somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাজী নজ্রুল ইসলামের প্রেম ও সৌ্নদর্য

১৩ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের জাতীয় কবি, সংগ্রামের কবি, যৌবনের কবি, প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কাব্যে যেমন প্রেম এসেছে তেমনি তাঁর জীবনেও এসেছে প্রেম। নানা রঙে, নানা ছন্দে তিনিও আলোড়িত হয়েছেন প্রেমে। তাই নজরুল চর্চার ক্ষেত্র যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি নজরুলের চেতনায় নারী ও নারীত্বও গুরুত্বপূর্ণ।

সাহিত্য সাধানার সূচনাপর্বেই কবির আত্মঘোষণা ছিল

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরি, আর হাতে রণ-তূর্য



তিনি নিজের জীবনে ছিলেনও তাই। একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে প্রেম- এই ছিল তাঁর জীবন সাধনার অন্বিষ্ট। তিনি যুদ্ধ করেছেন কলমে, কাব্যে, গানে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে, মূলত নির্যাতিতদেরই ভালবাসার একান্ত টানে। কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০ এর দশকের শুরুতেই প্রত্যয়ী ব্যঞ্জনায় তিনি শুনিয়ে দিলেন-

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছি নারী, অর্ধেক তার নর




নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজরুল চেতনা

নজরুলের চিন্তা চেতনায় নারীর বিচিত্র অনুষঙ্গ বরাবরই যুক্ত ছিল। বাঙালি সমাজ পরিবেশে নারীর পশ্চাৎপদতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। নজরুল যেমন নিজে তাঁর জীবনে ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে উঠে নারীত্বের মহিমাকে শ্রদ্ধা করেছেন তেমনি সাহিত্যেও তাঁর নারীরা হয়ে উঠেছেন মুক্ত জীবন-সন্ধানী। তাই নজরুল বাংলা সাহিত্যে কেবল নারীমুক্তি চেতনার অন্যতম রূপকার হিসেবেই আসেননি এসেছেন সাহিত্যের বৈচিত্র্য ব্যবহার নিয়েও। নারীর জাগরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি বলেছেন-

জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা



ধর্মের নামে নারী জাতিকে অন্তঃপুরবাসিনী করে রাখবার যে প্রথা, নজরুল তার কঠোর সমালোচনা করেছেন। মোল্লাতন্ত্রের দ্বারাই নারী কিভাবে নির্যাতিত হয়, তার ভয়াবহতা কতদূর এসব কিছু নিয়ে নজরুল লিখেছেন; তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন

আমাদের পথে মোল্লারা যদি হন বিন্ধ্যাচল, তাহা হইলে অবরোধ প্রথা হইতেছে হিমাচল।- আমাদের বাংলাদেশের স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানদের যে অবরোধ, তাহাকে অবরোধ বলিলে অন্যায় হইবে, তাহাকে একেবারে শ্বাসরোধ বলা যাইতে পারে।



কিন্তু এই ‘শ্বাসরোধ’কেই অনেক নারী জীবনসত্যের ‘নিয়তি’ হিসেবে গ্রহণ করতেন। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তৎকালীন বুলবুল পত্রিকার সম্পাদক ও রাজনীতিক হাবীবুল্লাহ বাহারের সখ্যতা ছিল। তাঁর ছোট বোন শামসুন্নাহার মাহমুদকেও তিনি অনেক স্নেহ করতেন। ১৯২৬ সালের ১১ আগস্ট শামসুন্নাহার মাহমুদকে লেখা নজরুলের একটি চিঠিতে পাওয়া যায়

আমাদের দেশের মেয়েরা বড় হতভাগিনী। কত মেয়েকে দেখলাম কত প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে, কিন্তু সব সম্ভাবনা তাদের শুকিয়ে গেল সমাজের প্রয়োজনের দাবীতে। ঘরের প্রয়োজন তাদের বন্দিনী করে রেখেছে। এত বিপুল বাহির তাদের চায়, তাদের ঘিরে রেখেছে বার হাত লম্বা আট হাত চওড়া দেওয়াল। বাহিরের আঘাত এ দেওয়ালে বারবার প্রতিহত হয়ে ফিরল। এর বুঝি ভাঙন নেই অন্তর হতে মার না খেলে। তাই নারীদের বিদ্রোহিনী হতে বলি।



নারীর পর্দা ও অবরোধ প্রথা থাকার ফলে অন্যতম মৌলিক কাজ শিক্ষাও বিপন্ন হয়। নজরুল নারী শিক্ষাকে যথার্থভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি এক প্রবন্ধে বলছেন-

কন্যাকে পুত্রের মতই শিক্ষা দেওয়া যে, আমাদের ধর্মের আদেশ তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের কেবল অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চিরবন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি।



