somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আধুনিক বাংলা কাব্যের পটভূমি !!!

০৭ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ড. ফজলুল হক তুহিন


ইতিহাসের পটভূমি ও কাব্যপ্রকৃতি বিচারে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’কে আবু সয়ীদ আইয়ুব কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত, অন্তত মুক্তিপ্রয়াসী রূপে গণ্য করেছেন। এই মতটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যদিও মাইকেল মধুসূদন দত্তকে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ বলেছেন। অন্যদিকে সৈয়দ আলী আহসানের মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ‘আধুনিক সাহিত্য’ (১৯০৭) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, বিহারীলাল, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, আবদুল করিম, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, যতীন্দ্রমোহন প্রমুখ। মোহিতলাল মজুমদার ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে’ (১৯৩৬) বঙ্কিমচন্দ্র, বিহারীলাল, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দীনবন্ধু মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে বিষয়ীভূত করেন। আবু সায়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৪০) এবং বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪) সংকলন দু’টি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে, শেষ হয়েছে তৎকালীন তরুণতম কবির কবিতার মাধ্যমে। কিন্তু দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপক রায় সম্পাদিত ‘বাংলা আধুনিক কবিতা-১’ (১৯৯২) জীবনানন্দ দাশকে দিয়ে সূচিত হয়েছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রদ্রোহী তিরিশোত্তর কালের ‘কল্লোল’ (১৩৩০) প্রভৃতি পত্রিকাবাহিত নতুন ভাবধারা ও আঙ্গিকশৈলীর কবিতাকে প্রকৃত অর্থে আধুনিক কবিতা রূপে চিহ্নিত হতে থাকে।

‘আধুনিক’ শব্দটি সময়ের দিক থেকে ক্রম-অগ্রসরমান, ক্রমপরিবর্তমান ও সঞ্চরণশীল। রবীন্দ্রনাথ ‘পাঁজি মিলিয়ে’ আধুনিকতার সীমানা নির্ণয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্তাপন করেছেন। তাঁর মতে, “এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্য তেমনি বারবার সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মর্ডান। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।” [আধুনিক কাব্য: সাহিত্যের পথে] এই ‘মর্জি’র সাথে তিনি শাশ্বত গুণের কথা বলেন: “আধুনিক বিজ্ঞান যে নিরাসক্ত চিত্তে বাস্তবকে বিশ্লেষণ করে আধুনিক কাব্য সেই নিরাসক্ত চিত্তে বিশ্বকে সমগ্রদৃষ্টিতে দেখবে, এইটেই শাশ্বতভাবে আধুনিক।” জীবনানন্দ দাশের মত রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছাকাছি: “সব সময়ের জন্যেই আধুনিক-এ রকম কবিতা বা সাহিত্যের স্থিতি সম্ভব। মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে।” [জীবনানন্দ দাশ: কবিতার কথা] সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক কবিকে অনাদি কালের ‘চারণের উত্তরাধিকারী’ এবং আধুনিক কবিতাকে ‘মহৎ কবিতা’ রূপে অভিহিত করেন। [কাব্যের মুক্তি: স্বগত] অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪) বিচিত্র দৃষ্টিতে আধুনিক কবিতাকে চিহ্নিত করেন: “আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্নদ্বারা অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবৃত্তি।” [ভূমিকা: আধুনিক বাংলা কবিতা] আধুনিক কবি ও কবিতা বলতে অধিকাংশ লেখক রবীন্দ্রোত্তর তথা তিরিশোত্তর কবি ও কবিতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। যাকে সমকালে ‘অতি আধুনিক’ বা ‘অত্যাধুনিক’ বাংলা কবিতা বলা হতো। প্রকৃতপক্ষে, আধুনিকতার দু’টি অর্থই বর্তমান; এক অর্থে সে সাম্প্রতিক, সমকালীন ও সমসাময়িক; অন্য অর্থে চিরকালীন, শাশ্বত, ভাস্বর। এই অর্থময় আধুনিক বাংলা কবিতার স্রষ্টারা হলেন: জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত প্রমুখ।

