খাবারের আইটেম ভালো। তারপরও গলা দিয়ে নামতে চাচ্ছে না। শর্ষে ইলিশ, চিংড়ির মালাইকারী। হলের ডাইনিংয়ের তুলনায় রাজকীয় খাবার। তবু মুনিয়ার খাবার গলায় আটকে থাকে। ভেতর থেকে কান্না ডুকরে ওঠে। টপ টপ পানির ফোঁটা গাল গড়িয়ে ঝোল তরকারির সঙ্গে মেশে। মুনিয়া তবু লোকমা তোলে। মা কষ্ট করে রেঁধে পাঠিয়েছে- ফেলতে মন চায় না। মুনিয়া ধীরে ধীরে চিবোয়। চোখের সামনে ভাসে, আব্বা খাবারের ভারী বোঝাটা এহাত-ওহাত করছেন। কলেজ গেটের বিপরীত দিকের যাত্রী ছাউনিতে বসার জায়গা আছে, কিন্তু বসার সুযোগ নেই। সারাক্ষণ মানুষজন বসেই থাকে।
আব্বা এসেছেন অনেক আগে। এসে কলও করেছেন। মুনিয়া টের পেল পনের-বিশ মিনিট পরে। হল থেকে নামতে নামতে গেটের কাছে যেতে যেতে দশ-পনের মিনিট এমনিতেই লেগে যায়। ঘণ্টাখানেক আজিজ সাহেব মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। মুনিয়া প্রায় দৌড়ে গেল গেটের কাছে। আব্বার কপালে ঘাম চিক চিক করছে। মেয়েকে দেখে হাসলেন। পুরুষ গার্ডিয়ানদের কলেজের ভেতরে ঢোকার সুযোগ নেই। এটা মহিলা কলেজ। দেখা-সাক্ষাৎ সব গেটের বাইরেই সারতে হয়। অভ্যর্থনা কক্ষ নামে অভিভাবকদের বসার একটা জায়গা আছে বটে। তবে সেটার দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি খুবই আরামপ্রিয়। সকালে সেই কক্ষ খুলতে তার ভীষণ আলসেমি লাগে। যেদিন ভালো লাগে খোলেন, না লাগলে খোলেন না। দূর-দূরান্ত থেকে আসা অভিভাবকরা বেশিরভাগ সময় গেটের বাইরে থেকেই ক্লান্ত পায়ে বিদায় নেন। মুনিয়া দ্রুত খাবার শেষ করার চেষ্টা করল।
আম্মা ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ খেতে পারেন না। অ্যালার্জিটা বড্ড জ্বালাতন করে। আব্বা এ জন্য এসব মাছ ছাড়া অন্য মাছ বেশি কেনেন। পদে পদে মাছ কেনার সামর্থ্য সব সময় হয় না। মেয়ে কত দিন বাড়ি আসে না। পরীক্ষা সামনে, কত পড়াশোনা। মেয়েকে দেখতে যাবেন। মাছ কেনা দরকার। জানা সত্ত্বেও মুনিয়ার মাকে জিজ্ঞেস করেন, ইলিশ মাছ নিয়ে আসি, কী বলো? সঙ্গে আধ কেজি চিংড়ি। মেয়েটা কী খায় না খায়! তোমার জন্য কই পেলে না হয় আনব। আম্মা আব্বার সামর্থ্য জানেন। বলেন, থাক অত কিছু লাগবে না। পুঁইশাক আছে, লাগলে একটা ডিম ভেজে খেয়ে নেব। আপনি মেয়ের জন্য ভালো দেখে মাছ নিয়ে আসেন। আব্বা মাছ কেনেন, ভালো বেকারি বিস্কুট কেনেন। মেয়ের রাত জেগে পড়ার অভ্যাস। রাতে নিশ্চয়ই ক্ষুধা লাগে। তখন দুটো বিস্কুট খেয়ে পানি খাবে। আজিজ সাহেব মুড়ি কেনেন, চানাচুর কেনেন। কী মনে করে একটা তেলাপোকার ওষুধ কিনলেন। আজকাল তেলাপোকা বেড়েছে; যদি দরকার হয়। তিনি দোকান ঘুরে বেছে বেছে বড় ডিম নেন। এ সময় বেশি করে ডিম-দুধ না খেলে শক্তি পাবে না।
মুনিয়া তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে ওঠে। ছোটবোন ফোন করেছে। বলল, আব্বার শরীরটা অনেক ক্লান্ত। এতদূর আসা-যাওয়ার ধকল, একদণ্ড জিরানোর সুযোগও পায়নি। মুনিয়া হাত-মুখ ধুয়ে বই-খাতা নিয়ে রওনা হয় রিডিংরুমে। মেয়েরা দলবেঁধে যাচ্ছে টিভি রুমে। সবার মুখে একটাই গল্প। নায়িকার আজ কী হবে? কুটনি বুড়িটা আজ যেন কী করে? মুনিয়া এসব গল্পের কিছুই জানে না। তার মাথায় অন্য গল্প। একটা ভালো রেজাল্ট, আব্বার কপাল, জুড়ে চিকচিকে ঘাম, মুখে তৃপ্তির হাসি। আম্মার হাঁফ ছেড়ে ফেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস। খুশিতে আব্বার দিশেহারা অবস্থা।
মুনিয়ার গল্পটা সত্যি হয়েছিল। তবে পুরোটা নয়। অনেক ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করেছে সে। কিন্তু রেজাল্ট দেখে তৃপ্তির হাসি দেওয়ার মানুষটা সেদিন ছিল না। খুশিতে কেউ আত্মহারা হয়নি। আম্মার আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা পড়েছিল, তবে সেটায় স্বস্তির বদলে মিশে ছিল আফসোস। তিনি ডুকরে ওঠা কান্নার দমক ঠেকাতে মুখে আঁচল চেপেছেন। মুনিয়া নিশ্চুপ ঘুরে বেড়ায়। বাবার পুরনো পাঞ্জাবিটা নামিয়ে দেখে। সাদা শার্টটার গন্ধ শোঁকে। পরিচিত গন্ধ। মমতার গন্ধ।