somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় বোনের ভালোবাসা....

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ ভোর ৬:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছোট বেলা থেকেই বড় আপুর কাছে আমি বেড়ে উঠেছি। আমাকে ঠিক মায়ের মতোই সযত্নে লালন পালন করেছেন বড় আপুমনি। আমার স্কুলের পড়া-লেখা থেকে শুরু করে খাওয়া, দাওয়ার সমস্ত কিছু বড় আপুই করতেন। শুধু তাই নয় স্কুল থেকে ফিরে আসার পরও সমস্ত দায়িত্ব আপুর উপরেই ছিলো। একটু যে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন সে সময়টুকু হতো না কারণ বড় মেয়ে হিসাবে ঘরের সমস্ত কিছুর দেখা শুনা ও করতে হতো আপুকে একাই।

আপুর কোরআন তেলাওয়াতোর শব্দেই প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙ্গতো। ঘুম থেকে উঠে পাখিদের কিচির মিচির শব্দে যখন চারিপাশ মুখরিত থাকতো ততক্ষনে আপু নামাজ শেষ করে উনুনে আগুন ধরিয়েছেন। শান্ত স্নিগ্ধ ঝিরঝিরে বাতাসের সকাল। আমাদের বাড়ির চারপাশে ও সামনে বিভিন্ন রকমের গাছ গাছালিতে ভরে আছে। পেয়ারা, লিচু, কুল, আম, জাম, কাঁঠাল, সহ নানান প্রজাতির গাছ। সেখানে প্রতিদিনই পাখপাখালির মেলা বসে। দোয়েল, বুলবুলি, কাঠঠোকরা চমৎকার ডাকাডাকি ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ছোট বেলা থেকেই প্রকৃতি আমাকে আকর্ষণ করতো। আমি প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে চাইতাম। এসবের সংস্পর্শে থেকে ভেতরে অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করতো। আমার ছোট্ট পৃথিবীটা ফুলে ফলে সব সময়ই ভরপুর থাকতো। কোন রকম চিন্তা নেই, ক্লেশ নেই, নেই কোন পিছুটান। বাড়ির ছোট ছেলে হাওয়ার জন্য সবাই মাথায় করে রাখতো।

আমি প্রতিদিন সকাল ৬:০০ টার সময় স্কুলের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বের হতাম এবং আমার ক্লাস শুরু হতো ৭:০০ টা থেকে। তাই আপু ফজরের নামাজ শেষ করেই গরম হোক কিংবা কনকনে শীত ব্যস্ত হয়ে পড়তেন সকালের নাস্তা তৈরীর কাজে। রান্না-বান্না, ঘরের কাজ সকাল থেকে শুরু করে শেষ রাত পর্যন্ত চলতো একটানা। তখন সময়ে আমাদের মাটির ঘর ছিলো যে কারণে শীতে ও বাহিরেই রান্না করতে হতো। মাঘ মাসের তীব্র শীত যখন সবকিছু গ্রাস করে নিতো তবু আপু ঠিক সকালেই ফজরের পর লেগে যেতেন বিরামহীন কাজে।

আপু দেখতে ঠিক পরীর মতো সুন্দর ছিলেন। এত সুন্দর মেয়ে আজকাল আমার চোখে তেমন পড়ে না। আপুর নিয়মিত নামাজ, কোরআন পড়া এবং সুন্দর ভাবে চলাচলের কারণে গ্রামে সবাই আপুকে অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতো। মানুষের মুখে আপুর সুনাম শুনে মনটা ভরে যেতো। অন্যান্য গাছ গাছালির মতো আমাদের বাড়ির চারিদিকে ছিলো সারি সারি সুপারি গাছ ও পুকুর পাড়ে নারিকেল গাছ। আপু মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে সেসব জায়গায় হাঁটাহাটি করতেন। শুনাতে মজার মজার সব রহস্যে ভরা গল্প। গল্প শুনে যেমন আনন্দ পেতাম তেমনি ভয় ও পেতাম। সবার ভালোবাসায় বেশ আনন্দে কেটে যাচ্ছিলো আমার শৈশব।

