লোওয়ার ম্যানহাটানের ওয়েষ্ট স্ট্রীট আর লিবার্টি স্ট্রীটের জাংকশনে উবার থেকে নেমে সামনে বিশাল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। এক সময় এখানে ছিলো পাশাপাশি দুটো যময ভবন, দ্যা টুইন টাওয়ার। এই দুটিতে মিলে ছিলে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার যা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিলো ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে দুইটি যাত্রীবাহী বিমানের মাধ্যমে। পায়ে হেঁটে নিউ ইয়র্ক সিটি সেন্টারে ঘুরে বেড়িয়েছি বহুক্ষন। এখানে, ওখানে। টুইন টাওয়ার যেখানে ছিলো সেই স্পটে এসে মনটা সত্যি বিষাদে ভরে গেলো। পৃথিবীর রাজধানী নিউ ইয়র্কে দুনিয়ার ট্যূরিষ্ট সব সময় গিজ গিজ করে। তার উপর এখন সামার, ধুন্ধুমার ট্যূরিষ্ট সীজন। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল এই দিনে সবখানে ঠাশাঠাশি ভীড়। এত ভীড়েও এই স্পট কেমন জানি নীরব। কোলাহলের শব্দও নেই। বিষাদ মাখা পরিবেশ।
প্রথমে নাইন ইলেভেন মেমরিয়াল ভালোমত ঘুরে ফিরে দেখলাম যেখানে এক সময় টুইন টাওয়ার ছিলো। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে পর পর দুটো যাত্রীবাহি বিমান টুইন টাওয়রের দুটো টাওয়ারকে ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী হামলায় বিমানগুলোর সকল ক্রু/যাত্রী সহ মোট তিন হাজার মানুষ মুহুর্তে মারা যায়। ভেঙ্গে যাওয়া দুটো টাওয়ার যেখানে ছিলো সেটা এখন নিহতদের স্মরণে সংরক্ষিত। বিশাল এলাকাজুড়ে বানানো হয়েছে কৃত্রিম জলপ্রপাত, পথরে খোদাই করে লেখা হয়েছে হাজারো নিহতের নাম। এত বছর পরও কি এক গভীর ব্যাথাতুর, মন খারাপ করা পরিবেশ। পাশে বানানো হয়েছে নাইন–ইলেভেন মেমরিয়াল মিউজিয়াম। আমাদের যাওয়া হয় নি, অনেক লম্বা কিউ। সময় হবেনা।
নাইন–ইলেভেন মেমোরিয়ালের অফিশিয়াল নাম দ্য সেপ্টেম্বর ইলেভেন মেমোরিয়াল এন্ড মিউজিয়াম।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের এগারো তারিখ পর পর দুটো প্যাসেঞ্জার বিমান নিউ ইয়র্ক সিটির প্রানকেন্দ্র গ্রিনীচ স্ট্রীট সংলগ্ন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পাশাপাশি দুটো ভবনে সরাসরি আঘাত করে পরে সেগুলো পুরোপুরি গুড়িয়ে যায়। আমেরিকান এয়ারলাইন্সএর একটি বোয়িং সেভেন–সিক্স–সেভেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের প্রথম ভবনের (WTC-1) ৯৪–৯৮ তলার মাঝামাঝি আঘাত করে স্থানীয় সময় সকাল ০৮:৪৬ এ। সতের মিনিট পর অর্থাৎ ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের আরেকটা বোয়িং সেভেন–সিক্স–সেভেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দিত্বীয় ভবনের (WTC-২) ৭৮–৮৪ তলার মাঝামাঝি আঘাত করে। একদম এক রকম দেখতে দুটি ভবনের উচ্চতা ছিলো ১০৪ তলা করে।
আগুনের লেলিহান শিখা মুহুর্তের মধ্যে পুরো এলাকা গ্রাস করে ফেলে। তারপর দুটো ভবনই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।
স্বরণকালের অন্যতম, জঘন্য এবং ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে হারিয়ে যায় প্রায় তিন হাজার মানুষের মহামূল্যবান জীবন, আহত হয় ছয় হাজারেরও বেশী। আর ঠিক সেই মুহুর্তের আর্থিক ক্ষতি হয় দশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু জীবনগুলোর মূল্য কোন কিছু দিয়ে মাপা যাবেনা। প্রতিটি জীবন মহামূল্যবান।
