(আলেক সাই-কে)
নিমীলিত নেত্রযুগল শরীরের সমুদয় তাকত একত্র করিয়া অত্যাধিক আয়াসে সীমিত পরিসরে পরিস্ফুট করিয়া জলকবি দেখিতে পাইল তাহার সম্মুখভাগে আদিগন্ত বিস্তৃত এক পটভূমি শরতের তীক্ষ্ণাগ্র সূর্যালোকে লীলাখেলা করিতেছে। তথাপি এই পটভূমি সম্বন্ধীয় কিঞ্চিৎ ধারণা পাঠকবৃন্দের মস্তিষ্কের কুহরে, কোষে কোষে প্রবেশাইতে সক্ষম না হৈলে তাহা বোধগম্যতার অতীত এক ভ্রান্ততায় পর্যবসিত হৈবার সম্ভাবনা দৃষ্টির সম্মুখে চক্ষু পাকাইতেছে। এই বিশ্ব সংসারে এইরূপ কিছুর অস্তিত্ব নাই যাহা সম্মুখস্থ চরাচরে বিরাজমান নাই। দক্ষিণ পার্শ্বে স্বর্ণকায় ধানক্ষেত্রের অভ্যন্তরভাগে মধ্য শরতের হুতাশন আপন বেগে ক্রীড়ারত রহিয়াছে। সম্মুখস্থ সুসজ্জিত বেদীপার্শ্বে পীরে চর্মোনাইয়ের মুরীদানের লাহান অভূতপূর্ব দক্ষতায় রত্নখচিত বংশদণ্ডের অগ্রভাগে ওরাংওটাং সদৃশ বিরল চতুষ্পদী সবেগে ব্রেকড্যান্স কষিতেছে। দূর প্রান্তরের সুউচ্চ গিরির মধ্যভাগ ফাটিয়া সৃষ্ট নির্ঝর হৈতে প্রবাহিত জলধারা কিয়ৎপথ অতিক্রম করিয়া ঈষৎ স্রোতধারী সরোবরে সন্নিবিষ্ট হৈতেছে- উহার পার্শ্ববর্তী তীরে বসিয়া সঘনকৃষ্ণ অলকরাশি ঊধ্বাংশের সর্ব প্রান্তরে সযত্নে ছড়াইয়া পীনোন্নত বক্ষ রূপসী মারমেইড স্বর্ণনির্মিত প্রাচ্যদেশীয় অভিজাত হুক্কা হৈতে একমনে সীসা সেবন করিতেছে। তাহারি পার্শ্বে পঞ্চম তলা অধিবাসের সর্বোচ্চ স্তর হৈতে রুপাঞ্জেল তাহার বিস্তৃত কেশরাশি নিম্নদেশে প্রবাহিত করিয়া দিয়াছে আর উহার প্রবহমান স্বর্ণস্রোতের মধ্যম পর্যায়ে চতুর্হস্তপদ সহযোগে এক বিকটবদন শাখামৃগ দোদুল্যমান অবস্থায় মনের সুখে আপন ললাটলিখনকে বাহবা পিটাইতেছে।
এই সকল স্বর্গীয় নিয়ামতরাজি দর্শনমাত্র জলকবির চক্ষুদ্বয় হৈতে তমসাচ্ছন্ন রাত্রির সুষুপ্তির অন্ধকার অবশেষটুকু মুহূর্তে দূরীভূত হৈলো, তৎক্ষণাৎ উহা সকল অতীত বিস্মৃত হৈয়া ষাষ্টাঙ্গে সিজদায় পড়িয়া গেল। অতঃপর দুই রাত্রি তিন দিবস উক্ত ভঙ্গিমায় নিশ্চল রহিয়া জলকবি মনে মনে আরজ করিল:
“প্রভু! মহামহিম মহারাজ!! পয়গম্বরসম্প্রদায়ের সর্দার!!! স্বর্গের যেই অভূতপূর্ব নিয়ামত, যেই প্রাণসঞ্জারী শীতল সমীরণ, যেই তৃষ্ণাবিনাশী জলের অমিয় ধারা, যেই একাকিত্বসংহারী রমনীকুলের সশরীর সাক্ষাৎ তুমি আমার ন্যায় অধম, কীটস্য কীট, ধুলিনগণ্য সামান্য কবিকে তোমার অনিঃশেষ রহমতের খাজানা হৈতে দানিয়াছ, তাহার কোনটা আমি প্রত্যাখ্যান করিতে পারি, আর আমি ইহার কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, পরমাণুসম অংশেরইবা অধিকার লাভের যোগ্য! এই অপূর্ব বেহেস্তের বেশ্যাখানায় তুমি এই পাপিয়সীকে আপনকৃত যোগ্যতাবলে নহে, তোমার অপূর্ব দয়াদাক্ষিণ্যের অনন্ত গোডাউন হৈতে সামান্য অংশমাত্র চিত্তপ্রদেশে আপলোড করিয়া, আমার তরে সঁপিয়াছ! অতঃপর আমি উহার কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করিব!!!”
অকস্মাৎ মহাকাশ চৌচির করিয়া, সমগ্র চরাচর কাঁপাইয়া, জলদগম্ভীর মন্দ্রস্বরে নাজিল হৈল:
“হে বেকুবস্য বেকুব, নরাধম কবি, ওহে অবোধ, আকাট নির্বোধ! আমাপ্রদত্ত শব্দ লৈয়া রতিক্রিয়ারত ধ্বজভঙ্গ নাবালক- ইহা কোনো স্বর্গভূমি নহে, এই আপাত সুদৃশ্য হেরেমখানা বেহেস্তের কোনো স্বর্ণময় ভূখণ্ড নহে; ইহা তোর অনন্ত কারাবাস, মর্ত্যলোকে যাপিত জীবনে শয়নে, স্বপনে, আধো জাগরণে তুই যেই মহল্লার কল্পনায় স্বপ্নদোষের তোড়ে ভাসিয়া যাইতিস, যাহার চিন্তামাত্র গনোরিয়া রোগীর ন্যায় অস্থির সুচিক্কন বীর্য তোর মসির অগ্রভাগ হৈতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কালিরূপে নির্গত হৈতো, ইহা সেই সমাধি, সেই অভিশপ্ত শ্মশান, ইহা তাহাই- যাহা তোর জন্মাইবার বহু আগে, সত্যযুগ সৃষ্ট হৈবার সাড়ে সাতাশি ক্রোড় বর্ষ পূর্বেই ললাটলিখন হিসাবে লিপিবদ্ধ কৈরাছি, ইহা সেই রৌরব- পাপিষ্ঠের পিঠস্থান। তোর অনন্ত নরকবাস অশুভ হৌক- ইহাই অদ্য পূর্বাহ্নে তোর প্রতি মোর অভিসম্পাতরূপ আশির্বাদ।
জলকবি উক্ত নিনাদসম ইর্ষাদের আপন মনোভূমে অকস্মাৎ অভিঘাতে প্রণিপাত পরিস্থিতি হৈতে সশব্দে ভূমিশায়ী হৈবে কি বজ্রাহত বৃক্ষের ন্যায় আপন স্থলে নিশ্চল খাড়া রহিবে তাহা মনস্থির করিতে না পারিয়া বিদ্যমান ষাষ্টাঙ্গবিক্ষেপ হৈতে খোমাখান উত্তোলন করিয়া বিস্ফারিত নেত্রদ্বয় আসমানের