আস্তে আস্তে আমি ও বড় হতে লাগলাম এবং আপুর অক্লান্ত পরিশ্রমে আমিও ভালো রেজাল্ট করে গেলাম। আপু যে শুধু মায়া, মমতায় বড় করছেন তা ও কিন্তু নয়। কড়া শাসন ও করেছেন পড়া লেখার জন্য। সব কিছু নিয়ম মতো করতে হয়েছে। নিয়মের বাহিরে যেতে পারিনি কখনো। একবার আপুর জন্য একটা প্রস্তাব আসলো বড় পরিবার থেকে। পাত্র লন্ডন প্রবাসী। ছেলের পক্ষ থেকে পাত্রের ছোট ভাই আসলো নির্ধারিত সময়ে উকিল সাহেবের সাথে। তাদের খুব ভালো ভাবেই আমরা আতিথিয়তা করেছিলাম। পাত্রের ছোট ভাই যাওয়ার আগেই আপুকে ভাবি বলে সম্বোধন করা শুরু করলো। বুঝাই গেলো আপুকে যতেষ্ট পছন্দ হয়েছে। উকিল সাহেব যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ছেলেটি তার ভাবি হিসাবে আপুকে খুব পছন্দ করেছে।

এভাবে সময় ও কাটতে লাগলো এবং আপু ঠিক আগের মতোই সব কিছু দেখা শুনা করতে লাগলেন। ক্লান্তিহীন কাজ করে গেলেন পরিবারের জন্য। আমার অন্যান্য বোনেরা ও আপুকে কাজ-কর্মে সহযোগিতা করতেন কিন্তু তা ছিলো অতি সামান্য। ইচ্ছে হলে করতো আর না হলে নাই। পরিবারের বড় মেয়েদের হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই। হয়তো এ জন্য অন্য বোনরা কাজ কর্মের প্রতি উদাসীন থাকতেন।

দেখতে দেখতে আমাদের নতুন ঘরের কাজ মোটামুটি শেষ হলো। তখন আমি ক্লাস পাইভে উঠেছি। ক্লাসে আমার রোল হয়েছে তিন (৩)। আপুর মন ভরেনি এই রেজাল্টে কারণ তিনি পরিশ্রম করতে কম করেননি আমার জন্য। এই বার তিনি কড়া ভাবে নির্দেশ দিলেন পড়া-লেখায় মনোযোগ দিতে হবে আরও ভালো ভাবে পড়া শুনাতে মনযোগী না হলে খানা-দানা সহ যাবতীয় সব কিছু বন্ধ করে দিবেন। আমি প্রতিদিন বিকেল বেলায় কার্টুন দেখতাম। কার্টুন দেখাটা ছিলো আমার কাছে নেশার মত এবং আপু আমার এই দুর্বল জায়গায় আঘাত আনলেন। কার্টুন দেখা বন্ধ করে দিলেন।
কিছু দিন বুকে পাথর চাপা দিয়ে ভালো ভাবে পড়া শুরু করলাম এবং আপুর মনে একটা দয়া-মায়ার উপদ্রোপ হলো যে কারণে আবার সব কিছু আমার প্রতিকুলে চলে এলো।

সময় ও থেমে থাকেনি, সময় চলছে সময়ের গতিতে। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে এবং বেশ ভালো ভাবেই পরিবার নিয়ে সময় কাটছে আমাদের। সবার আদরে আদরেই কেটে যাচ্ছিলো আমার মধুর শৈশব। পাত্র পক্ষ আবার এসেছে সময় মতো কিন্তু এখানে আপুকে বিয়ে দিবেন না বলে সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন। কোন কারণে বিয়ে দিবেন না আমি ছোট থাকায় এসব বুঝতে পারিনি তবে যাওয়ার সময় পাত্রের ছোট ভাইয়ের কান্না দেখেছি। যদিও সরাসরি না এখানে করেনি কেউ তবে ফোন করে জানিয়ে দিবেন বলে সবাই একমত হলো। একদম ছোট মানুষের মতোই কেঁদেছিলো বেঁচারা। ছেলেটির বয়স ১৯ থেকে ২০ হবে। হয়তো সে আপুকে ভাবি হিসাবে খুবই পছন্দ করেছিলো যে কারণে না শব্দটি বুঝতে পেরে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি।

