এস. এস. সির রেজাল্ট হয়েছে। ফেসবুকে আমি এ নিয়ে কোন শুভেচ্ছা কিংবা সমবেদনামূলক পোস্ট দেইনি। শুভেচ্ছা জানাতে হয়তো আমার ভালোই লাগতো কিন্তু সমবেদনা জানানোর সাহস হয়নি। কারন রেজাল্ট সংক্রান্ত মনোভাব কেবল ফেসবুক সমাজেই পরিবর্তন হয়েছে। খারাপ করা ছাত্র ছাত্রীদের কতটা সইতে হয় তা তাদের চেয়ে ভালো কেউ বলতে পারবে না। বাবা মা না বললেও পাড়া প্রতিবেশী তৈরি থাকে ভালো মন্দ বলার জন্য। আমি না দিলেও নিউজফিডে রেজাল্ট নিয়ে প্রচুর পোস্ট দেখেছি। কিছু ব্যাপার চোখে লেগেছে। রীতিমত ভাবনায় ফেললো।
বহু পোস্টের সামারি মোটামুটি এইরকম যে, একাডেমিক পড়াশোনা সার্টিফিকেট, জিপিএ এসব কিছুই না। অন্যান্য যোগ্যতা, ভালো কিছু করতে পারাই জীবনের মূল লক্ষ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা হয় ওমুক আইকন তমুক করেছেন। ছিলেন স্কুল ড্রপার, কলেজ ড্রপার ইত্যাদি। আমি নিজেও এরকম অনেক বিখ্যাতদের কথা জানি। কিন্তু যারা এসব বলছেন তাদের খেয়াল করা দরকার পরিবেশ পরিস্থিতির দিক থেকে আমাদের দেশ ওমুক আইকন তমুক আইকনদের দেশের ধারে কাছেও নেই। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই গৎবাধা এবং একঘেয়ে ধরনের। বড় ধরনের কোন উত্থান ছাড়া খুব শীঘ্রই এ ব্যবস্থা বদলে যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তাই আপাতত কোন ছেলে মেয়েকে ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হতে হলে এই গৎবাধা সিস্টেমের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। পড়ে হোক, বুঝে হোক, মুখস্থ করে হোক তাকে ভালো ফলাফল করতেই হবে। নতুবা সে ভালো প্রতিষ্ঠানে চান্স পাবে না। ভলো জায়গায় যেতে পারবে না।
ইচ্ছা স্বাধীনতার কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয় আগ্রহের বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চাওয়া মানুষের অধিকার। কেউ আগ্রহী হয়ে ডাক্তারি পেশায় যেমন যেতে চাইতে পারে তেমনি কেউ একজন সিনেমার পরিচালক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে চাইতে পারে। আমাদের দেশের যা সিস্টেম তাতে কেউ শখ করে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত বোরিং সাবজেক্টে পড়তে চাওয়ার কথা না। বাচ্চাবেলা থেকে বেশিরভাগ বাবা মায়ের ইচ্ছায় তাদের ছেলে মেয়েরা এ ধরনের লক্ষ্যের জন্য প্রস্তুতি নেয়।
জি পি এ ফাইভ বা পরীক্ষার ভালো নম্বর একজন মানুষের দক্ষতার মাপকাঠি হতে পারে এটা যেমন সত্যি, তেমনি ভালোভাবে পড়াশোনা না কর কিন্তু ভালো রেজাল্ট হয় না। এখনকার ফেসবুকের শান্তনা পোস্টগুলো থেকে "পড়াশোনা করে কি হয়" টাইপ ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলে আসতে পারে। যা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য আরো বড় ধরনের হুমকি। ইতোমধ্যে ধারণাটি ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। যার ফলাফল প্রশ্ন ফাঁস, নকল, জালিয়াতি। যে করেই হোক রেজাল্ট দরকার। বর্তমান অবস্থায় শিক্ষার্থীদের যদি ইচ্ছেমত পড়াশোনার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে বোধহয় দেশে আর কোন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, আইনজীবী খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার বদলে গেইমার, ফেসবুকার, অকর্মণ্য এক প্রজন্ম তৈরি হবে।
সরল স্বীকারোক্তি থেকে বলছি। আমি কোন দিনও আগ্রহ নিয়ে সিলেবাসের পাঠ্যবই পড়িনি। রেজাল্ট খারাপ হওয়ার লজ্জা বুঝে গিয়েছিলাম। শুধু সেই জন্য পড়ালেখা করেছি। বাবা মা কি বলবেন সেটাও তাড়না দিত। শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে আমার বাবা মা সচেতন থালেও তারা স্ক্রু টাইট দেয়া পদ্ধতির পক্ষপাতী নন। শহরে বড় হয়েও তাদের কল্যানে চমৎকার একটা শৈশবের সাক্ষী হতে পেরেছি। এক আধ নম্বর কম পাওয়া ছেলে মেয়েদের যখন তাদের মায়েরা চড় থাপ্পড় দিতে দিতে বাড়ি নিয়ে যেত মা তখন মাঝে মধ্যে তাদের বোঝাতেন। এখন সেই ছেলে মেয়েদের অনেকে যখন ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হয়েছে শুনি তখন মনে হয় মা আমাকে সেই সময় আরেকটু টাইট দিলে বোধহয় মন্দ হত না।
আমি কত কষ্ট করে অংক শিখতাম, ইংরেজি শিখতাম আমার মনে আছে। মাথায় কিছু ঢুকছে না অথচ করতেই হবে। বেশি জিজ্ঞেস করলেই ধমক। এগুলো মনে হলে কষ্ট হয়। এখন আমি আমার ছোট বোনটাকে সেই কষ্ট দেই না। সে কোথায় বুঝতে পারছে না, কেন তার মুখস্ত হচ্ছে না বোঝার চেষ্টা করি। একঘেয়ে লাগলে আটকে রাখি না। বোঝানোর চেষ্টা করি, আগ্রহ তৈরি করার চেষ্টা করি। পড়ার গুরুত্বটা ওর কাছে তুলে ধরতে চেষ্টা করি। ভবিষ্যতে আমার বাচ্চাদেরও আমি এটাই করব।
একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছু একাডেমিক জ্ঞানের দরকার অবশ্যই আছে। তা বলে আমরা গড়ে পিটে আমরা দেশের সব ছেলে মেয়েদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে ফেলতে পারি না। বিশেষ আগ্রহ এবং দক্ষতার বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। এ ব্যাপারগুলো ছোট বেলা থেকেই প্রকাশ পায়। সাধারণ শিক্ষার সময়টা আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে ইন্টার লেভেল পর্যন্ত গুরুত্বের সাথে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করা উচিৎ। করতে না চাইলেও করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর সে কোন দিকে যাবে, তার কি হওয়া উচিত সে নিজে কিছুটা হলেও বুঝতে পারবে।
সুতরাং এ সময়ে যারা ভালো ফলাফল করছে তাদের উৎসাহ দেয়াটা যেমন দরকার তেমনি যারা ভালো করে নি তাদের বোঝাতে হবে ভালো ফলাফল না করায় সে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশ্যই সেটা তিরস্কার নয়, অনুধাবন। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। সেটা যদ্দিন না হচ্ছে ততদিন যা আছে তা নিয়ে কাজ তো চালিয়ে যেতে হবে। পরিবর্তন যদি আসে তবে সেটা কোন গণ্ডমূর্খের মাধ্যমে আসবে না। বরং গৎবাধা শিক্ষা ব্যবস্থার ভুক্তভোগীদের মাধ্যমেই আসবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৮ রাত ৯:৪৯