শিমুল অনেকক্ষণ দরজায় নক করল। দরজা খুলল না। এক নাগাড়ে নক করা নয়, থেমে থেমে। প্রথমে কিছুক্ষন চাপর মারার মত করে থাপড়ে শব্দ করল। দুইটা করে থাপ্পর একটা করে ডাক। ‘মিজু মামা ।’ ডাকটা একটু চাপা গলায় দিতে হচ্ছে। কেউ শুনে ফেললে ধমক খেতে হবে । এই মুহূর্তে মামাকে খুব দরকার। কিছুক্ষন থাপড়ানোর পর শিমুলের মনে হয়েছে শব্দটা পর্যাপ্ত নয় । তখন হাতের উল্টো পিঠে আঙ্গুলের গাঁট দিয়ে নক করা শুরু হল । টক টক টক । এই আওয়াজটা আগের চেয়ে জোরালো । তবে হাতে ব্যথা লাগে । এক সময় মনে হল মামা ঠিকই জেগে আছে কিন্তু ইচ্ছে করেই দরজা খুলছে না । এবং আরও ঘণ্টা খানেক ডাকলেও খুলবে না । শিমুল মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে গেল ।
ঢোলা কোয়ার্টার প্যান্ট গলে শুকনো দুটো পা ধীর গতিতে চলে যাচ্ছে । মাথাটা বুকের কাছে নামানো। যেন মনোযোগ দিয়ে গেঞ্জির ডিজাইন দেখছে । গেঞ্জির ডিজাইনে হয়ত আবেগময় কিছু ছিল যা দেখে চোখ পানিতে ভরে উঠছে । হাত দুটো হাঁটার তালে তালে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে শরীরের দুই পাশে দুলছে । শিমুলের চলে যাওয়ার দৃশ্যটা যদি তার মিজু মামা দেখতে পেত তাহলে বউয়ের কঠিন চোখ অগ্রাহ্য করে দরজা ভেঙ্গে ছুটে আসতো ।
মিজু মামার পুরো নাম মেজবাহ উদ্দিন । মেজবাহ নামের উচ্চারণগত ঝামেলার কারনে প্রথমে মেজু এবং বিবর্তনের সূত্রানুযায়ী পরবর্তীতে মিজুতে রূপান্তরিত হয়েছে । গোষ্ঠীর সকল ছোটদের কাছে মিজু মামা ( কারো কাছে মিজু কাকা ) অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব । সাধারনত যারা ছোট মহলে জনপ্রিয় তারা বড় মহলে অনেকটা হেলার পাত্র হিসেবে থাকে । পড়াশোনায় কিছুটা কাঁচা , হেয়ালি স্বভাবের বেকার এবং পরিবারের সবচেয়ে অকর্মণ্য ব্যক্তিটিই এ ভুমিকা পালন করে । কিন্তু মিজু মামা এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যতিক্রম । মামা তুখোড় স্টুডেন্ট । পরীক্ষার সিজনে তিনি পড়তে পড়তে পা ফুলিয়ে ফেলতে পারেন । ছোটরা সেই ফুলন্ত পা টিপে টুপে দেখে । স্যান্ডেল ক্ষয় হবার আগেই মামা চাকরি পেয়ে গেলেন । তারপর থেকে প্রতি মাসে ছোটরা একবার করে ইচ্ছেমত তাদের প্রিয় খাবারগুলো খওয়ার সুযোগ পায় । বড়রা যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মামার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে ঠিক তেমনি ছোটরাও তাদের গুরুত্বপূর্ণ শলা পরামর্শে মামাকে উপদেষ্টা হিসেবে পায় । মামার সাথে পরামর্শের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মামার আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যায় । যে কারো যে কোন বিপদে মাথার ওপরে থাকেন মিজু মামা । আচার ওয়ালা চলে যাচ্ছে , ডাক পরে—‘মিজু মামা, ওনাকে আটকাও।’ কারো গাড়ি পুরনো হয়ে গেছে , খোঁজ পরে—‘মিজু কাকু কই, মিজু কাকু ?’ চুড়ি ফিতা ওয়ালারা মনে হয় মিজু মামার জন্যই ঘন ঘন আসে । বেছে বেছে ছুটির দিনে । মেয়েরা টেনেটুনে মিজু মামাকে নিয়ে ঝুড়ির সামনে দাড় করিয়ে রাখে । তারপর মনের আনন্দে কেনাকাটা করে । নানির রস মালাই খেতে ইচ্ছে হলে তিনি চিকন গলায় মিজুর খোঁজ করেন । কাউকে সামনে পেলেই বলেন , ‘অপিসে যাবার আগে মিজুকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস।’ মাঝে মাঝে বিন্টু গম্ভীর গলায় বলে, ‘কি লাগবে আমাকে বল, আমি কাকুকে বলে দেবো। তাহলে কাকুকে আর তোমার জরুরী কথা নামক অযথা গুজগুজ ফুসফুস শুনতে হবে না।’ নানি ক্ষেপে ওঠেন, ‘ওই ছ্যামরা, মিজু আমার পোলা। আমি গুজগুজ করলে তোর কি? বান্দরের বান্দর হইছস। হামান দিস্তায় সকাল বিকাল একবার কইরা ছেচন দেওন দরকার।’ বিন্টুদের এসব মুখস্ত হয়ে গেছে। বিন্টুরা মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করেই তাকে খ্যাপায়। কারন নাতি নাতনিদের নিয়মমাফিক বকাঝকা করতে না পারলে তার শরীর খারাপ করে।
