somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই ছাপানোর গল্প।

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা বই লিখে ফেলেছি।
ভ্রমণ উপন্যাস। কি অদ্ভুত! আস্ত একটা বই, গ্রন্থ। বই লিখে, তারপর প্রকাশ করে কি হাতি ঘোড়া উল্টে ফেলেছি জানিনা। তবে চেষ্টা করেছি, এবং কামিয়াব হয়েছি। মাশা আল্লাহ্।

যেহেতু বিদেশে থাকি, বই হাতে এলো ছাপা কম্প্লিট হবার অনেক পরে। বইটা হাতে নিয়ে কতক্ষন খাড়ায়া ছিলাম। কি করবো বুঝতেছিলাম না, অধিক সুখে কাতর। কি সুন্দর বই, কি সুন্দর! স্বপ্নেও ভাবিনি এমন একটা বই প্রকাশিত হয়ে বাজারে যাবে যার ওজন পৌনে এক কেজি। এত ওজন ক্যারে? আমার বইয়ের প্রকাশক বাংলা বাজার ঢাকার অনন্যা প্রকাশনী। ফোন করে বলি,
"বইয়ের এত ওজন কেন? এই ভোটকা বই কে পড়বে? গায়ের দাম এক হাজার টাকা! ডিসকাউন্ট দিবে পঁচিশ নয়তো তিরিশ পার্সেন্ট, কার ঠেকা পড়সে সাত শ’ টাকা দিয়া এই বই কিনে পড়বে? কোথাকার কোন নয়া লেখক, এগুলারে কেউ চিনে? টাকা কি গরুর ডট্‌-ডট্-ডট্ দিয়া বাইর হয়?"

অনন্যা প্রকাশনীর সিনিয়র স্টাফ বুঝায়,
"আরে ভাই ইউক্রেন যুদ্ধ ব্যাবসার বাম্বু মাইরা দিছে, কাগজের দাম ছয় থেইকে আট গুন বাড়সে। কালির দাম, প্লেটের দাম সব বাড়তি। আমরা কি করুম? বইয়ের দাম তো বাড়বোই। তয় ভাইজান দারুন জিনিষ লেইখালাইছেন, এইসব সাব্জেক্টই লোকজন খুঁজে। আজাইররা প্রেম পিরিতির ভাত নাই এখন। আপনের বই চলবো। আপনার বইয়ের কাগজ ফার্স্ট ক্লাস, আর কভার দ্যাখছেননি, প্রচ্ছদটা ঝাক্কাস। বহুত দুর থেইকাও আলাদা কইরা দেখা যায়, কাষ্টামার আইসা কইবো, 'ওই বইটা দ্যান তো, লাইরা-চাইরা দেহি। তারপর প্রথম চ্যাপ্টার পইড়াই ফিদা হইয়া যাইবো। কিনবোই।"
পজিটিভ মন্তব্য শুনে ভালোলাগায় বুকটা শিরশির করে। তারপরও গুতা দিলাম একটা, “প্রচ্ছদ ঝাক্কাস হইছে? হেহ! মনির মামু তো কইছিলো ধ্রুব মামুরে দিয়া প্রচ্ছদ বানায়া দিবো। আমি কইছি, 'নাহ্,আমার প্রথম বইর প্রচ্ছদ আমি বানামু।' প্রচ্ছদ, মলাট যা দেখতেছেন সেইটা আমার করা। ইলাস্ট্রেটর দিয়া বানায়া দিছি।” (মনিরুল হক সাহেব অনন্যা প্রকাশনার মালিক।)
"তাই নাকি?" সিনিয়র স্টাফ অবাক, "হেভ্ভী জিনিষ হইছে। গর্জিয়াছ্। এই পৌনে এক কেজি ওজনের বই বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলায় ফ্লাই করবো ইনশা আল্লাহ্।"

