somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাজাখস্তানঃ হিমেল ঠান্ডা আলমাতি শহরে (পর্ব - ১)

১২ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আলমাতি বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিতে আসা সুদর্শন চটপটে তরুন আদেল সাতারের কিছুটা সাবেকি আমলের মার্সিডিজ বেঞ্জে উঠেই সিটের আরামদায়ক গদিতে শরীর ছেড়ে দেই।ঝকমকে পলিশ করা গাড়ীর কাঠের মনোরম ড্যাশবোর্ডের ঘড়িতে সময় নির্দেশ করছে ভোর সাতটা বিশ সেই সাথে তাপমান যন্ত্রের পারদের মাত্রা দেখাচ্ছে তিন। ভোর সাতটা হলেও বাইরে রাজ্যের অন্ধকার। আদেলকে জিজ্ঞাসা করলাম যে আমি তো মনে হয়ে তোমার সকালের ঘুম নষ্ট করলাম, সে হেসে বলে একদিন না হয় হলোই তোমার জন্য, তাছাড়া সে তার উপরে অর্পিত দ্বায়িত্ব সম্পর্কে আমাকে ওয়াকিবহাল করে। এই সুদর্শন তরুণ কাজাখ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাশ করে যে প্রোগ্রামে গিয়েছি সেই অরগানাইজার সংস্থার সংগে জড়িত হয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটায় রাস্তায় চলমান সব গাড়ীরই হেড লাইট জ্বালিয়ে চলছে, সেই সাথে রাস্তার স্ট্রিট লাইটগুলো মধ্যরাতের মতই পরিপূর্ণ যৌবনা রূপে আলো বিলাচ্ছে বলে আমি কিঞ্চিত বিভ্রান্ত। কখন আলমাতির আকাশে সূর্য্যি মামার দেখা মিলবে তা জানতে চাইলে সে জানায় সকাল নয়টার কাছাকাছি সময়ে। শেষ অক্টোবরেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ডিসেম্বর জানুয়ারীতে কি অবস্থা হতে পারে এইটা কল্পনা করে আমি কিছুটা শংকিত হই।


রিপাবলিক স্কয়ার, আলমাতি

বেশ কয়েকদিন হল বাড়ী ছাড়া, নেপালের কাঠমন্ডু শহরে কয়েকদিন দাপ্তরিক কাজে কাটিয়ে, ঐখান থেকে লম্বা উড়াল দিয়ে ভোর পৌনে ছয়টায় আলমাতি বিমানবন্দরে নেমেছি। পথে ছয় ঘণ্টা তুর্কিস্থানের ইস্তান্বুল বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করতে হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টার বেশী সময় ধরে উড়াউড়ি এর আগে কর্মের ব্যস্ততায় কয়েকদিন গিয়েছে তাই স্বল্প পানিতে জিইয়ে রাখা মাছের মত ঘন নিঃশ্বাস নেয়া ক্লান্ত শরীর চাচ্ছে তারাতারি হোটেলে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে। বাইরে অন্ধকার হলেও এরই মধ্যে বাসস্টপে লোকজন দেখে বোঝা যায় আলমাতি শহরের লোকজন সূর্য্যি মামা জাগার আগেই ঘড়ির কাঁটাতে জাগে।


যদিও মনে হচ্ছে বনের মধ্যের রাস্তা! আসলে এটি শহরের রাজপথ, শরতের পাতায় রঙ ধরেছে

আলমাতি শহর আমাদের কাছে এত পরিচিত না হলেও কাজাখস্তানের রাজধানী ‘আস্তানা’ শহর এক বিশেষ কারনে বেশ পরিচিত। কম্পিউটারের ঘড়ি ঠিক করতে গেলেই দেখা যায় আমাদের ঢাকা আর আস্তানার সময় জিএমটি থেকে ছয় ঘন্টা প্লাস, মানে একই সময়! সেই সাথে আস্তানা আর আলমাতির সময়ই একই মানে ঢাকা আর আলমাতির ঘড়ির কাটা একই সাথে একই গতিতে ঘোরে।

ইতিমধ্যেই আদেলের গাড়ী হোটেল কম্পাউন্ডে ঢোকে, পূর্ব থেকেই সবকিছু ঠিক-ঠাক থাকাতে হোটেলের চেক-ইন ফরমে দস্তখত করে মাল-সামানা রুমে পাঠিয়ে আদেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি হোটেলের রেস্তরাঁয় প্রাতঃরাশ করতে যাই। ধীরেসুস্থে আয়েশ করে প্রাতঃরাশ সেরে রুমে এসে যথারিতি বিছানায় ঢলে পরি।



কাজাখ পার্লামেন্ট ভবন

কাজাখস্তান আমাদের জন্য অনেকটা অফট্র্যাক, কারন কাজকর্ম ছাড়া খুব কমই ওখানে বাংলাদেশীরা বেড়াতে যায়। কাজাখস্তান মধ্য-এশিয়ার অবস্থিত ইতিহাস আর সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি দেশ। ১৯১৭ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্য ভেংগে গেলে কাজাখস্তান অল্প কিছুদিন স্বায়ত্বশাসিত এর পরে সোভিয়েত শাসনাধীন হয়। ১৯২০ সালে এখনকার কাজাখস্তান একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রজাতন্র হিসেবে ‘কিরঘিজ অটোনোমাস সোভিয়েত সোশালিষ্ট রিপাবলিক (Kirghiz Autonomus Soviet Socialist Republic)’ নামে ‘সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশালিষ্ট রিপাবলিক (Russian Soviet Federative Socialist Republic –RSFSR)’এর আওতাভূক্ত হয়। ১৯২৫ সালে নাম বদলে এর নাম রাখা হয় ‘‘কাজাখ অটোনোমাস সোভিয়েত সোশালিষ্ট রিপাবলিক (Kazakh Autonomous Soviet Socialist Republic – Kazakh ASSR)’। ১৯৩৬ সালে ইউনিয়ন লেভেলের প্রজাতন্ত্র হিসেবে উন্নিত করা হয় তখন এর নাম হয় ‘কাজাখ সোভিয়েত সোশালিষ্ট রিপাবলিক (Kazakh Soviet Socialist Republic - Kazakh SSR)’। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেংগে গেলে ১৯৯১ সালের ১০ ডিসেম্বরে ‘রিপাবলিক অব কাজাখস্তান (Republic of Kazakhstan)’ হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে।



