সত্যি বলছি, ভ্লাদিমির পুতিনের জন্মানোরই কথা ছিলো না। অথচ আজ সে কি না ওয়েষ্টার্ণদের প্যাঁদাচ্ছে? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর পশ্চিমারা অনেকদিন মহাসুখে ছিলো। মরার এই পুতিন আইসা পানি ঢাইলা দিলো।
ইষ্টার্ণ ইউরোপে আমার প্রথম ভালোবাসা ইউক্রেন। অসাধারণ সুন্দর দেশ, ওই দেশের মানুষ। বিশেষ করে মেয়েগুলো, ও খোদা রে. . . যারে দেখি তারেই মনে হয় এইটাই সেরা সুন্দরী। টাইট করে বেড়াই ধরি আর কই, ওরে রূপসী তুই আমার বৌ, তুই আমার বৌ।
শুধু মেয়েরা না, রাস্তা, ঘাট, গথিক স্থাপত্যশৈলী সবকিছু সুন্দর।
রূপসী ওডেসা। ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় বন্দর নগরী।
টিভিতে যখন দেখছিলাম একের পর এক মিসাইল কিংবা ড্রোন এই সুন্দর স্থাপত্যগুলো ধ্বংস করছে তখন চোখ ফেটে পানি আসছিলো। এই ইউক্রেন দেখতে চাইনা, চোখের সামনে সব ঝ্বলসে যাচ্ছে।
ওয়েষ্টার্ণদের কোন ভাবেই উচিত হয় নি ভ্রাদিমির পুতিনকে আন্ডার এস্টিমেট করা। দুনিয়ার সব স্যাংকশান/এমবার্গো দিয়ে, নতুন নতুন সব ক্রাইসিস সৃষ্টি করেও যখন পুতিনকে দিয়ে ঝামেলা বাধাতে পরছিলোনা তখন ব্রিটিশ বুদ্ধিতে দারুন এক কুটনামি শুরু করলো আমেরিকা। ইউক্রেনকে ন্যাটোতে ঢোকাবে, সেখানে আমেরিকান ডিফেন্স সিস্টেম ডেভেলপ করবে, রাশান বর্ডার জুড়ে রাডার সিস্টেম, মিসাইল লাঞ্চার, এন্টি মিসাইল সিস্টেমস্ বসাবে। সী অফ আযোভ গিলে খাবে, আরো কত স্বপ্ন। ঠান্ডা মাথায় ৩২ বছর বয়েসি যেলেনস্কি নামের এক ইয়াং ম্যানকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বানিয়ে নিলো প্রথমে, তারপর শুরু। বেচারা কমেডিয়ান যেলেনস্কি, প্রেসিডেন্ট হয়ে ক্যারিয়ার, স্বপ্ন, দেশ সব হযভট অবস্থা। হাজার বছর ধরে যারা একসাথে মিলেমিশে থেকেছে, ভাষা, সংষ্কৃতি, ধর্ম সব কিছু এক রকম অথচ আজ যুদ্ধে লিপ্ত। বৃটিশদের ডিভাইড এণ্ড রুল তত্ব কামিয়াব হল। বৃটেনের আধা পাগল প্রধানমন্ত্রী, যারে খোদ ব্রিটিশরা দুই পয়সার দাম দেয় নাই, সেই আউলাচুলা বরিস ইউক্রেন গিয়া কইলো, "না না! যুদ্ধ করতেই হবে। আমরা সব দিবো।" ইউক্রেনের সহজ-সরল মানুষগুলো বুঝতেও পারলোনা ইউরোপের পেটে নতুন সিরিয়া বানিয়েছে ব্রিটিশ-আমেরিকানরা।
"গুরু, সেই দুহাজার বাইশ থেকে শুরু।"
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী যখন রাশান বাহিনীর ট্যাংক বহর ইউক্রেনে ঢুকছে তখন প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো আামার। এই রাগ পুতিনের উপর নয়, এই রাগ ওয়েষ্টার্ণদের উপর। ভ্লাদিমির পুতিনকে ওরা নিজেদের মত বলদ ভেবেছে। ওরা কি জানে না ভ্লাদিমির পুতিন শুধুই সামান্য একজন 'পুতিন' নয়। চরম দারিদ্রের ভেতর দিয়ে বড় হওয়া ভ্লাদিমির একজন উচ্চ শিক্ষত, স্কলার, একজন মিলিটারি পারসোনেল, দুর্ধর্ষ কেজিবি এজেন্ট, সিভিল সার্ভেন্ট, ঝানু পলিটিশিয়ান এবং আরো কত কি! .....
