মানুষ জন্ম নেয়। জন্মের সময় চাহিদার সহজাত প্রবৃত্তির সাথে পরিচয় হয়। জৈবিক কারণেই পরিচয় ঘটে। মানব জন্মের প্রথম চাহিদা ক্ষুধা। মানুষের বৃদ্ধি ঘটে, শরীরে, পরিপক্ক হয় মানসিকতা ও মন। চাহিদার উৎপত্তিস্থলে জৈবিক কারণ ছাড়াও পারিপার্শ্বিকতা স্থান পায়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের পূর্বে কিছু বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অবতারণা করা হল।
১) অভাবঃ কোন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা কিংবা চাহিদা যখন মানুষ টের পায় এবং এই চাহিদা যখন পূরণ হয় না, তাই হল অভাব।
২) দুঃখঃ মানুষ কোন বিষয়ে যে অভাব বোধ টের পায় সেই অনুভূতিটাই দুঃখ।
৩) সুখঃ সাধারণত আমরা বলে থাকি দুঃখের অনুপস্থিতিটাই সুখ। প্রকৃতপক্ষে, সুখ হল এমন একটা অনুভূতি যা ভুলিয়ে দেয় (স্বল্প কিংবা দীর্ঘ সময়ের জন্য) অন্য সকল অভাবের পক্ষান্তরে দুঃখের কথা। কোন একটা সুনির্দিষ্ট মুহুর্তের অনুভূতিতে যখন এমনভাবে আচ্ছন্ন হই যে অন্য দশটা অভাবের কথা আর ওই মুহুর্তে মনে পড়ে না তখন সেই অনুভূতিটাই সুখ। উদাহরনস্বরূপ, দীর্ঘপথ পাহাড়ি রাস্তায় পায়ে হেটে যখন বগালেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনুভব করি তখন খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও ভুলে যাই পায়ের ব্যথা, মাত্র ৫ মিনিট আগেও যা মনে ছিল- মাউএর সাথে ঝগড়া করে বগালেক ভ্রমণের টাকা নেয়ার দুঃখ, সদ্য ফল বের হওয়া পরীক্ষায় ফেল করার দুঃখ ইত্যাদি। কোন অভাববোধই হয়ত আর তখন টের পাই না। হয়ত কিছুক্ষণ পরই আবার আবার অভাব বা দুঃখগুলো মনের কোণে জমতে থাকে।
৪) ভালোলাগাঃ বিষয়টি বস্তুগতভাবে উপস্থাপন করলে সহজে বোধগম্য হবে। প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। ধরা যাক, কেউ জানতে চাইল- বগালেক তোমার ভালো লেগেছে কি? আমার মধ্যে যদি কোন সুখের অনুভূতি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও বগালেকের দ্বারা অনুভূত হয় তাহলে বগালেক আমার ভালো লেগেছে। কোন কিছু থেকে যখন স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সুখ পাওয়া যায় তখনই বলা যায় একে ভালো লেগেছে। ভালো লাগা স্বল্প সময়ের জন্য পাওয়া একটা সুখ।
৫) ভালোবাসাঃ ভালোলাগার আতিশায্যটাই ভালোবাসা। কোন কিছু যখন ভালোলাগার অনুভূতিটা দীর্ঘ সময় ধরে রাখে তখন তার ভালোবাসা। অর্থাৎ কোন উৎস থেকে সুদীর্ঘ সময় সুখ পাওয়া গেলে বলা যায় একে ভালোবাসি।
ভালোলাগা ও ভালোবাসার তুলনামূলক আলোচনাঃ
সাধারনভাবেই বলা যায় ভালোলাগা ও ভালোবাসার পার্থক্য হল তীব্রতা। এই তীব্রতা সাধারণত সময় নির্ভর। স্বল্প সময়ের জন্য সুখ প্রদেয় হলে ভালোলাগা আর যদি দীর্ঘ সময় ধরে সুখ প্রদান করে তাহলে ভালোবাসা। এখন প্রশ্ন হল কতটুকু সময়কে স্বল্প সময় বলব? ২মিনিট, ২ ঘন্টা, ২ সপ্তাহ, ২ মাস, ২ বছর? সময়টা নির্ভর করে বিষয় কিংবা বস্তু অর্থাৎ উৎসের উপর। বোধগম্যতার জন্য বলতে পারি- একটা শার্টের জন্য এই সময় ২ সপ্তাহ হতে পারে। যদি এরও বেশি সময় শার্টটি ভালো লাগে তাহলে বলা যেতে পারে এর প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু একজন মানুষের বেলায় সময়টা ২ মাসেরও বেশি, ৪ কিংবা ৬ মাস অথবা আরও বেশি হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি নির্ভর করে