আমি লেখক নই, পাঠক।
জীবনে এত কিছু পড়েছি যে বলে শেষ করতে পারবোনা। বই অথবা সাহিত্য না বলে "এত কিছু" বললাম কেন? আচ্ছা উদাহরণ দিই, আমি কোথাও কোন লেখা দেখলে পড়তাম। যেমন রাস্তায় পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজ।প্রত্যেকটা পণ্যের লেবেল পড়তাম। গ্লুকোজ বিস্কুটের গোলাপী মোড়কে, সিগারেটের বাক্সে, বিড়ির প্যাকেট, বয়ুমের লেবেলে, মুড়ির ঢোঙ্গায়, সাইনবোর্ডে, রিকশা, বেবীট্যাক্সি, বাস বা ট্রাকের সামনে, পেছনে। সিনেমার পোষ্টারে, দেয়ালের চিকা, ঢাকা গেলে রিকশায় বা জোর করে হাতে গুঁজে দেওয়া 'জীবনের শেষ চিকিৎসা'র' লিফলেট। পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে প্রিন্টার্স লাইন। লেখা হইলেই হইলো, পড়ে ফেলতাম। এমন কি যখন আমাদের ফেনী পাইলট হাই স্কুল বা ফেনী কলেজে মেট্রিক-ইন্টার বা ডিগ্রী পরীক্ষার সেন্টার পড়তো, পরীক্ষা শেষে এখানে ওখানে পড়ে থাকা নকল তুলে তুলে পড়তাম। নানান ডিজাইনের নকল, কত্তো রকমের হাতের লেখা, কি যে ভালো লাগতো! একটা নকলে সেন্টের মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিলাম, কি সুন্দর গোটা গোটা হাতের লেখা! চিকন লম্বা সাদা কাগজ, পরতে পরতে ছোট ছোট ভাঁজ করে কোনা কেটে এমন ভাবে সাজানো, হাতের তালুতে লুকিয়ে আরামে উত্তর লেখা যাবে। এটা নিশ্চই কলেজের কোন আপুর লেখা, নাইলে সেন্টের গন্ধ থাকবে কেন? ওরেব্বাবা, সাথে লাভ চিহ্নও আছে! ভালোবাসা মেশানো নকল। নীল কালিতে লেখা। তখন ইকোনো কলমে বাজার সয়লাব। লেখার শুরু এবং শেষে দুটো করে ছোট ছোট লাভ চিহ্ন আঁকা। সেন্টের গন্ধ মেশানো, লাভ চিহ্নওয়ালা পাতলা চিকন সাদা কাগজে নীল কালিতে কোনও এক আমলের ইতিহাস, সন, সরকার পদ্ধতি এসবের অল্প বিস্তর ছিলো, যেখান থেকে ক্লু নিয়ে ওই আপু ভালোমত উত্তর লিখবেন। বুদ্ধিমতী আপু। আমি না জেনে না শুনে কল্পনার সেই স্মার্ট নকল-লেখিকা আপুর প্রেমে পড়ে একেবারে পাগলপারা। তখন বড় হয়ে গেছি, অনেক বড়। ক্লাস টেনে পড়ি, সামনে মেট্রিক দেবো। শয়নে, স্বপনে, জাগরনে ওই আপুকে ভাবি। কল্পনার আপুটি ফর্সা, নীল ড্রেস পরা, ঠোটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল, স্বাস্থ্য ভালো। শুকনা হাড্ডিগুড্ডিওয়ালা মেয়ে দেখলে মাডগার্ড, গদি আর হুড ছাড়া রিকশার মত লাগে। গতরে গোস্তো না থাকলে নারী কিসের? সমবয়েসী আর জুনিয়র মেয়েগুলারে চোখে লাগেনা, সিনিয়র মানেই ভালোবাসা। পৃথিবীর সকল সুগন্ধ সিনিয়র আপুদের মাঝে।
রূপসী নরম-শরম ডানোর ডিব্বা আপুর সাথে মনে মনে কথা বলি,
"নকলটা কোথায় লুকানো ছিলো আপু?"
"আপনি এত সুন্দর কেন আপু?"
"আপনাকে আমার ভালো লেগেছে"
"আপনাকে ভালোবাসি আপু?"
প্লীজ আপু, আমাকে বেড়াই ধরেন, শক্ত করে বেড়াই ধরেন। তারপর বলেন, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।"
"কি বললেন? আমি মোটেও বাচ্চা পোলা না। অনেক বড়, ক্লাস টেনে পড়ি। সব বুঝি। প্লীজ আপু! মানা কইরেন না।"
স্বপ্ন লজ্জ্বাহীন, এতক্ষনে আমার আর আপুর প্রেম-ভালোবাসা হয়ে ছেলে মেয়ে হয়ে যাবার কথা।

