somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চংকিং (Chongqing): চীনা কসমোপলিটন শহরঃ আমার ভ্রমণ বিড়ম্বনা (!)

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



[ নিবেদনঃ বেশ বড়সড় পোষ্ট ! বিরক্ত হওয়ার অধিক সম্ভবনা ! তাই চা-টা নিয়ে পড়া শুরু করার সুপারিশ করা হল !!! :) :) :)]

ভ্রমণে বিড়ম্বনা আমার নিত্যসঙ্গী! আমি কোথাও যাব আর এই যাওয়া নিয়ে কোনরূপ ঝামেলা হবে না এই রকম আশা আমি কখনোই করি না! তাই ইদানিং এই সকল বিষয় নিয়ে আর খুব একটা ত্যাক্ত-বিরক্ত হই না, ব্যাপার গুলো সহজ ভাবে নিয়ে এই সকল ঝামেলা গুলোর ইন্নোভেটিভ সমাধানে মজা খোঁজার চেষ্টা করি। অতীতে বাস, ট্রেন আর লঞ্চ অসংখ্যবার মিস করার রেকর্ড আমার অভিজ্ঞতায় থাকলেও এইবার ফ্লাইট মিস করার রেকর্ড দিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলির ষোলকলা পূর্ণ করলাম :) । আমি দুই চার মিনিট দেরীতে গিয়া বাস ট্রেন খুব কম সময়ই ধরতে পেরেছি :( এই নিয়ে আগেও লিখেছি ।

প্রথমবারের মত চীন দেশে যাব এবং কর্মসূত্রে সংযুক্ত এই ভ্রমণের সূচীও বেশ দীর্ঘ। ছয়দিনে তিনটি বড় বড় শহর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। শুরুতেই সহযাত্রীরা একদিন আগে চলে গেলেও কর্মক্ষেত্রের অনিবার্য জটিলতায় আমাকে একদিন পরে যেতে হচ্ছে বলে এই নিয়ে বেশ খচখচ করছে। যাই হোক এতো প্রতিকূলতা ঠেঙ্গিয়ে যাওয়া হচ্ছে এতেই আমি খুশী কারণ চীন দেখার ইচ্ছা দীর্ঘদিনের।

নতুন যেকোন যায়গায় যাওয়া ঠিক হলেই আমার প্রথম কাজ হলো ওই যায়গার উপরে ছোট-খাটো পিএইডি মার্কা গবেষণা করে ফেলা :)। গুগলমামুর চিপা-চাপায় যা আছে খুঁজে-খুঁজে বের করা। লোনলি প্লানেট আর ট্রিপ এডভাইজার দেখে দেখে সম্ভাব্য কোথায় কোথায় কি ভাবে আর কম খরচে যাওয়া যায় তার একটা তালিকা তৈরি করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসতঃ কর্মক্ষেত্রের চাপে পরে আর যাওয়ার আগের সপ্তাহে ঢাকার বাইরে অন্তঃজালের সুবিধা বঞ্চিত যায়গায় থাকার ফলে এইযাত্রায় পিএইচডি তো দূরে থাক সাধারণ তথ্যও সংগ্রহের সুযোগ পাই নাই :( যার ফল প্রতি পদে পদে দিতে হয়েছে :(। যখন সুযোগ পেলাম তখন আকাশযাত্রার জন্য বিমানে আরোহনের ঘোষনা দিয়ে দিয়েছে।


