বেড়ে উঠা এক যুবতী-আমাদের বাংলাদেশ।স্বপ্নালু যুবতী এগিয়ে যেতে চাই পূর্ণতার দিকে।কিন্তু বখাটেরা বড়ই অমানবিক।তার দেহে ঢুকিয়ে দেয় ভয়াবহ ভাইরাস।জন থেকে জনে,প্রান্ত থেকে প্রান্তরে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।হয়ে উঠল সামাজিক ব্যাধি।এই ব্যাধি দুর্নীতি।এর ব্যাপ্তি এখন খুবই ব্যাপক।একক আমি,আপনি কিংবা কোন সংস্থা এর সামনে কাঠের পুতুল।ভয়াবহ এই ব্যাধি রুখার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ তাই আজ সময়ের দাবি।
দুর্নীতির সাথে আমাদের পরিচয় যখন আমরা পৃথিবী বুঝিনা।হাসফাতালে সিজার নামক জন্মপ্রক্রিয়া থেকে শুরু।এরপর স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ,ভূমি অফিস,থানা,উপজেলা এবং কোর্টহিলের উঁচা উঁচা দালান গুলোও চেয়ে থাকে ঘামে ভেজা কটা টাকার দিকে।ভাঙ্গা রাস্তা,ভাঙ্গা পুল ও দুর্নীতির চরম মাশুল।আরো অনেক আছে। মনের অজান্তেই দুর্নীতির একটা ছবি তৈরি হয়ে আছে আমাদের মস্তিষ্কে।জাতিসংঘ এবং আইএমএফ দুর্নীতির সংজ্ঞা দিয়েছে।এটি খুব ছোট কিন্তু অতি ব্যাপক। ‘(ক্ষমতা ব্যবহারকারীদের ওপর) অর্পিত ক্ষমতার ব্যক্তিগত লাভের জন্য অপব্যবহার’ (কনসেপ্ট অব করাপশন অ্যাজ দি অ্যাবিউজ অব পাওয়ার ফর প্রাইভেট গেইন)।এটাই দুর্নীতি।দেশের সুন্দর, মসৃণ পথচলাকে বন্দুর করে দেয়।
ঘুষকে দুর্নীতির প্রধান বাহন মনে করা হয়।এটি প্রধান হলেও আরো নানান উপায় আছে।যেমন বউয়ের জন্য গয়না,অফিসে আসার জন্য পাজেরো গাড়ি(উপঢৌকন)।
বেগম রোকেয়া একটা সুন্দর কথা বলেছেন।তার সারমর্ম এমন;রোগ প্রতিরোধ বা প্রতিকার করার আগে রোগের ক্ষত কেমন তা জানা আবশ্যক।তাহলে চিকিৎসা সহজ ও ফলপ্রসু হবে।
আমরাদেরও জানা প্রয়োজন আমাদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বানানো এই দুর্নীতির হালহাকিকত কি?তবেই আমাদের স্পৃহা,আমাদের উদ্দম, তেজ উদ্দীপ্ত হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুগুনে।
মজার ব্যাপার হল পৃথিবীর কোনদেশ দুর্নীতি থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।কোথাও সহনীয়, কোথাও অসহনীয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে এর প্রকোপ বেশি।যেমন, বাংলাদেশ পাঁচবার চ্যাম্পিয়নশিপ পাওয়া দেশ।আশার কথা হল,বার্লিন ভিত্তক দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন Transparency International (TI) এর সর্বশেষ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তের(১৩) তম।আসলে কি বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে? না।কোথাও হয়তো এর তীব্রতা অতিসামান্য বা সাময়িক কমেছে।খাত ভিত্তিক দুর্নীতির ধারণা পেতে সর্বজনগৃহীত টিআইবি-এর সর্বশেষ খানা জরিপের সহায়তা নিতে পারি।এই জরিপে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আঁতকে উঠার মতো।পাসপোর্ট ৭৭.৭%,আইন শৃঙ্খলাকারী সংস্থা ৭৪.৬%,শিক্ষা ৬০.৮%,বিআরটিএ ৬০.৮%,ভূমি প্রসাশন ৫৩.৪%,বিচারিক সেবা ৪৮.২% এবং স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির শিকার ৩৭.৫%। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ— টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান স্যার বলেছেন, দুর্নীতি বন্ধ হলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশেরও বেশি অর্জন সম্ভব। দেশে দুর্নীতির কারণে যে অবৈধ অর্থ অর্জিত হয় তার একটি বিরাট অংশ বিদেশে (উন্নত দেশগুলোয়) পাচার হয়। আর এতে সাধারণ মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে(৬ সেপ্টেম্বর ১৬:বাংলাদেশ প্রতিদিন)।
কে দাড়াবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে?সাধারণ জনগন?আমরা তো দুর্নীতিবাজদের দাবার গুটি।দুদক?এতো নখদন্তহীন খেলার বাঘ।চাপপ্রয়োগকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা ইদানিং নিরুত্তাপই মনে হয়।প্রশাসন নয়,ওরাও উপর তলার কীটজীবীদের আশীর্বাদপুষ্ঠ(সবসময় নয়)।উপর তলার রাজনীতিবিদ ও নয়।ওরাও নিচ তলার দুর্নীতিবাজদের কাঁধে পা দিয়ে আসন করেছে পোক্ত।
কত অসহায় আমরা!কটা কুকুর জলাতঙ্ক ছড়াবে আর আমরা অসহায়ত্বের দোহাই দিয়ে মুখ লুকাবো!