কিন্তু কল্পনায়ও আপু দুর দুর, ছাই ছাই করে।
বলে, "এখন পর্যন্ত মোছও উঠে নাই আবার বড় বড় কথা। দুধের দাঁত কয়টা বাকী?"
কি বলে এসব? দুধের দাঁত বহুত আগে শ্যাষ। আর দাড়িমোছ? গালে লাইফবয় সাবানের ফেনা লাগাইয়া চাইনীজ রেজারে বলাকা ব্লেড দিয়া প্রত্যেকদিন টান দিলে শাঁই শাঁই করে দাড়িমোছ উঠে যাবে।
* * * * * * * * *

ধুর! কিসের মধ্যে কি?
লেখতেছিলাম বইয়ের কথা, প্রকাশনার কথা।
আবার আসি বইয়ের প্রসঙ্গে। আমি লেখক না, একটা বই লিখে বিরাট কোনো হনূ হয়ে যাই নি। কিন্তু আমি পাঠক। খুব ভালো পাঠক, ভালো লেখা বুঝতে পারি।ভালো লেখা পড়তে ভালোবাসি। হোক সেটা বাংলায়, ইংরেজীতে কিংবা অনূবাদে। রাজ্যের টুকরা-টাকরা পড়ে ক্ষান্ত থাকিনি। পড়েছি, সব ধরনের বই'ই পড়েছি।বাসার বইয়ের আলমারী গুলোতে আর বুক-শেল্ফে দুনিয়ার বই থাকতো। সেই পাকিস্তান আমলের বই, ইন্ডিয়ান রাইটারদের বই সেই আদি থেকে আধুনিক, দস্যু বনহুর, কুয়াশা, মাসুদ রানা, ওয়েষ্টার্ণ আর অনুবাদসহ সেবা প্রকাশনীর বিশাল ভান্ডার, সাথে ওদের রহস্য পত্রিকা। সোভিয়েত আমলের রাশানদের মোটা মোটা বই, চায়নীজদের বই। ওগুলো কমিউনিষ্ট বিপ্লবের। পশ্চিমাদের বই, সেখানে থাকতো কমিউনিজমের দুঃখ, বদনাম আর চোখ ধাঁধানো পশ্চিমা আধুণিকতা। তার পাশাপাশি ইসলামী বিপ্লবের বই। ইরানীদের এক রকম বিপ্লব, প্যালেষ্টাইনিদের ইসরায়েল বিরোধী বিপ্লব, সিরিয়া-লেবাননের হিজবুল্লাহ্ বিপ্লব, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো যাদের সাথে আমেরিকানদের লদকালদকি তাদের আরেকরকম ইসলামী বিপ্লবের বই। কিংবা ম্যাগাজিন। এর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলতো দেশের দৈনিক পত্রিকা আর দুনিয়ার সব ম্যাগাজিন। তখন সবাই খালি ইত্তেফাক পড়তো, আব্বুও। আর পড়তো অবজারভার। অবজারভারের ইংলিশ কেমন জানি, মনে হত কে যেন আমার মাথায় ঝুনা নারকেল দিয়ে বাড়ি মারছে। অথচ টাইম ম্যাগাজিন পড়তে কষ্ট হতনা। আব্বু দেশী-বিদেশী ম্যাগাজিনও রাখতো, তার মধ্যে বেশী মনে পড়ে বিচিত্রার কথা। আম্মার জন্য নিয়মিত বরাদ্দ ছিলো পূর্বানী আর চিত্রালী, সাথে বেগম পত্রিকা। ওগুলোও পড়তাম। মেয়েদের পত্রিকাতো আগে পুরুষদেরই পড়া উচিত তাই না? পূর্বাণী বা চিত্রালীর পৃষ্ঠা জুড়ে সে আমলের বাংলা সিনেমার নায়িকাদের বড় বড় রঙ্গীন ছবি দেখতে কি যে ভালো লাগতো! যখন সিক্স-সেভেনে পড়তাম, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বড় হলে ববিতাকে বিয়ে করবো। আমি বড় হতে হতে ববিতা বেশী বেশী বড় হয়ে গেলো। সে আমলে এখনকার মত ওষুধপত্র, পেলাষ্টিক ইত্যাদি ছিলোনা। এখন মাশাল্লাহ বয়স লক্ করা যায়। তখন যেতো না। তাই ববিতা বাদ। ক্লাস এইটে উঠে বিশাল এক সাহিত্য আবিষ্কার করলাম। আমাদের স্কুল থেকে দুলাল সিনেমা হল এইতো কাছে, একছুটে চলে যাওয়া যায়। সেখান থেকে বিশেষ বই কেনা শুরু হল। একজন ওপার বাংলার লেখক অত্যন্ত ভালো বিষয়ের বই লিখতেন যার মান ভালো, দামে কম। আমরা বন্ধুরা আট আনা, এক টাকা একসাথ করে দুই/আড়াই টাকা জমলেই যে কোন একজন এক ছুটে দুলাল সিনেমার সামনের দোকানগুলো থেকে এই বিশেষ বই কিনে এনে সবাই ভাগেযোগে পড়তাম আর সেই মহান লেখকের প্রতি নানান ভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতাম। সমস্যা হচ্ছে শিক্ষামূলক এবং চরম বিনোদনমূলক এই বইগুলো স্কুলে হারাম ছিলো। প্রথমে একজন ধরা পড়লো বুলেট স্যারের হাতে। দিত্বীয় দফায় খুরশীদ স্যারের হাতে ধরা পড়ে বই সহ আরেক জন যেভাবে ভোঁ দৌড় দিলো, সে এক ইতিহাস। তৃতীয় জন ধরা পড়লো সন্তোষ স্যারের হাতে, প্রমাণ সহ। তারপর থেকে সাহিত্যের এই জগত থেকে বাধ্যতামূলক বিদায় নিতে হল।