নৃসংস, বর্বরোচিত এই হামলায় সারা বিশ্বের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
যে কোন অজুহাতে নিরপরাধ মানুষ হত্যা হারাম। ওটা জেহাদ ছিলোনা, ওটা ছিলো কাপুরুষোচিত গণহত্যা।
সি আই এ’র বিদ্রোহী এজেন্ট জন্মসূত্রে সৌদি নাগরিক ওসামা বিন লাদেনকে এর মুল হোতা বলে দাবী করা হলেও আজ পর্যন্ত ওয়েষ্টার্ণ পণ্ডিতেরা এর পক্ষে কোনো সাদাকালো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।
তর্ক আসবে তর্ক যাবে। নিরীহ প্রাণগুলো কখনো জানবেনা কি ছিলো তাদের অপরাধ।
নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার পাশেই বানানো হয়েছে তবে এখন এটা একটা বহুতল ভবন। প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিলো ফ্রীডম টাওয়ার।
নাইন–ইলেভেন মেমরিয়ালের পাশেই বৃটিশ কলোনিয়ালদের বানানো “সেইন্ট পল’স্ চ্যাপেল” যা নির্মান করা হয় ১৭৬৬ সালে। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর ১১’র সেই ভয়াবহ হামলায় টুইন টাওয়ারসহ আশপাশের আরো বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অথচ ঠিক পাশে থাকা সত্বেও প্রাচীন এই চার্চ এবং গ্রেভইয়ার্ড এতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হয় নি। তাই এর ডাকনাম হয়ে গেছে, “The Little Chapel That Stood.” এমনকি স্থানীয়দের দাবী চার্চ সংলগ্ন প্রাচীন গ্রেভইয়ার্ড এবং এর একটা গাছেরও কোন ক্ষতি হয় নি।
চার্চের সামনে দেখা যায় বিশাল একটা ঘন্টা, The Bell of Hope, যেটা সেইন্ট ম্যারী–লে–বোও (St. Mary-le-Bow chapel of England) এর পাঠানো উপহার। নাইন–ইলেভেনে নিহতদের প্রতি সম্মানস্বরূপ এই ঘন্টা বা বেল তৈরি করা হয় পূর্ব লন্ডনের বিখ্যাত হোয়াইটচ্যাপেল বেল ফাউন্ড্রীতে (Whitechapel Bell foundry)। ২০০২ সাল থেকে প্রতি ১১ সেপ্টেম্বরে নিহতদের স্মরণে এই বেল বাজানো হয়।
(Cruise to Staten Island)
অনেএএএএক গরম পড়েছে। আইসক্রীমের গাড়ী থেকে পোলাপানদের সাথে আমিও আইসক্রীম খেতে খেতে হেঁটে বেড়িয়েছি ম্যানহটান স্কাইলাইনগুলোর ফাঁক ফোঁকর দিয়ে। নাইন–ইলেভেন মেমরিয়াল পেরিয়ে সেইন্ট পল’স্ চ্যাপেল, তার ঠিক পেছনেই ব্রডওয়ে। সেখান থেকে হেঁটে পূবদিকে খানিকটা এগিয়ে গেলে বিখ্যাত ওয়াল স্ট্রীট যেখানে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ যার প্রতিদিনের ট্রেডিং ভ্যাল্যূ প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার (চৌদ্দ হাজার তিনশত বাষট্টি কোটি টাকা)। এই ওয়াল স্ট্রীট নিয়ে চলে নানান জল্পনা–কল্পনা, লেখা হয়েছে অনেক কাহিনী, বানানো হয়েছে ব্লকবাস্টার হলিউড মুভি। ষড়যন্ত্র তত্ববিদ বা কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টরা মনে করে এই ওয়াল স্ট্রীট থেকেই দুনিয়ার অর্থনীতির সলতে ঘোরানো হয়। এরা চাইলে কোন দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করে দিতে পরে কিংবা ধ্বংস।