গোয়াংজু এয়ারপোর্ট

যাই হোক, ওই যে বলছিলাম আমার ভ্রমণের সাথে বিভিন্ন অনির্ধারিত জটিলতার কথা ! আগেরদিন আমি যখন এক জটিল মিটিং এর চিপায় পরে মোটামুটি যখন খাবি খাচ্ছি তখন সঙ্গী-সাথিদের ফোন পেলাম তারা সহী-সালামতে বোর্ডিং এর জন্য অপেক্ষা করছে, একেই বলে কপাল :)। এদিকে বলা নেই কওয়া নেই শেষ বিকেলে খবর পেলাম আগামী কাল ‘হরতাল’ ! এই খবরে তো আমার চীন যাত্রা আবার ‘চাংগে’ (পড়তে পারেন ‘Rooftop’) উঠার দশা। আপনারা আবার ভাববেন না হরতালে আবার এই যাত্রা কিভাবে বাঁধাগ্রস্ত হবে, বিমানবন্দর পর্যন্ত কোনভাবে পৌঁছাতে পারলেই তো হল। আসলে বিষয় ওইটা না, মূল বিষয় হচ্ছে পরের দিন আমার অনুপস্থিতে কর্মকাণ্ড যেভাবে পরিকল্পনা করা হরতালের কারণে তার বড়ধরনের ছন্দ-পতন ঘটবে। যাই হোক চীনে তো যেতেই হবে তাই বিকল্প ব্যবস্থায় লেগে গেলাম। যেখানে প্লান ছিল তারাতারি বাসায় ফিরে বাক্স-পেটরা গুছিয়ে গুগলে অর ট্রিপ এডভাইজারে ঢুঁ মারা সেই আশায় গুড়ে বালি। বাসায় বেশ দেরীতে ফিরেও সেই বিকল্প ব্যবস্থার বিভিন্ন কিছু সাইজ করতে করতে সর্বশেষ ইলেকট্রনি্ট-ডাকটি পাঠিয়ে যখন মাল-সামানা গোছানোর সুযোগ পেলান তখন ঘড়ির কাঁটা মাঝ-রাত্রির মাত্রা বহুত আগেই পাড় করেছে।

সকালেও সেই বিষয়ের ফলোআপ দেখতে দেখতে দুপুর ১২টার ফ্লাইট ধরতে বিমান বন্দরে পৌঁছালাম তখন ১০:৩০ র বেশী বাজে। চেকইন কাউন্টারের সেবাপ্রদানকারী তরুনীর কাছে পাসপোর্ট আর টিকেট সমার্পন করে, ব্যাপক বিগলিত হাসি দিয়ে জানালা বরাবর আর তা সম্ভব না হলে অন্ততঃ আইল বরাবর একটা সিট দিতে অনুরোধ করলাম :)। যদিও এতো দেরীতে এসে জানালা বরাবর সিটের অনুরোধ করা বৃথা তার পরেও চেস্টা করতে তো দোষ নাই। তড়িৎকর্মা তরুণী খুট খুট করে কি বোর্ড চেপে দ্রুত গতিতে প্রিন্ট-ট্রিন্ট নিয়ে মাল-সামানায় ট্যাগ লাগিয়ে আমাকে বোর্ডিং পাশ দিয়ে মিস্টি হাসি দিয়ে বলল স্যার দিয়ে দিয়েছি। আমি তো তার সেবায় ব্যাপক মুগ্ধ, খুশীমনে :) পাসপোর্ট আর বোর্ডিং পাশ নিয়ে ইমিগ্রেশনের আনুষ্টানিকতা শেষ করে বোর্ডিং গেটে গিয়ে বসলাম। দমটা ফেলে গুগল মাত্র খুলেছি এই সময়েই বোর্ডিং এর আমন্ত্রন। আমার চীন যাত্রার প্রথম গন্তব্য হিসেবে চংকিং শহরে পদার্পন করবো। আপাতঃগন্তব্য গোয়াংজু, সেখান থেকে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কানেক্টিং আভ্যন্তরীন ফ্লাইটে কংচিং যাব।


