মুক্তিযোদ্ধা এক বন্ধুর গল্প - ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অবঃ)
একই সাথে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড র্যাঙ্কে ক্যাডেট হিসাবে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমী,কাকুলে যোগদেই। তাই আমাদের বন্ধুত্ব ৪৫ বছর অতিক্রম করতে চললো-দীর্ঘ সময় বটে! আমি কোর অব আর্টিলারীতে এবং আমার যে বন্ধুটির কথা বলছি,সে দি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রারম্ভে তার পোষ্টিং ছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নবপ্রতিষ্ঠিত ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ঐতিহ্যবাহী দি ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের নতূন একটি ইউনিট। পাকিস্তানী অধিনায়ক ছিলেন লেফটেনেন্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ জানজুয়া এবং জেনারেল জিয়া (তখন মেজর জিয়াউর রহমান) ছিলেন উপ-অধিনায়ক। আমার বন্ধুটি একজন তরুণ লেফটেনেন্ট , এ্যাডজুটেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিল।
১৯৭১ সালের মার্চের ১লা তারিখ থেকেই পাকিস্তানের সাথে ক্ষমতা হস্থান্তরের ব্যপারে রাজনৈতিক আলোচনায় পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার কোন অগ্রগতি হচ্ছে না দেখে একটি অত্যন্ত জটিল এবং অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যতই উত্তপ্ত হতে থাকে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙ্গালী সেনা সদস্যদের মধ্যে ব্যপক অস্থিরতা এবং কানাঘুষা চলছিল যে , যেকোন মুহুর্তে সসস্ত্র বিদ্রোহ ঠেকাতে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙ্গালী সেনা সদস্যদের নিরস্ত্র করা হতে পারে। ৮ম বেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন পাকিস্তানী লেফ্টেনেন্ট কর্নেল জানজুয়া। তবে ইউনিটে চাকুরীরত প্রায় সকল সদস্যই ছিল বাঙ্গালী । বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশ মুক্তির আকাক্সক্ষা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পাকিস্তানী আর বাঙ্গালীর মধ্যে অবিশ্বাস আর সন্দেহ ছিল চরমে। ৭১ এর মার্চ মাসের ১০ তারিখ থেকেই নিরস্ত্র করার যে কোন প্রচেষ্টা প্রতিহত করার জন্য মেজর জিয়ার এক গোপন নির্দেশে রাতের আধারে ৮ম ইষ্ট বেঙ্গলের বাঙ্গালী অফিসার ও সৈনিকরা অস্ত্রসস্ত্র গোলাবারুদ সহ গোপনে প্রস্তুতি নিয়ে ছাদের উপর অবস্থান নিত। যদি কোন পাকিস্তানী সেনা ইউনিট বাঙ্গালী সৈনিকদের নিরস্ত্র করার উদ্যেশ্য নিয়ে ৮ ম ইষ্ট বেঙ্গলের ইউনিট লাইন্সের দিকে এগিয়ে আসে তবে, কোন নির্দেশের অপেক্ষা না করেই, সকল অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানীদের উপর ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দেয়া ছিল। ভোর হওয়ার পূর্বেই আবার যথাস্থানে অস্ত্র -গোলাবারুদ রেখে দেয়া হত। যাতে কারো মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক না হয়। এমনি উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ মাসের প্রথম ক’টি দিন নির্ঘুম উৎকন্ঠা আর উত্তেজনার মধ্যে কাটছিল।
২৫শে মার্চ ১৯৭১। সবাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, ঐ রাতেই পাকিস্তানীরা বাঙ্গালী সৈনিকদের নিরস্ত্র করার জন্য চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থানরত বেলুচ রেজিমেন্ট যেকোন সময় আক্রমন করতে পারে। প্রথমে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চারদিক থেকে অবরোধ করবে এবং অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিবে। অস্ত্র সমর্পণে অস্বীকৃতি জনালেই বাঙ্গালী সৈনিকদের উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে পাকিস্তানী সৈনিকরা এবং হত্যা করতে পারে সকল বাঙ্গালী সৈনিকদের। এই তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরই ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। সন্ধ্যার পর পরই অস্ত্রসস্ত্র গোলাবারুদ, যা কিছু বহন করা সম্ভব তাই, নিয়ে সেনানিবাস থেকে অতি সন্তর্পনে সাধারন রাস্তাদিয়ে না গিয়ে রেললাইন ধরে বেরিয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয় এবং তাদের পেছনে ধাওয়া করা পাকিস্তানী ইউনিটদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রচুর হতাহত হয় উভয় পক্ষে। শেষ পর্যন্ত এই অসম যুদ্ধে শহর এলাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ে তাই পরিকল্পনা করা হয় কালুরঘাট ব্রীজের অপর পারে চট্টগ্রাম - দোলাহাজারা রেল লাইনের উপর প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করা হবে। পাকিস্তানী সৈনিকদের কোন অবস্থাতেই কর্ণফুলি নদী পেরিয়ে অগ্রসর হতে দেয়া হবে না। তাদের অগ্রযাত্রা যে কোন মূল্যেই ঠেকাতে হবে। রেল লাইন যেহেতু একটা এ্যামবেকমেন্টে বা বাঁধের উপর দিয়ে চলে গেছে যা আশে পাশের ভূমি থেকে উঁচুতে , তাই শত্র“র গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং তাদের উপর কার্যকরি ফায়ারের জন্য রণকৌশলগত দিক থেকে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহনের একটি আদর্শ স্থান।
১১ই এপ্রিল ১৯৭১ইং। ৮ম ইষ্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহী সৈনিকদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের সংবাদ পেয়েই পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট বিদ্রোহী ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আক্রমন করার জন্য কালুরঘাট ব্রীজের ওপর পাড়ে অবস্থান নেয় এবং প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু করে। পাকিস্তানের গোলন্দাজ বাহিনীও ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থানের উপর প্রচন্ড গোলাবর্ষন শুরু করে। মেজর জেনারেল (তখন ক্যাপ্টেন) হারুন আহমদ চৌধুরী ( সিলেটেরই এক কৃতি বীর মুক্তিযোদ্ধা) যুদ্ধরত অবস্থায় মারাত্মক ভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তার শরীরর থেকে গুলি বের করা সম্ভব হয় নাই বলে তিনি এখনো তার শরীরের অভ্যন্তরে গুলি বহন করে বেঁচে আছেন । মরাত্মক ভাবে আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমার যুদ্ধরত বন্ধু তখন একজন লেফটেনেন্ট - শামসের মোবিন চৌধূরী , তাৎক্ষনিক ভাবে ক’জন তরুন মুক্তিযোদ্ধাদের মারাত্মক ভাবে আহত ক্যাপ্টেন (পরবর্তিতে জেনারেল) হরুন আহমদ চৌধুরীকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য যুদ্ধরেখার পেছনে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেন।
লেফটেনেন্ট শামশের মোবিন চৌধুরী এই উদ্ধার অভিযানকে নির্ভিগ্ন করার জন্য কাভারিং ফায়ারের মাধ্যমে শত্র“দের অগ্রাভিযানের যে কোন প্রচেষ্টা প্রতিহত করার জন্য নিজের পজিশনেই থেকে যান এবং সামনা সামনি শত্র“সেনাদের উপর প্রচন্ড ফায়ার আনেন। বিপুল সংখ্যক শত্র“ সেনা হতাহত হওয়ায় শত্র“সেনাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। লেফটেনেন্ট শামশেরের কভারিং ফায়ারের আড়ালে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে আহত ক্যাপ্টেন হারুনকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই লেঃ শামশের মোবিন চৌধুরী নিজেই শত্র“র গোলার আঘাতে মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কমর থেকে তার পা প্রায় বিছিন্ন হয়ে পড়ে তার শরীর থেকে। শত্র“র প্রচন্ড গোলাগুলিতে বাঙ্গালী সৈনিকরা বাধ্য হয়েই পিছু হটতে হয়। প্রচন্ড গোলাগুলি এবং