নরসিংদী যাবো যাবো করেও সময় বের করতে পারছিলুম না । এ সপ্তাহে যেতেই হবে তাও ১৬ই ডিসেম্বার রাতে একটা ডিনার এর নেমন্তন্ন আছে যা এড়ানো সম্ভব না তাই ঠিক করলুম ১৭ তারিখ ঘুরে আসবো নরসিংদী থেকে । ১৫ তারিখ রাতে বাসায় ফেরার সময় হঠাৎই মনে হলো ট্রেনে যাওয়া যেতে পারে , অনেকদিন ট্রেনে উঠা হয় না । আমার ড্রাইভার শাহিনকে বললুম এয়ারপোর্ট স্টেশনে ঢোকো , কাউন্টারে গিয়ে দেখি ১৭ তারিখ সকালে এগারসিন্ধুরের নরসিংদীর কোন সীট নেই , ভৈরবের আছে ,তাও শোভন শ্রেণীতে, নিয়েই নিলুম । ১৭ তারিখ সকালে ৭ : ৩০ এ স্টেশনে নেমে শাহিনকে বললুম , 'তুমি নরসিংদী চলে যাও , ট্রেন যদি লেট থাকে , নরসিংদী স্টেশন থেকে আমাকে রিসিভ করো '। ৭:৪৫ এ ট্রেন আসার সময় তবে তখনো ট্রেন কমলাপুর থেকেই ছাড়েনি । প্লাটর্ফময়ে বেশ ভিড় , এরই মাঝে সুন্দরবন এক্সপ্রেসের আসার ঘোষণা হলো , আমি ভাবলুম এরা বোধহয় সব সুন্দরবনের যাত্রি , কিন্তু না কারুর তেমন কোনো চন্চলতা ও দেখলুম না । আশাকরি প্লাটর্ফম বোঝাই যাত্রিরা সবাই এগারসিন্ধুরের যাত্রি নয় । একটু পর ট্রেন এলো , বেশ কিছু মানুষ কমে গেলো (আমি সহ) প্লাটর্ফম থেকে । ৮:০১ এ ট্রেনেরও চাকা গড়ালো । মাত্র ১৬ মিনিট লেট , ব্যাপার না । ভেতরে ভিড় একেবারে মন্দ নয় । বেশিরভাগ দুজনের সীটেই তিনজন করে বসেছে , আমার সীটেও তাই । সামনের সীটে এক পরিবার , তারাও বেশ চাপাচাপি করেই বসেছে । সাথে দু বাচ্চা । পরিবারের কর্তাটির দেখলুম ছেলেটির দিকে যত মনোযোগ , মেয়েটির দিকে ততটা নয় । সাথে নিয়ে আসা বক্স খুলে চিকেন ফ্রাই বের করে ছেলেকেই আগে সাধাসাধি , মেয়েটিকে পরে একপিস হাতে ধরিয়ে দিলো , জ্যুস খাবে কিনা সে প্রশ্ন করলো শুধু ছেলেকে । অথচ মেয়েটিই বয়সে ছোট । বৈষম্য নিরসনে অভিভাবক সচেতন না হলে মানসিকতা গড়ে উঠবে কিভাবে ! ছোটবেলা থেকে এভাবে অগ্রাধিকার পেয়ে বড় হয়ে ওই ছেলেটির মানসিকতা আর পরিবর্তন নাও তো হতে পারে । অবশ্য আমার পর্যবেক্ষন ভূল হতেই পারে ।
টন্গী পার হবার পর দেখলুম ডাবল লাইন হবার কারনে এবং নগরায়নের চাপে রেললাইনের দুপাশেই অনেকই পরিবর্তন । নতুন লাইনটা দিয়ে ট্রেন যাচ্ছিলো নরসিংদীর পথে , পাশেই পুরনো লাইনটা , ঢাকাগামী ট্রেনগুলো ব্যবহার করে ওটা । পুবাইল আর আড়িখোলা স্টেশনের মাঝে চুয়ারিয়াখোলা এলাকাটা পার হবার সময় একটা ছোট্ট রেলওয়ে কালর্ভাট ও তার পাশে থাকা বড় একটা গাছ দেখে মনে হলো এইতো কিছুই বদলে যায় নি । অনেক আগের স্মৃতি মনে পড়লো , এই কালর্ভাটটিতেই অনেকক্ষন বসেছিলাম সেদিন ।
সেটা আমার ছাত্রজীবন তখন , ১৯৯৯ সনের কথা । ছুটিছাটায় যখনই নরসিংদী আসতুম , আমি আর আমার এক কাজিন উজ্বল মাঝে মাঝে বিকেলে রেললাইন ধরে হাটতে বের হতুম , হাটতে হাটতে নরসিংদী থেকে ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশন পর্যন্ত এসে আবার টেম্পো/হলারএ চড়ে নরসিংদী প্রত্যাবর্তন , সাথে চলমান আড্ডা। এমনই একদিন হাটতে হাটতেই হঠাৎ মাথায় একটা প্ল্যান অথবা পাগলামি এলো ,উজ্বলের সাথে শেয়ার করলুম এবং তৎক্ষনাৎ সাদরে গৃহীত । প্ল্যানটা ছিলো নরসিংদী থেকে রেললাইন ধরে হাটতে হাটতে ঢাকা যাওয়া । আমাদের প্ল্যানটা ছিলো সকাল ছটায় নরসিংদী থেকে রেললাইন ধরে হাটা শুরু করবো , ৮ টায় ঘোড়াশাল পৌছে ব্রেকফাস্ট , ১১ টায় আড়িখোলা, ১টায় পুবাইল পৌছে লান্চ , ৩:৩০ এ টন্গী , ছটার