somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূতির খালের হাওয়া ১৬ - বইমেলা ২০২১ এর প্রাক্বালে, লেখালিখি নিয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা ও অতীত ইতিহাস

১৭ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।

"Between my finger and my thumb
The squat pen rests; snug as a gun.

Under my window, a clean rasping sound
When the spade sinks into gravelly ground:
My father, digging. I look down

Till his straining rump among the flowerbeds
Bends low, comes up twenty years away
Stooping in rhythm through potato drills
Where he was digging.

The coarse boot nestled on the lug, the shaft
Against the inside knee was levered firmly.
He rooted out tall tops, buried the bright edge deep
To scatter new potatoes that we picked,
Loving their cool hardness in our hands.

By God, the old man could handle a spade.
Just like his old man.

My grandfather cut more turf in a day
Than any other man on Toner’s bog.
Once I carried him milk in a bottle
Corked sloppily with paper. He straightened up
To drink it, then fell to right away
Nicking and slicing neatly, heaving sods
Over his shoulder, going down and down
For the good turf. Digging.

The cold smell of potato mould, the squelch and slap
Of soggy peat, the curt cuts of an edge
Through living roots awaken in my head.
But I’ve no spade to follow men like them.

Between my finger and my thumb
The squat pen rests.
I’ll dig with it."


Seamus Heaney, "Digging" from Death of a Naturalist.

২।

গল্পের ঝুলি শুন্য হয়ে গেলে, মানুষের যখন বলার কিছুই বাকি থাকে না, তখন সে নাকি নিজের জীবনের গল্প বলতে বসে। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অমন নয়। বলার মতো, লেখার মতো, শোনানোর মতো জমা হয়ে আছে আরও অনেক গল্প। তবে আজকের প্রেক্ষিতটা খানিকটা ভিন্ন। বইমেলা শুরু হচ্ছে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতায়, ভিন্ন প্রেক্ষিতে, আগামীকাল থেকে। বইমেলার মৌসুমকে কেন্দ্র করে আমার লেখক হয়ে ওঠার কিছু গল্প বলার আগ্রহ বোধ করছি আজ।

বইমেলার মৌসুম এলেই আমার ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা মনে পড়ে যায়। আমি তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আইনের ছাত্র চিশতি অনিমেশ কানন, প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে তখন ঢাবির পরমাণু শক্তি ও গবেষণা কেন্দ্রের পাশে তৈরি হওয়া নতুন একটি ভবন, যা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ বর্তমানে তাদের সভা সেমিনারের জন্যে কাজে লাগায়, তার নীচে বসে আড্ডা দিতাম, গান লিখতাম, সুর করতাম। শর্ট ফিল্মের প্ল্যান করতাম।

এখন ঢাবিতে অনেক কিছুই নেই। সোডিয়াম বাতিকেও প্রতিস্থাপন করেছে লেডের রুপালি আলো। আমরা, ছাত্রজীবনে অভ্যস্ত ছিলাম সোডিয়াম বাতির ঘোলা আলোতে। ঐ আলোর নীচে বসে আমরা স্বপ্ন দেখতাম আমাদের সৃজনশীলতা নিয়ে। মুখে মুখে রাজা উজির মারতাম অনেক। আমাদের পলিটিকাল কনশাসনেস ছিল কম। আমরা রাদার কালচারাল রেভল্যুশন নিয়েই মাথা খাটাতাম বেশী।

তখন বইমেলার সময় টিএসসিতে বসতো নানা রকম ভাজিপোড়া খাবারের মেলা। সড়ক দ্বীপে চা তো ছিলই, ভ্যানে করে নিয়ে আসা পেয়াজু, বেগুনী, এই সেই চপ, আমার মূল আকর্ষণ ছিল পাঁচটাকা দামের জিলিপিতে। প্রতিদিন অনেকগুলো করে জিলিপি খেতাম। এই বৈকালিক নাস্তা শেষ করে আমি আর কানন হেলে দুলে হাঁটা শুরু করতাম বইমেলার দিকে। বই কেনার মতো পয়সা পকেটে থাকতো না আম দিনগুলোতে। বই দেখে, নাড়াচাড়া করে এসে বসতাম বইমেলার বাইরে, বাংলা অ্যাকাডেমির সামনের রোড ডিভাইডারে।

২০১৩র বইমেলার শেষ দিনগুলির একটিতে আমরা তেমনিভাবে বসে ছিলাম বইমেলার প্রবেশদ্বারের বিপরীতে রোড ডিভাইডারে। কানন সেদিন আমার কাছ থেকে কথা আদায় করিয়ে রেখেছিল, আমার লেখা গল্পগুলি গুছিয়ে ২০১৪র বইমেলায় একটা বই বের করার ব্যাপারে। আমরা দুজন তখন যে যা লিখছি, তৈরি করছি - ফিডব্যাকের জন্যে শেয়ার করছি একে অপরের সঙ্গে। অনলাইনে যেমন পীঠ চুলকাচুলকি, বা সারমেয়দের মতো কামড়াকামড়ি হয় সাহিত্যসমালোচনার নামে, আমাদের দুজনের মধ্যে সে লৌকিকতার বালাই ছিল না। লেখা ভালো না লাগলে একে অপরের মুখের ওপর বলে দিচ্ছি যে ভালো হয় নি, ভালো লাগে নি। কি হলে আর একটু ভালো হতো। বস্তুত, এমন দু একজন বন্ধু পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার, যারা সৎ পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়ে লেখক হিসেবে একে অপরকে গ্রো করতে সাহায্য করে। কাননের কবিতা লেখার হাত ছিল অসাধারণ। ওর কবিতার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে আমি কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।

যাই হোক, কানন যখন আমাকে বই বের করার প্রস্তাব দিলো, আমি তখনো লিখছি, পত্রিকায় কন্ট্রিবিউট করছি। বই বের করার পরিকল্পনাটা আমার কাছে ইতিবাচক মনে হল, কারন, এতে করে ফিরে আসার একটা তাড়া থাকে, লেখার কাছে। এক বইয়ের লেখক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করার আগ্রহ আমার কখনোই ছিল না। যদিও আমার চঞ্চল মন আমাকে সৃজনশীলতার এক শাখা থেকে আরেক শাখায় টেনে নিয়ে যেত স্বল্প বিরতিতেই। সাংবাদিকতার সূত্রে একদিন একজন বড় ফিল্ম মেকারের সাথে দেখা হল, কথা হল, তারপর একসপ্তাহ আমি ঘোরের ভেতরে থাকতাম সিনেমা বানানো নিয়ে। আবার কোন মিউজিশিয়ানের সাতে দেখা হলে কথা হলে, এমন ইন্সপায়ারড থাকতাম, মনে হতো, মিউজিক করাকেই প্রফেশন হিসেবে নেব। একবার এদিকে, একবার ওদিকে মন পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকতো, কারন, আমি নিশ্চিত ছিলাম না - আমার মূল সৃজনশক্তিটা কোনদিকে। নিজের অরিজিনাল শক্তির জায়গা খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত যে দোদুল্যমান অবস্থায় মানুষ থাকে, আমি ছিলাম ঠিক সে অবস্থায়। এমতাবস্থায় মনে হল, একটা বই যদি পাবলিশ করি, তবে সে প্রকাশিত বইয়ের সূত্র ধরেই আমার লেখালিখি চলতে থাকবে। বইটা হবে আমার ক্যারিয়ারের বেইজমেন্ট, যার ওপর ভর করে আমার স্বপ্ন লকলকিয়ে তরুণ চারাগাছের মতো বেড়ে উঠবে।