বক্ষপানে স্থাপন করিয়া আড়াই দিবস মূর্তিবহ ধ্যানস্থ রহিল, অতঃপদ গগনবিদারী আর্তনাদে সম্মুখস্থ বিস্তৃত চরাচর কাঁপাইয়া তুলিল। তাহার চিৎকারে কলকাকলিরত পক্ষিকুল বাকহারা হৈল, রাপুঞ্জেল ইরানী গোলাপের খোশবুসমৃদ্ধ চিরুনীখানা দিয়া আপন অলোকরাশির বিন্যাস হৈতে সভয়ে ফারাক রহিল, প্রাগুক্ত আরাধ্য স্রোতধারী অনির্বাণ বস্তু হৈতে ঝুলন্ত শাখামৃগ চতুর্পদের শক্তিরহিত হৈয়া আকস্মিক বেগে ভূমিশয্যা গ্রহণ করিল, মারমেইড সিসার নলখানা ছুড়িয়া ফেলিয়া হ্রদের বক্ষে অপেক্ষমান কুম্ভিরের লোভাতুর অক্ষিযুগলের সর্বনাশী আমন্ত্রণ অবশ্যম্ভাবী জানিয়াও ‘কস্কি মমিন!’ শব্দযোগে জলস্রোতে ঝাঁপাইয়া পড়িল। বংশদণ্ডের অগ্রভাগে ওরাংওটাং উদ্দাম নৃত্যরহিত হৈল, খেয়ালী মধুপ সম্মুখে পবনে ঈষৎ দোদুল্যমান পুষ্প হৈতে রস সংগ্রহ করিতে ব্যর্থতার দায়ভার স্বীয় স্কন্ধে লৈল, প্রধান ফটকের অভ্যন্তরভাগে দণ্ডায়মান ঈশ্বরনামজপরত শয়তানকুল শিরোমনি একটা হার্টবিট মিস করিল।
“ইয়া প্রভু, হে রহমান, ও ভগবান! ইহা তোমার কীরূপ জালিমত অসহায় এই অধমের পৃষ্ঠদেশ অভিমুখে পতিত হৈল! মর্ত্যভূমে অধিষ্ঠিত থাকিয়া দিবা রাত্রি চতুর্বিংশ ঘটিকা তোমারই মাহাত্ম্য বর্ণনায় কাটাইয়াছি, স্বর্গের বিলাসভূমে দ্বিসপ্ততি হুরবেষ্টিত অবস্থায় সুরাপানে তৃষা নিবারণের তাগিদে সমুদয় পার্থিব কামনা জলাঞ্জলি দিয়াছি, বিশ্বের পথে-প্রান্তরে, চ্যাম্প ইলিসির সুপরিসর পান্থপথে, হলিউডের হেরেমখানায়, রিওর আদিগন্ত বিস্তৃত সাগরপ্রান্তরের উন্মুক্ত বক্ষ রৌদ্রচশমা সুন্দরীবৃন্দের পানে, বার্সেলোনার সুদৃশ্য ব্রোথেলের দুয়ারে উকিঝুঁকি মারিবার অধিক অগ্রসর হৈ নাই, বাসস্থলের পার্শ্বস্থিত নহর দিয়া শিভাস রিগালের অনন্ত স্রোত বহিয়া গেলেও কদ্যপি চক্ষুপাত করি নাই, তোমার নাম জপিতে জপিতে রাত্রি দ্বিপ্রহরে নিদ্রা আসিয়া চক্ষুর উপর সশস্ত্র হীন আক্রমণ চালাইলেও কভু স্বীয় কর্ম হৈতে বিরত থাকি নাই; সর্বদা, সর্বজনে, সর্বস্থানে, সর্বকালে তোমার মাহাত্ম্য, তোমার পুণ্যনাম, তোমার শ্লোক, তোমার মোজেজা বর্ষাস্থ বারিসম বিলাইয়াছি ...”