যাই হোক, এত বিষয়ে বইপত্র পড়তে পড়তে আমার মাথা ঘুন্ডি দোকান হয়ে গেলো। ফেনী-নোয়াখালীর ভাষায় ঝুপড়ি টাইপের দোকান গুলোকে ঘুন্ডি দোকান বলে যেখানে সব পাওয়া যায়। ঘুন্ডি দোকানে যেমন সুন্দর করে বানানো ঘুন্ডি ঝুলে, সাথে চা, বিস্কুট, কলা, লোফ (স্থানীয় ভাষায় হাবারুডি, গেরাইম্মারা শুদ্ধ ভাষায় বলে পাউরুটি), পান, সুপারি, জর্দা, সাদাপাতা, বিড়ি, সিগারেট, মিছ্‌রি, চকলেট, চুইংগাম, লাড্ডু, মোয়া, নিমকসোলেমানী, বার্মাইয়া আচার, তেঁতুল, তেঁতুলের আচার, আমছি, সুঁই, সুতা, বইখাতা সেলাইয়ের সুঁই-সুতা, কায়েদা, আমপারা, নামতার বই, কাঠের হাতলওয়ালা পকেট ছুরি, তালাচাবি, নেইল কাটার, পঞ্জিকা, লুডু, ক্যারাম খেলার গুটি, বরিক পাউডার, কলম, আলপিন, ছুটা কাগজ, দাঁতের খিলাইল (তখনও টুথপিক আবিষ্কার হয় নি), কান খুচকী, নারকেল তেল, জবাকুসুম তেল, ম্যানোলা কোল্ড ক্রীম, ভ্যানিসিং ক্রীম, তিব্বত স্নো, মাইসিল ঘামাচি পাউডার, ইসলাম ভাইয়ের চাবি মার্কা দাঁতের মাজন, সাধনা ঔষধালয়ের দাঁতের মাজন 'দন্তরোগারী', চায়নীজ রেজার, বলাকা ব্লেড, রাজা কনডম, সাদা কনডম (দুই নম্বর, টাকায় চাইরটা), মায়া বড়ি, ওভাকন, বনানী লোম নাশক আরো দুনিয়ার জিনিষ। ছোট্ট একটা ঘুন্ডি দোকান অথচ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মত সব আছে। বিশেষ দ্রষ্টব্য: ফেনীর মানুষ ঘুন্ডিকে ফাজিলের মত ঘুড়ি বললে অফেন্সিভ হয়ে যায়। সাবধান।

