somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ কেমন ছিলেন !!!

২৬ শে জুলাই, ২০১২ রাত ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কোন এক বড় ভাই এর কাছথেকে শুনা !!!



শিক্ষক হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন, সে বিষয়ে সংক্ষেপে দু-একটা কথা বলছি।
তখন এরশাদের স্বৈরশাসন চলছে দেশে। সারা দেশের মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ছাত্ররা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তো সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। এ রকম একটা সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, রসায়ন বিভাগে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ঘটল আমার। বেশ কদিন হলো ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই পরিচিত হচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের সঙ্গে। ভেতরে ভেতরে একটা খচখচানি চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে পড়ছি, অথচ হুমায়ূন আহমেদের ক্লাস এখনো করার সুযোগ পাচ্ছি না—এটাই ছিল খচখচানির মূল কারণ। খচখচানিটা মিইয়ে যেতে বেশি দিন লাগল না। একদিন যথাসময়ে ক্লাসে এসে হাজির হলেন ছোটখাটো গড়নের এক শিক্ষক। এসেই বোর্ডে চক দিয়ে ইংরেজিতে লিখলেন ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’। বললেন, ‘এ বিষয়টি তোমাদের পড়াব আমি। আমার ক্লাস যদি মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করো, তাহলে গণিতের মতো সহজ মনে হবে, আর সেটা না করলে কঠিন লাগবে।’ এরপর এক এক করে সংক্ষেপে তিনি সবার নাম এবং কে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসেছি, জেনে নিলেন। মনের খচখচানি নিবৃত্ত করার জন্য আমি বললাম, স্যার, আপনার নামটা তো জানা হলো না। তিনি বললেন, ‘আমার নাম জানার দরকার নাই। আমি কোয়ান্টাম মেকানিক্স স্যার।’ তিনি কথা আর না বাড়িয়ে পড়ায় চলে গেলেন। আমি মনে মনে বললাম, আপনি রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাননি যে সবাই আপনাকে জানবে। কয়েক খানা উপন্যাস আর টেলিভিশনে কিছু নাটক লিখে ভাবতে শুরু করেছেন, দুনিয়ার সবাই তাঁকে চিনে ফেলেছে! আজ বুঝতে পারি, আমার বা আমার মতো তথাকথিত স্বঘোষিত সাহিত্য-সমঝদারদের মুখে চুনকালি দিয়ে আমৃত্যু জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিজেকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
আমাদের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্যার হুমায়ূন আহমেদ সময় ধরে ক্লাসে আসতেন এবং অত্যন্ত যত্নসহকারে পড়াতেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো একটি জটিল বিষয় খুব সহজ করে পড়াতে পারতেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে আমার মতো মাথামোটা ছাত্রও ৭০-৮০ শতাংশ নম্বর পেয়ে যেত। খুব অল্প দিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছি শিক্ষক হিসেবে তিনি কত উঁচু মাপের। তিনি ক্লাসে পাঠ্য বিষয়ের বাইরে একটি কথাও বলতেন না। কেন তিনি এ কাজ করতেন, সেটা বুঝতে পেরেছি অনেক পরে। সে সময়ে টেলিভিশনে তাঁর ধারাবাহিক নাটকগুলো একের পর এক জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যাচ্ছে, বইগুলো বেস্ট সেলার হচ্ছে। এসব নিয়ে ছাত্ররা কথা বলার সুযোগ পেলে তাঁর পাঠদানের ক্ষতি হবে। নির্দিষ্ট সময়ে তিনি কোর্স শেষ করতে পারবেন না। তাই তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে শ্রেণীকক্ষে পাঠ্য বিষয়ের বাইরে কোনো আলোচনা করতেন না।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কোর্স যেদিন তিনি শেষ করলেন, সেদিনটার কথা খুব মনে পড়ছে। ভোর থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে, অথচ স্যারের দেখা নেই। স্যার কখনো দেরি করে ক্লাসে ঢুকতেন না। সেদিন খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলেও স্যার আসছেন না দেখে আমরা করিডরে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম এবং ধরেই নিয়েছিলাম স্যার আজ আসছেন না। হঠাৎ লক্ষ করলাম, ছোট বাচ্চাদের মতো শার্টের কলারের দিকটা মাথার ওপরে দিয়ে বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচিয়ে চলে এসেছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের শেষ ক্লাস নিতে। যথারীতি পড়ানো শেষ করলেন এবং জানালেন কোর্সে তাঁর যতখানি পড়ানোর কথা, তা তিনি পড়িয়ে শেষ করেছেন। তার পরও আমাদের কারও কিছু জানার বা বোঝার থাকলে জানতে, বুঝতে চাইতে পারি। কারণ এটাই শেষ ক্লাস। সবশেষে বললেন, ‘আজ আমার একেবারেই ক্লাস নিতে আসতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। শুধু শেষ দিনটায় কেন তোমাদের ফাঁকি দেব? তাই চলে এলাম।’ সময় শেষ হলে জেনে নিলেন এরপর কোনো ক্লাস আছে কি না। যখন জানলেন সেদিন সেই ক্লাসের পর আর ক্লাস নেই, তখন তিনি যেন তাঁর গম্ভীর চেহারার খোলসটা ঝেড়ে ফেললেন। কাঠিন্যের আবরণে কঠিন বিষয় কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াতেন যিনি, তিনি কত সহজ-সরল আপন মানুষের মতো কথা বলছেন আমাদের সঙ্গে। বললেন, ‘আজ আমার মোটেও ক্লাস নিতে আসতে ইচ্ছা করছিল না। শুধু রবিঠাকুরের বর্ষার গান শুনতে ইচ্ছা করছিল।’ তাঁর প্রিয় কিছু বাদলদিনের গানের কথা বললেন। এরপর তিনি বিখ্যাত একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর নাম ধরে আমাদের কাছে জানতে চাইলেন তাঁর গাওয়া বর্ষার এই গান শুনেছি কি না, অমুকের অমুক গানটি শুনেছি কি না? অতি উৎসাহী হয়ে আমরাও দু-একজন আমাদের রবীন্দ্রসংগীত সমঝদারির প্রমাণ দিচ্ছিলাম। সেটা আসলে আর কিছু নয়, স্যারের সঙ্গে কথা বলার, আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নিচ্ছিলাম। তিনিও যাচাই করে নিচ্ছিলেন আমাদের জানাশোনার গভীরতা কতটুকু। বাইরের বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিল আমাদের আলাপচারিতা।
কোর্স শেষ হওয়ার পরই শুধু তাঁর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। শুধু ভালো পাঠদান নয়, একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি কখনো ফাঁকি দিতেন না। একসময় যখন তাঁর লেখালেখি ও নির্মাণকাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেল, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক অধ্যাপকের পদটি আঁকড়ে থেকেও তিনি তাঁর কাজ করে যেতে পারতেন, কিন্তু সেই মানসিকতার মানুষ ছিলেন না তিনি। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
১২টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×