গোয়াংজু এয়ারপোর্টে বোর্ডিং গেট কানায় কানায় পূর্ণ

যথারীতি বিমানে আরোহন করে খুঁজে খুঁজে সিটের সামনে গিয়ে আমি মাঝারি মানের টাসকি খাইলাম। সিট জানালার কাছে তো দূরে থাক আইলেও না, তিন সিটের সারিতে আমার সিট মাঝ-খানে :( এবং তাও আবার ইমারজেন্সি দরজার পাশে। যাই হোক এইটা আর নতুন কি? আমার যাত্রায় এই রকম হবে না তো কার হবে :(। মনে মনে বেশ বিলা হয়ে সিটে বসতে না বসতেই কেবিন ক্রু এসে ইমারজেন্সি ডোরের মহাত্ত্ব আর সত্যিকারের ইমারজেন্সি হলে এই সিটের বসনেওয়ালা হিসাবে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে বয়ান করে গেল। তবে বসার কিছুক্ষন পরেই এই সিটের আসল মাহত্ত্ব টের পেলাম। বোয়িং ৭৩৭-৮০০ সিরিজের বিমান বেশ ছোট ১৫০-১৬০ জনের মত যাত্রী ধারন ক্ষমতা, দুই পাশে তিনটি তিনটি করে ছয়টি সিট বেশ চাপাচাপি আর সামনের লেগ স্পেস ও অনেক ছোট। কিন্তু ইমারজেন্সি দরজার সামনে হওয়াতে আমাদের লেগস্পেস অনেক বড় মোটামুটি অন্য সিটের ডাবলের মত। আমরা বেশ পা টান টান করে আশেপাশের সিটের যাত্রীদের কিছুটা হিংসার পাত্র হয়ে আরামসে বসলাম। সিটের অবস্থান দেখে শুরুতে চেকইনের সেই তরুণীর প্রতি বেশ বিরক্ত হলেও পরে মনে হচ্ছিল এই মেয়ে আসলেই ব্যাপক দায়িত্ববান আর যাত্রীর আশা-আকাংখা বোঝার অদৃশ্য শক্তি তার আছে ! তার কাজকর্মের আরোও উন্নতি কামনা করতে করতে আমারা গোয়াংজু’র উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম।



কংচিং নগরে বহুতল বসতি

প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়াউড়ি শেষ করে গোয়াংজুর স্থানীয় সময় বিকেল ৫:৪০ টায় গোয়াংজু এয়ারপোর্টে নামলাম। বেশ ঝা-চকচকে আর বড় এয়ারপোর্ট। আমার কানেক্টিং ফ্লাইট ৭:২০ টাতে। ইমিগ্রেশনের লাইনের আগেই দেখি বিরাট জটলা, লাইনে যায়গা নাই বলে পুলিশ একটা যায়গাতে লোকজনকে আটকে দিচ্ছে। লাইনে যায়গা খালি সাপেক্ষে যেতে দিচ্ছে। শুরুতেই চীনের ব্যাপক জনসংখ্যার সরব উপস্থিতি টের পেলাম (পরে অবশ্য এই ধারনার পরিবর্তন হয়েছে)। এদিকে আমার ফ্লাইটের সময় বেশী নাই, এই সময়ের মধ্যে আমার ইমিগ্রেশন শেষ করে, মাল-সামানা সংগ্রহ করে আবার বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নির্ধারিত গেটে যেতে হবে, এয়ারপোর্ট বেশ বড় আর যেহেতু আমার আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট তাতে মনে হচ্ছে আমাকে আভ্যন্তরীণ টার্মিনালে যেতে হবে। পরে আমি যখন ইমিগ্রেশন লাইনে দাড়ানোর সুযোগ পেলাম তক্ষনে ৬:০০ বেজে গেছে। প্রায় ১০/১৫ মিনিট ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও খুব একটা আগাতে পারলাম না, এদিকে সময় দ্রুত গতিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে! পরিশেষে উপায়ন্তর না দেখে ইমিগ্রেশন পুলিশের দারস্থ হলাম। তাকে অনুরোধ করলাম যেহেতু আমার ফ্লাইট টাইম আসন্ন তাই আমাকে যেন প্রায় ফাঁকা “প্রায়োরিটি লাইনে” দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া হোক। পুলিশ সদস্য বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে আমাকে ‘প্রায়োরিটি লাইনে’ দাড়া করিয়ে দিল তাতে আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাগেজ বেল্টের দিকে দৌড় দিলাম ততক্ষনে ঘড়ির কাঁটা ৬:৩০ এ। চেক-ইন কাউন্টারেও যথারীতি লম্বা লাইনে আমি আবারো প্রায়োরিটি লাইনে গেলাম। বোডিং পাশের জন্য যখন পাসপোর্ট আর টিকিট দেখাতেই তারা আমাকে হতাশ করে দিয়ে জানালো এই ফ্লাইট আমি আর ধরতে পারবো না কারন এর বোর্ডিং ততক্ষনে কমপ্লিট হয়ে গেছে। ততক্ষনে আমার মাথা মোটামুটি খালি :( ব্যাপক হাউকাউ শুরু করার প্রস্তুতি নিতে না নিতেই কাউন্টারের উপস্থিত মেয়েটি বলল। কোন সমস্যা নাই স্যার! আপনে টেনশন নিয়েন না, মাত্র দেড় ঘণ্টা পরেই আরেকটা ফ্লাইট আছে আপরে সেইটাতে বোর্ডিং পাশ দিয়ে দিচ্ছি। যাই হোক, মন্দের ভালো দেড় ঘণ্টা সময় তো পাওয়া গেল এখন ধীর স্থিরে পরের ফ্লাইট ধরা যাবে। কিন্তু সমস্যা তো তৈরী হল, আমাকে পিক-আপ করতে আসার গাড়ী তো মনে হয়ে ফেরত যাবে। তাই ভাবলাম বোর্ডিং গেটে গিয়ে চংকিং এ আমার টিমমেট দের একটা মেসেজ দিতে হবে। সত্যি সত্যি টার্মিনাল অনেক বড় এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে গাড়ীতে যেতে হয়। বোর্ডিং গেটে এসে ট্যাবে ওয়াই-ফাই সংযোগ চালু করে প্রথমে ফেসবুক চালু করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম, পরে মনে পরলো চীনদেশে তো ফেসবুক হারাম! এর পরে একে একে গুগল, জিমেল, ইয়াহু মেইল সব গুলাই চালু করতে বাধ্য হলাম, স্কাইপ ও যাথারীতি ফেইল :( শেষে কিঞ্চিত ভগ্নমনোরথে সব বন্ধ করে টার্মিনালে ঘুরাঘুরি করা শুরু করলাম। পরে জেনেছিলাম আমার টিম মেটরা আমাকে ভাইবার এ মেসেজ দিয়েছিল আর মাই সব কিছু চেক করলেও ভাইবার চেক করি নাই।