একই অবস্থা আমার ব্রেনের। ছোট্ট মাথায় সব আছে, ওই ঘুন্ডি দোকানের মত। এত রকমের জিনিষ পড়েছি যে ঘুন্ডি দোকান মস্তিষ্ক নিয়ে যখন হাঁটাচলা করি তখনমাথার মধ্যে দুনিয়ার আইটেম খিচুড়ী পাকাতে থাকে। এত্তোসব আইটেম থেকে আমার সী-লাইফের অভিজ্ঞতাকে আলাদা ভাবে তুলে ধরতে গিয়ে চরম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ি। আমার মাথার তখন ঝুনঝুন অবস্থা। এই ঝুনঝুন চ্যালেঞ্জকে জয় করে সমুদ্র জীবনের প্রথম অধ্যায়ের প্রতি ফোকাস করতে গিয়ে প্রায় আধামরা হয়ে গিয়েছিলাম। পাক্কা আড়াই বছর লেগেছে বই লিখতে। নাইলে বই একটা লিখতে এত্তো সময় লাগে?

তারপরও, এক সময় লিখে ফেললাম, পাণ্ডুলিপি রেডি। বই ছাপা হল। প্রায় আশি হাজার শব্দের একটা হোঁৎকাপটাশ বই। অনন্যা প্রকাশনী ছেপে দিয়েছে। পুরো উপন্যাসের ওয়ার্ড প্রসেসিং করেছি আমি। সেখানে প্রচুর ছবি, ম্যাপ আর স্কেচ আছে। এগুলো দেয়ার কারনে পাঠকেরা বইয়ের সাথে নিজেকে জড়াতে পেরেছে। আমার সৌভাগ্য প্রথম সুযোগে ভিয়েতনাম থাকা হয়েছে প্রায় দুই মাস। উত্তর আর দক্ষিন ভিয়েতনাম যতখানি সম্ভব দেখেছি। আমাদের বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ভিয়েতনামিজদের ভালোবাসে, সম্মান করে। তিরিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে যুদ্ধ করে, প্রচুর রক্ত দিয়ে, শেষে আমেরিকান সুপার পাওয়ারকে চরমভাবে পর্যুদস্ত করে ভিয়েতনাম ছাড়া করেছে এবং দেশকে হানাদার মুক্ত করেছে। এই বিষয়টাও যতখানি পেরেছি বইয়ে উল্লেখ করে প্রচুর ছবি আর ম্যাপ সংযোজন করেছি। একইভাবে প্রাচীন ইসলামী সভ্যতার রেফারেন্স দেখাতে পেরেছি, মিশরের সিনাই উপকূল, জর্ডানের আক্বাবা এবং মিশর থেকে কেড়ে নেয়া আজকের ইসরায়েলের নেগেভ আর এলাট এলাকার ছবি ম্যাপ এবং ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ এনে। সেখান থেকে দুনিয়ার অর্ধেকেরও বেশী পেরিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া হয়ে চীনের মহাপ্রাচীর দেখা। কোরিয়ায় যাবার পথে ভয়াবহ টাইফুনের পাল্লায় পড়া এবং দ: কোরিয়ার ঈর্ষনীয়, চোখ ধাঁধানো উন্নতি এবং তাদের কালচার, সব কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