সুখ প্রদানকারী উৎসটিকে জানা কিংবা উপলব্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের উপর। যেমন- একটি শার্ট দেখে পছন্দ হল, ২ দিন অফিসে পরিধান করে আরামদায়ক মনে হল, রাস্তায় বাসে-ট্রামে চলাফেরায় সন্তুষ্ট হলাম, ধোয়ার পরও স্বাভাবিক রইল; এর বেশি একটি শার্ট সম্পর্কে জানার বা উপলব্ধির আর তেমন কিছু থাকে না যার জন্য ২ সপ্তাহের বেশি সময় প্রয়োজন। কিন্তু একজন পরিণত মানুষ বহু বহুমাত্রিক হয়। তাকে জানার বা উপলব্ধির জন্য ৪-৬ মাসেরও বেশি সময় প্রয়োজন হতে পারে। স্পষ্টতই, ভালোলাগা ও ভালোবাসার সময় নির্ভর তীব্রতার সীমারেখা সুনির্দিষ্ট বিষয়টির উপর নির্ভর করে।
অন্যদিকে, মানুষের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল প্রাপ্ত বস্তুর প্রতি আগ্রহ হ্রাস। সেজন্য ভালোলাগার সমস্ত কিছু যে ভালোবাসা পর্যন্ত পৌছাবে এমন নয়। তবে কোন একটি উৎসের প্রতি যখন ভালোলাগা ক্রমান্বরে বৃদ্ধি পায় অথবা হ্রাসহীনভাবে সময়ের সাথে সাথে স্থায়ী হয় তখনই তা ভালোবাসার উৎস হতে পারে। উল্লেখ্য, ভালোলাগা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি হল সময়ের সাথে সাথে উৎসের নতুন মাত্রা সামনে আসা ও এই নতুন মাত্রা থেকে সুখ অনুভূত হওয়া। আর ইহা সুস্পষ্ট যে, ভালোলাগার ক্রমবৃদ্ধির সাথে ভালোবাসার ক্রমবৃদ্ধি ওতপ্রোতভাবে শুধু জড়িতই নয় বরং নির্ভরশীল। আর ভালোবাসার এই ধারাবাহিকতাকেই আমরা দৈনন্দিন জীবনে বলে থাকি দিনে দিনে গভীর ভালোবাসার দিকে ধাবিত হওয়া।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো- উৎসের নতুন মাত্রার উপস্থিতি ও এর দ্বারা সুখের বদলে দুঃখের অনুভূতি একের পর এক অনুভূত হলে উপরিল্লিখিত ধারাটি বিপরীত দিকে ধাবিত হতে পারে।
জীবনে চলার পথে আমাদের ভালোলাগা বা ভালোবাসার উৎস একটি নয়, অনেক উৎস থাকে। কিন্তু সকল উৎসের বিস্তার আমার জীবনে সমান নয়, সমান নয় প্রভাবও। জীবনে একটি শার্টের বিস্তার, আর একজন বন্ধুর বিস্তার কিংবা পরিবারের বিস্তারের মধ্যে তারতম্য রয়েছে। উৎসের বিস্তারও ভালোলাগা এবং ভালোবাসা উভয়ের ক্ষেত্রে তীব্রতার পরিমাপক। একাধিক উৎস যখন পরস্পর সংঘর্ষী হয় তখন এই বিস্তার নির্ভর তীব্রতাই সামঞ্জস্যের পথ সুগম করে।
উদাসীনতাঃ উৎস যদি সুখ কিংবা দুঃখ কোন অনুভূতির জন্ম না দেয় তবে তা উদাসীনতা। প্রকৃতপক্ষে ইহা এমন এক অনুভূতি যা টের পাওয়া দুরূহ।
ঘৃণাঃ ভালোবাসার বিপররীত দিকটাকে ঘৃণা বলা যেতে পারে। উৎস যখন তীব্র দুঃখের উদ্রেক ঘটায় তখন তা ঘৃণ্য হয়ে উঠতে পারে।
৬) প্রেমঃ এ বিষয়ে প্রথম কথাই হল প্রেম একটি শরীর সংশ্লিষ্ট বিষয়। তবে শুধুমাত্র শরীর নির্ভর নয়। দুটো মানুষের মধ্যে ভালোবাসার উপস্থিতিতে শারিরীক সম্পর্ক হলে, তবে তাকে প্রেম বলা যায়। ভালোবাসাহীন যে শারিরীক সম্পর্ক তা শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদার পরিতৃপ্তি, প্রেম নয়। ইংরেজীতে একেই Carnal Love বলা হয়। উল্লেখ্য, শারিরীক সম্পর্ক সংগঠিত হওয়ার পর একে প্রেম বলা হবে তার পূর্বে নয়, বিষয়টি এরূপ নয়। দুটো মানুষের মাঝে ভালোবাসার উপস্থিতি থাকা সাপেক্ষে যখন পরস্পরের প্রতি শারিরীক আকাঙ্ক্ষা জন্মায় বা থাকে, অথবা ভবিষ্যতে শারিরীকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার মানসিক বোধ থাকে কিন্তু বর্তমানে শারিরীক সম্পর্ক নেই তখনও তা প্রেম।