নজরুল সাহিত্যের বিচিত্র পরিসরে নারীদের অধোগতি দেখানোর পাশাপাশি এর কারণও উদঘাটন করা হয়েছে। উদঘাটিত কারণসমূহের মধ্যে পুরুষের অনমনীয়তা ও বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় নারীকে গুরুত্বহীন চিহ্নিতকরণকেই দায়ী করেছেন তিনি। নজরুল বারবার বলেছেন- নারীকে বাদ দিয়ে পেছনে রেখে সভ্যতা বা প্রগতির মশালবহন সঙ্গতিহীন। একারণে সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেতনায় নজরুলের সাহিত্য বৈশিষ্ট্যম-িত।

নজরুল সাহিত্যে নারী: প্রেম ও রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে

একথা মানতেই হবে যে, নজরুলের সাহিত্যে প্রেমের সার্থক রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্যে তাঁর জীবন ও বাস্তবতার প্রেরণা ও অভিজ্ঞতার ভূমিকা কম নয়। রোম্যান্টিক কবি প্রত্যয় ও উচ্ছল-আবেগদীপ্ত স্বভাবের জন্য নজরুল জীবনে একাধিক প্রেমের রোম্যান্স সংঘটিত হয়। ১৯২০ এর দশকে কবি খ্যাতির দীপ্যমান পরিসরে বেশ কিছু নারীর সাহচর্য ও প্রেরণা তাঁকে রাঙিয়ে তোলে। নজরুল গবেষকদের লেখায় যাঁদের প্রেম ও প্রেরণার কথা উল্লেখ আছে- তাঁরা হলেন

নার্গিস খানম, প্রমীলা সেনগুপ্তা, ফজিলাতুন্নেসা, রানু সোম, উমামৈত্র, জাহান আরা চৌধুরী প্রমুখ। নার্গিস ছিলেন নজরুলের প্রথম প্রেমিকা এবং স্ত্রী। সৈয়দা নার্গিস আসার খানম ছিলেনকুমিল্লার দৌলতপুরের মেয়ে। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কক্ষে নজরুলের সাথে ঘনিষ্টতা হয় নার্গিসের মামা আলী আকবর খানের। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ১৯২১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি তাঁদের আকদ হয়। কিন্তু এরপরই চিরবিচ্ছেদ হয় দুজনের।

কাজী নজরুল ইসলামের সহধর্মিনী মিসেস প্রমীলা নজরুলও ছিলেন কুমিল্লার মেয়ে। কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে ছিল তাঁদের আবাস। নার্গিসের মামা আলী আকবর খানের সূত্র ধরেই কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে বীরেন্দ্র সেনগুপ্ত ছিল আলী আকবর খানের সহপাঠী। তাঁরই জেঠাত বোন প্রমীলা সেনগুপ্ত। প্রমীলার সাথে প্রেম ও আন্তজাতি সমস্যা অতিক্রম করে নজরুল তাঁকে বিয়ে করেন। নজরুল তাঁর নাম দেন দোলন। এরপরই তিনি ‘দোলন-চাঁপা’ কাব্যগ্রন্থটি লেখেন।

প্রমীলার পর যার পরশে নজরুলের বেদনা আর ব্যর্থতার সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছিল তিনি সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের ছাত্রী মিস ফজিলাতুন্নেসা। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন হয়। সেখানে যোগদানের জন্যে নজরুল আসেন ঢাকায়। উঠেন কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায়। একদিন হাত দেখানোকে কেন্দ্র করে নজরুল পরিচিত হন মোতাহার সাহেবের বোনের সাথে। এক সময় নজরুল প্রেম নিবেদন করেন কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে ব্যথিত হৃদয়ে ফিরে যান কলকাতা। ফজিলাতুন্নেসার বিয়ের পর ১৩৩৯ সালের আশ্বিন সংখ্যা সওগাতে কবির একটি গান ছাপা হয়

বাদল বায়ে মোর
নিভিয়া গিয়াছে বাতি
তোমার ঘরে আজ
উৎসবের রাতি



ফজিলাতুন্নেসার পর প্রেমে পড়েন ঢাকার বনগা নিবাসী রানু সোম ওরফে প্রতিভা সোম ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্র মৈত্রের কন্যা উমা মৈত্র (নোটন) এর সঙ্গে। তাঁদের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সঙ্গীত দিয়ে। উমা মৈত্র ছিলেন চিত্রশিল্পী ও সেতার বাদক। তাঁকে সরাসরি সম্বোধন করে নজরুল একটি গানও লিখেছেন-

নাই পরিলে নোটন খোঁপায় ঝুমকো লতার ফুল



নজরুলের সাথে আরেক রমণীর সখ্যতা পাওয়া যায়। তিনি হলেন ‘বর্ষবাণী’ সম্পাদিকা জাহান আরা চৌধুরী। নজরুল জাহান আরা চৌধুরীর সঙ্গে ১৯৩১ সালের ২০ জুন দার্জিলিং এ বেড়াতে যান। সেখানেই তাঁর জন্যে ‘স্বপন-মায়া’ গানটি লিখেন।

এভাবেই কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সাধনার মত তাঁর জীবনও নানাভাবে প্রেমে-কাব্যে দোলায়িত হয়েছে। আজ সেই কবির ১১৩ তম জন্মদিন। অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাঁর জন্যে শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:১১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×