৩।



(ছবিঃ পাক্ষিক আনন্দধারায় সাংবাদিকতার দিনসমূহের একটা খণ্ডচিত্র। তিনটা লম্বা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, ফেরদৌস সাহেব, আইয়ুব বাচ্চু সাহেব, আর মাহফুজ আহমেদ সাহেবের। ২০১১ সালে নেয়া মাহফুজ সাহেবের সাক্ষাৎকারের দিনের ছবি। আনন্দধারা পত্রিকা অফিস। ইস্কাটন, ঢাকা।)

ছেলেবেলার শখের লেখালিখি যদি বাদ দিই, আমার মেইনস্ট্রিম লেখালিখির হাতেখড়ি আমার বাবার হাত ধরে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে, পাক্ষিক আনন্দধারা পত্রিকায় ফিচার রাইটার হিসেবে কাজ করা শুরু করি। বাবা ছিলেন ঐ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী, তারপর অরুণ চৌধুরী, তারপর কথাসাহিত্যিক মইনুল আহসান সাবের। বাবা আমাকে ওয়ার্ল্ড মিউজিক, সিনেমা ইত্যাদি বিটের ওপর ফিচার লিখতে দিতেন। নিজের সন্তানকে এভাবে পুল করছেন দেখে অফিসে তাকে প্রায়ই আড়ালে আবডালে বাজে কথার শিকার হতে হতো হতো। কিন্তু ঢাবির ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হিসেবে আমার যোগ্যতা নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন ছিল না বিধায় , সম্পাদকের হস্তক্ষেপে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট পেতে থাকি। আনন্দধারা পত্রিকায় লেখালিখি করে ২০১৬র জানুয়ারি পর্যন্ত। মধ্যে, ২০১৪ সাল থেকে জনকণ্ঠ পত্রিকায় নিয়মিত কন্ট্রিবিউট করেছি প্রায় ২০১৬র শুরু পর্যন্ত। তারপর ২০১৭ - ১৮ থেকে নিয়ে এখনও ইত্তেফাক পত্রিকায় মাঝেমাঝে লিখি। বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রিকায় আমার জুনিয়ররা চাকরী করে। পত্রিকায় হিসেব করে লিখতে হয় বলে দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখতে ভালো লাগে না। তারোপর, পত্রিকার সাব এডিটররা সুযোগ পেলেই, পদাধিকার বলে আমার লেখার ওপর কলম চালায়, যেটা আমার বিরক্তির আরেকটা কারন।

কিন্তু সাংবাদিকতা, আর সৃজনশীল কথাসাহিত্যের চর্চা একজিনিস নয়। নিজেকে ফিচার রাইটার, কলাম লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার কোন আগ্রহই আমার নেই। আমার চোখ ছিল বরাবর এমন কিছুতে, যা আমাকে ভিড়ের মানুষদের মধ্য থেকে আলাদা করবে। সৃজনশীলতার প্রতি আমার আগ্রহ সে কারনেই। তবে, সৃজনশীল লেখাকে ভবিতব্য হিসেবে বেছে নেয়ার পেছনে আমার দুটো গল্প আছে।

৪।



(ছবিঃ দেশ টিভির ধারাবাহিক 'রেডিও চকলেট' এর প্রেস কনফারেন্সে, ২০১২, ঢাকা ক্লাব।)

এই গল্প পরিণতি লাভ করে ২০১২ সালের মার্চ মাসে। গল্পের শুরু ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে।

আব্বু বিনোদন সাংবাদিক ছিলেন বলে, আজীবন বিনোদন জগতের মানুষের মাঝেই আমার বেড়ে ওঠা। পুরোটা কলেজ লাইফ জুড়ে আমার স্বপ্ন ছিল, অভিনেতা হবার। ছেলেবেলায় ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার কিছু পূর্বঅভিজ্ঞতার সূত্রে জানা ছিল, ক্যামেরার সামনে থাকা মানুষদের নিয়ে সাধারণ মানুষদের কি ক্রেজ থাকে। তরুণ বয়সে লাইম লাইটের প্রতি আগ্রহ, আর আমার বাবার নিরবচ্ছিন্ন উৎসাহ, আর সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে পোর্টফোলিও নিয়ে নানা পরিচালকের অফিসে ঘোরা শুরু করি। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ব্রেক থ্রু পাই। পরিচালক রেদওয়ান রনির রেডিও চকলেট নামে এক ধারাবাহিকে স্টেশনের আরজের চরিত্রে।

আমি থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডের ছিলাম না বলে অভিনয় ভালো পারতাম না। আমার সঙ্গের তরুণ অভিনেতা যারা ছিল, একজন বাদে তাদের কেউই ছিল না থিয়েটার শিখে আসা। ছবিয়াল, ভাই ব্রাদাররা আসলে থিয়েটারের অভিনেতাদের খুব একটা প্রেফার করে, এমনও না। রেডিও স্টেশনের মালিক দুই ভাইয়ের রোলে থাকা শহিদুজ্জামান সেলিম, আর মোশাররফ করিম সাহেব ছিলেন থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডের। তারা তো অভিনেতা হিসেবে কিংবদন্তির পর্যায়ে।