দুনিয়া কাঁপানো পুতিন(বাঁয়ে) - ছেলে পুতিন মা মারিয়ার কোলে(ডানে)
অথচ আজকের এই দুনিয়া কাঁপানো ভ্লাদিমির পুতিন, ওর তো জন্মানোরই কথা ছিলো না!
কিন্তু জন্ম হল, বিষ্ময়করভাবে হলেও সত্যি। ৭ অক্টোবর ১৯৫২। সেদিন জন্ম নিলো ভ্লাদিমিরের ছেলে ভ্লাদিমির। ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। মা বাবার বিয়ের ২৪ বছর পর। ৪১ বছর বয়েসি মারিয়া সেদিন তৃতীয় সন্তানের জন্ম দেয়। আগের দুই সন্তান বাঁচেনি।
ঐতিহ্যগতভাবে রাশিয়ানদের নাম রাখা হয় তিন শব্দে। প্রথম শব্দ ইংরেজদের মত প্রথম নাম বা ডাকনাম, দিত্বীয় শব্দ দিয়ে বোঝায় পিতার নাম অর্থাৎ কার ছেলে (আরব ট্রেডিশনের মত), তৃতীয় শব্দ হচ্ছে বংশ পদবি।
বাঁয়ে বাবা পুতিন, মাঝখানে ছেলে পুতিন, ডানে মা পুতিনা
এখানে দেখুন,
রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্টের পুরো নামঃ ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন
পিতার নামঃ ভ্লাদিমির স্পিরিদোনোভিচ পুতিন
মায়ের নামঃ মারিয়া ইভানোভনা পুতিনা (জন্মনামঃ- মারিয়া ইভানোভনা শেলোমোভা)
বাবা পুতিন ছেলের নামও নিজের নামে রেখেছে তাই প্রথম নাম: ভ্লাদিমির, দিত্বীয় নাম: ভ্লাদিমিরোভিচ (ভ্লাদিমিরের পূত্র), তৃতীয় নাম: পুতিন (পারিবারিক পদবী)
দাদা পুতিন
ভ্লাদিমির পুতিনের বাবার নাম ভ্লাদিমির স্পিরিদোনোভিচ পুতিন কারন দাদার নাম স্পিরিদোন (স্পিরিদোন ইভানোভিচ পুতিন, যিনি ছিলেন শেফ। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবিসংবাদিত নেতা লেনিন এবং স্ট্যালিনের জন্য রাঁধতেন।)
আমার গল্পে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম রেখেছি: ছেলে পুতিন। পুতিনের বাবার নাম রেখেছি: বাবা পুতিন। মায়ের নাম: মা মারিয়া। এরা সবাই লেনিনগ্রাদের স্থানীয়। লেনিনগ্রাদের আগের নাম পেট্রোগ্রাড। লেনিনগ্রাদের পরের নাম সেইন্ট পিটার্সবার্গ (স্থানীয় উচ্চারণ: সাংক্ট পিতারবুর্গ)।
এ কি? আমি গল্প জুড়ে দিলাম কেন? ভ্লাদিমির পুতিনের তো জন্মানোরই কথা ছিলো না! আরে? এই ঘটনাকে আমি গল্প বলছি কেন?
