমরা করে। তারা নাস্তিক্যের ছদ্মবেশে থাকা ইসলামোফবদের প্রায়ই বলে - "আপনি কীভাবে 'এটা' বা 'ওটা' বলতে পারেন! জানেন কুরআন কি বলেছে এই ব্যাপারে?!" কথা হচ্ছে, কোরআনকে তো ইসলামোফোবরা মানে না। তাদের কুরআনিক রেফারেন্স দেয়ার মতো অনর্থক কাজ আর কি হতে পারে? এই মুসলিমদের যদি বেদ বা বাইবেলের রেফারেন্সে কিছু বলা হয়, তারা কি তা মেনে নেবে? আমার মনে হয়, ফ্রান্স বা পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক প্রয়াসকে ইসলামিক সেন্টিমেন্ট দিয়ে ডিল করবার চেষ্টাও মুসলমানদের একই রকম একটা ভুল। তারা মুসলিমদের সেন্টিমেন্টের উপর ভিত্তি করে তাদের কোন পলিসি নির্ধারণ কখনোই করবে না, যদি না এখানে বাণিজ্যের কোন ব্যাপার থাকে।
.
ফ্রান্স বা অন্য যেকোনো ইউরোপিয়ান দেশকে নৈতিকভাবে বেড় দেয়ার একটা সহজ উপায় হচ্ছে, তাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের উপর সহজ দু' একটা বই পড়া। বেশী দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, এই ষাটের দশকে আলজেরিয়ার ফ্রেঞ্চ উপনিবেশ বিরোধী ইতিহাস পড়লেই জানা যায়, জাতি হিসেবে ফ্রান্স কতোবড় চোদনা ছিল।
.
ইউরোপে যখন এমন একটা আপহিভেল হয়, যেমনটা আমরা দেখলাম গত বছরের নভেম্বর - ডিসেম্বরে, তখন বাংলাদেশী মুসলিমদের চোখ রাখা উচিৎ ইউরোপিয়ান ইসলামিক স্কলারদের দিকে। ইউরোপে যে মুসলিমরা বাস করছে তাদের চোখ দিয়েই আমাদের ইউরোপে মুসলিমদের অবস্থা বুঝতে হবে। নিজেদের আবেগ দিয়ে না। ইউরোপিয়ান দেশগুলোর কন্স্যুলেটের সামনে তাদের পতাকা পুড়িয়ে না। আমার আপনার আত্মীয়স্বজন ঐদেশের সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়তে যায়। কেউ কাজ করতে যায়। কেউ খয়রাত করতেও যায়। এটা যেন আমরা না ভুলি।
.
ইউরোপের জনগন আর দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমরা সমান না। এ অঞ্চলের মুসলিমদের সামনে পড়ে আছে অন্তত দুশো বছরের দায়িত্ব, নিজেদের ঢেলে সাজানোর। জ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, শিল্পে, সাহিত্যে নিজেদের সমৃদ্ধ করার। গালি দেবো ইসরায়েলকে, আবার নতুন নতুন ঔষধ আবিস্কারের জন্যেও তাকিয়েও থাকবো হাভাতের মতো ওদের দিকেই? কি দুর্ভাগ্যজনক বিষয়!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:১৫
৯টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×