(১)আমি রহিমকে বিশ্বাস করি
(২) কাজটির বিষয়ে রহিমকে বিশ্বাস করা যায়
প্রথম বাক্যে বিশ্বাস বলতে রহিমের সত্য পথের অবলম্বনকে স্বীকার করা হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যে “নির্ভর করা” অর্থে বুঝানো হয়েছে। কেন রহিমের উপর নির্ভর করা যায়? কারণ তাকে যা করতে বলা হয়, তার কাছ থেকে ঠিক তাই পাওয়া যায়। অর্থাৎ একটি কাজের যে নির্দেশনা রহিম পায় আর সম্পাদিত কাজের যে ফলাফল তা নির্দেশনার ব্যতিক্রম নয়। অর্থাৎ নির্ধারিত কাজের বিষয়ে নির্দেশনাটাই রহিমের সত্য পথ যা অবলম্বন করে সে কাজ সম্পাদন করে।
তাহলে আমরা বলতে পারি বিশ্বাস বলতে সত্য পথের অবলম্বন বুঝায়। অর্থাৎ সত্য পথের অবলম্বনকারী ব্যক্তিরাই আমাদের বিশ্বাসভাজন হয়।
[ প্রাসঙ্গিকতায় যারা সত্য ও সত্য পথ সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব তাদেরকে বলছি- আমাদের সামাজিক জীবনের চলফেরায় সত্য, আর পুরো পৃথিবীকে একক ব্যবস্থা মনে করে যদি সত্যের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় তাহলে বেশ কিছুটা ব্যবধান আছে। এ প্রসঙ্গে সত্য ও সততা প্রবন্ধে আলোচনা করব।]
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়, সত্য পথ বলতে সামাজিক, নৈতিক ও মানবিক ন্যায়-নীতির পথকে বুঝানো হয়। আপাতত সমাজ ব্যবস্থার সত্য পথেই আমরা সীমাবদ্ধ থাকব। সামাজিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বাসভাজন হওয়ার মত গুণাবলী ধারণ করা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। সামাজিক সদস্যদের বিশ্বাসভাজন যেন হতে পারি সেই পথই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। বিশ্বাসকে দার্শনিকতায় ২ ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ
(১) অন্ধ বিশ্বাস (২) যৌক্তিক বিশ্বাস
(১) অন্ধ বিশ্বাসঃ
বিশ্বাসের প্রথম ধাপ। একজন মানুষ যার সাথে আমার ব্যক্তিগত চলাফেরা উঠাবসা হয়নি, কিংবা হলেও তা ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে পড়েনি তার প্রতি বিশ্বাসটা হল অন্ধ বিশ্বাস। যেমন বাড়ি খুজতে গিয়ে রাস্তার অপরিচিত কোন মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়া। আমি বিশ্বাস করে নিই যে সে আমাকে ভুল পথ দেখাবেনা, যদিও তিনি আমার অপরিচিত।
(২) যৌক্তিক বিশ্বাসঃ
বিশ্বাসের মূল বুনিয়াদ। জীবনের চলতি পথে আমরা অনেক মানুষের সাথেই সামাজিক সম্পর্ক রাখি। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে আমরা খুব ভালভাবে জানি। ব্যক্তিটি কেমন, তার আচরণ, নৈতিকতা, চিন্তা করার ভঙ্গি ইত্যাদি জানি। এবং এসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমরা তাকে বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাস হল যৌক্তিক বিশ্বাস।
একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্বচ্ছ করে দিইঃ আমার কোন এক প্রতিবেশিকে ১০০০০ টাকা ধার দিলাম। সে টাকাটা ৫ দিন পর ফেরত দিবে। এই প্রথমবার যখন তাকে ধার দিচ্ছি তখন এটা আমার অন্ধ বিশ্বাস। কিন্তু সে যদি ৫ দিন পর সত্যিই টাকাটা ফেরত এবং আরও এক মাস পর আবার ধার চায় তাহলে তার প্রতি বিশ্বাসটা এবার অন্ধ বিশ্বাস হবে না। এটা হবে যৌক্তিক বিশ্বাস। কারণ সে যে সত্য পথ অবলম্বন করে তার প্রমাণ সে পূর্বেই দিয়েছে এবং তাকে বিশ্বাস করার পিছনে একটা যুক্তিও আছে।
