"পাসপোর্ট কেড়ে নেবার পর যখন বুঝলাম সে ফ্রড, আমি অসুস্থ্য হয়ে পড়ি" এই কথা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিলো। প্রতিজ্ঞা করলাম, বিষয়টা আজীবন মনে রাখবো।
অনেকদিন আগের কথা। চট্টগ্রামে এক বাসায় সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছি। সেখানে মধ্যবয়েসী এক ভদ্রলোক ছিলেন, সম্প্রতি কলকাতা ঘুরে এসেছেন বাই রোডে। তিন বলছিলেন এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। সে আমলে সরাসরি ঢাকা-কলকাতা বাস চলতোনা। বর্ডারে নেমে ওপারে গিয়ে আবার ট্রান্সপোর্ট ধরা লাগতো। সুতরাং দুই পাশের ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ইত্যাদি ফরমালিটিজ সেরে ওপারে গিয়ে যে যার যার মত কলকাতায় রওনা হত। বেশীরভাগই কলকাতার বিখ্যাত এ্যাম্বাসেডর ট্যাক্সী ক্যাবে করে সরাসরি শহরে চলে যেতো।
ভদ্রলোক বলছিলেন, তিনি সব ফরমালিটিজ শেষ করে হেঁটে অনেকখানি এগিয়ে গেলেন ট্যাক্সী ধরার জন্য হঠাৎ সামনে এক লোক এলো। সাদা হাফ শার্ট প্যান্টে গোঁজা। কালো ফরমাল জুতো। বুক পকেট থেকে কি জানি একটা খানিকটা তুলে আবার পকেটে রাখলো। তারপর বললো সে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে, পাসপোর্ট দেখাতে বললো। পাসপোর্ট হাতে নিয়ে জানতে চাইলো এই ভিসা জেনুইন কিনা চেক করবে, ফলো করতে বলে হাটা শুরু করলো। এর মধ্যে পাসপোর্ট সে তার প্যান্টের পকেটে ভরে রেখেছে। ভদ্রলোক পেছন পেছন হাটছেন আর বলছেন জেনুইন না হলে ইমিগ্রশনই বলতো। এখন কেন এসব প্রশ্ন আসছে। তিনি বারবার বলছিলেন পাসপোর্ট ফেরত দিতে। বেশ খানিকটা হাটিয়ে খানিকটা নিরিবিলিতে গিয়ে সে বললো দশ হাজার (তখন প্রায় ২৫০ ডলার) টাকা দিলে পাসপোর্ট ফেরত পাবে। এর পর ওর সাথে চিল্লাচিল্লি আর হাতাহাতি অবস্থা। কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা, অনেকখন ধরে ঝগড়া, হাত পা ধরাধরি এসবের পর চার হাজার টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট ফেরত পেলো। যত সংক্ষেপে লেখলাম মূল ঘটনা তত সংক্ষিপ্ত নয়। বিমূঢ়, ভুক্তভোগী ভদ্রলোক অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। সীমান্তে ওই একই রকম বদমায়েসীর কথা পরে পত্রিকায়ও পড়েছি।
* * * * * * * * * * * *
ওই ঘটনার অনেকদিন পরের কথা। আমরা তিন বন্ধু মিলে বাসে করে বেনাপোল হয়ে কলকাতা যাচ্ছি। আগেই বলে রাখি আমরা তিনজন মেরীন অফিসারস। দুনিয়ার বহুত দেশের কাস্টমস, ইমিগ্রেশন করে অভ্যস্থ। এপারে এবং পরে ওপারে সব ফরমালিটিজ সেরে আমরাও পায়ে হেঁটে ট্যাক্সীর দিকে যাচ্ছি। আমি ঢিমে তালে চারপাশ দেখতে দেখতে স্লো হাঁটছিলাম, কারন আমি গোঁ ধরেছি আগে মাড়ির ভাঁড়ে চা খাবো তারপর অন্য কথা। তাই খানিকটা পিছিয়ে পড়লাম, ওরা সামনে। এর মধ্যেই দেখি আমার সামনে এক লোক দাঁড়ালো অনেকটা পথ রোধ করার ভঙ্গিতে। ফুলপ্যান্টে সাদা হাফশার্ট গোঁজা, বুক পকেট থেকে একটা কিছু অর্ধেকটা বের করে আবার রেখে দিতে দিতে বললো সে আমার পাসপোর্ট দেখতে চায়। সেকেণ্ডের মধ্যে আমার ব্রেনে ফ্ল্যাশ করতে লাগলো অনেকগুলো ঘটনা; বেনাপোল বর্ডার পেরিয়ে ভারত, পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া, কায়দা করে হাতিয়ে নেওয়া, অনেক টাকা দাবী করা নয়তো পাসপোর্ট দেবে না, সেই ভদ্রলোকের অসুস্থ্য হয়ে পড়া....