যেমনটা আগে বলেছি, পুরো বইটা ওয়ার্ডপ্রসেসিং করে রেডি করে দেখি শক্তপোক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ছাপাবো কোথায়? মনে সুপ্ত বাসনা ছিলো অনন্যাকে দিয়ে ছাপাবো কারন ওরা ড. হুমায়ুন আহমেদের সর্বাধিক বই ছেপেছে, সারা দেশের মানুষ অনন্যাকে চেনে। তাছাড়া আরেকটা বিষয় হল অনন্যাকে সফট্ কপি দিয়ে দিলে ছাপানোর সময় সুপারভাইজ করতে হবে না। ওরা অনেক পুরোনো এবং প্রফেশনাল। যোগাযোগ করার পর দেখি উনি আমার মামা বিশিষ্ট সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরনের জানে-জিগার বন্ধু। কেমনে কি? উনাকে পান্ডুলিপি পাঠালাম, বললেন, "পড়ে দেখি"। পরদিন বললেন, "আটত্রিশ ফর্মার বই, এত কি লেখসো? ঠিক আছে, এটা আমি ছাপাবো।" মনে মনে বলি, আটত্রিশ ফর্মা কি জিনিষ? বই ছাপানো নিয়ে আমি যত রকমের নকশা করেছি তিনি মেনে নিলেন। শুধু তাই নয় আমার বিশেষ অনুরোধ ছিলো বইটা যেন গতাণুগতিকের চেয়ে বড় রয়েল সাইজ ডিসি (Royal size double crown) হয়। তিনি বললেন, "আচ্ছা"। আবার বললাম প্রচ্ছদ আমি বানাবো। তিনি বললেন, "আচ্ছা"। আমি বললাম, "প্রচ্ছদে লেখকের নাম বড় হবে, উপরে হবে, বইয়ের নাম হবে নীচে।" তিনি বললেন, "এইটা কেমন উল্টা কথা?" আমি মনে মনে জেদ ধরে বসে আছি, টাইপ করতে করতে আঙ্গুল বেঁটে করে ফেললাম এখন বলে এইটা কেমন কথা? আমি আগে না বই আগে? শেষমেষ বললেন, "আচ্ছা"। তারপর বললাম, "আমি চাই আমার বই লিট ফেস্টে যাবে।" তিনি শব্দ করে হেসে ফেললেন। বললেন, "আচ্ছা আচ্ছা, জানুয়ারীর ৫ তারিখে বাংলা এ্যাকাডেমীতে ইনটারন্যাশণাল লিটফেস্ট শুরু হবে, আমরা সব সময় লিটফেস্টে থাকি, সেখানে তোমার বই যাবে।" লিটফেস্ট হচ্ছে লিটারেচার ফেস্টিভালের সংক্ষেপ। প্রতিবছরের একদম শেষে বা বছরের শুরুতে বাংলা একাডেমীতে এই বিশেষ এবং গুরুগম্ভীর সাহিত্য উৎসব হয় যেখানে দেশের সাহিত্যানুরাগী, লেখক, কবি, আঁতেল বৃন্দ, বিদেশী লেখক, নোবেল লরিয়েট, টপ লিষ্টেড পাবলিশার্স, প্রচুর বিদেশী পাবলিশার্স ইত্যাদি আসে। আমি যতদুর জানি সেখানে খুব একটা ভীড় হয় না।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসের চরম ডলার সংকট বাংলাদেশের সকল শ্রেণী ব্যাবসায়ীদেরকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। অনন্যা প্রকাশনী সহ বাংলা বাজারের অনেক গুলো প্রকাশনা সংস্থা সরাসরি বলে দেয় তারা ২০২৩ এর বইমেলায় অংশ নেবেনা। দেশের পেপার মিল গুলোকে অকেজো করে রাখা হয়েছে অনেক আগে থেকে তাই দেশে কাগজ নেই। এখন ডলার নেই, কোন ব্যাংক এলসি খুলছেনা। বিদেশ থেকে কাগজ আনবে কেমনে? বইমেলা সামনে রেখে সকল প্রকাশনা সংস্থা, তাদের প্রেসগুলো প্রচন্ড বিজি হয়ে যাবে অক্টোবর মাস থেকে। সেখানে বাজারে কাগজের দাম বেড়েছে গতানূগতিকের তুলনায় ছয় গুন যা পরে প্রায় আটগুন পর্যন্ত বেড়েছে। বেশী টাকা দিয়েও প্রকাশকেরা কাগজ পাচ্ছেনা বই ছাপাবে কোত্থেকে? বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর কানে গেলে তিনি নড়েচড়ে বসেন, শেষমেষ দাম অনেক হলেও প্রকাশকেরা কাগজ হাতে পেলো। শুধু কাগজ না ছাপাখানার কালি আর অন্যান্য স্পেয়ার পার্টসের দামও আকাশ ছুঁয়েছে। প্রকাশকেরা বইয়ের দাম বাড়াতে বাধ্য হল এবং আমার বইয়ের দাম প্রাথমিকভাবে ধরা হল পনেরো শ' টাকা। আমি বাধ সাধলাম, এই দামে কেউ হুমায়ুন আহমেরদের বইও কিনবে না। আমি কোথাকার কোন নয়া মাল? প্রকাশক মহোদয় দয়া করলেন, তিনি প্রফিট মার্জিন মাটিতে নামিয়ে বইয়ের গায়ের দাম ধরলেন এক হাজার টাকা।
মহান একুশের বই মেলায় স্পেশাল ডিসকাউন্ট তিরিশ পারসেন্ট হলে বিক্রয় মূল্য হবে সাত শ' টাকা। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশের বই বানিজ্যে ডিজসাউন্টের এই কালচার বহু পুরোনো, আমরাও সব সময় পনেরো থেকে পয়ত্রিশ পার্সেন্ট পর্যন্ত ডিসকাউন্ট দিয়ে বই কিনেছি। এখন প্রশ্ন হল, সাত শ' টাক দিয়েও কেউ কি নতুন এই অখ্যাত লেখকের বই কিনবে? আমি জানিনা।