যৌক্তিক বিশ্বাস স্থায়ী হয়। আর অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তি নড়বড়ে। তাই আমাদেরকে অন্ধ বিশ্বাস থেকে উন্নীত হয়ে যৌক্তিক বিশ্বাসের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কেউ যদি আমার কাছে যৌক্তিক বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকে তবে তার সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন হওয়াটা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ বিষয়। তাই এটা স্থায়ী। তবে এটা সত্যি যে, কখনো কখনো অন্ধ বিশ্বাস অর্জনের অভাবে যৌক্তিক বিশ্বাস স্থাপনে ব্যর্থ হই আমরা। অর্থাৎ কাউকে অন্ধ বিশ্বাস করলে তবেই সে সুযোগ পাবে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার এবং তখনই যৌক্তিক বিশ্বাস স্থাপনের রাস্তার উদয় হবে।
এবার তাহলে দর্শনের পথ ছেড়ে সামাজিক রাস্তায় আসিঃ
মৌচাক মোড়, সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। বৃষ্টির ছাঁট ক্রমশ বর্ধমান, আর দন্ডায়মান আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি বৃষ্টি থেকে বাঁচবার। মৌচাক মোড়ে, উত্তর পুর্ব কোণে ফুজি কালার ল্যাব স্টুডিওর শেডে দাড়ালাম। সাথে আরও অনেক পথ চলতি মানুষ। শেডের কর্ণার থেকে আমি হাত দুয়েক দূরে দাঁড়ানো। একটি লোক হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে শেডের কর্ণারে পৌছাল। পোশাক পরিচ্ছেদে যা মনে হল তাতে অর্থনৈতিক অবস্থা সুবিধের নয়। লোকটি শেডের কর্ণারে পৌছেই বলল, ভাই একটা মোবাইল দেন ১ মিনিট কথা কমু। ৫/৬ জনের কাছে অনুরোধ করেও লোকটি মোবাইল পায়নি। আশেপাশে ফোন করার মত দোকান নেই জানতে পেরে লোকটি আরও হতাশ হয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে মোবাইল চাইছিল, আর ২/৩ জনের নিকট চেয়ে ব্যর্থ হল। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে জনবলের পিছনের সারিতে ছিলাম। লোকটির সামনের দিকে ছুটতে ব্যস্ত হওয়ার উপক্রম দেখে আমি ডাক দিই। মোবাইলটি তার হাতে দিয়ে বললাম ফোন করেন। সমস্ত ঘটনা ১.৫ থেকে ২ মিনিটের। লোকটি ফোন করে শুধু বলল, “ ২০০০ টাকা বিকাশ করার দরকার নেই। আমি চলে আসছি। বিকাশ কইরো না। বাকি কথা পরে কমু।”
২৭ সেকেন্ডের কথোপকোথন আজও মনে আছে আমার।
এবার পিছনের ঘটানা বলিঃ
লোকটিকে মৌচাক মার্কেটের সামনে পুলিশ ধরে। চেক করে কিছু পায়নি, একটি মোবাইল ছাড়া যার বর্তমান মূল্যমান লোকটির ধারণা অনুযায়ী ৩০০-৪০০ টাকা। তখন পুলিশ নাকি তার কাছে ৫০০০ টাকা চায়, নইলে গাড়িতে পেট্রোল বোমা মারার অপরাধে থানায় নিয়ে যাবে। দড় কষাকষি শেষে বাড়িতে সে বলে ২০০০ টাকা বিকাশ করতে। ভাগ্যক্রমে পুলিশ প্রদত্ত যে দোকানের বিকাশ নম্বর বাড়িতে দেওয়া হয়েছে , সেই দোকানে পুলিসটি আগে প্রবেশ করে। আর সুযোগ পেয়ে লোকটি পিছন থেকে পালিয়ে দৌড়ে আমাদের কাছে আসে।
সময়ের মূল্যঃ
যথা সময়ে ফোন করতে না পারলে তার বাড়ির লোক ২০০০ টাকা বিকাশ করে দিত পুলিশ প্রদত্ত নাম্বারে। লোকটির জন্য হয়ত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণটা বিশাল। যাক শেষ পর্যন্ত লোকটি বেঁচে যায়।
বিশ্লেষনঃ