না এমন হয় না।প্রতিটা সেক্টরে খারাপ মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়।ভালো মানুষ দাবি করা আমাদের নিরবতা ওদের আগুনে কেরোসিন ডালে বলে আগুনের লেলিহান শিখা সব কিছুকে জ্বালিয়ে দিতে পারে।মনে হয় এখন ওদের রাজত্ব। আমি একক প্রসাশন, রাজনীতিবিদ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, চাপপ্রয়োগকারী গোষ্ঠী এমন কি দুদক ও এই আগুনের কাছে যেতে ভয় পায়।কত একা আমরা!রবির একটা বিজ্ঞাপনের মুল ধারণাটা মনে আসছে। হ্যাঁ,আমরা সবাই একা।কিন্তু সবাই মিলে? আমরা একটা সমাজ,একটা রাষ্ট্র। যখন আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসাথে দাড়িয়ে যাবো,দুর্নীতিবাজরা তল্পিতল্পাসহ মুলোৎপাটিত হবে।এটা স্বপ্ন নয়।এটা বাস্তবায়িত স্বপ্ন।এটা শুধু বুলি নয়;আমরা সকল ক্ষমতার উৎস।রাশিয়া থেকে চীন হয়ে বাংলদেশে এর অসংখ্য প্রমাণ সবার জানা।
এখন আর নীতি বাক্য নিয়ে বেড়ানোর সময় নেই।জনগণ,রাজনীতিবিদ, প্রসাশন, চাপপ্রয়োগকারী গোষ্ঠী, ধর্মীয় নেতা, গণমাধ্যম,দুদক, বিচার বিভাগ সবাইকে নিজ নিজ ভুমিকা চিহ্নত করে দাড়াতে হবে।দাড়াতে হবে একসাথে।কেও পিচিয়ে থাকা মানে শক্তি ক্ষয়।কারণ আমাদের ভালো জানা আছে,দেহের একটা অঙ্গ আক্রান্ত হলে সম্পুর্ণ দেহকে প্রভাবিত করে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের প্রত্যকের অবস্থান এভাবে দেখা যায়----
রাজনীতিবিদ ও সরকার:বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহুদলীয়।ফলে গড়ে উঠেছে বহু রাজনৈতিক দল।বর্তমান নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৪১(জামাতে ইসলামীসহ;সম্প্রতি আদালত কর্তৃক নিবন্ধন বাতিল হয়) হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল প্রধান চারটি দল।এরা পালাক্রমে সরকার গঠন করেছে।যদিও নির্বাচনী ইশতিহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ঘোষণা ছিল তবু তাদের শাসনামলে আমরা দুর্নীতির বন্যা দেখেছি।যাহোক,সরকার গঠন তথা দেশ শাসন করছে রাজনীতিবিদরা।সব কিছু শাসকবর্গের ইশারায় হয়।রাজনীতিবিদের সদিচ্ছায় অল্প সময়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব।লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরকে দুর্নীতিমুক্ত করে দেখিয়েছে।১৯৫৯ সালে সিঙ্গাপুর যখন স্বায়ত্তশাসন পায়,এটি ছিল পুর্বের সবচেয় দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ।তবে সৎ রাজনীতিবিদ ও পেয়েছিল বলে তারাই সবার আগে কম দুর্নীতির কাতারে সামিল হতে পেরেছে। লিকে একবার এক বাক্যে তার ‘সাকসেস’ সম্পর্কে বলতে বলা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তিনি ‘কখনোই তার নিজের স্বার্থকে সিঙ্গাপুরের স্বার্থ হিসেবে দেখেননি। জনগণের স্বার্থই তার স্বার্থ ছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও জাতিসংঘ তাদের সংজ্ঞায় আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করেছে। জনগণ কখনোই দুর্নীতি করে না। তারা দুর্নীতির শিকার এবং এর বোঝা বহনকারী। দু’টি শ্রেণী শুধু দুর্নীতিতে জড়িত— আমলা এবং রাজনীতিবিদ। এরা সৎ, শুদ্ধ এবং নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ হলে দুর্নীতি হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