‘কল্লোল’ পর্বের এই কবিদের লক্ষ্য মূলত দু’টি দিকে প্রবাহিত; এক. সচেতনভাবে ‘রবীন্দ্রোত্তর হওয়া’, দুই. নিজস্ব কাব্যলোক সৃষ্টির প্রচেষ্টা। ‘কল্লোলে’র লেখকদের মানসিকতার পরিচয় মেলে জীবনানন্দ দাশের আলোচনায়: “কল্লোলের লেখকেরা মনে করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ অনেক সার্থক কবিতা লিখেছেন- কিন্তু তিনি যাবতীয় উল্লেখ্য বিষয় নিয়ে কবিতা লেখবার প্রয়োজন বোধ করেন না- যদিও তাঁর কোনো-কোনো কবিতায় ইতিহাসের বিরাট জটিলতা প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে হয়; তিনি ভারত ও ইউরোপের অনেক জ্ঞাত ও অনেকের মনে শাশ্বত বিষয় নিয়ে শিল্পে সিদ্ধি লাভ করেছেন, কিন্তু জ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞানের নানা রকম সংকেত রয়েছে যা তিনি ধারণ করতে পারেননি বা করতে চাননি।” [অসমাপ্ত আলোচনা: কবিতার কথা] সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সমকালের সাথে রবীন্দ্রনাথের দূরত্ব সম্পর্কে বলেন: “এ-কথা না মেনে তার উপায় নেই যে প্রত্যেক সৎকবির রচনাই তার দেশ ও কালের মুকুর, এবং রবীন্দ্রসাহিত্যে যে-দেশ ও কালের প্রতিবিম্ব পড়ে, তাদের সঙ্গে আজকালকার পরিচয় এত অল্প যে উভয়ের যোগফলকে যদি পরীর রাজ্য বলা যায়, তাহলে বিস্ময় প্রকাশ অনুচিত।” [সূর্যাবর্ত: কুলায় ও কালপুরুষ] অন্যদিকে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত রবীন্দ্রদ্রোহের ফলে ‘নতুন পথ’ ও ‘নতুন পৃথিবী’র সন্ধান পেয়েছেন: ‘‘ভাবতুম, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তাঁর পরে আর পথ নেই, সংকেত নেই। তিনিই সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু “কল্লোলে” এসে আস্তে আস্তে সে-ভাবকেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরো ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তির রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ- তখনকার সাহিত্য শুধু তাঁরই বহুকৃত লেখনির হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনের আরেক পরিচ্ছেদ’’। [কল্লোল যুগ] আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি কবিতায় ইশতেহার রচনা করলেন:

পাশ্চাতে শত্রুরা শর অগণন হানুক ধারালো, সম্মুখে থাকুন বসে পথ রুধি রবীন্দ্রঠাকুর,আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষè আলোযুগ-সূর্য ম্লান তার কাছে। মোর পথ আরো দূর।

তিরিশোত্তর আধুনিক কবিদের ‘পথ’ অনেক দূরবর্তী বন্দরের দিকে এবং ‘আপন চক্ষের’ আলোয় তারা সেইখানে পৌঁছাতে চান। আর পৌঁছাতে চান বলেই দ্রোহী মনোভাবের প্রতিধ্বনি শোনা যায় ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ কাব্যের ২৫ শে বৈশাখ কবিতায় বিষ্ণুদের কণ্ঠে:

রবীন্দ্রব্যবসা নয়, উত্তরাধিকার ভেঙে ভেঙেচিরস্থায়ী জটাজালে জাহ্নবীকে বাঁধি না, বরংআমরা প্রাণের গঙ্গা খোলা রাখি, গানে গানে নেমে সমুদ্রের দিকে চলি, খুলে দেই রেখা আর রংসদাই নূতন চিত্রে গল্পে কাব্যে হাজার ছন্দেররুদ্ধ উৎসে খুঁজে পাই খরস্রোত নব আনন্দের।