তার জন্মেরও এগারো বছর আগে তার মা এবং বাবা দুজনেই মরে গিয়েছিলো।
অন্ততঃ প্রথমে এটা ভাবা হয়েছিলো যে তারা মৃত। দুজন দুই যায়গায়, কেউ কারো তাৎক্ষনিক অবস্থান জানতো না।
ছেলে পুতিনের জন্মেরও আগের কথা। বাবা পুতিন (ভ্লাদিমির স্পিরিদোনোভিচ), তার বয়স তখন ৩০। লেখাপড়া খুব একটা করেনি। কাজ করতো সাবমেরীন সোলজার হিসেবে। বৌ মারিয়াকে নিয়ে থাকতো লেনিনগ্রাদেরই ছোট্ট একটি গ্রাম পেত্রোদভোরেৎস্-এ। ১৯৪১ সালে হিটলারের নাৎসী বাহিনী রাশিয়া আক্রমণ করলে বাবা পুতিনকে চলে যেতে হয় প্রতিরোধ সংগ্রামে। ভেটেরান ভ্লাদিমির স্পিরিদোনোভিচ পুতিন (বাবা পুতিন) তখন যুদ্ধ করছে লেনিনগ্রাদের বাইরে। তার প্রিয়তমা স্ত্রী মারিয়া আর নবজাতক পুত্র অবরূদ্ধ লেনিনগ্রাদে আটকা পড়ে আছে, কিন্তু কোথায় আছে জানে না। সমগ্র লেনিনগ্রাদ চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে হিটনারের নাৎসী বাহিনী আর ফিনল্যাণ্ডের ফিনিস বাহিনী। কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারছেনা। চলছে গোলাগুলি, কামান, মর্টার, শেল আর উপর্যুপরি বিমান হামলা …
বাবা পুতিন আর মা মারিয়ার প্রথম সন্তান ওলেগ জন্মের কিছুদিন পর মারা যায়। জার্মান নাৎসীরা যখন রাশিয়া আক্রমণ করে এবং লেনিনগ্রাদ সীজ (অবরূদ্ধ) করে তখন মা মারিয়ার কোলে তাদের দিত্বীয় সন্তান এক বছরের ছোট্ট ভিক্টর। নাৎসীদের অবরোধ, উপর্যুপরি আক্রমণ সত্বেও মারিয়া ছোট ভিক্টরকে নিয়ে পেত্রোদভোরেৎস্(Petrodvorets) ছাড়তে চায় নি। মা মারিয়ার ভাই আইভান শেলমভ নাৎসীদের প্রচন্ড গোলাগুলি এবং বোমাবর্ষণ ইত্যাদি থেকে মারিয়াকে বাঁচিয়ে লেনিনগ্রাদের ভেতরেই অপেক্ষাকৃত কম বিপদজনক একটি রিফিউজি ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। আগে থেকে অসুস্থ্য মারিয়ার শরীর খারাপ হতে হতে নিস্তেজ হয়ে গেলে মারিয়াকে মৃত ঘোষণা করা হয়। বাইরে বরফ ঠান্ডায় অন্যান্য লাশের স্তুপে মারিয়ার দেহ ফেলে রাখা হয় লাশ সংগ্রহের গাড়ী এসে নিয়ে যাবে বলে। পথচারীরা লাশের স্তুপ থেকে চাপা কাতরানির শব্দ শুনতে পেয়ে মারিয়াকে আবার তুলে নিয়ে আসে আসে হাসপাতালে, সেখান থেকে মোটামুটি সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসে শিবিরে, শিশু ভিক্টরের কাছে।
কপালের কি লিখন! অন্য দিকে নেভা নদীর তীরে পিতাচোক ফ্রন্টে মরনপণ যুদ্ধ করছিলো ভ্লাদিমির স্পিরিদনোভিচ পুতিন ওরফে বাবা পুতিন। হঠাৎ চোখের সামনে ভুতের মত আবির্ভাব হয় এক নাৎসী সেনা, হাতে গ্রেনেড। ছুঁড়ে মারে বাবা পুতিনের দিকে, তারপর বিষ্ফোরণ। তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয় সঙ্গীর। জার্মান সেনা হাওয়া হয়ে যায়। আহত, মৃতপ্রায় বাবা পুতিনের দেহ পড়ে ছিলো বরফের উপর। পিতাচোকে এর মধ্যে প্রান হারিয়েছে তিন লাখেরও বেশী সোভিয়েত সেনা। বাবা পুতিনও হয়তো তাদেরই একজন। আহতদের খোঁজে