“খামোশ, উল্লুক্কা পাঠ্ঠে! আমি সর্বজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ মহামহিম স্রষ্টা এবং দ্রষ্টা- তোর সকল কর্ম, অপকর্ম, কুকর্মের স্বাক্ষী সপ্ত আসমানের ঊর্ধ্বস্থ আরশ বরাবর অধিষ্ঠিত রহিয়াছি মহাত্মা জিউসের ভাস্কর্যবৎ। স্বীয় সম্মুখস্থ হলোগ্রাফিক প্রজেক্টরে তোর ভূমিষ্ঠকালীন পর্ব হৈতে মৃত্যুমুহূর্ত আগমনের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সমুদয় কার্যকলাপ বলিউডি সিনেমার রঙ্গে, যাত্রার ঢঙ্গে, বিবিধ কলায় এবং প্রভূত ছলায় ক্রীড়া করিয়া যাইতেছে। তোর প্রতিটা কীর্তিকলাপ স্কন্ধের দুই দেবদূত লিপিবন্ধ করিয়াছে, নীলক্ষেত্রের সুদৃশ্য কালো বাইন্ডিংয়ের উপরিভাগে স্বর্ণাক্ষরে জাজ্বল্যমান্য ‘ক্লাসিফায়েড’ নামাঙ্কিত নথিখানা আমার সুমুখে রক্ষিত আছে। জীবিতকালে তুই পরিপার্শ্বের দ্বিপদযুক্ত প্রাণীকুলকে তোর ভক্তিরস জারিত পংক্তিমালায় জর্জরিত করিয়াছিলি, বৈজ্ঞানিক সত্য হৈতে উহাদের মুখমণ্ডল অদৃষ্টবাদিত্বের রন্ধনকলায় নিবন্ধ রাখিতে প্রয়াসের খামতি করিস নাই। স্বর্গমধ্যে দ্বিসপ্ততি হুর-পরিবৃত হৈয়া সুরাপানে বিভোর থাকিবার যে স্বপ্নোত্থিত দোষে আপনাকে সিক্ত করিয়াছিলি প্রতি তমসাঘন বিভাবরী হৈতে কলকাকলিপূর্ণ প্রাত অবধি, সেই স্খলিত বীর্য হৈতে সহস্রফনাবিশিষ্ট সর্প জন্মলাভ করিয়া আজ তোকে দংশাইবার খাতিরে অশ্বকায় নারীমুখ বিশিষ্ট স্বর্গযানে চাপিয়া এ স্থলে আগমনের তরে রওয়ানা হৈয়াছে। তাহার কোমল-কঠোর দংশন সর্বাঙ্গে বরণ করিয়া লৈতে প্রস্তুত থাকিস, আমার রাডারে তাহার অস্তিত্ব ধরা পড়িতেছে, এই ক্ষণে সে ঈষাণ কোণে পৌনে চৌত্রিশ ক্রোশ দূরবর্তী স্থানে রহিয়াছে, কিন্তু সে বিদ্যুৎ বেগে ধাবিত হৈয়া যে কোনো মুহূর্তে উপস্থিত হৈবেক ... খোমাগ্রন্থে একখানা ‘লাইক’ বাটন টিপিতে যেই সময় প্রয়োজন হয়, ততোধিক কাল তোর অবশিষ্ট নাই ...”
আসমানী কানেকশন কাটিয়া গেল, ক্রমশই পিঙ্গলবর্ণে ছাইয়া যাওয়া ভুবর্লোকে ভাসমান পুঞ্জিভূত মেঘমালার অন্যপাশ হৈতে ‘টুট টুট’ শব্দ ভাসিয়া আসিল, জলকবি তাহার ক্রন্দনরেখায় রক্তিম চক্ষুদ্বয় পূর্ণরূপে বিকশিত করিয়া দিগন্তে স্থাপন মারফত দ্রুত অগ্রসরমান অশ্বপৃষ্ঠে আরোহিত সুজা-আক্রার বিকটসদৃশ গর্বোদ্ধত ভয়াল প্রতিচ্ছায়া গোচরীভূত করিল।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৩৯