উপরোক্ত ঘটনায় আমি লোকটিকে অন্ধ বিশ্বাস করি। যার মূল্য সে রেখেছে। অন্ধ বিশ্বাসের গুরুত্ব সুষ্ঠু সমাজ গঠনে খুব একটা কম নয়। লোকটি যদি সেদিন যথা সময়ে মোবাইল না পেত তার ক্ষতি হত। এবং সে এই ধারণাই করত যে, এই শতাব্দীতে মানুষ মানুষের উপকার করেনা। এরপর তার কাছে কেউ সাহায্য চাইলে হয়ত সেও এগিয়ে যেত না। আশা করা যায় পরবর্তীতে অন্যের বিপদে সে এগিয়ে যাবে। কেননা তার সামাজিকতায় সে এই শিক্ষার উদাহরণই (আমার ও তার ঘটনা) পাচ্ছে। এভাবেই মানবিক মূল্যবোধ সম্প্রসারিত হয়। আমাদের মনে রাখা দরকার মানবিকতা উঠে যাচ্ছে বলে গাল-মন্দ করার অধিকার আমাদের নেই। কেননা কোন না কোন ভাবে সমাজ থেকে মানবিকতা উঠে যাওয়ার কারণ আমিও। চারিদিক থেকে সবাই মিলে অন্ধ বিশ্বাসকে আশ্রয় করে এগিয়ে গেলে মানবতার পুনুরদ্ধার অবশ্যই সম্ভব।
অন্ধ বিশ্বাসের মূল্যঃ
চলুন ঘটানার প্রেক্ষিতে সাইকোলজিক্যাল ডিকোডিং করি। লোকটিকে কেউ মোবাইল দিতে চায়নি তার কারণ নিম্নরূপ হতে পারেঃ
(১) অন্যের পিছনে ২ টাকাও খরচ করবার দরকার নেই
(২) অযথা সময় খরচের কি দরকার
(৩) লোকটি যদি মোবাইল নিয়ে পালায়
১ ও ২ নং এর মত তুচ্ছ কারণ নিশ্চয় এ ঘটনার জন্য দায়ী নয়। ২ টাকা এমন কিছু টাকা নয়, আর সময়! ওরা ত দাড়িয়েই ছিল বৃষ্টি থামবার অপেক্ষায়। কারণ ৩ গুরত্বপূর্ণ। এখন কথা হল, আমাদের ভাবা দরকার লোকটি কি আদৌ মোবাইল নিয়ে পালাতে পারবে? ৩০ জনের মাঝখান থেকে সে মোবাইল নিয়ে দৌড়ে পালানোর সাহস করবেনা। কোন চোরই করেনা। ধরা খাওয়ার ১০০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে। তাহলে কেন তাকে সাহায্য করা হলনা? কোন কারণই হয়ত নেই, কি দরকার অন্যকে নিয়ে ভাববার? এটাই হয়ত কারণ। প্রতিদিনের সামাজিকতায় এভাবেই মানবিকতাকে অবহেলা করে আমরা সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা থেকে দূরে চলে যচ্ছি। সমাজ ব্যবস্থার উৎপত্তি যে মূল উদ্দেশ্য থেকে হয়েছিল, দিনে দিনে আমরা তা থেকেই সরে যাচ্ছি। এর জন্য আমরা সকলেই দায়ী। তাই পুরুরদ্ধারের দায়ও সকলের।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, অন্ধ বিশ্বাসের ফলে যে প্রতারণার শিকার হয় তার কি হবে?
হবে তারও একটা ব্যবস্থা হবে। অন্ধ বিশ্বাসটা আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী করুন। আমি যে মোবাইলটি লোকটিকে দিয়েছিলাম তার মূল্য ছিল ৮৯০ টাকা। এই ৮৯০ টাকা চুরি গেলেও আমার অর্থনৈতিক অবস্থায় আচড় কাটতে পারত না। তাই আমি মানবাতার নামে ৮৯০ টাকার ঝুকি নিতে পারি। একটা বাংলার প্রবাদ বলি,- “ মশার দুঃখে মশারি পুরিয়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ”। একটু দুঃখের কিংবা ঝুকির ভয়ে মানবতার পথ ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
পরিশেষে সহজ ভাষায় এইটুকুই বলব, যদি একজন লোক ১০/৫০/১০০’/২০০/৫০০ টাকার সাহায্য চায়, আর এই পরিমাণ ঝুকি নেয়ার সামর্থ্য আপনার থাকে তাহলে অবশ্যই মানবতাকে অনুসরণ করুন। অন্যদিকে ৫০০০০ টাকার ঝুকি নিতে আপনাকে বলব না। কেননা এর প্রতারণা হয়ত আপনার নুন্যতম মানবিকতাকেও বিলুপ্ত করবে যা পুরো সমাজের জন্যই ক্ষতিকর।
মনে রাখবেনঃ
মানবিকতা মানুষের পিছন পিছন দৌড়ায়। মানুষ যদি নর্দমায় থাকে তাহলে মানবিকতাকে দৌড়ে ঠিক নর্দমায় যেতে হবে। নয়ত নর্দামা থেকে মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৫৭