আসা সোভিয়েত সেনাদের একজন বাবা পুতিনকে চিনতে পারে, সে ছিলো বাবা পুতিনের প্রতিবেশী। চলেই যাচ্ছিল মৃত ভেবে, কি মনে করে কাছে গিয়ে নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে দেখে হাল্কা গরম। না, একেবারে মরে যায় নি। তবে মর মর অবস্থা। সেই প্রতিবেশী ভ্লাদিমির স্পিরিনোভিচ পুতিনকে (বাবা পুতিন) কাঁধে চেপে হেঁটে ফ্রোজেন নদী পার হয়ে অবরূদ্ধ লেনিনগ্রাদের এক হাসপাতালে নিয়ে আসে।
নেভস্কি পিতাচোকের স্মৃতিস্তম্ভ। রাশানদের এখনও কাঁদায়।
সত্যি কথা বলতে, যুদ্ধে বাবা পুতিনের উপর এই ভয়াবহ গ্রেনেড আঘাতই তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। যে ব্যাটেলগ্রাউন্ডে সে যুদ্ধ করেছিলো সেটা নিশ্চিত মৃত্যূকুপ। সোভিয়েতরা বলতো দৈত্যাকার কিমার মেশিন। চারিদিকে মাংস আর মাংস। মানুষের এত মাংস? এত রক্ত? সোভিয়েত কমান্ডের মূর্খতা আর জোসেফ স্ট্যালিনের একগুঁয়েমির কারনে লাখো সেনা প্রান দিয়েছিলো এবং লেনিনগ্রাদকে অবরোধমুক্ত করার বদলে উল্টোটা হচ্ছিলো।
বাবা পুতিন যখন লেনিনগ্রাদের সামরিক হাসপাতালে, স্ত্রী মারিয়াও তখন লেনিনগ্রাদের অন্য কোথাও। বাবা পুতিন মারিয়াকে খুঁজতো কিনা জানা যায় নি, হয়তো জানতোইনা প্রিয়তমা স্ত্রী এই শহরেরই কোথাও আছে। অন্যদিকে রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা মারিয়া সব সময় খুঁজতো স্বামীকে, লেনিনগ্রাদের এখানে ওখানে।
মারিয়ার শেষ পর্যন্ত স্বামীকে খুঁজে পায় হাসপাতালে। নিয়মের বিরূদ্ধে, বাবা পুতিন নিজের হাসপাতালের রেশন মারিয়ার সাথে ভাগ করতো। নার্সদের থেকে নিয়ে হাসপাতালের খাবার লুকিয়ে মারিয়াকে দিতো। একজন ডাক্তার বিষয়টা লক্ষ্য করেন এবং মারিয়াকে কিছু দিনের জন্য ভিজিটিং ব্যান করা হয়।
১৯৪২ সালের এপ্রিলে ভ্লাদিমির হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে অস্ত্র কারখানায় চাকুরী পায়। সেবছরই জুন মাসে তাদের দিত্বীয় সন্তান ভিক্টর ডিপথিরিয়ায় মারা যায়। যুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসীদের বুলেট বা শেলের আঘাতে বাবা পুতিনের দুই ভাই এবং মা মারিয়ার মা মারা যায়।
এগুলো ছিলো মহান দেশরক্ষার যুদ্ধের গল্প, The Great Patriotic War (22 June 1941 to 9 May 1945)। হিটলারের নাৎসী বাহিনী রাশিয়া আক্রমণ করে এই আশায় যে তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করবে। মস্কো শহর পুরোটা গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে বানাবে বিশাল কৃত্রিম হ্রদ, হিটলারের হলিডে হোম হবে সেখানে। বিশাল রাশিয়ার রাজধানী ফিরিয়ে নেবে আগের যায়গায়, কিয়েভে। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ লেনিনগ্রাদকে সকল দিক থেকে ঘিরে ফেলে হিটলারের নাৎসী এবং মিত্র ফিনিস বাহিনী। হিটলারের প্ল্যান ছিলো বোমা, গুলি আগুন দিয়ে যতখানি সম্ভব নাগরিকদের হত্যা করা আর বাকিদের দাস বানানো।