‘বরীন্দ্রব্যবসা’ ছেড়ে আধুনিকরা ‘সমুদ্রের দিকে’ যাত্রা করেন নতুন দিগন্তের প্রত্যাশায়। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ: “বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে, প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য প্রচুর- কোনো-কোনো ক্ষেত্রে দুস্তর; দৃশ্যগন্ধস্পর্শময় জীবনানন্দ আর মননপ্রধান অবক্ষয়চেতন সুধীন্দ্রনাথ দুই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন, আবার এ-দু’জনের কারো সঙ্গেই অমিয় চক্রবর্তীর একটুও মিল নেই। তবু যে এই কবিরা সকলে মিলে একই আন্দোলনের অন্তর্ভূত, তার কারণ এঁরা নানা দিক থেকে নতুনের স্বাদ এনেছেন; এদের মধ্যে সামান্য লক্ষণ এই একটি ধরা পড়ে যে এঁরা পূর্বপুরুষের বিত্ত শুধু ভোগ না-করে, তাকে সাধ্যমতো সুদে বাড়াতেও সচেষ্ট হয়েছেন, এঁদের লেখায় যে-রকমেরই যা-কিছু পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথে ঠিক সে-জিনিসটি পাই না। কেমন করে রবীন্দ্রনাথকে এড়াতে পারবো- অবচেতন, কখনো বা চেতন মনেই এই চিন্তা কাজ করে গেছে এঁদের মনে; কোনো কবি, জীবনানন্দের মতো, রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন, আবার কেউ-কেউ তাঁকে আত্মস্থ করেই শক্তি পেলেন তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াবার। এই সংগ্রামে-সংগ্রামই বলা যায় এটাকে, এঁরা রসদ পেয়েছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভান্ডার থেকে, পেয়েছিলেন উপকরণরূপে আধুনিক জীবনের সংশয়, ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণা। এঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধসূত্র অনুধাবন করলে ঔৎসুক্যকর ফল পাওয়া যাবে; দেখা যাবে, বিষ্ণু দে ব্যঙ্গানুকৃতির তির্যক উপায়েই সহ্য করে নিলে রবীন্দ্রনাথকে; দেখা যাবে সুধীন্দ্রনাথ, তাঁর জীবন ভুক্ পিশাচ-প্রমথর, রাবীন্দ্রিক কাব্যবিন্যাস প্রকাশ্যভাবেই চালিয়ে ছিলেন, আবার অমিয় চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথেরই জগতের অধিবাসী হয়েও, তার মধ্যে বিস্ময় আনলেন প্রকরণগত বৈচিত্র্যে, আর কাব্যের মধ্যে নানা রকম গদ্য বিষয়ের আমদানি করে। অর্থাৎ এঁরা রবীন্দ্রনাথের মোহন রূপে ভুলে থাকলেন না, তাঁকে কাজে লাগাতে শিখলেন, সার্থক করলেন তাঁর প্রভাব বাংলা কবিতার পরবর্তী ধারায়।” অর্থাৎ ‘রবীন্দ্রেতর’ হওয়ার সংগ্রামে এইসব আধুনিক কবি রবীন্দ্র-ব্যতিক্রমী মন ও মর্জি, ভাষা ও ভঙ্গির অবলম্বন করেন। এর প্রমাণ তাঁদের প্রাথমিক কাব্যপ্রয়াসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে: জীবনানন্দ দাশের ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭) ও ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬); সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘তন্বী’ (১৯৩০); বিষ্ণু দে-র ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৩৩); বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা’ (১৯৩০); প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘প্রথমা’ (১৯৩০) ইত্যাদি।