চংকিং শহরের সুউচ্চ ভবন

যথাসময়ে উড়াল দিয়ে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে চংকিং এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম। চংকিং এয়ারপোর্টও আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট তবে আমি আভ্যন্তরীণ যাত্রী হওয়ার কারণে আভ্যন্তরীন টার্মিনালে অবতরণ করেছি। মাল-সামানা সংগ্রহ করে দেখলাম আমার জন্য কেও অপেক্ষা করে নাই এ দিকে ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুই ছুঁই। প্রথমে ডলার বদলিয়ে চীনা মুদ্রা ‘আরএমবি’ নেয়ার জন্য একচেঞ্জ বুথে গিয়ে দেখলাম বুথ ১০ টায় বন্ধ হয়ে গেছে। আর কোন বুথ আছে কি না জিজ্ঞাসা করাতে কেউ কোন উত্তর দেয় না। আমি ‘টিউব লাইটের’ মত একটু দেরীতে বুঝলাম এরা কেউও ইংরাজী বুঝতে পারছে না। এদিকে আমার যথেষ্ঠ ক্ষুধা পেয়েছে, একেতো ছিল আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট আর ডিনার টাইমের পরে রওনা হওয়ার জন্য ফ্লাইটে তেমন কোন খাবার দেয় নাই। সামনে একটা ম্যাকডোনাল্ডের আউটলেট দেখতে পাচ্ছিলাম কিন্তু চিন্তা করছিলাম আগে খেয়ে নিব না আগে হোটেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো। এদিকে আরেক সমস্যা হলো ডলার যেহেতু ভাংগানো যাচ্ছে না আমার কাছে কোন স্থানীয় মুদ্রাও নাই, ম্যাকডোনাল্ডে গেলেও স্থানীয় মুদ্রার অভাবে বিল দিতে পারবো না। অবশেষে হোটেলে যাওয়াই মনঃস্থির করলাম।