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, প্রচন্ড খুশী লাগছিলো। সারা রাস্তায় দোয়া করতে করতে আসছিলাম যেন এমন কিছু হয়। নিজের মুখটায় যতখানি সম্ভব আনন্দিত ভাব এনে তাকে উদ্ভাসিত হাসি উপহার দিলাম। তারপর বিশুদ্ধ ফেণী অরিজিন ভাষায় প্রশ্ন করলাম,
“তুই কন?” (Who are you?)
প্রথমে হতভম্ব পরে বদরাগী হয়ে বললো, “শুনতে পাননি, আমি ইমিগ্রেশনের লোক। পাশ-পোর্ট বের করুন, পাশ-পোর্ট।”
সবগুলো দাঁত বের আমি হাসছি তবে নিঃশব্দে। কাঁধ ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। ঝুপড়ি-ঝাপড়ি দোকান, রাস্তার পাশের প্রাচীন বৃক্ষগুলোর ওপাশে হলুদ রংয়ের দালান, খানিক আগে যেখানে আমার সব ফরমালিটিজ সেরে এসেছি, মুহুর্তখানেক ওটা দেখলাম। তারপর আবার তার দিকে তাকালাম, আমার নিঃশব্দ হাসি থামছেই না। কটমট করে চেয়ে হাত পেতে দিয়েছে সে। আমার পিঠে ব্যাকপ্যাক আর বাঁ হাতে ধরা মিডিয়াম সাইজ লাগেজ।
“তোর বাফের নাম কিয়া রে?” খাঁটি মাতৃভাষায় জিজ্ঞেস করলাম।
“হোয়াট? আপনি… “ কথা আটকে গেলো ওখানেই। এত জোরে থাপ্পড় মারলাম আমার ডানহাত জ্বলে উঠলো। মনে হল ওর বাঁ গলে আমার হাতের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। লাগেজ ছেড়ে দুহাতে তার শার্টের কলার ধরে চীৎকার করে বন্ধুদের ডাকলাম। বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেও শুনতে পেলো। আমাকে এই অবস্থায় দেখে হুমমুড় করে এদিকে আসছে ওরা। আশপাশে লোকজন খুব একটা নেই তবে কয়েকটা ছোকরা আমাদের দিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে।
লোকটা আমার হাত ওর দুহাত দিয়ে ধরে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর হাফাতে হাফাতে বলছে, “আপনি অনেক বড় বিপদে পড়েছেন। আপনাকে এরেস্ট করা হবে, থানায় নিয়ে চালান দেয়া হবে। অফিশারের গায়ে হাত তুলেছেন…. “
খুব বাজে একটা গাল দিলাম, এসব গালি বস্তির পোলাপানও মুখে আনতে লজ্জা পাবে। তারপর বললাম,
“তোর বাফের নাম কিল্লাই জিংগাইছি জানছ? কারন তোর আব্বারা বেগগুন ওই বিল্ডিংয়ে আঁর কাগজপত্র চেক কইচ্ছে। এইবার তোর আব্বাগোরে কমু তোরে চেক কইরবাললাই। মা****, চল তোর আব্বাগো কাছে চল।” এখন আর হাসছিনা।
এরমধ্যে বন্ধুরা চলে এসেছে। একজন আমার লাগেজটা ধরলো। আমি ওর কলার ধরে হুড়মুড় করে কাস্টমস ইমিগ্রেশন ইত্যাদি যেখানে হয়েছে সেদিকে নিয়ে যাচ্ছি, আর ওই বেটা ধস্তাধস্তি করছে ছাড়া পাবার জন্য, আর বলছে পুলিশ ষ্টেশন ওই দিকে ওই দিকে।
“চোপ! তোর পুলিশ স্টেশনের ক্ষ্যাঁতা পুড়ি। আগে তোর আব্বাগো কাছে চল। ইমিগ্রেশন আব্বা। তুই বলে ইমিগ্রশনের পূত?”