যাই হোক, এক পর্যায়ে হিটলারের পতন হয়। রাশিয়া হয়ে শত্রুমুক্ত। লেনিনগ্রাদ অবরোধমুক্ত হয় ৯০০ দিন পর, আড়াই বছর! হিটলার নাকি এক পর্যায়ে অবরূদ্ধ লেনিনগ্রাদে হামলা, বোমাবাজি আর গুলি বন্ধ করে দিয়েছিলো খরচ বাঁচাতে। সে নাকি বলেছিলো খাদ্যের অভাবে রাশানরা একে অন্যকে মেরে খাওয়া শুরু করবে, বুলেট খরচ করার দরকার নেই। দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসী বাহিনী কেড়ে নিয়েছিলো দুই কোটি সত্তুর লাখ সোভিয়েত প্রাণ। মরতে মরতেও বেঁচে গেলো বাবা পুতিন আর মা মারিয়া। বাবা পুতিন ছিলো লেখাপড়া কম জানা নিরেট সরল-সোজা মানুষ। মা মারিয়াও তাই।
যুদ্ধ শেষ, সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন মুক্ত। কিন্তু সারা দেশের মত লেনিনগ্রাদ তখনো অবরোধদ্বারা ক্ষতবিক্ষত। ভুগছে বঞ্চনায়, ডুবে আছে ভয়ে আর আতংকে। ক্ষমতার দাপটে স্ট্যালিন তখন *মেগালোমেনিয়ায় আক্রান্ত। দেশ চালাচ্ছে বুলেট দিয়ে। লেনিনগ্রাদ অ্যাফেয়ার নামের শুদ্ধি অভিযান আর কঠোর কমিউনিষ্ট শাসন আমলে সবাই নিরব থাকাই নিরাপদ মনে করতো। (*Megalomania - নিজেকে অতিমাত্রায় ক্ষমতাধর ভাবার বাতিক।)
এরই মধ্যে, ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর মারিয়া জন্ম দেয় তৃতীয় পুত্র। থার্ড টাইম লাকি। ৪১ বছর বয়সে সন্তানের জন্ম দেয়া, লাকি তো বটেই। আগের দুই ছেলের অকাল মৃত্যুর কষ্ট ভোলেনি বাবা পুতিন। নিজের নামে নাম রাখলো তৃতীয় অথচ জীবিত প্রথম ছেলের, ভ্লাদিমির।। - ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। নবজাতক ছেলে-পুতিন কে কোলে নিয়ে বাবা পুতিন বলেছিলো, “এ যে স্বয়ং ইশ্বরের উপহার!” বলে চকিতে চারিদিকে তাকায়, কেউ শুনে ফেললো কিনা। প্রকাশ্যে ধর্মকর্ম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকারের আদর্শ বাক্য, “রিলিজিয়ন ইজ পয়জন - ধর্ম মানেই বিষ!” ধর্মের কথা বললে জেল, নয়তো জরিমানা, নয়তো গুম।
লেনিনগ্রাদের নেভস্কি এলাকায় জরাজীর্ণ একটি কমিউনিষ্ট ব্লক যেখানে এক রুমের ফ্ল্যাট, যা শেয়ার করতো ইহুদী পরিবারের সাথে। কল্পনা করা যায়? এক রুমের ফ্ল্যাট, তা-ও সাবলেট! তাদের একটি মেয়েও ছিল, ওরা ছিলো বাবা-পুতিন মা-মারিয়ার মা, বাবা আর বোনের মত। হলওয়ের এক প্রান্তে একটি সিংক (বেসিন), পাশে এক বার্ণারের গ্যাসের চুলা যা শেয়ার করতে হত আরো চার পরিবারের সাথে। সিঁড়ির সাথে আলমারী-সাইজের একটা টয়লেট। নোংরা, পূতিগন্ধময়। সেটাও অন্যদের সাথে শেয়ার করতে হত। লেনিনগ্রাদ শহরে এই ছিলো ভ্লাদিমির স্পিরিদোনোভিচ পুতিন আর মারিয়া ইভানোভনা পুতিনা’র সংসার। কোলে তাদের তৃতীয়, অথচ একমাত্র ছেলে ভ্লাদিমির। ডাকনাম ভলোদিয়া।
