ইতিহাসের নামে দলীয় প্রোপাগান্ডা মেশিন অব্যাহত রেখে কিছু সংখ্যক মানুষকে কিছু সময়ের জন্য ধোঁকা দিয়ে রাখা সম্ভব হলেও সবাইকে দীর্ঘ সময়ের জন্য তা যায় না। এই প্রোপাগান্ডা মেশিনের চালকরা যা-ই বলুক না কেন বর্তমানে চারিদিকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং যে সমস্ত ঘটনা পর্যায়ক্রমিকভাবে ঘটে চলেছে, তাতে এইসব প্রচারণার অসারতা অচিরেই জনমানসে উন্মুক্ত হয়ে যাবে যে সম্ভাবনা যথেষ্ট প্রবল। এখন কথা হচ্ছে যাদের সাথে ৭১-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে তারা কেউ সেই সময়টাকে দ্যাখে নি, আমিও দেখি নি। তাহলে কীসের ভিত্তিতে আমরা দাবি করতে পারি কোনটা সঠিক আর কোনটা মিথ্যা? বস্তুত ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। ধরুন আপনার সামনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিষয়ে একাধিক ভাষ্য হাজির করা হলো যেগুলো পারস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক। আপনি এর সব কয়টাকে বাতিল করতে পারেন আবার যেকোনো একটাকে গ্রহণ করতে পারেন। এখন আপনি যা-ই করেন না কেন, প্রশ্ন এসে যায় তার ভিত্তি কী হবে? এক্ষেত্রে যা মনে রাখতে হবে তা হলো অতীত কিন্তু বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। অতীতে যা হয়েছে বর্তমানে তার প্রবহমানতাই অক্ষুণ্ন থাকে (বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন সংঘটিত না হলে) এবং অতীতের এসব কর্মকাণ্ডের ফলাফল বর্তমান পর্যায়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে মূর্ত হতে দেখা যায়। অতীত এবং বর্তমানে সংঘটিত সমানুপাতিক ঘটনাগুলো তাই কার্য-কারণ সূত্রে গ্রথিত। আমরা বর্তমানে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা আমাদের পরিপার্শ্বে সংঘটিত হতে দেখছি, যেগুলো সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি যে সেগুলো সত্যি এভাবেই ঘটছে। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আজকের দিনে বিচ্ছিন্নভাবে হঠাৎ সংঘটিত কোনো ঘটনা নয়, অতীতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ এগুলো আজ আমরা এভাবে সংঘটিত হতে দেখতে পাই। এখন আপনার সামনে অতীত ঘটনাসমূহের যেই সমস্ত ভাষ্য হাজির করা হচ্ছে তার মধ্যে কোনটার সাথে বর্তমান ঘটনাবলীর কার্য-কারণ সূত্রায়ন ঘটিয়ে এগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় সেটা নির্ধারণ করতে হবে। আপনি প্রত্যেকটা ভাষ্যকে একবার করে নিরীক্ষণ করে তার সাথে বর্তমান ঘটনাসমূহের নির্মোহ বিশ্লেষণকে মিলিয়ে দেখুন এর মধ্যে কোন ভাষ্যটি বর্তমানকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। এখানে আপনাকে পলেমিকস ব্যবহার করতে হবে অর্থাৎ পারস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক প্রতিটা ভাষ্যই পরীক্ষা করতে হবে, তা নাহলে আপনার টানা সিদ্ধান্ত বৈজ্ঞানিকভাবে সিদ্ধ বলা যাবে না। এ কারণেই যেই অতীতকে (অর্থাৎ ৭১-পরবর্তী সময়কাল) আমি নিজ চোখে দেখি নি সে বিষয়ে তর্কে লিপ্ত হওয়ার আগে আমাকেও এভাবেই এগোতে হয়েছে। আমি যখন ইতিহাসের ঘটনাগুলোর সঠিক এবং সত্য ভাষ্য খুঁজছিলাম তখন এই প্রোপাগান্ডা মেশিন থেকে বের হওয়া বক্তব্যগুলোর সাথে বর্তমানকে কোনোভাবেই মেলাতে পারছিলাম না। এ কারণে আমি হাতে তুলে দেয়া ঐতিহাসিক আবর্জনা এবং শ্রবণযন্ত্রের ওপর অহর্নিশ নির্যাতন চালানো প্রচারণাসমূহে যথেষ্ট সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ি। কানের কাছে যা কিছু ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজে চলে তাতেই বিশ্বাস স্থাপন না করে মস্তিষ্ককে কিছুটা