বই বাজারে এলো ডিসেম্বর ২০২২ এর দিত্বীয় সপ্তাহে। জীবনে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ, কি জগাখিঁচুড়ী লিখেছি জানিনা। সবাই এক কথায় বলছে, "ভালো হয়েছে, দারুন হয়েছে।" আমার মায়ের কঠোর আদেশ, "বহুত কষ্ট করে বই লেখছস, কাউর বিনে পয়সায় বই দিবিনা, খবরদার। আমিও তোর বই কিনে পড়বো।” এটা হল ভালোবাসার ফেভারিটিজম।

দুই সপ্তাহের মধ্যে বিক্রী হয়ে গেলো প্রায় দেড়' শ কপি।

এরপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মহান একুশে বইমেলা ২০২৩। যার অপেক্ষায় ছিলাম সেই ডিসেম্বর থেকে। এবছরের বই মেলায় অনন্যা তার অন্যান্য প্রকাশনার সাথে আমার বই মহাসমারোহে প্রদর্শন এবং বিক্রী করেছে। আমার লেখা প্রথম বই মেলায় এলো আর আমি পড়ে আছি বিদেশে। প্রকাশক, স্টাফ সবাই ধুন্ধুমার ব্যাস্ত। এত বই, এত মানুষ, এত ব্যস্ততা। কারো সময় নেই আমার সাথে কথা বলার। এর মাঝে যখন দেখি প্রিয়জনেরা বই হাতে ছবি তুলে ফেইসবুকে দিয়েছে, ভালোলাগায় আর কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হই। ছবিতে মেলায় অনন্যা প্রকাশনীর স্টলে বইয়ের পশরায় যখন আমার লেখা বইয়ের সগর্ব উপস্থিতি দেখি আবেগে আপ্লুত হই, কান্না পায়। ছোট্ট এই জীবনে আর কিই বা চাওয়ার আছে? অনলাইনে রকমারি.ডট.কম থেকে বইমেলা চলাকালীন সোল্ড আউট হয়ে গেছে দুই বার। এই ক্যাটাগরির টপ টেন লিস্টে আমার বইয়ের অবস্থান ছিলো চার নম্বরে। প্রকাশক জানালেন নতুন লেখকের বই হিসেবে এটা ভালোই সাড়া ফেলেছে। প্রকাশক মনিরুল হক সাহেব স্বয়ং বলেছেন তিনি সন্তুষ্ট, খুবই সন্তুষ্ট।

এর চেয়ে বড় অর্জন কি হতে পারে? আলহামদুলিল্লাহ্।

মহান একুশে বইমেলা ২০২৩, অনন্যা প্রকাশনীর স্টলে।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ২:৫৯
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×