সাকিব বহু কষ্টে দৌড়ঝাপ করে এসে বাসটা ধরতে পেরেছে। দুটো সিট খালি। তাড়াতাড়ি গিয়ে জানালার পাশেরটায় বসে পড়ল। হুড়মুড় করে লোক উঠছে। কিছুক্ষন পর উঠলে আর বসে যাওয়া লাগতো না। হ্যাঙ্গারের মত ঝুলতে ঝুলতে আর ঠেলা ধাক্কা সামলাতেই খবর হয়ে যেত।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে খালাম্মা টাইপের মোটাসোটা এক মহিলা ধপ করে এসে পাশে বসলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই টের পেল সাকিব, তার সাধের বাগানে ঢুকে গরু খেতে শুরু করেছে ঘাস...। খালাম্মার আবার সামান্য গল্পগুজবের অভ্যাস। সাকিবকে পেয়ে উনি মনে হল ভীষণ খুশি। একটা পান গালে দিয়ে শুরু করলেন-- কি করে গত পরশু তার তিন বছরের নাতনি ফ্রিজ খুলে ডিম বের করে ফেলল সেই কাহিনি।
কথার সাথে সাথে ভক ভক পানের গন্ধ বেরুচ্ছে সেই সাথে ছিটকে আসছে পান সুপারির চর্বিত কণা। বাড়তি পাওনা হিসেবে আছে ঘামের উৎকট গন্ধ। সাকিবের নাড়িভুঁড়ি উলটে আসার জোগাড়। সাকিব বসেছে জানালার পাশে। খালাম্মার স্থান সংকুলান হচ্ছে না। তাই কিছুক্ষন পর পর তিনি নড়েচড়ে বসছেন। এবং বাসের বডির সঙ্গে সাকিবকে প্রায় লেপ্টে দিচ্ছেন। এই চিপা থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই।
অগত্যা সাকিব পান সুপারির কনাগুলো ঝেড়েমুছে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে বক বক থেকে রেহাই পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কানে ইয়ারফন লাগাতে দেখে খালাম্মা জিজ্ঞেস করলেন “কি শুনতাছ বাবা?” সাকিব শুনেও না শোনার ভান করে বসে রইল। খালাম্মা জোরে আবারও জিজ্ঞেস করলেন এবং তার কথার ধাক্কায় মুখ থেকে এক দলা পান সুপারি বেরিয়ে এলো। তাড়াতাড়ি ইয়ারফোন খুলে সাড়া দিল সাকিব। আরেকটু হলে মনে হচ্ছে পান সুপারির বন্যায় ভেসে যেতে হবে।
“বাবা ইডার মইদ্যে খবর কয় না?”
মেনটস ছাড়াই বুদ্ধির বাত্তি জ্বলে উঠল সাকিবের মাথায়। খবর শুনতে দিলে যদি জ্বালা খানিকটা উপশম হয়।
“জি খালাম্মা আপনি শুনবেন?”
“হ বাবা দেও ইট্টু শুনি। দেশ বিদেশের খবর রাখন দরকার।“
একটা খবর চ্যানেল সেট করে দিয়ে সাকিব যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু আশার গুঁড়ে বালি। কিছুক্ষন পর পর খালাম্মা চেঁচিয়ে উঠছেন। “ মার শালা শয়তানের ছাও। মাইরা হাড্ডিগুড্ডি এক কইরা দে। বদের বদ। দেকছনি কারবারডা করছে কি? এমনে খুন কইরা ফালাইলো”। আশে পাশের যাত্রীরা বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। খালাম্মার সেই দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, বোঝা গেলো তিনি মনোযোগ দিয়েই খবর শুনছেন। তার কিছু পরে খালাম্মা আবার চিকন তীক্ষ্ণ গলায় গান গেয়ে উঠলেন “ পাগল মন মনরে হুম হুম হু......”। কে জানত এই মহিলার সুর বোধ এতো তীব্র হবে।
এদিকে গাড়ি এগুচ্ছে পিঁপড়ের গতিতে। গুলিস্তান থেকে পিঁপড়ের গতিতে এগুতে এগুতে সে গতি শামুকের গতিতে রূপ নিয়ে মৎস ভবনের সামনে এসে হ্যাং করলো। শুরু হল নিয়মিত উৎপাত । দফায় দফায় হকার উঠছে। রুমাল নেন দশ টাকা, কি করিলে কি হয় জানতে চাইলে বই কিনুন দশ টাকা সাথে পাবেন আরও দুইটা বই ফ্রি, এই পেন্সিলটা নিতে পারেন আপনার ছোট্ট সোনামণির জন্য, এই বইটা নিলে মাত্র ত্রিশ দিনে ইংরেজিতে কথা বলতে পারবেন পটাপট। আছে নানান ধরনের খাবার আয়োজন, বাদাম ভাজা খাইতে মজা (পচা হলেও), ঝাল মশলা দিয়ে মাখানো আম, আম খেয়ে ঝাল লাগলে আছে ঠাণ্ডা পানি, জুস, মাঠা, (এইসবের মান নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই আপনাকে দেয়া হবে না) ইত্যাদি। খবর শোনা, গান শোনা এইসব বাদ দিয়ে এবার খালাম্মার নজর গেলো খাবারের দিকে। বাদাম কিনছেন, পপকর্ন কিনলেন, আম কেনার আগেই আমওয়ালা নেমে গেলো, খেলেন নারিকেল ভাজা।
অতএব যা হবার তাই হল। বাস চলতে শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যে হোয়াক হোয়াক করে বমি। সাকিবের গায়ের ওপর দিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বমি করছেন খালাম্মা। ধৈর্যের বাঁধ চুর চুর করে ভেঙ্গে পড়ল সাকিবের। শাহবাগ থেকে ধানমণ্ডি পনের প্রয়োজনে হেঁটেই যাবে তবু এই মুহূর্তে নামতে হবে বাস থেকে। সাকিবকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই আরেকজন ভিড় ঠেলে সিটের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু মুচকি হেসে বাস থেকে নেমে পড়ল সে। নেমে কিছুদূর হাটতেই সিগন্যাল ছেড়ে দিল। চোখের সামনে দিয়ে হুস করে চলে গেল বাস।
সাকিব হাঁটতে হাঁটতে মনে করার চেষ্টা করল, আজকে তার রাশিফলটা কি যেন ছিল?
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৪৬