এবার প্রথমে এয়ারপোর্টের পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম যে এয়ারপোর্টের ট্যাক্সি স্টান্ড কোথায়? সে প্রথমে শুনে একটু চিন্তা করে কানের কাছে হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালো সে বোঝে নাই। এর পরে আমি বেশ কয়েক জন ভদ্র মহিলা ও ভদ্র লোক কে জিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর পেলাম না। প্রথমে তারা চোখ বড় বড় করে শোন আর আমি আশাম্বিতঃ হই পরে যথারীতি কানের কাছে হাত দিয়ে ইশারায় দেখায় বুঝে নাই। দুই এক জন আবার বললো ইংলিশ...! ইশারায় বললো নো...!! আমি তো মহা মুশকিলে পরলাম, এদিকে রাত বেড়ে চলছে আর টার্মিনাল দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। উপায়ন্তর না বুঝে আমি একটু দূরে চলমান ট্যাক্সির দিকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম ট্যাক্সি...... ট্যাক্সি...... এরা তাও বোঝে না!




নান্দনিক স্থাপত্যকলা

আমি যখন এই কমিউনিকেশনের সমস্যায় খাবি খাচ্ছি তখন উড়া-ধূড়া টাইপের এক লোক আমার দিকে দৌড়ে আসল বললো ট্যাক্সি...... ট্যাক্সি......?? আমি মোটামুটি জানে পানি পাইলাম। আমি বললাম ইয়েস...ইয়েস সাথে সাথে আমার সাথে নেয়া হোটেলের ঠিকানার প্রিন্ট কপি ভাগ্য ভালো বুদ্ধি করে ইংরাজী আর চীনা দুই ভাষাতেই ছিল। লোকটার বেশভূষা দালালদের মত হলেও আমার কাছে তখন সে সাক্ষাৎ দেবদূত :)। সে ঠিকানা দেখেই বললো থ্রি হান্ডেত আরএমবি, যদিও আমার জানা নাই আসলে ভাড়া কত আমি ইচ্ছা করেই বারগেনিং এ গেলাম আমি বললাম ওয়ান হান্ডেড :( সে বোঝে না। মর জ্বালা বারগেনিং ও বোঝে না :(। আমি পরীক্ষা করার জন্য বললাম হোয়াট ইজ ইওর নেম জেন্টেলম্যান, যে যথারীতি ঘাড় নাড়ে আর বলে ‘থ্রি হান্ডেত...... থ্রি হান্ডেত”। আমি ব্যপক হতাশ হয়ে কপালে যা আছে এই চিন্তা করে ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। এদিকে আমার পকেটে তো লোকাল মুদ্রা নাই কিন্তু আবার কোন জটিলতায় পরি এই চিন্তায় আমি কিছু বললাম না। আমার ভরসা যে হোটেলে তো যাচ্ছিই আর অভিজ্ঞতায় দেখিছি হোটেলে সুন্দর মুদ্রা বিনিময় করা যায়।