প্রসাশন : দেশ পরিচালিত হয় মুলত রাজনীতিবিদ এবং আমলার যৌত প্রোযোজনায়।এখানে প্রসাশনকে দেখবো।বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো তিনভাগে বিভক্ত।একটা হল নির্বাহী /সাশন বিভাগ(প্রধানমন্ত্রীর অধীনে)।বাংলাদেশের প্রশাসন হল শাসন বিভাগ।বাংলাদেশের সকল প্রশাসন নির্বাহী বিভাগের অধীনে দুইভাগে বিভক্ত--কেন্দ্রীয় ও মাঠপ্রশাসন।কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে নিউক্লিয়াসের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।সুস্থ্য নিউক্লিয়াস ছাড়া মানব দেহ যেমন বিকল হয়ে যায়,ঠিক একটা রাষ্ট্র দুর্নীতিগ্রস্থ ও ভঙ্গুর প্রশাসন দিয়ে শুধু ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হতে পারে।আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডার কথা বলতে পারি,যাদের সমৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে শক্তিশালী, দক্ষ ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনের।বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাজ হল(Rule of Business কার্যবিধিতে লিপিবদ্ধ আছে) নীতিমালা তৈরি করা,আইন প্রণয়ন করা এবং তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করা।এই কাজগুলো যদি সুচারুরূপে, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সততার সাথে করা সম্ভব হয় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দুর্নীতি প্রতিরোধ হবে।উল্টো হলে আন্দোলনে শহীদের সারি যতই দীর্ঘ হোক,দুর্নীতি বরং নীতিতেই রুপ নেবে।
গণসচেতনতা ও স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন:সবার খুব পরিচিত একটা বচন হল; অধিকার কেও কাওকে দেয়না,আদায় করে নিতে হয়।এটাও ঠিক যে,আপনি যদি সচেতন না হন,তথ্য না জানেন দুর্নীতির শিকার হবেনই।আপনি যদি প্রতিরোধ না করেন আমলা আর রাজনীতিবিদ দুধ খেয়েই যাবেন আপনি দুধের গাভীর ঘাস কেটে যাবেন। যদি এমনটা অন্যায় মনে হয় স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনের বিকল্প নেই।তারেক শামসুর রহমান তার "বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর" নামক গ্রন্থে বলেছেন--জনগণের ভেতর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা না থাকলে,জনগণ স্বতস্ফূর্ত অংশ না নিলে কোন বিপ্লব সফল হতে পারে না।১৯১৭ সালে রাশিয়ায়,১৯৪৯ সালে চীনে জনগণ যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তন করে দিয়েছে আমরা নিশ্চয়ই দুর্নীতি রুখে দিতে পারবো।আমাদের ঘরেও দীপের মতো জ্বল জ্বল করছে অনেক উদাহরণ।৫২ এর ভাষা আন্দোলন,৬৬এর ছয়দফা,৬৯এল গণঅভ্যুত্থান,৭১এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০এর স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলন সেই সব দীপাবলি।
আমাদের এবারের আন্দোলন হবে রক্তপাতহীন এক বিপ্লব। আমাদের অস্ত্র হবে দুটি।দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের চরম ঘৃণা এবং তথ্য অধিকার আইন ২০০৯।অধিকাংশ দুর্নীতি হয় তথ্য না জানার ফলে।দুর্নীতির প্রতি ঘৃণা আর তথ্য প্রব
আমরা শান্ত বাঙ্গালি, আমরা সরল বাঙ্গালি। আমরা কঠিন সময়ে এক হতে জানি।১৯৭১ হয়েছি,সম্প্রতি জঙ্গি ইস্যুতে আবার দেখিয়েছি।দুর্নীতিও ভয়াবহ বিধ্বংসী বিষয় তা ইতোমধ্যে আমরা বুঝে গেছি।দুর্নীতির অপবাদ আমাদের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে বিশ্বদরবারে।আমাদের দাড়াতে হবে এখনই।দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসাথে।মানুষ হিসেবে আমাদের নৈতিকতা বোধ আছে।আত্মা আছে।এই দুটি জিনিস দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতটা কাজ করতে পারে,আইন তা পরে না।আইনকে ঠকানো যায়,এই দুটুকে যায় না।যদি আমরা রাজনীতিবিদ হিসেবে,আমলা,সাংবাদিক,পুলিশ,বিচারক কিংবা সাধরণ মানুষ হিসেবে নৈতিকতার শক্ত পুনঃস্থাপন করতে পারি,নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে নিজ আত্মার কাছে জবাবদিহিতা করতে পারি তবেই গঠিত হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্ববৃহৎ ঐক্য--আত্মার ঐক্য।তখন রবিন্দ্রনাথের তাল গাছের মতো আমাদের দেশও নিজ পায়ে দাড়িয়ে সব দেশ ছাড়ি উঁকি মারবে উন্নত দেশের সিংহাসনে।আর যদি না পারি,বুঝতে হবে আমাদের আত্মা ড. ফস্টাসের মতো শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসাথে