ভূমিকা
বিয়ে হচ্ছে পরিবারের ভিত্তি, আর পরিবার হচ্ছে সমাজের ভিত্তি । বিয়ে হচ্ছে সমাজের একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান, যা কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েএকটি জৈবিক চাহিদা পূরনের বৈধ ব্যবস্থা যা মূলত সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়। সভ্যতার আদি ইতিহাস থেকে বিয়ে ব্যবস্থার বিভিন্ন রূপ ও ধরন থাকলেও আধুনিক কালে সভ্য সমাজ ব্যবস্থায় পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ভিত্তিতে স্থিরীকৃত বিয়ে Arrange Marriage বা এবং প্রেম-বিয়ে বা Romantic Marriage এই দুই ধরনের বিয়ে ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে সহ বিভিন্ন দেশে প্রেম-ভালোসার ভিত্তিতে ক্রস-কালচারাল বিয়ে তথা ভিন্ন ধর্মীয় এবং ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিয়ে ব্যবস্থায় আবদ্ধ হতে পরিলক্ষিত হয়।
বিয়ে
বিয়ে হল সমাজ,সংস্কৃতি ও ধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত এমন এক চুক্তি যার মাধ্যমে একজন পুুরুষ এবং একজন নারী একত্রে বসবাস করার চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্জন করে পরিবার গঠনের যোগ্যতা রাখে। বিবাহ একটি জৈবিক চাহিদা পূরনের বৈধ ব্যবস্থা যা মূলত সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়। সভ্যতার আদি ইতিহাস থেকে সমগোত্রীয় ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক সম্পর্কের লোকদের সাথে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে অভ্যাস্ত। তারপরেও ব্যতিক্রম ঘটনার মধ্যে দিয়েও অনেকে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ যা দু’জনের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় বা ভিন্ন সংস্কৃতির অনুসারী হওয়ায় জীবন যাপনে ভিন্নতা সৃষ্টি করে। তাদের সন্তান সন্তুতি সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাপনা,ধর্মীয় ব্যবস্থাপনা,আচার অনুষ্ঠান পালন এবং সামাজিক সম্পর্ক রক্ষায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
প্রেম বিয়ে
প্রেম হল এমন একটি বিষয় যা জাতি,ধর্ম,বর্ণও সংস্কৃতি ইত্যাদি দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এটি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির মন,পছন্দ এবং ভাল লাগার উপর নির্ভরশীল। যেটাকে জাতি,ধর্ম,বর্ণও সংস্কৃতি ইত্যাদি দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না। এমনকি দেশ,জাতীয়তাবোধ,পারিবারিক অবস্থান,সামাজিক মর্যদা ও সামাজিক রীতি নীতি উপেক্ষা করে মানুষ তার পছন্দের ব্যক্তিকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে সর্বাত্ত্বক কৌশল অবলম্বন করে। সমাজের ভিত্তি হচ্ছে পরিবার,আর পরিবারের ভিত্তি হচ্ছে বিয়ে। বিয়ে সম্পর্কিত কৌতূহল সুপ্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসলেও বিভিন্ন গবেষণা কর্মে একক বিয়ে, বহু বিয়ে, অন্তর্গোষ্ঠী বিয়ে, বহির্গোষ্ঠী বিয়ে,বলপূর্বক বিয়ে,পিতৃবাস বিয়ে, মাতৃবাস বিয়ে, নয়াবাস বিয়ে,প্যারাল কাজিন বিয়ে, ক্রস কাজিন ইত্যাদি বিয়ে ব্যবস্থার রীতি নীতি এবং এ ধারায় জীবন যাপনের বিশদ আলোচনা আমরা দেখতে পায়। বিভিন্ন ধর্মে বিবাহ সম্পর্কিত নিয়ম কানুন ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বলে সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে থাকে এবং সে বিশ্বাসের আলোকে তাদের জীবন ধারণ করতে আস্থা পোষণ করেন। কিন্তু ধর্মীয় নিয়ম কানুন,আইন,রীতি নীতি ও আচার ব্যবস্থার বাইরে এসে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে প্রেম সূত্রীয় বিবাহ সম্পন্ন হতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক,সামাজিক,সংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ব্যবস্থায় যুগলদ্বয় কি ধরনের সমস্যা বা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয় এবং রাষ্ট্র্রীয় ব্যবস্থায় কোন ধরনের আইনের আওতায় পড়ে, ব্যক্তিগত জীবনে পারস্পরিক বুঝাপড়ায় কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়।
L.H.Morgan এর সংক্রান্ত মতবাদ (Scheme)
L.H.Morgan তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Ancient Society (১৮৭৭) তে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা পদ্ধতি প্রয়োগ করে সামাজিক বিবর্তন তত্ত্বে পরিবারের উৎপত্তি এবং পর্যায়ক্রমিক রূপান্তর সংক্রান্ত একটি মতবাদ (Scheme)দিয়েছেন। সমাজের অনুরূপ একরৈখিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের উৎপত্তি, বিকাশ প্রক্রিয়ায় তিনি যে পাঁচ টি ধরনকে চিহ্নিত করেছেন তা মূলত বিয়ের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো :- রক্তসম্পর্কযুক্ত পরিবার (Consanguine Family) যা আপন ভাই বোন তথা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের ভিত্তিতে গঠিত হয়। দলগত পরিবার (Punaluan Family)যা একদল সহোদরা বা জ্ঞাতিসম্পর্কের ভগ্নীদের প্রত্যেকের স্বামীর সাথে যৌথ বিয়ের মাধ্যমে গঠিত হয়। যুগল পরিবার (Syndyasmian Family) যা একজন পুরষ ও একজন মহিলার খেয়ালখুশির উপর ভিত্তি করে স্থায়ীত্ব নির্ভর যুগল বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গঠিত হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার (Patriarchal Family)যা একজন পুরষের সঙ্গে একাধিক মহিলার বিয়ের মাধ্যমে গঠিত হয়। একক পরিবার (Monogamian Family)যা একজন পুরুষেরর সাথে একজন মহিলার বিয়ে স্থায়ীভাবে গঠিত হয়। L.H.Morgan পাঁচ টি ধরনকে চিহ্নিত করে সামাজিক বিবর্তন তত্ত্বে পরিবারের উৎপত্তি, বিকাশএবং পর্যায়ক্রমিক রূপান্তর সংক্রান্ত মতবাদ টি ব্যাখ্যা করেছেন। আমিও L.H.Morgan এর এই তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ক্রস-কালচারাল বিয়ে ব্যবস্থার ফলে বিবাহিতদম্পতির পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক,ধর্মীয় ব্যবস্থা এবং এরূপ বিয়ে ব্যবস্থার ধরন পর্যবেক্ষণ করেছি।
ক্রস-কালচাল বিয়ের সমস্যাসমূহ
১. ক্রস-কালচাল বিয়ে ও সংগঠিত হয়েছে এমন যুগলের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী উভয় যাদের মধ্যে ধর্মীয় ভিন্নতা বিরাজমান। তাদের মধ্যে অনেক নিজ নিজ ধর্মে স্থির আছেন আবার কেউ কেউ নিজ ধর্ম পরিবর্তন করে স্বামী বা স্ত্রী এর ধর্ম গ্রহণ করে সুখে জীবন যাপন করেন।
২. ক্রস-কালচাল বিয়ে সংগঠিত হবার পরে একক পরিবার গ?ন করে তারা নিজ নিজ ধর্ম পালন করে সুখে তাদের দাম্পত্য জীবন অতিক্রম করেছে।
৩. নিজ জাতি,ধর্ম,বর্ণও সংস্কৃতি ইত্যাদি দিয়ে মূল্যায়ন নাকরে পরিবারের অমতে ক্রস-কালচাল বিয়ে করে তারা পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করছে।
