চীনের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব যতকাল অটুট ছিলো ততকাল পাকিস্তানের তর্জন-গর্জনকে আমল দেয়ার বিশেষ একটা প্রয়োজন বোধ করেনি ভারত। ভারত-চীন যুদ্ধের পূর্ব থেকেই চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যখন উত্তরোত্তর খারাপ হতে আরম্ভ করে, পাকিস্তান সত্যি সত্যি ভারতের কাছে একটা মারাত্মক হুমকী হয়ে দাঁড়ালো। চীন এবং পাকিস্তান দুই সীমান্তের নিরাপত্বা অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় চারগুণ বেড়ে গেল।
ভারত বৃহৎ দেশ এবং দরিদ্র দেশ। এই প্রতিরক্ষা ব্যয় ফি-বছর মেটাতে যেয়ে তার উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বন্ধ হয়ে গেলো, দেশে অভাব এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো, প্রতিটি রাজ্যে শাসক কংগ্রেসের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে থাকলো, উগ্র এবং চরমপন্থীদের দৌরাত্ম্যে শাসন যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ার অবস্থা। এই ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে কার্যকর একটা কিছু করা শাসক কংগ্রেসের পক্ষে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছিলো।
ভারতের আভ্যন্তরীণ নানা দ্বন্দ্ব এমনভাবে পরস্পর মাথা ঠোকাঠুকি করছিলো যে, জনগনের চিন্তাচেতনাকে সংঘাতরত প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রসমূহ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছিলো। বিশেষত, সেই সময়ে ভারতের রাজ্যসমূহে কংগ্রেসের প্রভাব ভয়ঙ্করভাবে হ্রাস পেতে আরম্ভ করেছে। একটা যুদ্ধ লাগলে সেই দ্বন্দ্বসমূহ সাময়িকভাবে নিরসন করা যায়। এই যুদ্ধ চীন কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গেই লাগাতে হয়।
পাকিস্তানের শাসকবর্গ যেমন আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে উঠলে যে কোনো অছিলা করে ভারতের সঙ্গে একটা গোলমাল পাকিয়ে তুলে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতেন, ভারতও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশের দাবি দাওয়ার প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে বিবাদ ঘনিয়ে তুলবে তাতে এমন বিচিত্র কি!
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বিচার করলে পাকিস্তান একটি কৃত্রিম এবং বিসংগত রাষ্ট্র। রাষ্ট্র হিসেবে এখানেই ছিলো পাকিস্তানের দুর্বলতার আসল উৎস। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভৌগোলিক কোনো সংযোগ নেই। ধর্ম ছাড়া উভয় অংশের মধ্যে স্থায়ী কোনো বন্ধনের সূত্র অনুপস্থিত। পূর্বাঞ্চলের পর্যায়ক্রমিক শোষণের ওপর পশ্চিমাঞ্চলের সমৃদ্ধি। পাকিস্তানের এই দুর্বল স্থানটিতে আঘাত করে আভ্যন্তরীণ প্রবল দ্বন্দ্বটি শাণিত করার কাজে ভারতীয় শাসকবর্গ সব সময়ে তৎপর ছিলেন।
সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে দু’অংশের দ্বন্দ্বটা আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষণা না করেও একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব এবং তাতে জয়লাভের সম্ভাবনা অত্যধিক। ভারতীয় শাসকবর্গ প্রচারমাধ্যমগুলো একই লক্ষ্যে ব্যবহার করতেন।
ঊনিশশো বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন এবং ঊনিশশো চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে ফলাও করে প্রচার করেছিলো ভারতীয় প্রচারমাধ্যম এবং পত্র-পত্রিকাসমূহ। এই প্রচারণার মধ্যে একটি অবহেলিত অঞ্চলের জনগন যে সংগ্রাম করে আপন ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন এবং আরোও নানা দাবীদাওয়া আদায় করে নিচ্ছেন, তার চাইতে অধিক কিছু ছিল।
পাকিস্তানের ভাঙ্গনের বীজটি অঙ্কুরিত হতে দেখে তাঁরা উল্লসিত হয়েছিলেন। সেই মনোভঙ্গীটুকুও প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো।
উলঙ্গ হুংকার এবং হম্বিতম্বির চাইতে ধীরে ধীরে সময় বুঝে কাজ করাই ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির বৈশিষ্ট্য। ঊনিশশো পঁয়ষট্রি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাঁদের আক্রমন মূলত পশ্চিম রণাঙ্গনেই সীমিত রেখেছিল। আক্রমনকারী হিসেবে উপস্থিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের মনোভাব বিগড়ে যাবে এই আশঙ্কা করেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বলেতে গেলে একেবারে অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানে স্থলপথে, জলপথে কিংবা বিমানপথে কোনো আক্রমণ করেনি। কোনোরকমের সামরিক হামলা না করে পূর্ব পাকিস্তানের জনমতকে জয় করার ইচ্ছাই ছিলো তার মূলে. এ কথা স্বয়ং ভারতীয় জেনারেল কাউলও তাঁর আত্মকথায় স্বীকার করেছেন।
ঊনিশশো পঁয়ষট্রি সালের ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধের পরে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পুনরায় সংগঠিত হয় এবং ছয়দফা আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ছয়দফার অন্তর্ভুক্ত দফাসমূহের একটি ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের লোক দিয়ে একটা প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করতে হবে, এবং অন্য একটি দফায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সুযোগ- সুবিধা মতো যে কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করার অধিকার।