প্রায় ৩০/৩৫ মিনিট পরে ট্যাক্সি আমাকে হোটেলে নিয়ে আসলো কিন্তু আমি যথারীতি কনফিউজড। এইটা যে একটা হোটেল তা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু আমাদের বুক করা হোটেলেই এসেছি কিনা তা বুঝতে পারছিলাম না। কোথাও কোন ইংরাজী সাইন বা লেখা দেখছিলাম না। কাউন্টারে দুই জন মেয়ে ছিল আর দূরে সোফাতে এক পোর্টার ঝিমাচ্ছে। আমি পরিচয় দিয়ে আমাদের বুকিং এর কথা বললাম, তারা দুই জনই চোখ বড় বড় করে শুনে না বোঝার সাইন দেখালো। এবার আমি ওদের কে ডলার দেখিয়ে বললাম চেঞ্জ দাও আমি ট্যাক্সি ভাড়া দেব, যথারীতি এবারো না। এদিকে ট্যাক্সি ওয়ালা তাগাদা দিচ্ছে, সে চলে যেতে চাইছে। আমি সরাসরি ট্যাক্সি ড্রাইভার কে ডলার অফার করলে সে তো ব্যাপক ক্ষেপে গেল সে তার ভাষাতে বকর-বকর শুরু করলো। আমি পরলাম মহা পেজগিতে, পরে হোটেলের রিসিপশন কাউন্টারে উকি দিয়ে ওদের মানি রিসিপ্টে ইংরেজী নাম দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে আমি ঠিক হোটেলেই এসেছি। এর পর আমি তাদের বুঝানোর সকল হাল ছেড়ে দিয়ে যখন আমার সবুজ পাসপোর্ট বের করেছি তখন দেখি মেয়েদের মুখে খুশীর ঝিলিক দেখা গেল। অনেকে আমাদের এই সবুজ পাসপোর্টে অনেক নাজেহাল হলেও আমি ব্যাপক উপকৃত হলাম। সবুজ পাসপোর্ট চিরজীবি হোক!!! কাউন্টারের মেয়েটি তারাতারি একটা লিস্ট বের করলো যেখানে আমাদের পুরো টিমের নাম আর রুম নম্বর ছিল। আমি আমার টিমমেট সহকর্মী যে এই প্রোগ্রামের ব্যাবস্থাপনায় ছিল তাকে তার রুমের নম্বরে ফোন করলাম কিন্তু ধরলো আরেক জন, পরের বারো একই অবস্থা। পরে জেনেছিলাম কমিউনেকেশনের এই জটিলতার কারনে তাদের রুম নম্বরো এলোমেলো হয়েছিল। অবশেষে মেয়ে দুইটিকে অনেক কস্টে বুঝালাম যে ট্যাক্সিওয়ালা কে বলতে যে আমার কাছে ডলার ছাড়া আর কিছু নাই। ওরাও মনে হলো ট্যাক্সিওয়ালাকে অনেক কস্টে বুঝালো, এরপরে হিসাব করে সমমানের ডলার তাকে দিলাম। অবশেষে এই সব ক্যাচাল শেষ করে আমি রুমে গেলাম রাত ২টার পরে পরে। অনুরূপ ভাবে আমি যে ক্ষুধার্থ তাও বুঝাতে অনেক কষ্ট করতে হলো। হোটেলের পোর্টার আমাকে এক কাপ ইন্স্ট্যান্ট নুডুলস এনে দিল। ইলেকট্রনিক কেটলি তে পানি গরম করে এই নুডুলস তৈরী করে খেয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম !



চংকিং স্কাইক্যাপারস

যাকগে! অনেক ভোগান্তির কথা হলো এবার চংকিং সম্পরকে কিছু জানার চেষ্টা করি। চংকিং সিচুয়ান প্রদেশের অন্তর্গত দক্ষিন-পশ্চিম চীনের প্রধান শহর। প্রশাসনিক ভাবে চীনের কেন্দ্র শাসিত চারটি বড় শহরের একটি চংকিং, বাকি তিনটি হলো বেইজিং, সাংহাই ও তিয়ানজিং। চংকিং মিউনিসিপ্যালিটির আয়তন মোট ৮২,৪০৩ বর্গ কিলোমিটার হলেও মূল শহর এলাকা ৫,৪৭২ বর্গ কিলোমিটার এবং মূল শহরের লোকসংখ্যা ১.৮৩ কোটি। মিউনিসিপ্যালিটির প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩৭০ জন।