হঠাৎ একদিন ঘরে বড়দের তুমুল শলাপরামর্শ শুরু হল। বেশিরভাগ সময় সেখানে মিজু মামা থাকছেন না। তবে তাকে খুশি খুশি দেখায়। যারা সাইজে একটু বড় তারা আবিষ্কার করল মিজু মামার বিয়ে। তারা ছোটদের বুঝিয়ে দিল, তাদের জন্য একটা নতুন মামি আনা হবে। এই ঘটনা ছোটদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। কেউ নতুন মামি বা কাকি আনার পক্ষে কেউ বিপক্ষে। কখনও কখনও এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া ঝাটিও বেঁধে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানের দিন ঘনিয়ে আসায় ঝগড়া ঝাটি চাপা পরে যেতে থাকল। নতুন জামা কাপড়, মজার খাবার দাবার আর উৎসব উৎসব আমেজের কারনে সবাই নতুন মামি আনার পক্ষে চলে এলো। তুমুল হৈ চৈ এর মধ্য দিয়ে শিমুল সুমনদের মামি ওরফে বিন্টু কাঁকনদের কাকি চলে এলেন। মামি যে সিনেমার নায়িকাদের চেয়েও বেশি সুন্দরী সেটা নিয়ে কারো মধ্যে কোন ঝগড়া ঝাটি হল না। মামির কি যেন একটা নাম আছে। বড়রা ডাকে। তবে ছোটদের কারো কাছে মিজু মামি কারো কাছে মিজু কাকী। প্রথম দিকে মামিকে মামার চেয়েও বেশি ভালো মনে হয়েছে। আস্তে আস্তে মামি কেমন বদলে গেলেন। মামার ঘরটা ছোটদের জন্য সর্বক্ষণ খোলা থাকতো। মামি আসার কয়েকদিন পর সেটা সর্বক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। মামির বদলে যাওয়া নিয়ে ছোটদের সমস্যা হত না। কিন্তু মামির সঙ্গে সঙ্গে মামাও কেমন বদলে গেলেন। মিটিং গুলোতে মামাকে আর আগের মত পাওয়া যায় না। জরুরী প্রয়োজনে মামাকে ডাকতে রুমের দরজা নক করতে হয়। প্রায়দিন মামি মিষ্টি গলায় বলেন, ‘ খুকি তোমার মামার তো এখন মাথা ব্যথা। একটু ঘুমুচ্ছে। উঠলে পাঁঠিয়ে দেবো। এখন তুমি যাও।’ আগে মামার কখনও মাথা ব্যথা হত না। এখন অফিস থেকে ফিরে রুমে ঢুকলেই মামার মাথা ব্যথা শুরু হয়। ছোটরা বুঝতে পারে মামি তাদেরকে পছন্দ করেন না। বড়রাও মামির প্রসঙ্গে কেমন চুপ করে যায়। কেবল নানি সশব্দ বাক্য বর্ষণে জানিয়ে দেন নতুন বউকে তার একদমই পছন্দ না।
শিমুলের আজ মামাকে খুব দরকার। স্কুলে কাজল একটা নতুন পেন্সিল বক্স এনেছে। শিমুল একটু হাতে নিয়ে দেখছিল। কিন্তু হাত থেকে কেমন করে পরে গেল। মুহূর্তের মধ্যে দুই টুকরা। কাজলের সে কি কান্না। শিমুলের নিজেরই খুব খারাপ লাগছিলো। শিমুল ওর কাছ থেকে ভাঙ্গা বক্সটা নিয়ে এসেছে। ওকে বলেছে মামাকে দেখিয়ে ঠিক এরকম একটা এনে দেবে। নইলে বেচারা কাজলকে বাবার হাতে মার খেতে হবে। শিমুলের ভয় লাগছে। যদি ওর মা বাসায় বিচার দিতে আসে। এই কথা আর কাউকে বলা যাচ্ছে না। মা শুনলে হাত ধরে টানতে টানতে বাবার কাছে নিয়ে যাবেন। বাবার কাছে গেলে কি হবে সেই পর্যন্ত শিমুল ভাবতে পারে না।
অনেকক্ষণ ডেকেও মামাকে পাওয়া গেল না। শিমুল ভাঙ্গা বক্সটা হাতে বারান্দায় চলে এলো। আটকে রাখা পানি ঝর ঝর করে পড়তে শুরু করেছে। আকুল হয়ে কাঁদছে শিমুল। মাঝে মাঝে ফুপিয়ে উঠছে, ‘মিজু মামা, ও মিজু মামা।’
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০০