১৯৩০-এ ‘পরিচয়ে’র প্রথম সংখ্যায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রকাশিত হলে আধুনিক কবিদের মধ্যে আধুনিকতার অন্তর্গূঢ় চেতনা ও বহুমাত্রিক ধারণা সঞ্চারিত হয়। এই লেখার মাধ্যমে আধুনিক কবিরা এলিয়ট, পাশ্চাত্যের আধুনিক কাব্য ও কাব্যতত্ত্বের সাথে পরিচিত হন এবং নিজেদের পূর্ব ভাবনা-চিন্তার পুনর্বিবেচনা করেন। এই রচনা থেকেই আধুনিক কবিরা কবিতায় ‘রূপে’র গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে যান। সুধীন্দ্রনাথের মতে, “ভাবানুষঙ্গ অভিধানের সাহায্যে স্পষ্ট হয় না। কারণ এদের অনিবর্চনীয়তার মূলে শুধু শব্দার্থ নেই, আছে শব্দের অন্তঃশীল আবেগ। সমাবেশ ও ধ্বনিবৈচিত্র্য, এবং ছন্দের শোভনতা। এই গুণসমষ্টির নাম রূপ; এবং রূপের প্রত্যেক অঙ্গ অপরিহার্য। রূপ আর প্রসঙ্গের পরিপূর্ণ সঙ্গমেই কাব্যের জন্ম। তাই কাব্যের ভাষান্তর অসাধ্য; তাই কাব্যের ভাষা আর কথ্যভাষা স্বভাবত স্বতন্ত্র; তাই আধুনিক কাব্যে রূপের এত প্রাধান্য।” [কাব্যের মুক্তি: স্বগত] অন্যদিকে তিনি ‘প্রেরণা’র সনাতন ধারণাকে পুনর্মূল্যায়ন করে বলেন, “আধুনিক কবি প্রেরণা মানে বটে, কিন্তু প্রেরণা বলতে সে বোঝে পরিশ্রমের পুরস্কার।” অর্থাৎ সে মননধারায় স্নাত হয়ে কবিতা সৃজন করবে। কবিতার প্রয়োজনেই সে বিশ্বভ্রমণে বের হবে; “বিশ্বের সেই আদিম উর্বরতা আজ আর নেই। এখন সারা ব্রহ্মা- খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে, কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না।” এইভাবে ‘কাব্যের মুক্তি’ রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিদের ‘রবীন্দ্রেতর’ হবার সাধনায় উৎসাহ ও সাহস যোগায়; অপরদিকে ‘পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভান্ডার’ এবং ‘আধুনিক জীবনের সংশয়, ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণা’ তাদের স্বতন্ত্র স্বরায়ণের ক্ষেত্রে ‘রসদ’ হিসেবে কাজ করে। ফলে তিরিশোত্তর কবিরা বাংলা কাব্যে নতুন পথ ও নতুন পৃথিবীর স্রষ্টারূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে আধুনিক কবি ও কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নানা সময় নানা মন্তব্য করেন- যেখানে তাঁর কাব্যাদর্শের সাথে নতুনদের সাদৃশ্য অনুপস্থিত। তিনি তরুণদের কখনো স্বাগত জানিয়েছেন, কখনো সমালোচনা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ‘সর্বমানবের’ ‘চির আধুনিক’ সাহিত্যে বিশ্বাসী। সে কারণে তিনি মনে কারেন: সাহিত্যের সম্পদ চিরযুগের ভান্ডারের সামগ্রী- কোনো বিশেষ যুগের ছাড়পত্র দেখিয়ে সে আপনার স্থান পায় না। তবে অনস্বীকার্য, এই নতুন যুগের নতুন মেজাজ ও চরিত্রের সাহিত্য তাকে চিন্তিত করে তোলে; আবার সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর পূর্বতন আদর্শের পুনর্মূল্যায়নে রচনা করেন ‘সাহিত্য’, ‘সাহিত্যের পথে’ ও ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ গ্রন্থসমূহ। কিন্তু তিনি এসব গ্রন্থে তাঁর আজন্মলালিত সাহিত্যাদর্শকেই প্রতিষ্ঠা করেন।