সামরিক শক্তিতে বহুগুন শক্তিশালী শত্র“বাহিনীর ক্রমাগত অগ্রভিযানের চাপের মধ্যে গুরুতর আহত শামশের মোবিন চৌধুরীকে সহযোদ্ধারা উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতে পারলো না। তারা শামশেরকে ঐ স্থানে ফেলে রেখেই পেছনে নতূন অবস্থানে সৈনিকদের প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। শত্র“রা এ্যামবেকমেন্টের উপর গুরুতররূপে আহত প্রায় অচেতন হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা শামশের মোবিন চৌধুরীকে বন্দী করে। টেনে হিচড়ে তাকে একটি পিকউপ গাড়ীর পেছনে ফেলে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
বেশ কিছু সময় পর যখন কিছু কিছু জ্ঞান ফিরে আসে তখন শামশের তাকে পাকিস্তান নেভী হাসপাতালে ফ্লোরে রক্তাক্ত ষ্ট্রেচারের উপর নিজেকে আবিষ্কার করে। একজন নেভী মেডিক্যাল অফিসার কিছুক্ষণ পর এসে তাকে যথাসম্ভব প্রথমিক চিকিৎসা প্রদানে উদ্যত হলে অন্যান্য পাকিস্তানী চিকিৎসারত আহত পাকিস্তানী সদস্যগন প্রচন্ড ক্ষোভের সাথে ঐ ডাক্তারকে কোন প্রকার চিকিৎসা দিতে বাঁধা দেয়। তারা সমস্বরে চিৎকার করতে থাকে,“ইয়্যে গাদ্দার হ্যায়,ইয়্যে গাদ্দার হ্যায় -হামারা দুশমন হ্যায়-কোয়্যি নেহি উসকো মদদ্ করেগা”।এদিকে শামশের প্রচন্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তান নেভীর সেই ডাক্তার সামনে এগিয়ে আসেন এবং দৃঢ় কন্ঠে বলেন ,“ আমি একজন ডাক্তার আর ওহচ্চে একজন আহত মানুষ, সে কোন পক্ষের সৈনিক তা আমার দেখার বিষয় নয় - একজন ডাক্তার হিসাবে আমার, নৈতিক এবং পেশাগত দায়িত্ব তার চিকিৎসা করা-এবং আমি তা অবশ্যই করবো। কেউ আমাকে বাঁধা দিতে পার না”। এই কথা শুনে প্রতিবাদী পাকিস্তানীরা ধীরে ধীরে সরে পড়ে। ডাক্তার কানে কানে শামশেরকে বলে ,“ তুমি মোটেও ভয় পেয়ো না। যতক্ষণ আমি এই হাসপাতালে আছি আমি তোমার চিকিৎসা করবো। তুমি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত শত্র“ তা আমার কাছে কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের সম্পর্ক একজন আহত রুগী ও ডাক্তারের”। এই বলেই কিছু কিছু ড্রেসিং করে ব্যাথা নাশক মরফিন ইনজেকশন দিয়ে শুইয়ে রাখেন শামশেরকে হাসপাতালে।
পরদিন ভোরে তার অবস্থা আরো অবনতি দেখে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সি এম এইচ’ এ শামশেরকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। এ্যাম্বুলেন্স করে পতেঙ্গা থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সি এম এইচ’এ নিয়ে যাওয়ার সময় পথেই এ্যাম্বুলেন্সে থাকা পাকিস্তানী এটেনডেন্টরা তাকে হত্যা করার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করে। শামশের এতই গুরুতররূপে আহত ছিল যে কোন প্রকার প্রতিরোধ করার এমনকি নড়াচড়া করার শারিরীক ক্ষমতাই তার ছিল না। পেছনে ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে দৌড়ে আসে এবং অনুরোধ করতে থাকে,“ ইয়ে মারিজ হ্যায়,ইয়ে মারিজ ( ইনি একজন রুগী, ইনি একজন রুগী) হ্যায়-ইস্কো মত মারো। হাসপাতাল তক্ পৌঁছানে দ্যাও-ভাই,উস্কো মত মারো ” বলে চিৎকার করতে থাকে এবং ঐ পাকিস্তানীদের কোন মতে নিবৃত করে। চট্টগ্রাম সি এম এইচ’এ পৌঁছার সাথে সাথে এ্যাম্বুলেন্সের পেছনের দরজা খুলে চলন্ত এ্যাম্বুলেন্স থেকে লাথি দিয়ে আহত শামশেরকে রাস্তার উপর বিনা চিকিৎসায় ক্রমাগত রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণের জন্য ফেলে রেখে দ্রুত চলেযায়। নড়াচড়া করতে অক্ষম শামশের দ্রুত চলে যাওয়া এ্যাম্বুলেন্সের দিকে অসহায় ভাবে অপালক দৃষ্টিতে চয়ে থাকলো।