স্টেটেন আইল্যান্ডের আসল মালিক কিন্তু নিউ জার্সি (the state of New Jersey) অথচ এর বর্তমান মালিক কলোনিয়াল নিউ ইয়র্ক সরকার। বৃটিশদের শাসন থেকে মুক্ত স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনাইটেড স্টেটস সরকার যতই গলা উঁচু করে চীৎকার করে বলে “আমরা কলোনি বিরোধী!” ততই বেশী বোঝা যায় এটা ডাঁহা মিথ্যে কথা। স্টেটেন আইল্যান্ড, লিবার্টি আইল্যান্ড এবং এলিস আইল্যান্ডের প্রকৃত মালিক নিউ জার্সি হলেও বৃটিশ আমলে সেই যে নিউ ইয়র্ক এদের পেটে ঢুকিয়েছে। আমেরিকা স্বাধীন হবার এত বছর পরও দখলদার নিউ ইয়র্ক রাজ্য সরকার এই দ্বীপগুলোর দখল ছাড়েনি। পরে জানা যায় ২০১৭ সালে সুপ্রীম কোর্টের এক বায়ে নিউ জার্সি এলিস আইল্যান্ড ফেরত পায় যদিও দখলদার কলোনীবাজ নিউ ইয়র্ক সরকার এখনও ছাড়েনি তার বড় প্রমাণ এলিস আইল্যান্ডের জিপ কোড।
একজন প্রসিদ্ধ আদার ব্যাপারী হিসেবে এসব সাত–পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিশাল জনস্রোতের মাঝ দেয়ে ফেরী টার্মিনালে ঢুকছি আর অবাক হচ্ছি। লাখো মানুষের ঢল অথচ কি সুশৃংখল সবাই। সামনে বিশাল কাঁচের অটোম্যাটিক ডোর, তার উপরে দেড় ফুট চওড়া আর প্রায় বিশফুট লম্বা ফিতার মত এলসিডি স্ক্রীন। সেখানে ডোর নাম্বার উল্যেখ করা আছে, আবার নোটিশ কিংবা বিজ্ঞাপন উঠছে। ফেরীতে উঠার পর সবাই মিলে একদম টপ ডেকে চলে এলাম। ফেরীর প্রায় সব প্যাসেঞ্জারই ট্যূরিষ্ট এবং সবাই এই দিকেই দাঁড়িয়েছে কারন সবার উদ্যেশ্য একটাই, ফেরী থেকে স্ট্যাচু অর লিবার্টি দেখা।
আটলান্টিকের বুক চিরে ফেরী ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। বেলা গড়িয়ে গেলেও এখনো ঝকঝকে দিনের আলো। মুগ্ধ হয়ে দেখছি সব. . . ধীরে ধীরে নিউ ইয়র্ক সিটি দুরে সরে যাওয়া, ম্যাহটান স্কাই স্ক্র্যাপার্স।
দুরে লিবার্টি আইল্যান্ডের উপর স্ট্যাচ্যূ অফ লিবার্টি দাঁড়িয়ে আছে, দেখে রোমাঞ্চিত হই। লিবার্টি আইল্যান্ডে যাবো, কাল কিংবা পরশু, নয়তো তার পরদিন। যেতে আমাকে হবেই। অন্যদিকে নিউ জার্সি আবার আরেক দিকে নিউ ইয়র্ক সিটি। সমুদ্র থেকে আসলেই অপরূপ সুন্দর লাগে দেখতে।
স্টেটেন আইল্যান্ডে নেমে তাড়াতাড়ি ফিরতি ফেরী ধরতে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে এই ফেরীটিই পেয়ে গেলাম। এবার আর লিবার্টি আইল্যান্ডের দিকে নয়, উল্টোদিকে বসলাম। দুরে ভেরাজানো ব্রীজ দেখা যায় যেটা নিউ ইয়র্ক আর স্টেটেন আইল্যান্ডকে একসাথে জুড়ে দিয়েছে। ম্যানহাটানে ফেরার সময় ধীরে ধীরে নিউ ইয়র্ক সিটি কাছে আসতে আসতে মনে হয় হাই রাইজ বিল্ডিংগুলো যেন গায়ের উপর উঠে যাচ্ছে।
গ্রীষ্মের শেষ বিকেল, হাল্কা মিস্টি বাতাস, শান্ত আটলান্টিকের উপর ভাসি আর ভাবি, “আমেরিকা, কখনোই তুই আমার হিট লিস্টে ছিলিনা, তুই ছিলি আমার স্বাভাবিক গন্তব্য। জানতাম, নিয়তি একদিন আমাকে এখানে নিয়ে আসবে।”
(২০১৯ এর অগাষ্টে নিউ ইয়র্ক বেড়াতে যাই। তার মাত্র ছয় দিন আগে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এর পাসো-তে এক বন্দুকধারীর গুলিতে ২৩জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। সেজন্য ক্রুজ শীপের পতাকা অর্ধনমিত)
© আফলাতুন হায়তার চৌধুরী
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৫:২৫