পর্যটকদের জন্য ব্যপক এমিউজমেন্টের ব্যবস্থা

১৯৯৭ সালের ১৪ মার্চ এ ১৮ তম চীনা ন্যাশনাল পিপল’স কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাদেশিক শহরের সাথে পাশাপাশি আরো চারটি প্রি-ফ্রেকচারাল শহর একত্র করে চংকিং মিউনিসিপ্যালিটি গঠন করা হয়। মূলতঃ অপেক্ষাকৃত কম উন্নত চীনের পশ্চিম অঞ্চল উন্নত করা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ‘চীনের পশ্চিম অঞ্চল উন্নয়ন কৌশল’ অনুযায়ী এই শহর গড়ে তোলা হয়েছে। অত্যাধুনিক শহর হিসেবে চংকিং খুব দ্রুত গড়ে উঠে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বসবাস, বানিজ্যিক ও কারখানার জন্য দৈনিক গড়ে প্রায় ১,৪৩,০০০ বর্গ মিটারের নির্মাণ কাজ করা হয় আর প্রতিদিন গড়ে ১,৩০০ মানুষ শহরে বসবাসের উদ্দেশ্য আসে। এই হারে দ্রুত বর্ধনশীল নগর হিসেবে ২০১০ সালের ৮ ফ্রেব্রুয়ারী চংকিং নগর চীনের পাঁচটি প্রধান নগরের একটির মর্যাদা লাভ করে। একটি বিষয় সহজেই অনুমেয় যে সরকারী কৌশল আর পরিকল্পনা কি পরিমান টেকসই, শক্ত আর নিখুঁত হলে মাত্র ১৩ বছরে একটি প্রাদেশিক শহরকে কসমোপলিটন হিসাবে দেশের একটি প্রধান নগরে রূপান্তর করা যায়।



চংকিং সিটি সেন্টার

চংকিং এর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলতঃ মোটরগাড়ী ও মোটরসাইকেল নির্মাণ শিল্পের উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। চংকিং মোটরসাইকেল উৎপাদনে চীনের নম্বর ওয়ান এলাকা আর মোটরগাড়ী উৎপাদনে তৃতীয়। ২০০৭ সালে চংকিং বাৎসরিক ১ মিলিয়ন মোটরগাড়ী ও ৪.৮ মিলিয়ন মোটর সাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। চংকিং এ বিশ্ববিখ্যাত মোটরগাড়ী নির্মাতা “ফোর্ড” কোম্পানির তিনটি প্লান্ট রয়েছে। এইজন্য চংকিং এর রাজপথে অত্যাধুনিক মডেলে চকচকে-ঝকঝকে গাড়ীর ভিড়ে চোখ ধাধিয়ে যায়।




নান্দনিক সিটি সেন্টারে নগরবাসীর বিনেদন


চংকিং রাজপথ

চংকিং একদিকে যেমন অত্যাধুনিক শহর অন্যদিকে আবার বিখ্যাত নদী বন্দরও, মূলতঃ অবস্থান ও পরিবহন-যোগাযোগের সুবিধা এই নগরকে অত্যাধুনিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। চীনের বিখ্যাত ইয়াং শি (Yangtze) নদী চংকিং শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। নদীর এপাড় আর ওপাড় মিলিয়েই চংকিং শহর। শহরের মধ্যে নদীর বহমানতা আর নান্দনিক নদী শাসন যথেষ্ঠ দৃষ্টিনন্দন হলেও আমাদের চোখে বরাবরই একধরণের আফসোস আর অতৃপ্তি তৈরি করছে! অন্যদের কি হয় জানি না বিদেশে কোন ভালো কিছু দেখলেই আমার এক ধরনের তুলনা চলে আসে। আসলে একই রকমের সুবিধা (অনেক ক্ষেত্রে বেশী) আমাদের থাকলেও আমার নানাবিধ জটিলতার কারনে এই সকল সুবিধাগুলোর সঠিক প্রয়োগে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হই! আমারদের শহরের পাশে বহমান সুন্দর নদীগুলির টেকসই ব্যাবহার না করে দিনে দিনে আমরা আবর্জনার ভাগারে পরিনত করছি। ইয়াং শি নদীতে ক্রুজ উপভোগ করতে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক চংকিং এ ভীড় করে। নদীর দুই পার্শ্বের সংযোগ করতে বেশ কয়েকটা সেতু রয়েছে, স্থাপত্যের গুণাবলী বিচারে একটা আরেকটার চেয়ে সুন্দর।


চংকিং এর প্যানরোমা (Wiki থেকে নেওয়া)
=======================================================
ছবিঃ মানস চোখ ও তার একজন ভ্রমণ সঙ্গী
এই পোষ্টে বর্নিত তথ্য সমুহ উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া হয়েছে (https://en.wikipedia.org/wiki/Chongqing)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৯:৪২
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×