মধ্যেকমলাপুর পৌছে রিক্সা নিয়ে গুলিস্তান , তারপর বাসে চড়ে নরসিংদী প্রত্যাবর্তন । তবে প্ল্যান অনুযায়ী তো আর সবসময় সবকিছু হয়না । তখন আগস্ট মাস , কোন একটা রাজনৈতিক কারনে সকালসন্ধ্যা হরতাল ছিল সেদিন । সকাল ছটার বদলে দশটা নাগাদ নরসিংদী স্টেশনের প্লাটর্ফম থেকে দুজনে হাটা শুরু করলুম , বারোটায় ঘোড়াশাল পৌছে গেলুম । শীতলক্ষার উপর শহীদ ময়েজউদ্দিন সেতু তখন ছিলোনা , ফেরী ছিল সেখানে । ফেরীঘাটের কাছেই একটা মিস্টির দোকান ছিল বেশ নামকরা ঘোড়াশালের জন্য , সেখানে বসে বড় আকারের রসগোল্লা দুটো করে খেয়ে নদী পার হয়ে আবারো রেললাইন ধরে হাটা শুরু করলুম । আড়াইটায় পৌছলুম আড়িখোলা স্টেশনে , প্লাটর্ফম পার হয়ে ভেতরে ঢুকে ভাতের হোটেলের খোঁজ করতে লেগে গেলুম , ক্ষিধেও পেয়ে গিয়েছিলো বেজায় । খুব সাধারণ হোটেল , ভাত আর মাছের ঝোল , তাই চেটেপুটে ভরপেট খেয়ে আবারো রেললাইন ধরে হাটা শুরু করলুম । এবং একটা ভুল অলরেডী করেই ফেলেছি সেটাও টের পেলুম , তা হচ্ছে অমন ভরপেট খাওয়া উচিৎ হয়নি । এখন তো হাটতে একটু কষ্টই হচ্ছে । আরও একটা ভুল প্রথমেই করেছিলুম তাও টের পাচ্ছিলুম পদে পদেই , তা হলো কেডস জাতীয় কিছু না পরে চপ্পল পরে বের হওয়া । (সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় শুধু আম্মাকে বলেছি , 'আম্মা এই একটু ঘুরেআসছি ' ডিটেইলসয়ে বলতে গেলে আর বের হওয়া লাগতো না ) চুয়ারিয়াখোলা এলাকাটা পার হবার সময় একটা ছোট্ট রেলওয়ে কালর্ভাটে বসে বিশ্রাম করলুম কিছুক্ষন , অনেক বাতাস ছিলো জায়গাটাতে । সাড়ে চারটা নাগাদ পুবাইল পৌছে প্লাটর্ফম পার হয়ে ভেতরে ঢুকে কালীগন্জ - টন্গী সড়কে এসে এক দোকানে কোল্ড ড্রিন্কস চাইলুম , তারা তাদের নিজেদের তৈরী দৈ চেখে দেখতে অনুরোধ করলো । সে দৈয়ের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে । পথে অনেকেরই কৌতুহলি দৃষ্টি ছিলো আমাদের উপর তবে সেটা সম্ভবত দুজনের হুবহু একই রকম পোশাক ও মাথার ক্যাপের কারনে । সাড়ে ছটা নাগাদ টন্গী স্টেশনে ঢুকে একটু বিশ্রামের অবসরে উজ্বলের সাথে আলাপ করে ঠিক করলুম , যেহেতু আমাদের রওনা হতেই চারঘন্টা লেট হয়ে গেছে তাই রেলওয়ে ট্র্যাক ধরে হাটা আজ এই টন্গী স্টেশনেই শেষ করি , তা না হলে নরসিংদী আজ পৌছতে সমস্যা হতে পারে । আবারো একদিন বেরুবো দুজনে নরসিংদী থেকে ভৈরব , পারলে ব্রাহ্মনবাড়িয়া পর্যন্ত । উজ্বলের হিসেবে ব্রাহ্মনবাড়িয়া পর্যন্ত একদিনে খুবই সম্ভব , সে পারলে আখাউড়া পর্যন্ত যায়।
তারপর টন্গী স্টেশন থেকে একটা রিক্সা করে আবদুল্লাহপুর , সেখান থেকে সিএনজি বেবিট্যাক্সি নিয়ে গুলিস্তান , তারপর বাসে উঠে সোজা নরসিংদী । আম্মার বকুনী কিছুটা শোনার পরে আমার ভ্রমণ বৃতান্ত শুনে আম্মা থমকে গিয়ে শুধু বললেন এরপর কোথাও গেলে অবশ্যই বলে যাবে (আম্মা নিজেও বেড়াতে ভালোবাসেন) ।
পুরনো কথা ভাবতে ভাবতেই দেখি নরসিংদীতে ট্রেন ঢুকছে । ৮:৪৩ এ নরসিংদীতে নেমে শাহিনকে ফোন করলুম, কোথায় তুমি ? "স্যার আমি মাধবদিতে " এবার সোজা বাসায় , স্টেশন থেকে কাছেই । সেসময় স্মার্টফোন ছিলোনা , ডিজিটাল ক্যামেরা ও আমার ছিলোনা , সাধারন ক্যামেরায় তোলা এই একটি ছবিই অক্ষত পেলুম আমার এলবামে । এটা সেই চুয়ারিয়াখোলায় ছোট্ট রেলওয়ে কালর্ভাটে বসে বিশ্রাম নেয়ার সময় তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৫