রবীন্দ্রনাথ নিজের পরিচয় নিজেই দিয়েছেন ‘আমি জন্ম রোম্যান্টিক’ বলে। আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁকে ‘রোম্যান্টিকতার পরাকাষ্ঠা’ বলেছেন। সে জন্যে রবীন্দ্র-কাব্যে সত্য, সুন্দর, স্বপ্ন, কল্পনা, অস্তিবাদ, প্রেরণা, অতিন্দ্রীয় বিশ্বাস, মঙ্গলবোধ ইত্যাদি রোম্যান্টিক (Romantic) গুণাগুণের রূপায়ণ হয়েছে বিস্তৃতভাবে। বিষ্ণু দে-র মতে, ‘‘রোম্যান্টিকের পরিবর্তন-অভীপ্সা, হৃদয়বৃত্তির সূক্ষ্ম সৌকুমার্য, পেলবতা তাঁরই দান। বড়ো কথা, সৌন্দর্যতত্ত্বের প্রথম পরীক্ষাতেই প্রয়োজন যে নিছক সৌন্দর্যের চেতনা, সেও আমরা রবীন্দ্রনাথেই দেখেছি। ভিক্টোরীয় চরিত্রের বলিষ্ঠ সততা, কর্মের দায়িত্ববোধও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের রচনা।” [বাংলা সাহিত্যে প্রগতি: সাহিত্যের ভবিষ্যৎ] কিন্তু ‘মানসী’ প্রকাশের পর অর্ধ-শতাব্দী গত না-হতেই রবীন্দ্র-কাব্যবিচারে খুব বড়ো রকমের পটপরিবর্তন দেখা যায়; কাব্যের মানদন্ডই যায় পাল্টে। ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম মহাযুদ্ধের পর রোম্যান্টিক মনন ও সংবেদনা, বিচার ও রচনাশৈলী খুব দ্রুত গতিতে অশ্রদ্ধেয় হয়ে পড়ে। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের মধ্যভাগে যে-মেজাজ ও রুচি ইংরেজি সাহিত্যে প্রতিষ্টিত হয়, তার কাছে রবীন্দ্রনাথ অকস্মাৎ অত্যন্ত ছোটো হয়ে যান, অন্যান্য রোম্যান্টিক কবিরা যতোটা হয়েছিলেন তার চেয়েও যেন কিছুটা বেশি। সে কারণেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন ‘পরিশেষ’ (১৯৩২) এর আগন্তুক কবিতায়:

কালের নৈবেদ্যে লাগে যে-সকল আধুনিক ফুলআমার বাগানে ফোটে না সে।

কিন্তু ‘দানের একান্ত দুঃসাহসে’ তাকে ‘বড়ো কিছু দান’ যে দিতে হবে, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। ফলে তিনি রচনা করেন গদ্যছন্দ ও আটপৌরে জীবন আশ্রিত কাব্যগ্রন্থ ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২)। যদিও গদ্যছন্দের সূচনা ‘লিপিকা’ (১৯২২) থেকেই। ‘অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেকদূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব’- এই বিশ্বাস থেকেই তাঁর গদ্যছন্দের অবলম্বন। ‘পরিশেষ’ ও ‘পুনশ্চ’- একই বছরে (১৯৩২) প্রকাশিত এই দুটি কাব্যগ্রন্থ রবীন্দ্র-কাব্যের রূপান্তরে বিশেষভাবে স্মরণীয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায়: “এই গ্রন্থ-দু’খানিতে রবীন্দ্রনাথ ভাষা, ধ্বনি ও প্রসঙ্গের দিক দিয়ে যেখানে পৌঁছেছেন, তার পরে আর এগোনো অসম্ভব।” [ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ: কুলায় ও কাল পুরুষ] গদ্যছন্দের বৈচিত্র্য ও সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে এই দু’টি কাব্যের ধারাবাহিকতায় রচনা করেন ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬)। অবশ্য এইসব কাব্যে রবীন্দ্রনাথের নানা রূপ দৃশ্যমান: ‘নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।’ প্রকৃতপক্ষে, সদাচলিঞ্চু, বৈচিত্র্য সন্ধানী ও বিপুল সৃজনীশক্তির অধিকারী রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বারবার ভেঙেছেন, আবার নতুনভাবে গড়েছেন, নতুন কালের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলার চেষ্টাও করেছেন।