২০১২ র জানুয়ারি থেকে শুরু হল শুটিং। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাজ করলাম আশা সহকারে, কোন প্রশ্ন , বা সমালোচনাকে মনে জায়গা দেয়া ছাড়া। মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় সেমিস্টারের মিডের রেজাল্ট দিলো, দেখলাম, অধিকাংশ কোর্সে ডাব্বা মারছি। সারাজীবন পড়াশোনারে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেয়া আমার পক্ষে এহেন রেজাল্ট হজম করা মুশকিল ছিল। শুটিং এর জন্যে ক্লাস ফাঁকি দেয়া লাগছিল। এদিকে, সিরিয়ালে আমার চরিত্রটা আসলে কি - এটা নিয়ে ডিরেক্টরের কোন স্থির ধারনা ছিল না। উনি প্রধান চরিত্রগুলির ওপর ভর করে ধারাবাহিকের গল্প সামনে টানছিলেন। প্রতিদিন রাতে, ঘুমানোর আগে কিছু সিকোয়েন্স তার মাথায় আসতো। কোন ডায়লগ থাকতো না। সেটে ইনস্ট্যান্ট বুঝিয়ে দিতেন তিনি কি চাচ্ছেন। ক্যামেরার সামনে আমরা নিজেদের মতো করে ইম্প্রভাইজেশন করে অভিনয় করতাম। পাকা অভিনেতাদের জন্যে এটা একটা ভালো অভিজ্ঞতা হতে পারে, কিন্তু আমার মতো নতুন, আনকোরা অভিনেতাদের জন্যে স্ক্রিপ্ট ছাড়া অভিনয় কোরা মুশকিল। বাসা থেকে কিছু রিহার্স করে আসতে পারতাম না। পারফর্মেন্স ভালো হতো না। সব মিলিয়ে একটা হতাশা কাজ করতো।

নতুন অভিনেতা, সেটে যাই সকালে সবার আগে, ঢাকা শহরের একপ্রান্ত, গ্যান্ডারিয়া ফরিদাবাদ এলাকা থেকে মিরপুর ১২ পার হয়ে ডিওএইচএস। সারাদিনে, মূল অভিনেতাদের সোলো শট শেষ হলে রাত সাড়ে আটটা, নয়টায় ডাক পড়তো প্রায় দিনই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার। প্যাকাপ করে রাত এগারোটায় যখন ফিরতি বাসে চড়ে বসতাম, ঢাকা শহর তখন প্রায় খালি। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা, সাড়ে বারোটা। পড়ালেখা মাথায়। অভিনয় বাবদ একটা পয়সায় পাচ্ছি না। যাতায়াত ভাড়াও না। এভাবে হতাশা ক্রমশ বাড়ছিল।

একদিন, লাক্স ফটোসুন্দরী আরাবির সঙ্গে আমার একটা শট। আরাবি নিজেও আরজে ঐ নাটকে। একটা লম্বা শট, আমি দুই তিনবারে ওকে করতে পারছি না, তৃতীয় বা চতুর্থবারে গুছিয়ে এনেছিলাম প্রায়, এবার আরাবি হুট করে হেসে উঠে শট ভণ্ডুল করে দিলো। পঞ্চমবার আমি আর কোনভাবেই পেরে উঠলাম না। পরে, ডিরেক্টরকে বললাম, ভাই আমি আজকে আর কাজ করতে চাচ্ছি না। চলে যেতে চাই বাসায়। প্রচণ্ড হতাশ লাগছিল। মোশাররফ করিম ভাই সেই সিনে ছিলেন না, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা দেখছিলেন দূরে দাঁড়িয়ে। একটু পর উনি নিজেও এসে আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারপরেও আমি পারলাম না। ডিরেক্টর বলল ড্রেসিং রুমে গিয়ে ওয়েট করতে, বাসায় যেন না চলে যাই।

যে বিল্ডিং এ শুটিং হচ্ছিল, আমি তার ছাদে গিয়ে বসে রইলাম দীর্ঘ একটা সময়। আমার মূলত হতাশ লাগছিল, ডিরেক্টরের চাহিদা মতো আউটপুট দিতে পারছিলাম না বলে। নিজের জীবন কোন দিকে আগাচ্ছিল না বলে। ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুব অরগানাইজড মানুষ। আমার নিজের গোছানো প্যাটার্নের বাইরে ঘটনা প্রবাহ এগোতে থাকলে আমার মাথা হ্যাং করে। জীবন যদিও মূলত প্রবাহিত স্রোতে ভেসে থাকার অপর নাম, আমি জেনেও না জানার ভান করে থাকি তা। সেদিন, দীর্ঘদিন পর, জীবনে এমন একটা অবস্থায় পড়েছি বলে মনে হচ্ছিল যে, আমার আর আমার জীবনের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সাইকোলজিক্যালি প্রায় কোলাপ্স করে বসেছিলাম সেদিন। সেদিনই অবশ্য, ছাদে বসে বসে খুব সুন্দর একটা গান লিখি, আমার সে সময়ের মানসিক অবস্থার ওপর -

"যা কিছু দেখো, তাতেই মজে যাও
যা কিছু শোনো তুমি তাতেই হারাও
শুধু বোঝো না মন তোমার কুলহারা
যে কাছে, তাকে দূরে ঠেলে দাও
যে ভালোবেসেছে, তাকে পায়ে মাড়াও
কুহেলিকার খোঁজে হও ঘরছাড়া।।

ডানা ম্যালে পাখি ঐ নীলিমায়
তা দেখে মন কেঁদে ওঠে কেন হায়
তোমার নেইকো ডানা উড়তেও জানো না
তাই পোড়ো সে শীতল জলের ধারায়
ভুলে গেছো তুমি আছে কল্পনা
তার ডানায় চেপে উড়ে দেখো না
মনের ঝাঁপিতে হর্ষ বাঁধনহারা।

তীর ভেঙ্গে পথ খোঁজা সেই সে নদী
তার অস্থিরতাও যেন মৌন ছবি
তোমার দৈর্ঘ্যবিহীন চিত্তে অশান্ত ঢেউ
তার গভীরতা বুঝতে চায় ও না কেউ
চাপা বেদনা কাঁদে অলিক ছায়ায়
সুন্দর যা কিছু, তা আপনিই সুন্দর
অমূল্য ধনের কেনো করতে যাও দর
স্বপ্নের দাম করেছে কবে কারা?"


অর্থাৎ, একজন ২০ - ২২ বছর বয়সী বাঙ্গালীর স্বপ্নের একটা জীবন আমার হাতের মুঠোয় ছিল। টিউশনির বদলে পত্রিকায় লিখে হাতখরচ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে গ্রাজুয়েশন, ভালো বন্ধু, প্রেমিকা, পরিবারের সবাই সুস্থ্য। তবুও কেন লোভ করে আরও কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে সব হারাতে বসেছি আমি, তার ওপর এই গান। সুর করেছিলাম সেদিনই। রেকর্ড করি নি। র' ভার্শনটা আমার ফেসবুক পেইজে আছে।