মারিয়াও তার স্বামীর মত অল্পশিক্ষত ছিলো। দুই সন্তানের অকাল মৃত্যুর পর ছেলে পুতিনের জন্ম হয়, মারিয়ার বয়স তখন ৪১। যুদ্ধ, দারিদ্র, ক্ষুধা, আগের দুই সন্তান হারানো, লাশের স্তুপে পড়ে থাকা মৃত্যুর মুখ থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে আসা; এত কষ্টের পর এই বয়সে এসে নবজাতক পুতিনকে বুকে নিয়ে মা মারিয়া ভাবে, ভ্লাদিমির (বাবা পুতিন) ঠিকই বলেছে, এ যে ইশ্বরের অলৌকিক উপহার। এই ছেলেকে যেভাবেই হোক ভালো রাখতে হবে, সুস্থ্য রাখতে হবে, মানুষ করতে হবে। অর্থ উপার্জনের জন্য হেন কোন কাজ নেই মারিয়া করেনি। আবর্জনা পরিষ্কার থেকে শুরু করে ল্যাবের টেষ্ট টিউব ধোয়ার কাজ, সব করেছে। যাদের সাথে সাবলেট থাকতো তারা বয়স্ক এবং ধার্মিক ইহুদী মা-বাবা, বড় একটি মেয়ে হাভা, ওরা ওদের অনেক স্নেহ করতো, ভালোবাসতো, যত্ন নিতো। ওরা ছিলো শিশু ভ্লাদিমিরের দাদা আর দাদী। মা মারিয়াও গভীর ধার্মিক ছিলো, ওরা ছিলো রাশান অর্থোডক্স খ্রীষ্টান। কিন্তু কমিউনিষ্ট লেনিন-স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে ধর্মচর্চা ছিলো নিষিদ্ধ, ধরা পড়লে নিশ্চিত জেল, বাড়াবাড়ি করলে গুম।
হিটলারের নাৎসী আগ্রাসনের সময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকার রাশান অর্থোডক্স চার্চ, মুসলমানদের মসজিদ সহ অন্যান্য উপাসনালয়গুলোতে খোলাখুলিভাবে উপাসনা করার অনুমতি দিয়েছিলো যাতে সকল জাতি এক হয়ে নাৎসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নাৎসীদের দমন করে হটিয়ে দেবার পর আবার সকল প্রকার ধর্মকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশাল বিশাল রাশান অর্থোডক্স চার্চ, সবগুলোতে তালা।
বড় হয়ে ছেলে পুতিন বলেছিলো যখন তার বয়স সাত সপ্তাহ, তারিখটা ছিলো ২১ নভেম্বর। প্রচন্ড শীতের মধ্য দিয়ে বাবা আর মা তাকে নিয়ে বরফের উপর দিয়ে তিন ব্লক হেঁটে শহরের ক্যাথেড্রালে তাকে ব্যাপটাইজ করিয়েছিলেন, গোপনে। কোন এক পাদ্রী বিপদ জেনেও গোপনে দরজা খুলে দিয়েছিলো। ছেলে পুতিন মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলো ব্যাপটিজম ক্রুশ। মা ধার্মিক ছিলো কিন্তু বাবা পুতিন কমিউনিস্ট সরকারের অত্যন্ত অনূগত হিসেবে নিজের ধর্ম বিশ্বাস দমিয়ে রাখতো। চল্লিশ বছর পর, ছেলে পুতিন যখন প্রথমবারের মত ইসরায়েলের জেরুজালেম সফরে যায়, মা মারিয়া তখন তার হাতে সেই নবজাতক সময়ে দেয়া ব্যাপটিজমের ক্রুশ দিয়ে বলেছিলো ওটা হাতে নিয়ে জেরুযালেমের চার্চ অফ দ্য হলি সেপুলচারে গিয়ে যেন দোয়া করে। যেখানে চীরনিদ্রায় শুয়ে আছে যীশুখ্রীষ্ঠ।
পুতিন বড় হয়েছে বাসকভ লেনের এই জরাজীর্ণ ভবেনের এক রুমের সাবলেট বাসায়। এটাই তার পৃথিবী যা দেখে সে বড় হয়েছে। ছোট্ট ভ্লাদিমির সাইজেও ছোটখাট ছিলো, বাকি দশটা বাচ্চার মত পুতিনও দুরন্ত, শান্ত সব মিলিয়ে। বিল্ডিংয়ে প্রচুর ইঁদুর ছিলো, ছড়ি দিয়ে ওগুলোর পেছনে ছোটা ছিলো ছেলে-পুতিন আর তার বন্ধুদের খেলা।