এমন সময় একজন পাকিস্তানী মেডিক্যাল এসিসটেন্ট ঐ রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় আহত শামশেরকে রাস্তায় অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গিয়ে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসে,একাই তাকে কোন মতে টেনে স্ট্রেচারে উঠায়। অন্ততঃ দুইজন ছাড়া একটি স্ট্রেচার বহন করা যায় না,কিন্তু আহত শত্র“ সেনাকে বহন করতে অন্য কেউ তাকে সাহায্য করতে রাজী হল না। অগত্যা সেই পাকিস্তানী মেডিক্যাল এসিসট্যান্ট একাই স্ট্রেচারের এক প্রান্ত দু’হাতে তুলে ধরে অন্য প্রান্ত রাস্তায় ঘষে ঘষে টেনে নিয়ে যায় অফিসার ওয়ার্ডে।
কিন্তু অন্যান্য চিকিৎসারত পাকিস্তানী সৈনিকদের প্রচন্ড বাঁধার মুখে অফিসার ওয়ার্ডে রাখতে পারে নাই। পরে নিরাপত্তার জন্য শামশেরকে বন্দীদের জন্য নির্দ্ধারিত অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও আহত শামশেরের উপর পাকিস্তানীরা আক্রোশে আক্রমন করে। একজন আহত পাকিস্তানী অফিসার একদিন ক্রাচে ভরকরে শামশেরের কক্ষে ঢুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং তার বুকের উপর চড়ে বসে। হাতের ব্যায়ানেট দিয়ে তার বুকে উপর্যোপরি দুটি আঘাত করে - একটি আঘাত বেশ গভীর ছিল এবং ফিন্কি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। শামশের শুয়ে শুয়ে হাতদিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। এখনো তার হাতে ও বুকে সেই ক্ষত চিহ্ন সে বয়ে বেড়াচ্ছে। তার পর সেই পাকিস্তানী অফিসারটি শামশেরের চোখ দুটি তুলে নিতে ব্যায়নেট দিয়ে চোখে আঘাত করে কিন্তু ঠিক চোখে না লেগে তা চোখের বাদিকের কপালে আঘাত করে। আজো সেই আগাতের চিহ্ন স্পষ্ট। এরই মধ্যে একজন পাকিস্তানী মেডিক্যার এসিসট্যান্ট দৌড়ে আসে এবং অনেক কষ্টে অনুনয় বিনয় করে সেই পাকিস্তানী অফিসারকে টেনে নিয়ে যায়। সে তাৎক্ষনিক ফোনে আর অধিনায়ককে এই ঘটনাটি জানায়। সি এম এইচ এর অধিনায়ক ছুটে আসেন এবং সেখানকার ব্রিগেড কমান্ডারকে বেশ চড়া কন্ঠে বিষয়টি অবগত করান। তিনি বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসারত কোন ব্যাক্তির প্রতি এ রকম আচরণ অগ্রহনযোগ্য-যদিও সে একজন শত্র“ সৈন্য তবুও তাকে নিরাপত্তা এবং চিকিৎসা দিতে হবে। যদি এই অফিসারকে হত্যা করতে হয় তা হলে তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বা অন্য কোন স্থানে তাকে হত্যা করা হউক অথবা হাসপাতালে তাকে যতেষ্ট নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করা হউক”। শামশের হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে পাশের রুমের এই সব কথাবার্তা শুনতে পারছিলো। এরপর হাসপাতালে শামশেরের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা করা হয়েছিল।
উন্নত চিকিৎসার জন্য না হলেও, ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক’দিনের মধ্যেই শামশেরকে ঢাকা সেনানিবাসে সি এম এইচ এ স্থানান্তর করা হয়। কোন ওয়ার্ডে নয়, সি এম এইচ এর অভ্যন্তরে খোলা মাঠে অস্থায়ী বন্দীশিবির হিসাবে স্থাপিত কড়া পাহারায় একটি ৪০ পাউন্ডার তাঁবুতে তাকে থাকতে দেয়া হয়। চলে নির্যাতন আর জিজ্ঞাসাবাদ । বার বারই তাকে মুক্তিবাহিনীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং গতিবিধির ব্যপারে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ চলে। যুদ্ধের প্রথমিক পর্যায়ে আহত হওয়া একজন অত্যন্ত কনিষ্ট অফিসার হিসাবে কোন পরিকল্পনাই তার জানা ছিল না তাই সে কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই পাকিস্তানীদের দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তানীরা তাকে মোটেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। অব্যাহত ভাবে তার উপর নানা ধরণের নির্যাতন অব্যাহত থাকে। ঢাকায় থেকেও তার পরিবার পরিজন জানতেও পারে নাই যে সে এখনো জীবিত আছে না যুদ্ধে শহিদ হয়েছে। তিন-চার মাস পর পাকিস্তানী একজন সুবেদার সম্পূর্ণ মানবতাবোধ থেকে শামশেরের কাছ থেকে অত্যন্ত গোপনে তার পিতার ফোন নম্বর নিয়ে উনাকে জানায় যে তাঁর সন্তান এখনো বেঁচে আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার পিতার কাছথেকে শামশের এই তথ্য জানতে পারে।