৪. দুইটি ভিন্ন সংস্কৃতির নারী পুরুষের মধ্যে বিয়ে পরবর্তী পারিবারিক জীবনে সংস্কৃতির দ্বৈত অবস্থান বিরাজ করে। যেখানে পরস্পর বুঝাপড়ার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘ মেয়াদি অভিযোজন প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে পারিবারিকভাবে মতানৈক্য থাকলেও পরবর্তীতে উভয় পরিবারে সমাঝোতা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। এমনকি অনেক সময় পারিবারিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
৫. ভাষা ও ধর্মীয় আচরণে পারস্পরিক সন্তুষ্টি অর্জনেও দুইজনে বাধাগ্রস্থ হয়।সেক্ষেত্রে তারা স্বতন্ত্র আচরণ অনুসরণ করে থকলেও মনের সাদৃশ্যতার কারণে পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করে থাকে। তবে, ধর্ম পরিবর্তন করে থাকলে সেক্ষেত্রে একজন অন্যজনের অনুসারী হয়ে নতুন ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
৬. ক্রস-কালচারাল বিয়ে সংগ্ত পরিবারের সন্তানেরা ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ritual পালনে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে যে সকল ক্রস-কালচারাল বিয়ে সংগঠিত যুগল এর মধ্যে প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ritual পালন করে তাদের সন্তান প্রাথমিক পর্যায়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে চরম জটিলতায় ভোগে। তারা মা-বাবার ২টি ভিন্ন ও বিপরীত ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে কোনটা কে গ্রহণ করবে, আর কোনটা কে গ্রহণ করবে না, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। একদিকে মা তার সন্তানকে তার ধর্মের প্রভাবিত করতে চায়, অন্য দিকে বাবাও তার সন্তানকে নিজ ধর্মের প্রতি প্রভাবিত করতে চায়।তবে ধর্ম পরিবর্তন করে স্বামী-স্ত্রী দুই কোন এক ধর্মের অনুসারী হলে সেক্ষেত্রে সন্তানদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে কোন সমস্যা হয় না।
৭. দুইটি ভিন্ন সংস্কৃতির নারী পুরুষের মধ্যে যদিও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে বিয়ে হয়,কিন্তু পারিবারিক জীবনে তাদের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। তাদেরকে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়।সমাজপতিদের আধিপত্যের বিপরীতে তাদের কোন কিছু করার অধিকার থাকে না।
৮. এ ধরনের বিবাহ ব্যবস্থার নিবন্ধন পদ্ধতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকারী ভাবে কোন ব্যবস্থা নেই।
উপসংহার
সাধারণত ক্রস-কালচারাল বিয়ে পরিবার,সমাজ,সংস্কৃতি,ধর্ম, বর্ণ ও জাতি কে উপেক্ষা করে নিজ পছন্দের পাত্র-পাত্রী কে কোর্টে এর সহায়তায় করা হয়।সমাজ ব্যবস্থায় তাদের স্বীকৃতিতে নানা ধরনের সমস্যা হয়।তাদের সন্তানেরা প্রতিবেশী অন্য ছেলে সাথে তেমন বেশি মিশতে পারে না তাদের দৈনন্দিন জীবনের ধর্মীয় জটিলতাসংস্কৃতির দ্বৈত অবস্থান বিরাজ করে এবং তাদের সন্তানেরা ২টি ভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের সম্মিলন ও পৃথকিকরণে দ্বিধান্বিত ছাড়াও নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।আবার অনেকে ধর্ম পরিবর্তন করে উভয়েই একই ধর্মের অনুসারী হয়ে যায়, এক্ষেত্রে সামাজিক,সাংস্কৃতিক,ধর্মীয় স্বীকৃতিতে এবং পারিবারিক জীবনে কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না।