বাবার আদর কখন কিভাবে পেয়েছি জানিনা।
আহ্লাদিত হয়ে তার গলাটি কখনো জড়িয়ে ধরেছি কিনা মনে পড়ে না তাও।
অত্যন্ত কঠোর হৃদয়ের মানুষটির সঙ্গে মৃত্যুপূরির শুনশান নিরবতা নিয়েই যেন বড় হয়ে উঠেছি।
স্বাধীনতার পর চুয়াত্তরের শেষ দিকে আমাদের সেই বাবা পরিবারের সকলকে নিয়ে মাগুরা ছাড়লেন।
অল্প বেতনের ছোট্ট চাকরি নিয়ে পাড়ি জমালেন আমাদের জেলা শহর যশোরে।
সংসারে চার ভাই একটি বোন।
পাহাড় সমান অভাব নিয়ে বাবার চেহারাখানা সব সময় যেন রুক্ষ হয়ে থাকে।
আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি দূরে। আর আমাদের মা সেই অভাবি বাবাকে যেন আল্লাহর মতো ভয় পান।
অত্যন্ত শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় বাবার জন্য আমার মায়ের আপনি-তুমি দু’ধরণের সম্বোধন দেখে আসছি সেই না বোঝার বয়স থেকেই।
একবার টু-থ্রীতে পড়ি এমন সময়কার কথা। সেটি আশি বা একাশি সাল।
গায়ে প্রচণ্ড জ্বর।
মা সারাদিন মাথায় পানি ঢালেন। কিন্তু জ্বর কোন ভাবেই ছাড়ে না।
এমন অবস্থায় মায়ের সকরুণ আর্তিতে বাবা আমাকে কাঁধে তুলে নিলেন।
আমরা তখন থাকি যশোরের বাবলা তলা। স্টাফ কোয়াটারে।
সেখান থেকে ডাক্তার বাড়ি পুরাতন কসবা। পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের পথ।
এই দূরত্ব যেতে বাবা কখনো আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কখনো মুখের খোচা খোচা দাড়ির সঙ্গে মুখটি ঘসেন পরম মমতায়। কখনো আবার কাধে তুলে নেন।
আর আমি আনন্দে আত্মহারা। শারীরের অসুস্থ্যতা ভুলে যাই নির্ণিমেষে। হাত দুটিকে প্রসারিত করে উড়তে থাকি পাখির মতো করে।
বাবা যেন সেদিন আমাকে দিয়েছিলেন এক আকাশ ভালবাসা। যে আকাশে আমি পরম আনন্দে ডুব সাতার খেলেছি। আর জলের স্পর্ষে তাকে ছুয়ে দেখেছি অত্যন্ত নির্ভরতায়। এই আমার বাবা, এই আমার নির্ভরতা আর নির্ভাবনার প্রতিমূর্তি।
এরপর বদলির কারণে বাবা চলে গেছেন আরো দূরে। আর মা আমাদের নিয়ে ফিরেছেন আবার মাগুরাতে।
সপ্তাহে, কখনো মাসে একদিন বাড়িতে ফিরেছেন বাবা। আর মা তার কোমল ডানার নিচে বড় করেছেন আমাদের।
কিন্তু জানি বাবা আছেন আমার নির্ভরতার সঙ্গী হয়ে।
........এ বছরের জানুয়ারিতে আমার সেই নির্ভরতা আমার বাবা ছেড়ে গেছেন আমাদের।
মাথার উপর এখনো বিশাল আকাশ। সেই আকাশে বাবাকে খুজি। আর ক্লান্ত হয়ে চোখ দুটি যেন কেবলই ঝাপসা হয়ে ফিরে আসে।
ঝাপসা হয়ে ফিরে আসে।