তিরিশের দশকে প্রকাশিত তাঁর গদ্যকাব্যগ্রন্থগুলোতে তিনি নবযুগের ধর্ম ও ছন্দের মুক্তির মাধ্যমে তরুণ কবিদের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারপরে ১৯৩৭-১৯৪১ পর্যন্ত লেখা তাঁর শেষ পর্যায়ের কবিতায় তিনি প্রত্যাবর্তন করেন আপন জগতে, যা আজীবনের সাধনায় নির্মিত। আসলে রবীন্দ্রকাব্যে বারবার প্রসঙ্গ ও প্রকরণের নব্যতা ঘটলেও ‘আজন্মলালিত বিশ্বাসের ধ্রুববীজটি, কোনো না কোনোভাবে বর্তমান থেকেছে। তবে তিনি বুঝেছিলেন জন্মদিনের ধারাকে বহন করে ‘মৃত্যুদিনের দিকে’ চলেছেন, কালের নিয়মেই পুরোনো কবি চলে যাবেন, নতুন কবির আগমন ঘটবে, তার জন্যে ‘পথ ছেড়ে দিতে’ হবে:

সব লেখা লুপ্ত হয়, বারম্বার লিখিবার তরেনতুন কালের বর্ণে, জীর্ণ তোর অক্ষরে অক্ষরে কেন পট রেখেছিস পূর্ণ করি। হয়েছে সময়নবীনের তুলিকারে পথ ছেড়ে দিতে। হোক লয়সমাপ্তির রেখা-দুর্গ। নবলেখা আসি দর্পভরে [লেখা: পরিশেষ]

ইতিহাসের এই ধর্ম রবীন্দ্রনাথের গভীরভাবে জানা ছিলো বলেই বাংলা কাব্যের পরিবর্তন সত্ত্বেও তিনি নিজ আদর্শচ্যুত হননি। বরং ‘আধুনিক কাব্যে’ সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। তবে অনস্বীকার্য যে, সামাজিক-রাজনৈতিক-দৈশক-বৈশ্বিক ও সাহিত্যিক উপপ্লবে রবীন্দ্রনাথের অটুটপ্রায় অস্তিত্ববাদ, শান্তিস্বর্গ, স্থৈর্য ও আত্মপ্রত্যয় ভেঙে যাবার উপক্রম হয় শেষ দিকে। আবদুল মান্নান সৈয়দের মতে, তিরিশোত্তর বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রীয় প্রবহণগুলি- অনিশ্চয়তা, মানববিচিত্রতা, সংহতি, গদ্য-পদ্যের সমীকরণ প্রয়াস, সমকালীন বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ, বিশ্বের সঙ্গে একাত্মবোধ তথা বিশ্ব পটভূমিকায় মাতৃসাহিত্যের স্থাপনা, বাস্তবতা, শারীরিকতা, মনস্তত্ত্ব, নিখিলনাস্তি, অমঙ্গলবোধ, নিম্নবিত্তের সম্পর্কে আগ্রহ, আঞ্চলিকতার প্রতি আগ্রহ, সামাজিক সাম্য, অনীশ্বরবোধ- এইসব কেবলি তাঁর সাহিত্যিক প্রত্যয়ে অস্বস্তির সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় উল্লিখিত প্রবণতাগুলো অঙ্কিত হতে থাকে নতুন কবিদের হাতে। তবে ‘কল্লোল’ ও ‘পরিচয়’- যুগের এই নতুন কবিরা শিক্ষা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের পাঠশালাতেই, তাদের চোখ, কান, কণ্ঠ ও মন তৈরি হয়েছিলো তাঁরই ঝরণাতলায়। স্নাতকোত্তর কালে তাঁরা অবশ্য অনুভব করলেন রবিতন্ত্র থেকে মুক্তিলাভের প্রবল তাগিদ, একাধারে স্বতন্ত্রের প্রেরণা এবং ‘আধুনিক’ অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পাশ্চাত্য সাহিত্যের আকর্ষণ। অর্থাৎ রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিদের ‘রবীন্দ্রেতর’ হবার সাধনা এবং স্বতন্ত্ররূপে আত্মপ্রকাশের প্রেরণা বাংলা কাব্যে সৃষ্টি করে আধুনিতার নতুন এক স্রোতধারা- যার গন্তব্য মহাসমুদ্রের দিকে।

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১০:৫৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×