যাই হোক, শেষ বিকেলে ড্রেসিং রুমে গিয়ে দেখলাম, বাকিরা শুটিং করছে। মোশাররফ করিম ভাই একা ড্রেসিং রুমে বসা। মোশাররফ ভাইয়ের সঙ্গে যাদের কর্মসূত্রে, বা ব্যক্তিগত সূত্রে পরিচয় আছে, তাদের জানার কথা, সেটে তিনি খুব ফ্রি একজন মানুষ। নিজের স্টারডম কাঁধে ক্যারি করে বেড়ান না। সেটে যখন কাজ বন্ধ থাকতো, তিনি নিজেই আড্ডায় হাসিতে গানে আসর মাতিয়ে রাখতেন। আমি তাকে বললাম, ভাই, আমি আর পারছি না। সব খুলে বলার পর, তিনি আমাকে একটা কথা বললেন। বললেন - তোমাকে দেখে আমার মনে হইসে, তুমি গ্রুপ ওয়ার্কের জন্যে পারফেক্ট না। ক্রিয়েটিভ কাজ করা যদি তোমার জন্যে একান্তই জরুরী হয়, এমন কোন কাজ খুঁজে বের করো, যেটা তুমি একা একা করতে পারবা।

আমি চিন্তা করে দেখলাম, উনি কথা ঠিক বলেছেন। আমি জীবনে যতবার ব্যান্ড ফর্ম করার চেষ্টা করসি আমার লাইফে, গানের, প্রত্যেকবার আমার ব্যান্ডমেটদের সঙ্গে আমার মিউজিক্যাল টেস্ট, সেন্স, ডিসিশনে ঝামেলা লাগসে। কিন্তু একা একা আমি মিউজিক করা আমার খুবই পছন্দের একটা কাজ। কাজেই দলবদ্ধ ক্রিয়েটিভ কাজ কোরা হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু, একাকী কোন কাজটা করবো আমি? নিজের ভেতরের আওয়াজ খুঁজে পাওয়া বাকি ছিল তখনও।

তবে আমি সেদিন সেট ছেড়ে যাওয়ার পর, আর সেই সেটে কোনোদিন ব্যাক করি নাই। আমার অভিনেতা হবার স্বপ্নের সেটাই ইতি।



ছবিঃ রেডিও চকলেটের সেটে, ২০১২। এই শটটা ভালো হইসিল। ইউটিউবে এই পর্বটা অ্যাভেইলেবল।

৫।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বর অক্টোবরে প্রথম আলো সার্কুলার দিলো, তারা নতুন সাব এডিটর নেবে। যারা আগ্রহী তারা যেন একটা ওয়ার্ড লিমিটের ভিতরে 'আমার প্রিয় শিক্ষক' বিষয়ে একটা বাংলা প্রবন্ধ লিখে নির্দিষ্ট ঠিকানায় ইমেইল করে , বা লেখা পাঠিয়ে দেয়। বাবাকে দেখেছি সাংবাদিক হিসেবে কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জীবন পার করতে, তাই ক্যারিয়ার হিসেবে সাংবাদিকতাকে নেয়ার ব্যাপারে আমার বরাবরই কুণ্ঠা, আর অনীহা ছিল। তবে ছাত্রজীবনে কাজ করতে তো আপত্তি নেই, বাংলাদেশের সবচে সেলিব্রেটি পত্রিকায়। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে লিখতে বসে দেখলাম, প্রবন্ধের বদলে গোটা লেখাটা একটা গল্পের শেইপ নিয়ে ফেলেছে। গল্পের নাম দিলাম - 'রমিজুদ্দিন মৌলভি ও কয়েকটি কুকুর'। আমার জীবনে লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ গল্প। এর ২ বছর পর আমার যে বইটা প্রথমবারের মতো আলোর মুখ দেখবে, সে বইয়ের প্রথম গল্প হবে এটি। লেখাটা, খুব স্বাভাবিকভাবেই পাঠানো হয় নাই আর প্রথম আলোতে, কিন্তু লেখাটা আমার জীবনের মোড় ঘুরায়ে দিয়েছিল। আব্বুর পত্রিকায় ফিচার লেখার সূত্রে আমার অমানুষিক দ্রুত গতিতে বড় বড় ফিচার লেখা, অনুবাদ করা, এডিট করার দক্ষতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই গল্পের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে আমি আবিষ্কার করলাম আমার গল্প বানানোর দক্ষতা, এবং সৃজনশীল লেখার প্রতি আমার অনুরাগ। আমার ব্লগের একদম শুরুর দিকে এই গল্পটা পোস্টও করা আছে।

৬।
নিজের গল্প বাদ দিয়ে, লেখালিখি নিয়ে এবার আমার কিছু নৈব্যত্তিক ভাবনা শেয়ার করি।

মানুষ সিরিয়াসলি কেন সৃজনশীল/মননশীল লেখার জগতে প্রবেশ করে বলা মুশকিল। যত ধরনের সৃজনশীল কাজ আছে, এটা তারমধ্যে সবচে লোনলি জার্নি। আমাদের দেশে লেখকদের কোন কমিউনিটি নাই, কোন স্কুল নাই যেখানে ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানো হয়। ইউল্যাব অবশ্য সম্প্রতি মাস্টার্স চালু করেছে বোধয়, ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর ওপর। যাই হোক, লেখালিখির ফল সবচে দেরীতে পরিপক্ক হয়। তাছাড়া, আপনার লেখার ওপর অথেনটিক ফিডব্যাক দেয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। সাহিত্য সম্পাদনার মতো যোগ্য ব্যক্তি এখন প্রায় নেই বললেই চলে। তাছাড়াও, পেইন্টারদের কমিউনিটি আছে, ফিল্মমেকারদের কমিউনিটি আছে, আছে মিউজিশিয়ানদের কমিউনিটি। লেখা - লেখকদের সেরকম অর্থে কোন গ্রুপ নাই, যাদের সঙ্গে আপনি সকাল - বিকাল আপনার লেখক হিসেবে ক্রাইসিস নিয়ে আড্ডা দিতে পারবেন, এবং তাতে আপনার উপকার হবে।

একজন লেখকের জীবনের আরও কিছু নৈব্যত্তিক সমস্যা হলঃ

প্রথমত, একজন লেখক, যে আদতেই লেখক, শখের লেখক নয়, তার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন খুব যান্ত্রিক। যতজন লেখকের জীবনী পড়েছি, তাদের প্রায় সবাইকেই উল্লেখ করতে দেখেছি যে - অতি কঠোর একটা রুটিনের মধ্য দিয়ে তারা জীবনযাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা হুমায়ূন আহমেদ, লিও তলস্তয় থেকে নিয়ে ওরহান পামুক বা হারুকি মুরাকামি, তারা প্রত্যেকেই লেখার প্রক্রিয়াটাকে তাদের জীবনের কেন্দ্রে প্রোথিত করেছিলেন, করেছেন।