কিছুদিন যেতে না যেতেই আপুর বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের পর আপু আমাদের বাড়িতেই থাকতেন কারণ ভাই প্রবাসী ছিলেন এবং তিনি আমাদেরই আত্মীয়। এক সময় আপু আমাকে ছেড়ে পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রের পথে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে খুব খুশি লেগেছিলো এই ভেবে যে, “এখন আমি স্বাধীন ভাবে উড়বো মুক্ত পাখির মতো।” কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই আপুর অভাব আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আপু যাওয়ার পর আমার সব কিছু এলো মেলো হতে শুরু করে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাওয়ার মত হয়, মনের আকাশে জমাট বাঁধে কালো মেঘের ছায়া।

দেখতে দেখতে আমি স্কুল শেষ করি এবং কলেজে ভর্তি হই। তবে আমার জীবনে আপুর শূন্যতা থেকেই যায়। যে শূন্যতা কেউ কখনো পূরণ করতে পারেনি। আপুর জন্য মাঝে মাঝে আমি ঘুম থেকে কেঁদে উঠতাম। দু’চোখের নুনা জল মিশে একাকার হয়ে যেতো। নির্ধারিত সময়ে আমি কলেজ পাস করেছি। এর ভিতরে আপুর এপ্লাইয়ে আমার মা-বাবা ও চলে যান আমেরিকায়। আমার বাহিরে বাহিরে থেকে তখন লেখা পড়া করছি। শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে আমার পৃথিবীটা আরও ছোট হয়ে আসে। কলেজ পাস করে আমি তখন “সমাজ বিজ্ঞান” নিয়ে সিলেটের এম.সি. কলেজে ভর্তি হয়েছি। ততদিনে আব্বা আমার জন্য ইমিগ্রেশন এপ্লাই করে রেখেছেন। এক বছর পরে আমার ও সময় আসে মা-বাবা ও বড় বোনের সাথে দেখা করার। কতদিন আপুর চাঁদের মতো মুখ দেখা হয়নি আমার। কত কিছু ভেবে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। খুশির অশ্রু মুছে ফেলি দু’হাতে। শ্রাবণের আকাশ একদম পরিষ্কার হয়ে আছে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে সবাই আমার খুশিতে নেচে গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে। কর্কশস্বরের কাকের ডাকটাও আজ বেশ লাগছে। নাম না জানা অথচ চেনা ক’টি পাখির ডাকও প্রকৃতির সুর ব্যাঞ্জনাকে মোহিত করে তোলে।

কিছুদিন পরেই চলে আসি স্বপ্নর দেশ আমেরিকায়। এয়ারপোর্টে আপুকে দেখতে পাই সাথে ভাই ও আব্বা ছিলেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর আপুর সাথে দেখা। সব কিছুই আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো। প্রায় এক যুগের সব মান অভিমান শেষ হয় সবার চোখের অশ্রুতে। বিমানে সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি আমার। কয়েকটি কেক খেয়েছিলাম মাত্র। ক্ষুধার যন্ত্রনায় মুখ শুকিয়ে কাঁঠ হয়ে গিয়েছিলো আমার। ক্লান্ত শরীরে বসায় পৌঁছে দেখি আমার প্রিয় সব রকমের খাবার আপু আগেই রান্না করে রেখেছেন। আপুর হাতের রান্না তৃপ্তির সাথে খেলাম বহু বছর পর যেন অমৃত স্বাদের!

দেখতে দেখতে প্রায় পাঁচটি বছর চলে গেলো যুক্তরাষ্ট্রে। বেশ কিছু মাস ধরে আপুর সাথেই আমি থাকি। সময় ও স্রোতের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু আপু আগের মতোই আছেন, ভালোবাসায় সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি। আপুর ৫ ছেলে মেয়ের সংসার কিন্তু এখনো আমার যত্ন নেন ঠিক আগের মতোই। আপু আমাকে এখনও মায়া-মমতা ও ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন মায়ের মতো। এমন ভালোবাসা পৃথিবীর বুকে থাকবে চিরসবুজ ও অমলিন.......


ছবি: সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ ভোর ৪:৫২
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×