ব্যস্ত রাখি, এদিক-সেদিক অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা তাঁর খোঁজ-খবর করতে থাকি। প্রবীণ মানুষজনের সাথে যোগাযোগ করি, তাদের কাছ থেকে অতীতের ঘটনাবলীর বিবরণ শুনি। তাদের কাছ থেকে যা জানতে পারি তার সাথে প্রচারণাগুলোর সাংঘর্ষিকতা প্রায় মৌলিক হয়ে ধরা দ্যায় নিজের কাছে। কিন্তু বর্তমানের সাথে এগুলোর মিল থাকলেও তাদের সাধারণ ভাষ্যে উপস্থিত বিবরণগুলো বৈজ্ঞানিক বিশ্বস্ততায় অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। এর জন্য আমাকে আরো লিটারেচার ঘাঁটতে হয়েছে, বর্ণনার আরো গভীরে যেতে হয়েছে, সত্যানুসন্ধানী তাত্ত্বিক গবেষকদের কাজগুলোকে পর্যালোচনা করতে হয়েছে। খুব বেশি পরিশ্রম যে করেছি তা নয়, কিন্তু অতীতকে জানতে পারা এবং বর্তমান বাস্তবতার সাথে যোগসূত্র স্থাপনের জন্য যে ভাষ্য, পরিসংখ্যান, ব্যাখ্যা এবং তত্ত্ব প্রয়োজন ছিল, সেগুলো আমার চেতনার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, কিছুটা হলেও চিন্তার জগতে দীর্ঘসঞ্চিত জঞ্জালগুলোকে সরিয়ে দৃষ্টিতে স্বচ্ছতা আনয়ন করেছে।
প্রবহমান রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সম্পূর্ণ বিষয়টিকে একটা জিগসো পাজলের সাথে তুলনা করলে (এবং বর্তমানে সংঘটিত ঘটনাসমূহের নির্মোহ ভাষ্যকে ইতোমধ্যে সেট হয়ে যাওয়া পিস হিসেবে বিবেচনা করে নিলে) যেই পাজল পিসগুলো সার্বিক চিত্রকে পূর্ণাঙ্গ করতে সমর্থ হয় আপনাকে কেবল সেগুলোকেই বেছে নিতে হবে। এরপর অপ্রাসঙ্গিক অবশিষ্ট পিসগুলো আপনি বাতিল করে দেবেন। ৭১-পরবর্তী ঘটনাবলীর অন্যান্য ভাষ্য সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। এই ভাষ্যগুলোর ভিত্তি আপনি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন যে, সেগুলোর রেফারেন্স কিন্তু কোনো না কোনোভাবে এই ভাষ্য-প্রচারকারী নিজেরা অথবা তাদের প্রভুদের সৃষ্ট। আরেকটা বিষয় হলো ঘটনাগুলো সংঘটিত হওয়ার সময় এগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না এগুলোকে তৈরি করা হয়েছে পরবর্তীতে, সংঘটিত ঘটনাসমূহের সাফাই হিসেবে। এরমধ্যে কোনো কোনো ঘটনা টুইস্ট করা হয়েছে, কোথাও একেবারেই পাল্টে দেয়া হয়েছে আর যেগুলো এভাবে কিছু করা সম্ভব হয় নি সেগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। ভিকটিম পরিণত হয়েছে বিভ্রান্ত, চক্রান্তকারী, লুটেরায়। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীকে অসহায়রূপে উপস্থিত করা হয়েছে, আশপাশের সুযোগ-সন্ধানীদের মূল কুশীলবের ভূমিকায় নামানো হয়েছে। যাকে "হাজার বছরের সেরা বাঙালি" কিংবা "জাতির পিতা" বলা হচ্ছে, অথবা বলা হচ্ছে সবচেয়ে ক্যারিশমাটিক নেতা, বিপদ বুঝলে তাকেই আবৃত করা হচ্ছে সহজ-সরল মানুষের রূপে; প্রায় শিশুর মতো নাদান ব্যক্তিত্বে নামিয়ে আনা হচ্ছে তখন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন তুললে প্রথমে এ বিষয়ে মনগড়া কিছু একটা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তথ্যপূর্ণ পাল্টা-যুক্তি দিয়ে চেপে ধরলে বুকভরা ভালোবাসার খতিয়ান এবং ক্ষমা প্রদর্শনের যিশুতোষ বাণী উপহার দেয়া হয়। কিন্তু সমান্তরালে হাজারো দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা নিধনের কথা বলা হলে প্রথমে অস্বীকার করা হয়, তারপর ঝামেলার গন্ধ পেলে উল্টো তাদের ঘাড়েই যাবতীয় দোষের ভার চাপিয়ে নিষ্কৃতির প্রয়াস লাভ করা হয়। এভাবেই মূলত এগিয়ে চলেছে এদেশের প্রোপাগান্ডা-সর্বস্ব ইতিহাস-চর্চার রেলগাড়ি অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। কিন্তু ... (চক্রাকারে আবার প্রথম থেকে পড়তে হবে)