একজন লেখকের সংগ্রাম ও সাধনা সেলফ হিপনোসিসের সাধনা। নিজেকে নিজের চিন্তার বলয়ে সম্মোহিত করে রাখা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাদা কাগজ, বা সাদা কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যাওয়া। প্যারার পর প্যারা বসিয়ে - রাজমিস্ত্রির মতো আপনার আফসানা, বা গল্পের মহলের এক একটা দেয়ালের গাঁথনি তৈরি করা। তারপরেও, কিছুদিন পর আবার যখন পেছনের লেখার কাছে ফিরে আসবেন, আপনার মনে হবে - কিছুই হয় নি সে লেখা। শব্দ পছন্দ হবে না, বাক্য বিন্যাস পছন্দ হবে না, লেখার পেছনের দর্শনকে খেলো মনে হবে। আবার কোমর বেঁধে নেমে পড়বেন পেছনের লেখা সম্পাদনার কাজে।

মুরাকামি প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠে প্রাতকৃত্য সেরে নিজের লেখার ডেস্কে বসেন, এবং লেখেন গড়ে চার পাঁচ ঘণ্টা। নিজের আত্মজৈবনিক রচনা - 'হোয়াট আই টক অ্যাবাউট, হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং' এ মুরাকামি ঔপন্যাসিককে তুলনা করেন একজন ম্যারাথন দৌড়বিদের সঙ্গে। বলেন, উপন্যাস লেখাটা খালি মানসিক শক্তির ব্যাপার নয়, শারীরিক সক্ষমতারও ব্যাপার, যেমন কিনা লং ডিসটেন্স রানিং। ওরহান পামুকের নন ফিকশন আর্টিকেলের কালেকশন আদার কালারসে পামুক বলেন, দিনে উল্লেখযোগ্য একটা সময় লেখার টেবিলে বসে তার নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে নাড়াচাড়া না করলে তার অস্বস্তি বোধ হয়। কষ্ট লাগে। তারপরেও সারাদিনে যা লেখেন, তার দশভাগের একভাগ তার মনঃপুত হয়। বাকি ন'ভাগ লেখা শিফট প্লাস ডিলিট। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজৈবনিক লেখাগুলোয় জানা যায়, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পোশাক বদলে লেখার টেবিলে বসে ঘণ্টা ৩ - ৪ লেখা তার নিয়মমাফিক কাজ ছিল। হুমায়ূন আহমেদও যখন লিখতেন, বাড়িতে তখন টু শব্দটি কেউ করার সুযোগ ছিল না, যেন পৃথিবীর সবচে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সে মুহূর্তে সংঘটিত হচ্ছে তার বাড়িতে, এই ছিল অবস্থা। হুমায়ূন আহমেদের সন্তানদের কারো লেখায় পড়েছিলাম এটা। নিজে যে একটা কঠোর যান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করেন তিনি, এটা পড়েছিলাম তার আত্মজৈবনিক লেখাগুলোর কোন একটায়।

দ্বিতীয়ত, লেখালিখির নগদ কোন ফল নেই। বলেখার বিষয়টা প্রতিভার ঝলক দেখানোর জায়গাও নয়। এখানে হুট করে ভাইরাল হওয়ার সুযোগ নেই। ধরেন আপনি জানেন না আপনার কণ্ঠ কতোটা সুন্দর, পাঁচ মিনিটে, মনের খুশীতে একটা গান রেকর্ড করে আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আপলোড করলেন, রাত পার হলে সকালে উঠে দেখলেন - কয়েক হাজারবার শেয়ার হয়েছে আপনার গান, ফলোয়ার হয়ে গেছে হাজার হাজার - এরকম রাতারাতি সফলতার মুখ সৃজনশীল / মননশীল কথাসাহিত্যে দেখা পাওয়া অসম্ভবের কাছাকাছি। পেলেও, তার ফলাফল নেতিবাচক হয়, সাধারণত।

বরং লেখালিখির সঙ্গে তুলনা করা চলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চার সঙ্গে, যে চর্চা প্রাথমিকভাবে, এবং মূলগতভাবেও - শুধুই নিজের জন্যে। নিজের মুক্তির একটা পথ। ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত হবার একটা পথ। ভিলায়েত খাঁ সাহেবের সেতার পরিবেশন শুনুন, সদ্যপ্রয়াত পণ্ডিত যশোরাজ'জীর খেয়াল পরিবেশন শুনুন, বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেবের সানাই শুনুন, শুনে মনে হবে - এই মানুষগুলোর আত্মা মর্ত্যের পৃথিবীর কলুষ কালিমার অনেক উরধে কোথাও মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু একজন ভিলায়েত খাঁ, পণ্ডিত যশোরাজ, বিসমিল্লাহ খাঁ হওয়ার জন্যে তারা যে কতো হাজার হাজার হাজার ঘণ্টা বদ্ধ রুমে একাকী সাধনা করে গেছেন, তার হিসেব কসতে বসলে বিস্ময়ে ভিরমি খেতে হবে।

ধরুন, আপনি লিখতে লিখতে অসাধারণ একটা গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখে ফেলেছেন বলে আপনার মনে হল। আপনি একজন তরুণ লেখক হিসেবে সেটা নিয়ে কোন প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার সম্পাদকের কাছে গেলে, যদি কারো রেফারেন্স না থাকে, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে, বেশীরভাগ সাহিত্য সম্পাদক আপনাকে তাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগও তারা দেবে না, বা দেখা করলেও খুব দায়সারাভাবে কথাবার্তা বলে আপনাকে বিদায় করে দেবে, অথবা আপনাকে অনেক উপদেশ দেবে, আপনার লেখা মেইল করতে বলবে, আপনি লেখা মেইল করবেন, কিন্তু কোন রেসপন্স পাবেন না।

অন্যদিকে বই প্রকাশ করতে চাইলে সেটা সোজা। প্রত্যেক বইমেলার আগে প্রকাশকরা 'মুরগি ধরা'র অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসে থাকে। টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর অসংখ্য ট্রাশ লেখা বেরোয়। খুব কম কয়েকটা প্রকাশনা সংস্থা আছে, যারা পাণ্ডুলিপির একটা প্রপার রিভিউ প্রসেসের মধ্য দিয়ে যায়।

তৃতীয়ত, লেখালিখির প্রতি আপনার সিরিয়াসনেস আপনার পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশে লিখে পেট চালানোর মতো পরিবেশ তৈরি হয় নি এখনও। সবাই কমবেশী একটা পেশা ধরে রেখে পাশে লেখালিখি করে। একটা চাকরী শেষ করে যদি আপনি দিনে কিছু সময় লেখালিখি করবার জন্যে বের করতে চান, তাহলে সে সময়টুকু আপনার পরিবারের কাছ থেকেই আলাদা করে বের করে নিতে হবে। এভাবে একটা ব্যালান্সড লাইফ মেনটেইন করা খুব কঠিন, যেখানে চাকরী - সৃজনশীল লেখালিখি - পারিবারিক/সামাজিক জীবনে সমতা রেখে চলা যায়। কোন না কোন একটা, বা দুটো দিক মার খেয়ে যায়ই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ সেক্রিফাইস করে তার সৃজনশীলতার দিকটাই। ছেড়ে দেয় লেখালিখি।