আমার বন্ধুরা এতক্ষনে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। বেটার ঘাড়ের পেছনের কলার বজ্রমুষ্ঠিতে ধরে কুঁজো করে হাটিয়ে তাকে আস্তে আস্তে নিয়ে যাচ্ছি। বেটা ছাড়া পাবার প্রানপন চেষ্টা করছে। লোকজন এগিয়ে এসে জানতে চাচ্ছে কি হয়েছে। কোনো কথা না বলে ওকে নিয়ে যাচ্ছি বিল্ডংয়ের দিকে। পাশ-পোর্ট তার দেখবার চায়। পাশ-পোর্ট হেতের হোগা দিয়া হন্দানো হবে। স্থানীয়দের মধ্যে কেউ না কেউ তার দলের থাকতে পারে তবে এটা নিয়ে টেনশন করছিনা। তিনজন গ্রেটার নোয়াখাইল্লা আমরা, রায়ট বাধিয়ে দিতে পারবো তার মায়েরে বাপ।
হঠাৎ বেটা মাটিতে বসে পড়লো। কৌশলে পায়ের গোড়ালির উপর ঘুরতে আমার হাত লুজ হয়ে গেলো। তারপর দে-ছুট। পিছুতাড়া করতে গিয়ে আমিই মানা করলাম বন্ধুদের। আমরা দেখতে পাচ্ছি ছিঁচকে চোর বা পকেটমারের মত কোনো দিকে না তাকিয়ে প্রানপনে পালাচ্ছে সে। অনেক খানি এগিয়ে রাস্তার পাশের বড় নর্দমা লাফ দিয়ে পেরুতে গিয়ে কাদায় পড়ে গেলো, নোংরা সব গায়ে মাখামাখি। এরপর একটা দেয়াল পেরিয় দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলো। এবার তাকালাম উৎসুক জনতার দিকে। ওদের মধ্যে এক চিকনা পোলার দিকে এগিয়ে গেলাম,
“তোর ভাই হয় হেতে, ক্যান?”
“কি বলচেন আপনি? আমি ওকে চিনি নে। জীবনে দেকিইনি কখনও!”
“এতক্ষন এত দরদ দেখাইলি কিল্লাই? চোরে চোরে খালতো ভাই?”
চেংড়া আর কথা বাড়ালো না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো।
বন্ধুরা তাড়া দিচ্ছিলো। আমার জেদ চেপে গেছে। ট্যাক্সী নিতে গিয়েও বারবার চারিদিকে তাকাচ্ছিলাম। আবার আসে নাকি, বেটাকে পেলে আরেক ছ্যাঁচা দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসের ভেতরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম কোন অফিসার সে।
ট্যাক্সীওয়ালাকে বললাম আমরা চা খেয়ে তারপর যাবো, ইচ্ছে করলে সে ও আমাদের সাথে চা খেতে পারে। ভাঁড়ের চা আমি খাবোই। বিহারী ট্যাক্সী ড্রাইভার চা খেতে আপত্তি করলো না। সব শুনলো। চা দোকানদার, ড্রাইভার এবং উপস্থিত কিছু কাস্টমার বলছিলো ওদের একটা চেইন আছে, ওদের লোকজন সুযোগ পেলেই যে কোনো অজুহাতে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষদের হয়রানি করে আর মোটা টাকা খসিয়ে নেয়।
মাটির চায়ের ভাঁড়ে কোন হাতল থাকেনা। এই ভাঁড়ের চায়ের কথা সেই ছেলেবেলা থেকে দুনিয়ার সব উপন্যাসে পড়েছি। খুব লোভ হত, খেতে ইচ্ছে করতো। তখন থেকেই ভেবে রেখেছিলাম যেদিন প্রথম পশ্চিমবঙ্গে পা রাখবো, আগে ভাঁড়ের চা খাবো তারপর অন্য কথা।
গেলাসের মত করে ধরে চা খেতে হয়। কিন্তু হাত জ্বলছে। হালারপূতেরে এত জোরে থাপ্পড় মেরেছি হাতের তালু জ্বলে যাচ্ছে। গরম চায়ের ভাঁড় ধরতে গিয়ে হাতের আঙ্গুল, তালু যেন জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলে বাঁ হাত চা খেতে পারি সেটাও করছিনা।
হাত জ্বলুক, আরো জ্বলুক। যত জ্বলবে তত সুখ। আহ্! আমার দেশের মানুষকে বহুত হয়রানি করেছিস হারামী, ফইন্নির পূত। আরেকবার করতে গেলে আমার থাপ্পড়ের কথা মনে পড়বে, এই সুখ।
আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মজা করে চা খাচ্ছি। ওহ্ না চা পান করছি। চা খায় বাংলাদেশে, ভারতে নয়।