পড়েছে স্থানীয় স্কুলে, একদম বাচ্চা বয়সে ছুরি সহ ধরাও পড়েছিলো। বাবা পুতিনকে ভালোবাসতো খুব কিন্তু তাঁর সুশৃংখল জীবনধারা পরিবর্তে গতানূগতিক শৃংখলার বাইরে যেতে চাইতো খুব। স্কুলেল ম্যাডামকে একবার বলেছিলো, “আমি হুলিগান, পাইওনিয়ার না।” স্কুল টিচার বিশ্বাস করতেন ছেলে-পুতিন বাবা পুতিনের তুলনায় অনেক বেশী বুদ্ধিমান এবং সম্ভাবনাময় কিন্তু বড্ডো এলোমেলো। মা মারিয়া এবং বাবা-পুতিন মিলে ছেলে-পুতিনকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। প্রথমে ছেলে-পুতিনকে বক্সিং ক্লাসে পাঠানো হল, একজনের নাক ফাটিয়ে দেওয়ায় তাকে পাঠানো হল মার্শাল আর্ট স্কুলে। কিন্তু বাবা মা’র ইচ্ছার বিরূদ্ধে গিয়ে ছেলে-পুতিন ‘সাম্বো’ শেখা শুরু করলো যা তার ক্ষুদে দেহের জন্য মানানসই। (সাম্বো: জুডো আর রেসলিংএর সংমিশ্রনে সোভিয়েত স্টাইলের বিশেষ কমব্যাট, পরে জুডোতে হাত পাকায় পুতিন)। অষ্টম শ্রেণীতে উঠার আগেই সে স্কুলের পাইওনিয়ার ব্রাঞ্চের লীডার হয়ে যায়, ইতিমধ্যে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ইয়থ ইউনিট (Komsomol)-এর নজরে পড়ে। ওর ভবিষ্যত হয়তো ইতিমধ্যে নির্ধারণ করা হয়ে গেছে।
তলস্তয় নয়, ভ্লাদিমিরের মন কেড়েছে ভাদিম কোঝেভনিকভ। The Shield and the Sword (স্পাই উপন্যাস Щит и меч বা শিট ই মিচ্ ) লিখেছেন ভাদিম কোঝেভনিকভ (Vadim Kozhevnikov) কিশের বয়সে এই ছবি একবার দুই বার নয়, বার বার দেখেছে ছেলে-পুতিন। “মায়ের দেশের শুরু কোথায়?” আবেগভরা দেশের গান। যেখানে আছে, নদী, ঝর্ণা, সাগর, পাহাড়, মাটি আর মানুষের কথা। এই সেদিনও ছোট্ট ভ্লাদিমির বলতো বড় হলে সে নাবিক হবে। সাত সাগর পাড়ি দেবে, দেখবে এবার জগতটাকে। নয়তো পাইলট হবে, আকাশে উড়বে। এই ছবি দেখার পর থেকে ভেতরে ভেতরে সংকল্প আঁটে, স্পাই হবে সে। এখনো মনে মনে আওড়ায় প্রিয় সেই সিনেমার ডায়ালগ, “হাজার মানুষের জীবন নির্ভর করে একজন স্পাইয়ের উপর।”
কেজিবি সম্পর্কে শুনেছে সে। কিন্তু জানে সামান্যই। ছেলে পুতিনের বয়স তখনো ষোল হয়নি, গর্ধবের মত অথচ দুঃসাহসী কান্ড করে বসলো। সত্যিই একদিন লেনিনগ্রাদের কেজিবি হেডকোয়ার্টার গিয়ে হাজির হল। বিশাল কেজিবি ভবনের সঠিক প্রবেশদ্বার খুঁজে বের করতে পারলোনা। ছেলে পুতিন থামলো না।
চতুর্থবার এক অফিসারের দেখা পেলো যে তাকে নিরাশ করেনি তবে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলো কেজিবি ভলান্টিয়ার নেয় না, যোগ্যদের নেয়। যেমন অনেক ভালো ছাত্র যারা সুযোগ্য সেনা অফিসার, কিংবা ইউনিভার্সিতে আছে। ছেলে পুতিন হাল ছাড়েনা, আরো জানতে চায়, কোন কোর্সটি তার জন্য ভালো হবে। অফিসার হয়তো বাচ্চাটির সাথে কথা না বাড়িয়ে বিদায় করে দিতে চেয়েছিলো। বলেছিলো আইন বিষয়ে ডিগ্রী নিতে। ব্যস, মা-বাবার ইচ্ছার বিরূদ্ধে সে তাই করতে গেল। ছেলে-পুতিনের মেধা, শরীরের গঠন আর মেজাজ মর্জি বিচার করে মা মারিয়া আর বাবা-পুতিন চেয়েছিলো টেকনিক্যাল স্কুল যেমন সিভিল এভিয়েশন, যেখানে পড়লে পাইলট হতে পারবে। ছেলে পুতিনের এই উদ্ভট আবদার শুনে মা-বাবার পাশাপাশি স্কুল টিচারেরাও আকাশ থেকে পড়েছিলো। কেউ জানেনা ছোট ভ্লাদিমির একা একা কেজিবি হেড কোয়ার্টারে গেছে, কার সাথে জানি কথাও বলেছে। ওরা ভেবে বসে আছে, ছেলে পুতিন প্রসিকিউটর কিংবা পুলিশ হতে চায়।
ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতি তার শক্তি ফিরে পেয়েছে। বাবা পুতিন আর মা মারিয়া ছিলো ওয়ার্কিং ক্লাস, হত দরিদ্র। তারপরও রাষ্ট্রের উন্নতির সাথে সাথে তাদের জীবনের মানও দ্রুত উন্নত হতে থাকে। বাবা পুতিন ফ্ল্যাটে টেলিফোন লাগায়, শুধু তাই নয় মা মারিয়া আর বাবা পুতিন মিলে লেনিনগ্রাদের খুব কাছের টসনো ভিলেজে একটা তিন রুমের ‘ডাচা’ (কান্ট্রি হাউস বা কটেজবিশেষ, শহরের বাইরে দিত্বীয় আবাস হিসেবে) কিনে ফেলে। ছেলে-পুতিন তার টিনএজ জীবন এখানেই কাটায়, যা কিনা শহরের বদ্ধ পরিবেশের উল্টো। ছেলে ভ্লাদিমিরকে সেকেন্ডারি এডুকেশনের জন্য স্পেশালাইজড সায়েন্টিফিক একাডেমিতে পাঠানো হয় ইউনিভার্সিটির জন্য প্রস্তুত হবার জন্য। লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধুলা প্রতি আগ্রহ বেশী ছিলো। প্রস্টিজিয়াস কোন এক ইউভার্সিটিতে পাঠানোর উদ্দেশ্যে সায়েন্স পড়াতে পাঠিয়েছিলে, সেটা বাদ দিয়ে ছোট পুতিন পড়লো হিউমানিটিজ (লিবারেল আর্টস), সাহিত্য এবং ইতিহাস। সাথে জার্মান ভাষাও শিখতে লাগলো কারন এর আগে ফোর্থ গ্রেডে থাকতে প্রিয় শিক্ষিকা ভেরা গুরেভিচের উৎসাহে জার্মান শেখা শুরু করেছিলো। তখন ভেরা ব্রিলেভা নামের এক জুনিয়রের সাথে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়, তাকে চুমুও খায়। কিন্তু ভেরা ছেলে পুতিনকে পায় তার নিজের জগতে, ডেস্কে মুখ গুঁজে লেখাপড়াতেই মন ছিল বেশী। মেয়েদের প্রতি তেমন উৎসাহ দেখাতোনা। দুই বছরের অধ্যবসায় কাজে লেগেছে, ছেলে পুতিন ভালো রেজাল্ট করেছে। তাক লাগানোর মত না হলেও যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট। ইতিহাস এবং জার্মান ভাষা শিক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট অন্যদিকে অংক আর বিজ্ঞানে খুব একটা ভালো ফল পায় নি। শেষের বছর দিন রাত এক করে লেখাপড়া করে তার প্রবল কাংখিত, সোভিয়েত ইউনিয়নের মোস্ট প্রস্ট্রিজিয়াস লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেবার মত প্রয়োজনীয় নাম্বার তোলার সংকল্প আঁটে। “লেনিনগ্রাদ ইউনিভার্সিটিতে চান্স খুব কম”, প্রিয় শিক্ষিকা ভেরা গুরেভিচের সন্দেহ থেকেই যায়, “এই সমস্যার সমাধান আমি নিজেই বের করবো।” ক্ষুদে শরীরের ছোট পুতিন মাদাম ভেরা কে জবাব দেয়। এর পর কেটে যায় দিন। বড় হতে থাকে ছেলেটা . . .
তারপর কোন কিছু থেমে থাকে নি। ছেলে পুতিন আজকের মহাপরাক্রমশালী ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৬