ঢাকা সি এম এইচ এ কর্মরত একজন বাঙ্গালী মেডিক্যাল এসিসটেন্ট সবার অলক্ষ্যে শামশেরকে যে কোন ভাবে একটু সাহায্য করতে উদ্গ্রীব ছিল। কিন্তু চার দিকে কড়া পাহারা এবং সবার দৃষ্টি এড়িয়ে এই কাজটি করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সে তার উপর যাতে কোন সন্দেহ না হয় সে জন্য সি এম এইচ এ কর্মরত তার অপরএক পাকিস্তানী বন্ধুকে দিয়ে নিয়মিত শামশেরের জন্য গোপনে সিগারেট পাঠাত-খোজখবর নিত। শামশের অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে তাকে যারা বন্দীকালিন সময়ে সাহায্য করেছিল অথবা অন্ততঃ সহানুভূতি প্রদর্শন করেছিল তাদের সকলকে আজো স্বরণ করে। সেই নেভী ডাক্তার, এ্যাম্বুলেন্সের সেই ড্রাইভার যে তার প্রান বাঁচিয়ে ছিল, চট্টগ্রাম সি এম এইচের পাকিস্তানী মেডিক্যাল এসিসট্যান্ট ও সি এম এইচ এর পাকিস্তানী অধিনায়ক এবং ঢাকা সি এম এইচ এর পাকিস্তানী মেডিক্যাল এসিসট্যান্ট যে তাকে গোপনে সিগারেট সরবরাহ করত-এদের সাবাইকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বরণ করে। সেই সাথে যারা অসহায় গুরুতর আহত অবস্থায় তার প্রতি নির্দয় বিভৎস হিংস্র আচরণ করেছিল তাদের কথাও ঘৃণাভরে স্বরণ করে। বন্দী অবস্থায় শামশের মানুষের মানবতাবোধ,মমত্ববোধ এবং সুন্দর সহানুভূতিপূর্ণ দিক যেমন দেখেছে ঠিক তেমনি দেখেছে এর উল্টোটিও একজন অসহায় আহত মানুষের প্রতি ঘৃণ্য,বিভৎস এবং নির্দয় আচরণও।
শেষপর্যন্ত তেমন কোন অপরাধ না পেয়ে দীর্ঘ নয়টি মাস আহত অবস্থায় বন্দী থাকার পর শামশেরকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে ৩রা ডিসেম্বর’৭১ তারিখে কোর্টমার্শেল করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। কিন্তু ৩রা ডিসেম্বরই কাকতালিয় ভাবে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক যুদ্ধ ঘোষনা করে। তাই সেই কোর্ট মার্শেল আর অনুষ্ঠিত হয় নাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শামশের মোবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম কে জার্মানীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয় ।দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে শামশের সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে এবং স্ক্রাচ বা লাঠির সাহায্যে চলাফেরা করতে হয়। সামরিক বাহিনী থেকে তার চাকুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে ন্যাস্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত শামশের মোবিন চৌধুরী বীর বিক্রম তার পেশাগত দক্ষতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সর্বোচ্চ পদ পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর গ্রহন করে। আমার বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শামশেরকে নিয়ে গর্ববোধ করাই যায়। লাল সবুজ পতাকায় শামশের মোবিন চৌধুরীর মত কত নাম নাজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ করুণ কাহিনী আর লাল রক্ত লেগে আছে- তাদের সবাইকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বরণ করছি। এদের আত্মত্যাগই আমাদের একটি স্বাধীন দেশের গৌরব এনে দিয়েছিল। এই জাতি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
মুক্তিযোদ্ধা এক বন্ধুর গল্প - ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অবঃ)।