চতুর্থত, আপনার ভাগ্যের এ নির্মম রসিকতার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে যে, আপনি আপনার পেশাগত জীবন, পরিবার - সবকিছুকে স্যাক্রিফাইস করে লেখালিখিকে বেছে নিলেও, হতে পারে, লং রানে, অর্থাৎ আপনার গোটা জীবদ্দশায় লেখক হিসেবে খ্যাতি পাবেন না। আপনার মেধা না থাকলে সেটা নিয়ে আফসোস করবার খুব বেশী কিছু নেই, কিন্তু, যখন একজন জন কিটসের দিকে তাকাই, ফ্রাঞ্জ কাফকার দিকে তাকাই, তাকাই জীবনানন্দ দাসের দিকে, শহিদুল জহিরের দিকে - তখন আফসোস হয়। ভয় লাগে। এখন তাদের ঘিরে বিশাল ব্যবসা, তাদের নিয়ে গবেষণা, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লেখা। জীবদ্দশায় তারা তাদের উপযুক্ত পাঠকও হয়তো পান নি। মৃত্যুকালে জীবনানন্দ দাসের অভিলাস ছিল একজন গ্যাটে, একজন শেক্সপিয়রের মতো মহৎ সৃজনশীল কর্ম সম্পাদনের আনন্দ নিয়ে মারা যাওয়া। মানে, একজন প্রকৃতঅর্থে সৃজনশীল মানুষ বোঝে তার কাজের মান কেমন হয়েছে। জীবনানন্দ দাসের অন্তিম অভিলাষ ছিল, স্রেফ সেই অনুভূতিটুকু পাওয়া যে - মহাকালের পাতাকে ছুঁয়ে দেয়ার মতো কিছু কবিতা তিনি লিখে যেতে পেরেছেন, যেমন লিখেছিলেন গ্যেটে, বা শেক্সপিয়র। আমরা জানি না, 'আটবছর আগের একদিন' কবিতার কবি, ট্রামে কাটা পড়বার আগে নিজের ব্যাপারে অতটা উচ্চ ধারনা নিয়ে মারা গিয়েছিলেন কিনা।

৭।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বই বের হলে, ধরা যাক, ২০১২ - ১৩ সাল থেকে গল্পগুলো প্রস্তুত করছি। পেছনের সাংবাদিকতা, ফিচার রাইটিং, রিপোর্টিং এর অভিজ্ঞতা বাদ দিলাম। ২০১৪ থেকে ২০২১ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬টি। চারটি ছোটগল্পের সংকলন, একটি কবিতার সংকলন, একটি অনুবাদ। ২০১২ থেকে ২০২১, আজ ৯ বছর। পেছনে ফিরে দেখলে, আমার নিজের লেখকস্বত্বাকে নিয়ে কি চিন্তাভাবনা মাথায় এসে জমে?

আমার জীবনের পুরো ক্যারিয়ার ট্র্যাক আমি তৈরি করেছি আমার লেখক সত্ত্বাকে আরও বেশী সময় দেয়ার উদ্দেশ্যকে ঘিরে। আমি শিক্ষকতা পেশায় এই কারণে যে, এই পেশায় থাকলে আমি পড়ায়, চিন্তা করায়, লেখায় আরও বেশী সময় দিতে পারবো। আলহামদুলিল্লাহ, ঠিক যেরকম একটা অবস্থায় থাকলে নিজের লেখায়, চিন্তায় বেশী সময় দেয়া যায়, আমি সেরকম একটা অবস্থানে আছি, পেশাগত ভাবে। এখান থেকে যদি আমি মহাকালের পাতা ছোঁয়ার মতো কিছু তৈরি করে যেতে না পারি, তবে সেটা স্রেফ আমার ব্যারথতা হবে। আমি আমার পেশাগত জীবনকে দোষ বা দায়ী করতে পারবো না। মানে, অনেকে বলে না, ধুর বাল, চাকরীটাই আমার লাইফ খেয়ে দিলো, নইলে কতো কিছু করতে পারতাম জীবনে! - এরকম কোন কথা বলার সুযোগ আমার নেই। ভালো সাহিত্যকর্মের জন্ম দিতে না পারা দায় থেকে যাবে কেবল আমার অলসতা, অযোগ্যতার। এই চ্যালেঞ্জ আমাকে আরও উৎসাহ দেয়, উদ্বুদ্ধ করে। আমি ভীত নই, আলহামদুলিল্লাহ।

লেখক হিসেবে আমার বিশ্বাস, একজন লেখক যা লেখেন, তারচে' তার অন্তত দশগুণ বেশী পড়া উচিৎ। অ্যাকাডেমিয়ায় থাকার এই একটা সমস্যা - আপনাকে গবেষণামূলক লেখার জন্যেও নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, যার জন্যে আপনার প্রচুর পরিমাণে অ্যাকাডেমিক লেখাও পড়া লাগবে। এই জার্নালের পেপারস পড়তে গিয়ে অবশ্য আমার ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করবার জন্যে যতটুকু মহান লেখকদের লেখা পড়া দরকার, সেটার জন্যে সময় বের করতে কষ্ট হয়। যাই হোক, শুরুর দিন তো ক্যারিয়ারের, চেষ্টা করছি, হয়তো একসময় একটা রুটিন তৈরি হয়ে যাবে। তবুও, ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বইগুলোর দিকে যখন তাকাই, তখন মানবজীবনের এক অন্যতম ট্র্যাজেডি হিসেবে আমার কাছে প্রতিভাত হয় এই সত্য, যে - আমরা কখনোই একজীবনে আমাদের কালেকশনে থাকা সব বই পড়ে যেতে পারবো না।

আমার পাঠ, বই পড়া, বরাবর নেয়ার জন্যে পড়া। শেখার জন্যে পড়া। লেখক হিসেবে কোন ন্যারেটিভ টেকনিক, ডিকশন, সিনট্যাকটিক স্ত্রাকচার, ফিলসফি ধার করতে পারি, সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমি পড়ি। এটাকে প্লেজার রিডিং বলা চলে না মোটেই। আমার পঠিত উপন্যাসের পাতাগুলো দেখলেও মনে হবে, হয়তো এই বইটার উপর আমার একটা পরীক্ষা আছে সামনে। আন্ডারলাইন, সাইডনোটস। লাল - কালো - নীলকালি।

আমি ভক্ত হওয়ার জন্যে কারো লেখা পড়ি না। তবে পড়তে পড়তে কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়। তারপর তার সব লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ি। আমার পড়া, বইয়ের লেখকের সঙ্গে একটা ইন্টেলেকচুয়াল কনভারসেশনের মতো, যেটা পড়ার সময় আমার মাথায় চলতে থাকে। লেখকের কিছু আইডিয়ার সঙ্গে একমত হই, কিছু আইডিয়া খারিজ করে দিই, কিছু আইডিয়ার সঙ্গে সম্মানের সাথে দ্বিমত পোষণ করি।