‘আলমাতি’ কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর মোট আয়তন ৬৮২ বর্গ কিলোমিটার আর লোকসংখ্যা হচ্ছে ১৭ লক্ষেরও বেশী। ভৌগলিকভাগে এই শহর ট্রান্স ইলি-আলাতু (Trans-Ili Alatu) পর্বত শ্রেনীর পাদদেশে অবস্থিত।১৯২৯ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত আলমাতি ‘‘কাজাখ অটোনোমাস সোভিয়েত সোশালিষ্ট রিপাবলিক (Kazakh Autonomous Soviet Socialist Republic – Kazakh ASSR)’ এর রাজধানী ছিল এর পড়ে ১৯৩৬ সালে মর্যাদা উন্নিত হলেও এই শহর ‘কাজাখ সোভিয়েত সোশালিষ্ট রিপাবলিক (Kazakh Soviet Socialist Republic - Kazakh SSR)’ রাজধানী ছিল। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতার পড়ে ১৯৯৭ সালে কাজাকিস্তানের রাজধানী আস্তানা (Astana) তে স্থানান্তরিত হয়। যদিও রাজধানী আলমাতি থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে তবুও কাজাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাতি সেই সংগে জাতিগত ও সংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের শহর।

কতক্ষন ঘুমিয়েছি তা ঠাওর করতে পারি না, ঘুম ভেংগে গেছে গরমে দেখি কম্বলের নিচে সারা শরীর ভিজে জবজব করছে। কারন বুঝতে বিছানা ছেড়ে উঠে পরি, শীততাপ নিয়ন্ত্রনের চাবি ঘুরিয়ে নিচের দিকে নামালেও কোন লাভ হয় না।ব্যর্থ হয়ে হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে ফোন দেই। তারা জানায় এখন তো শীততাপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রে শীতকালিন তাপমাত্রা ফিক্সড করা তাই একটা নিদিষ্ট মাত্রার পড়ে আর নামানো যাবে না। বেশী গরম লাগলে তারা আমাকে যন্ত্র বন্ধ রাখতে পরামর্শ দেয়। আমি বন্ধ করে জানালার পর্দা সরাই। বাইরে কমলা রঙের হালকা রোদ, যা মুহূর্তেই মনে একধরনের চনমনে ভাব নিয়ে আসে। তবে তার পরেও কেমন যেন হালকা ঘোলাটে মনে হয়। জানালা দিয়ে আবার ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করি। হা তাই তো কেমন যেন ঘোলাতে, হাল্কা হাল্কা এগুলো কি উড়ে বেরাচ্ছে, আমাদের হেমন্তের শেষে নদীর পাড়ে কাশফুলের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ যখন উড়ে বেড়ায় ঠিক এই রকম! নিচে ভালো করে তাকিয়ে দেখি গাছের পাতায় আর লনের ঘাসের উপরেও হালকা সাদা প্রলেপ যেন কেউ ঘাসের উপড়ে সাদা রঙের সামিয়ানা বিছিয়ে দিয়েছে।




সিজনের প্রথম তুষারপাত, তবে কিছুটা অগ্রিম

হালকা তুষারপাত হচ্ছে বাতাসে যে মিহি তুষার ভেসে বেরাচ্ছে তা বুঝতে আমার বেশ কিছুক্ষন লেগে যায়। হাহ!এই কি তুষারপাত! যা দেখার জন্য সেই বাল্যকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি! আমি এক মুহূর্ত দেরী না করে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নামার জন্য এলিভেটরে উঠে পরি। সত্যিই তো তুষারপাত হচ্ছে তবে খুব হালকা আর মিহি! হাত দিয়ে ধরা যায় না দেখা যায় কি অদ্ভুত অনুভূতি !! আমার অনুভূতি হয় কবিতার মত;

"খুলে দাও বরফের আলপনা আকা হোটেলের সমস্ত জানালা,
খুলে দাও আমার পোষাক,
আমাকে আবৃত করে আজ শুধু বরফ ঝরুক,
আজ শুধু বরফের সাথে খেলা"
(নির্মলেন্দু গুন)

হঠাৎ তীব্র শীত বোধ করি, খেয়াল করে দেখি অতি উত্তেজনায় এই বাঙ্গাল ঘরের হাল্কা পোষাক পড়েই নিচে চলে এসেছে। এই মফিজের মফিজামি যাথে কেউ আর না বুঝতে পারে আর ঠান্ডায় আশু সর্দি কাশির ভয়ে তারাতারি রুমে ফিরে আসি।
(চলমান...)

=============================================
ছবিঃ মানস চোখ
ক্যামেরাঃ ক্যানন ১১০০ ডি
লেন্সঃ ৫৫ - ১২৮ মি মি
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১:৪৮
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×