ভালোবাসা ও প্রেমের তুলনামূলক আলোচনাঃ
প্রেমের জন্য ভালোবাসা একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ও পূর্বশর্ত। ভালোবাসা না থাকলে তা নিছকই জৈবিক চাহিদা বা চাহিদার পরিতৃপ্তি মাত্র। শারিরীক সম্পর্ক বলতে বাস্তবিকই শারিরীক সম্পর্ক সংগঠিত হতে হবে এরূপ নয়, বরং শারিরীক সম্পর্কের একটি মানসিক বোধের উপস্থিতিই যথেষ্ঠ। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- আমার মা কিংবা বোনের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক নেই এবং হবারও নয়। কারণ, জন্ম থেকেই এমন মানসিকতা স্থায়ী হয়েছে আমার মস্তিস্কের স্নায়ুতে। কিন্তু তাদের সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে বাহিরের পরিবেশের একটি মেয়ের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক হতে পারে। আবেগ প্রকৃতপক্ষে এমন একটি বিষয় যা সন্তর্পণে লক্ষ্য করলে শরীরেও টের পাওয়া যেতে পারে। প্রেম, ভালোলাগা, ভালোবাসা কিংবা নিছক শারিরীক সম্পর্কের একটি প্রভাব শরীরে লক্ষ্য করা যায়। তীব্রতার তারতম্য হতে পারে যদিও। একটি সুশ্রী, বাঙ্গালি পোশাক পরিহিত, সদ্য স্নান করা নির্মলতায় আচ্ছন্ন , বাম হাতে একটি খাতা ও বই বুকের কাছে জড়িয়ে রাখা মেয়ে যখন আমার সামনে দু’দন্ড দাড়ায় (যে মনে করিয়ে দেয় মাধবীলতা মুখার্জির কথা, শুধু আমার ক্ষেত্রে) তখন স্পষ্ট টের পাই হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহের গতি স্বাভাবিক নেই, তারতম্য ঘটেছে। অন্যদিকে শারিরীক সম্পর্কের সময়ও রক্তপ্রবাহের গতি স্বাভাবিকের চাইতে বেশি থাকে। পুরুষের গোপন অঙ্গে প্রায় আট হাজার স্নায়ু রয়েছে যাতে শারিরীক সম্পর্কের সময় রক্ত সঞ্চালন অধিকমাত্রায় ঘটে, তারই একটি প্রভাব হৃদযন্ত্রে পাওয়া যায়। প্রথমক্ষেত্রে, মেয়েটিক ভালোলাগা ও দ্বিতীয়ক্ষেত্রে শারিরীক সম্পর্কের বেলায় হৃদযন্ত্রে একই ধরনের প্রভাব পরিলিক্ষিত হয়। পার্থক্য শুধু তীব্রতার। ধারণা করা হয়, পরস্পরের সম্মতিতে কিংবা আকাঙ্ক্ষায় শারিরীক মিলনে যে সুখ ও পরিতৃপ্তি পাওয়া যায়, ধর্ষণের সময় এর কম পাওয়া যায়। সহজবোধগম্যতার জন্য বলছি- ধর্ষণের সময় শুধু শরীর নির্ভর তৃপ্তি পাওয়া যায়, যখন অন্যদিকে শারিরীক তৃপ্তির সাথে মনসিক সুখও পাওয়া যায়।
অতএব, ভালোবাসার উপস্থিতিতে শারিরীক সম্পর্ক অর্থাৎ প্রবন্ধে উল্লিখিত প্রেমই সর্বোৎকৃষ্ট।
** সহানুভূতি থেকে উদ্ভূত ভালোবাসাঃ এ বিষয়ে প্রথম প্রশ্নই আসে সহানুভূতি থেকে উদ্ভূত আবেগ ভালোবাসা কিনা। হ্যা, তা অবশ্যই ভালোবাসা হতে পারে। কারোর অপ্রাপ্তি ও দুঃখ অনুভূত হলেই তার প্রতি সহানুভূতি জন্মায়। পরবর্তীতে হয়ত এই সহানুভূতির কারণে তার জন্য কিছু করা হয় কিংবা সময়ের ও মানসিকতার মিথোস্ক্রিয়া ঘটে (Time interaction & Mentar interaction)। কিন্তু এর ফলে যদি আমার মধ্যে সুখের অনুভূতি টের পাওয়া যায় তাহলে তা ভালোবাসা পর্যন্ত পৌছাতে পারে। অর্থাৎ শুরুতে সহানুভূতিই একমাত্র আবেগীয় মাত্রা থাকলেও পরবর্তীতে তা ভালোবাসা হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। হয়ত অনুভূতিটা শুধু সহানুভূতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে ভালোবাসার সম্ভবনা নেই তা নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৫২