লেখক হিসেবে আমার পৃথিবী দেখার চোখ ভিন্ন। আমি দরকারের চে' বেশী দেখি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। লেখকের একটা মানবিক মন থাকতে হয়। নিজের সৃজনশীলতার জগতে লেখক নিজেই স্রষ্টা। তাকে মানবিক হতেই হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা, যেখানে মানবিকতা, বা দয়াশীলতার প্রকাশ পায়, বা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্র্যাকটিস করে চলা অমানবিকতা যা প্রায় কারোই চোখে পড়ে না, আমার অন্তরে তারা সবাই জায়গা পায়। তারা আমার লেখায় চরিত্র হয়ে উঠে আসে। আমি জানি না আমি লেখক হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে আমি সেনসিটিভ, নাকি আমি সেনসিটিভ বলেই লিখছি। এটা আমার জন্যে ডিম আগে না মুরগি আগের মতো এক প্যারাডক্স।

যেদিন আমি ব্যস্ততার কারণে লেখার সময় বের করতে পারি না, আমার সেদিন প্রচণ্ড মনঃকষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমার পারিবারিক, পেশাগত জীবনে তার প্রভাব স্পষ্ট বোঝা যায়। আমি বিরক্ত থাকি। এটা বোঝার পর, আমার বাকিজীবনে ব্যালান্স আনার জন্যে হলেও আমি চেষ্টা করি প্রতিদিন কিছু সময় লিখবার। অন্তত পাঁচশো শব্দ। এভারেজে দিনে একহাজার শব্দ।

আমার পক্ষে যদি সুযোগ থাকতো, আমি লেখক হতে চাইতাম না। আমার লেখালিখি নিয়ে কোন রোম্যান্টিক ফ্যাসিনেশন নেই। কাঠমিস্ত্রী যেমন কাঠ চেরাই, তাতে নকশা তোলার কাজ ভালো পারে, আমি তেমনি লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এতটুকুই। কারন আমি বুঝেছি, বা আবিষ্কার করেছি যে, আমার দক্ষতাটা লেখায়। বাংলাদেশের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশে বসে অনেক ছাড় দিয়ে, অনেক ভেবে চিন্তে লিখতে হয়। এদেশে ইন্টেলেকচুয়াল সুপেরিওরিটি কারো সামাজিক জীবনে অতিরিক্ত কোন সুবিধা দেয় না। বরং মনঃকষ্ট বাড়ায়। সব দেখি, সব বুঝি, সরাসরি কিছু করার থাকে না। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার পাওয়ার ডিনামিক্স আগে বুঝলে মানুষের জীবনে সরাসরি উপকার পৌঁছানো যায়, এমন কোন পেশায় যেতাম। কারন, শুনতে নাটকীয়, বা বলার জন্যেই বলছি, এমন শোনালেও - আমার জীবনের প্রথম এবং প্রধান দায়বদ্ধতা আমার দেশ, ও দেশের মানুষের প্রতি। কোন একটা পার্টিকুলার ক্রিয়েটিভ ফর্মের প্রতি না। আমার দক্ষতা লেখায়, তাই আমি লিখছি, আর লেখার মাধ্যমে যে সময়টায় আমি বাস করছি, সে সময়টায় যা যা ঘটছে, সততার সাথে তা তুলে ধরবার চেষ্টা করছি। লেখক না হলে চেষ্টা করতাম অন্যকোনোভাবে কমিউনিটির জন্যে কাজ করার।

৮।



ছবিঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের হাতে লেখা আমার প্রথম বইয়ের মুখবন্ধ

প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু পার্সোনাল লেজেন্ড থাকে, যা মানুষকে পেছন থেকে ঠেলতে থাকে, সামনে যাবার অনুপ্রেরণা হিসেবে। কোন একটা ঘটনা, কারো একটা দুটো অনুপ্রেরণাদায়ক বাক্য, যা মানুষকে বিপদঘন মুহূর্তে সাহস যোগায়, আশা দেয় সামনে এগিয়ে চলার, এমন কিছু। আমার লেখক জীবনে এমন দুটো পার্সোনাল লেজেন্ডের প্রথমটি হচ্ছে - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমিরিটাস অধ্যাপক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের লিখে দেয়া আমার জীবনের কাঁচাহাতে লেখা একদম প্রথম বইটির মুখবন্ধ, যাতে তিনি লিখেছিলেন -

"সাজিদ উল হক আবির বয়সে তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এখনও সে। এটি তার প্রথম গল্পের বই, কিন্তু গল্পগুলো মোটেও কাঁচা হাতের লেখা নয়। এই লেখক নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে আরও ভালো লিখবে, কিন্তু এখনি যা লিখেছে, তা অত্যন্ত সুন্দর। তার গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলি একে অপরের থেকে আলাদা। তাদের জগত ও অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু আবির তাদের প্রত্যেককেই জীবন্ত করে তুলেছে। তার ভাষা ঝরঝরে, গল্পবলার ধরন নিজস্ব, এবং প্রতিটি গল্পে বিষয়ানুগ। বোঝা যায় যে তার আছে দেখবার দক্ষতা এবং কল্পনার ক্ষমতা। ছোটগল্প লেখার কাজটি মোটেই সহজ নয়, লেখক সেটাকে আয়ত্তে এনেছে ..."

সিরাজুল ইসলাম স্যারের আমার তৎকালীন লেখাকে প্রশংসা করে, সামনে করা সেই ভবিষ্যৎবানী - "এই লেখক নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে আরও ভালো লিখবে ..." এটা সবসময় আমার লেখক হিসেবে আঁধার রাতের আলোরূপে কাজ করে।

দ্বিতীয় পার্সোনাল লেজেন্ড হল, এই ঘটনাঃ

ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে তার, বা আমার নিজের লেখার সূত্রে প্রায়ই কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু স্যার সময় দিয়ে উঠতে পারতেন না। আমার প্রকাশিত তৃতীয় বই স্যারকে দেয়ার পর স্যার তা পড়েন। পরবর্তীতে একদিন স্যারের একটা বইয়ে স্যারের অটোগ্রাফ আনতে গেলে স্যার সেটা লেখেন উক্ত বইয়ের উৎসর্গপত্রে, এভাবে -

"উৎসর্গ - অমুক, তমুক, এবং আবিরকে, যার গল্প লেখার হাত ভালো ..."