ভারত এই ছয় দফার মধ্যে অন্তীষ্ট সিদ্ধির পথ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলো। পাকিস্তানের দুই অংশ যদি শ্লথভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, ভারতের প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসেবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেকাংশে কমে আসবে। পাকিস্তান যখন- তখন আর যুদ্ধের হুঙ্কার দিতে পারবে না। আন্তর্জাতিক শক্তিবর্গ সংহত পাকিস্তানকে যেভাবে অস্ত্র সাহায্য করে, অর্থ যোগান দিয়ে ভারতের সমপর্যায়ের একটি শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখত; শিথিল পাকিস্তান বৃহৎ শক্তিবর্গের দৃষ্টিতে সেরকম গুরুত্ব বহন করবে না। পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়লে তার যুদ্ধংদেহী মনোভাবে মনোভাব আপনা থেকেই প্রশমিত হয়ে আসবে। তখন বৃহৎ শক্তিবর্গ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ভারত-ঘেঁষা নীতি প্রণয়ন করতে বাধ্য হবে।
ছয়দফার একটা দফায় পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের অধিকারের কথা উচ্চারিত হয়েছিল। তাতেও ভারত নিজের স্বার্থটি খুব বড় করে দেখতে পেয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গে হুগলির পাটকলগুলো কাঁচামালের অভাবে প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান বিদেশে অঢেল পাট রপ্তানি করে এবং তাকে বিদেশ থেকে প্রচুর কয়লা আমদানী করতে হয়। ভারতের কয়লার বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাট আমদানি করতে পারলে চটকল শিল্পের মতো ভারতের একটি বুনিয়াদি শিল্পের সংকটের সহয সমাধান হয়ে যায়।
ইত্যাকার বিষয় বিবেচনা করে শুরু থেকেই ভারতের শাসক কংগ্রেস আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি একটি অনুকূল মনোভাব তৈরি করে রেখেছিল। ছয়দফা আন্দোলন যখন ধাপে ধাপে বেগ ও আবেগ সঞ্চয় করে সর্বস্তরের জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তার প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি উৎক্রান্তিতে আওয়ামী লীগ যে কৌশল এবং প্রচার পদ্ধতি গ্রহন করেছিল, ভারতের শাসক কংগ্রেস পত্রপত্রিকা এবং প্রচার মাধ্যমগুলোতে যে ঢালাও প্রচার করেছিল, তা ভারতীয় জনগনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর আন্দোলনের প্রতি একটি স্বত:স্ফূর্ত অনুরাগ জন্মলাভ করতে সহায়ক হয়।
ছয়দফা আন্দোলনের শেষপর্বে অহিংস অসহযোগ কর্মসুচী ঘোষণার পরবর্তী পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় জনগনের দৃষ্টিতে মহাত্মা গান্ধীর মানসপুত্র হিসেবে দেখা দিলেন।
অথচ শেখ মুজিবুর রহমানকে মহাত্মা গান্ধীর মত অহিংসামন্ত্রে বিশ্বাসী বলার কোনো উপায় নেই। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা থেকে পরিণতি পর্যন্ত সন্ধান করলে এমন প্রমান খুঁজে পাওয়া যাবে না যে তিনি অহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। সুতরাং তিনি অহিংস আন্দোলনকে শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক ট্যাকটিকস হিসেবেই গ্রহন করেছিলেন।
আর বাংলাদেশ আন্দোলন সত্যিকার অহিংস ছিলো না। বিস্তর হিংসাত্মক কার্যকলাপ সংগঠিত হয়েছে। জ্বালানো, পোড়ানো, লুটতরাজ এবং খুন জখমের অনুষ্ঠানও হয়েছে বিস্তর। আওয়ামী লীগ হাই-কম্যান্ড এসবের বিরুদ্ধে মৌখিক বক্তব্য রাখলেও থামানোর জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করেনি। তার ফলস্রুতিতে বিহারী এলাকাগুলোতে নানা রকম নৃশংস কার্যকলাপের অনুষ্ঠান ঘটে। এই নৃশংসতা দমনের অছিলা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঁচিশে মার্চের রাতের অন্ধকারে ঢাকা শহরের ঘুমন্ত নগরবাসীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ভারতীয় জনগনের পক্ষে বাংলাদেশি অহিংসা চোখে দেখার উপায় ছিলো না। তাঁরা কাগজে দেখেছেন, বেতারে শুনেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন।
২৫ মার্চের পর স্রোতের মত বাংলাদেশের মানুষ যখন ভারতে প্রবেশ করতে আরম্ভ করলো, উল্লিখিত কারনসমূহের দরুন ভারতীয় জনগন স্বত:স্ফূর্তভাবে তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। সর্বশ্রেনীর মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে রাজপথে নেমে এলো। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার এই জনমতকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রন করতে আরম্ভ করলেন যে বিরোধীদল সমূহেরও সরকারের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বাংলাদেশের কথা বলতে হলো। এক বাংলাদেশ সমস্যা সমস্ত ভারতীয় সমস্যা চাপা দিলো।
বাংলাদেশে একটি নতুন জাতি জন্মলাভ করার সংগ্রাম ছিলো, কিন্তু তার ধাত্রীর কাজ করছিলো ভারতের শাসক কংগ্রেস। শেক্সপীয়র সরনীতে প্রায় অভ্যন্তরীন আওয়ামী লীগের তাজুদ্দিন মন্ত্রীসভা একটা উপলক্ষ মাত্র ছিলো। .............................................।
[আহমদ ছফার ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ অবলম্বনে]
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৪৩