এই 'উৎসর্গ - ... আবিরকে, যার গল্প লেখার হাত ভালো', এটা স্যার নিজে হাতে কলমের কালিতে লেখেন।

আমি জানি না, এই দুইজন মানুষকে আপনারা কতটুকু চেনেন, সাহিত্য বিষয়ে তাদের জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে আপনারা কতটুকু ওয়াকেফহাল, কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনের এই দুই মহীরুহের কাছে যোগ্যতা ব্যাতিরেকে একটা ভালো শব্দ কেউ কখনো বের করিে আনতে পারে নি। আমার কাছে পাওয়ার মতো তাদের কিছুই নেই। তবুও, আমার লেখালিখির একদম শুরুর দিনগুলোতে, আমার দক্ষতার উপর তারা ভরসা রেখেছিলেন। আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। সাহস দিয়েছিলেন। তাও পাবলিক্যালি। জনসম্মুখে। এটাই আমাকে সাহস যোগায়।

আমার সাহিত্যিক হিসেবে সক্ষমতা নিয়ে আমার নিজের মনে কোন প্রশ্ন কোনদিনই জাগে নি। লিখে আমি কি পাব - এটা নিয়েও আমার বড় কোন প্রশ্ন নিজের সামনে খাড়া করে রাখা নেই। আমি যেটা জানি, তা হচ্ছে, আমার লিখতে ভালো লাগে, না লিখলে আমার কষ্ট হয়। একজন মহান লেখক হবার জন্যে যে রসদ মানুষের লাগে, আমার তা অ্যাকাডেমিক সূত্রে আছে। এখন কেবল খুঁড়ে যাওয়ার কাজ, নিজের ভেতরে। কেননা, একজন লেখক পৃথিবী দেখে নিজের অন্তরের লেন্স দিয়েই।

৯।

ব্লগকেন্দ্রিক আমার অনুজ লেখক যারা আছেন (আমার সমসাময়িক, বা আমার আগে যারা লেখা শুরু করেছেন, তাদের ব্যাপারে আমার কোন মন্তব্য, বক্তব্য নেই), তাদের উদ্দেশ্যে অল্পকিছু কথা আমার বলার আছে।

প্রথমত, কোনোদিন ব্লগ পড়া, ব্লগ লেখা, ব্লগে পাওয়া মন্তব্যকে ষ্ট্যাণ্ডার্ড হিসেবে ধরবেন না। যাদের মন্তব্যে আপনার উপকার হবে, তাদের আপনার লেখা পড়ার সময় হবে না সাধারণত। আর যাদের আপনার মতো নতুন লেখকের লেখা পড়ার সময় হবে, তাদের মন্তব্যে আপনার লেখকসত্ত্বার কোন উপকার হবে না।

দ্বিতীয়ত, পড়া বাড়াতে হবে। বিচিত্ররকম মতপথের লেখকদের লেখা পড়তে হবে।

তৃতীয়ত, শুধু উপন্যাস না, মানুষের চিন্তার ইতিহাস - তথা দর্শন, কবিতা, এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে গাঢ় জ্ঞান রাখতে হবে। ইতিহাসের জ্ঞান টনটনে না হলে লেখায় এমন সব ভুল হবে যা আপনাকে লজ্জায় ফেলবে, দর্শন না জানলে আপনার লেখা খেলো হবে, কবিতা না পড়লে মানবিক একটা অন্তর তৈরি হবে না।

চতুর্থত, কোন দিন কোন রাইটিং ওয়ার্কশপে যাবেন না। বাংলাদেশে এগুলোর নামে যা হয়, তা হচ্ছে স্রেফ টাকা কামানোর ধান্দা। লেখা শেখার শুধু মাত্র তিনটা উপায় আছে। এক - অনেক অনেক পড়া। দুই - লেখা। তিন - বারবার লিখতে থাকা।

পাঁচ, সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে যান, কিন্তু কোন সাহিত্য সার্কেলে যোগ দেবেন না। সাহিত্য সার্কেলে থাকলে আপনি অযোগ্য সাহিত্যিক হলেও অমুক তমুক পুরস্কার পেয়ে যাবেন। এছাড়া কোন লাভ নেই। যোগ্য সাহিত্যিকরা আপনার সঙ্গে আড্ডা দিতে আসবে না। তাদের সময় নেই।

ছয়, নিজের উপর আস্থা রাখুন। স্বপ্ন দেখুন দুনিয়াকে ওলট পালট করে দেবে এমন কিছু লিখবেন। সেই স্বপ্নের পেছনে প্রতিদিন কাজ করে চলুন। প্রতিদিন ফিরে ফিরে আসুন আপনার লেখার ডেস্কে। পাঠকপ্রিয়তা যদি স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলে আসে, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপনার পাঠকের পড়ার ষ্ট্যাণ্ডার্ডে আপনার লেখার ষ্ট্যাণ্ডার্ড নামিয়ে আনবেন না। আপনার পাঠকের পড়ার ষ্ট্যাণ্ডার্ড আপনি তৈরি করবেন, লেখক হিসেবে। এতটুকু ভরসা রাখুন নিজের সক্ষমতার ওপর। যদি পাঠকের রুচি অনুযায়ী আপনি লেখা সাপ্লাই দিতে থাকেন, তা কেবল নীচে নামতে নামতে একসময় খাদে গিয়ে পড়বে। সেটা হবে লেখক হিসেবে আত্মহত্যার সামিল।

১০ ।
একদম প্রথমে মেনশন করা কবিতাটায় ব্যাক করি। এই কবিতার কবি সিমাস হিনি আধুনিক ইংরেজি কবিতার কবিদের মধ্যে একদম প্রথম সারির একজন। ১৯৯৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী। তিনি অসাধারণভাবে একজন লেখকের লেখকসত্ত্বার কথা ফুটায়ে তুলেছেন তার ডিগিং / খুঁড়ে চলা কবিতায়।

কবি এখানে হাতে কলম আর সামনে সাদা খাতা হাতে বসা। জানালা দিয়ে নীচে তার কৃষিজীবী বাবাকে ক্ষেতে কর্মরত অবস্থায় দেখা যায়। তিনি তার লেগেসি জারি রাখছেন তার কৃষিকাজের যন্ত্রসমূহ দিয়ে। খুঁড়ে চলছেন তিনি মাটির গভীরে, মাটিকে আরও উর্বর, আরও সুজলা সুফলা করে তুলতে। কবির বাবা, তার কৃষিজীবী দাদার লেগেসি ক্যারি করছেন। কবি বলেন আমার অস্ত্র, আমার আঙ্গুলের ফাঁকে ধরা আমার স্কোয়াট পেন। মোটা কলম। এইটা দিয়ে আমি আমার সামনের সাদা কাগজে লাঙ্গল চালাবো, তাকে উর্বর, সুজলা সুফলা করে তুলবো। আমি লেখক এটাই আমার লেগেসি।

প্রিয় নবীন লেখক,
আপনি যে লেখক,
এটাই আপনার লেগেসি।


সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১১:১৭
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×